#চোরাবালি_মন (পর্ব ৬)

0
484

#চোরাবালি_মন (পর্ব ৬)

৫ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1474808936367462/

১.
দিলারা বেগম টিভিতে একটা সিরিয়াল দেখছিলেন, আর মনে মনে ফুঁসছিলেন। এই সিরিয়ালগুলোই যত নষ্টের গোড়া। বিরক্তি নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে একটা নিউজের চ্যানেল দেখতে থাকেন। মোবাইল নিয়ে বকা দেওয়াতে ক্লাশ টেনের একটা মেয়ে সুইসাইড করেছে। ইশ! কী যে হচ্ছে সব চারদিকে। এই মোবাইল ফোন আরেকটা নষ্টের গোড়া, ভাবেন দিলারা।

ঠিক এমন সময় কলিং বেলের শব্দ হতেই চমকে দরজার দিকে তাকান। উঠে দরজা খুলতে যাবার আগ পর্যন্ত বার বার বেলটা বাজতে থাকে। দিলারা ভ্রু কুঁচকে ভাবেন, কে এমন অসভ্যের মতো বেল বাজাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই নীলা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকায়, আকুল গলায় বলে, ‘মা, টুকুন কোথায়?’

দিলারা অবাক গলায় বলেন, ‘ও তো গোসলখানায়, কেন, কী হয়েছে?’

নীলার পা কেমন ভেঙ্গে আসে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। টুকুন বাথরুমে? এই অসময়ে? নীলা এক দৌড়ে টুকুনের ওয়াশরুমের দরজায় জোর ধাক্কা দেয়, আর আকুল গলায় ডাকে, ‘টুকুন, টুকুন।’

ভেতর থেকে টুকুনের ক্ষীণ গলা পাওয়া যায়, ‘হ্যাঁ আম্মু, আমি গোসল করছি। কিছু বলবে?’

নীলা ধপ করে বসে পড়ে, ধীরে ধীরে এতক্ষণের চেপে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ে। ওর মনে হয় পৃথিবীটা অনেক সুন্দর, এই যে ভেতরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে, সেটাও সুন্দর। টুকুনের কচি গলাটা সুন্দর, ওকে আম্মু করে ডাকল, কী মিষ্টি সুন্দর! ওর টুকুন বেঁচে আছে, ভালো আছে। বুকটা ভেঙে কান্না আসে, ও কোথায় নিয়ে এসেছে ওর পুরো পরিবারকে! একটা ভীষণ অনুশোচনা, একটা অপরাধবোধ ওকে গিলে খেতে চায়।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ও ঝট করে টুকুনের মোবাইলটা খোঁজে। একটু খুঁজতেই টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর ফোনটা পেয়ে যায়। নীলা কাঁপা হাতে মোবাইলটা নেয়, পাশের কি সুইচে টিপ দেয়। নাহ, খুলছে না। কী হলো? আবার চাপ দেয়। তারপর বুঝতে পারে চার্জ নেই। ও যখন ফোন দিয়েছিল তখন হয়ত চার্জ অনেক কম ছিল। বার বার ফোন দেওয়াতেই চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। নীলা দ্রুত চার্জার লাগিয়ে ফোনটা অন করে। দ্রুত টুকুনের ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ঢোকে। দম বন্ধ করে নতুন মেসেজগুলো চেক করে, নাহ, উল্টাপাল্টা কিছু নেই। তার মানে তাহসান ওকে শুধুই ভয় দেখিয়েছে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে নীলা। নাহ, টুকুনকে আর স্মার্ট ফোন দেওয়া যাবে না।

কিন্তু এই অসময়ে টুকুন এতক্ষণ গোসলখানায় কী করছে?

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন টুকুন বের হয়। কী নিষ্পাপ মুখটা! নীলা নরম গলায় বলে, ‘কি রে, তুই এই অসময়ে এতক্ষণ ধরে বাথরুমে কী করছিলি?’

টুকুন একটু চুপ থাকে, তারপর মাথা নিচু করে বিব্রত গলায় বলে, ‘আম্মু, ওই আজ আমার প্রতি মাসের ওটা শেষ হলো। তাই একটু সময় লাগল।’

নীলার মনটা আর্দ্র হয়ে যায়, মেয়েটা কবে কবে বড় হয়ে গেল। যেদিন প্রথম ওর মেন্সট্রুয়েশনটা হয়, কী ভয়টাই না পেয়েছিল! নীলা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘খুব ভালো করেছিস।’

সেদিন রাতে খাওয়ার সময় অবশ্য অতটা নিশ্চুপ কাটে না। এক দুটো কথা হয়। আবির যথারীতি মুখ গম্ভীর করে রেখেছে।

খাওয়া শেষে নীলা টুকুনের রুমে যায়। তারপর স্কুলের টুকটাক খবর নিয়ে আলতো গলায় বলে, ‘টুকুন, আপাতত কিছুদিন তুই এই স্মার্ট ফোনটা আর ব্যবহার করিস না। আমার কাছে রেখে দিলাম। তোকে একটা ছোট্ট এনালগ ফোন কিনে দেব কাল।’

টুকুন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কেন আম্মু? আমার যে স্মার্ট ফোন লাগবেই। আমার সামনে পরীক্ষা, বন্ধুরা সব মেসেঞ্জারে শেয়ার করে। প্লিজ আম্মু, ফোনটা দাও। আমি কথা দিলাম মোবাইলে পড়া বাদ দিয়ে গেমস খেলব না।’

নীলা বিপদে পড়ে যায়, এখন টুকুনকে ও কী করে বুঝিয়ে বলে ওর বিপদের কথা। লম্বা করে নিশ্বাস নেয়, বলে, ‘আম্মু, আমাদের মতো বড় মানুষদের জীবন অনেক জটিল। সব কথা তোকে আজ বলতে পারব না। বড় হলে আমার কষ্টটা অবশ্যই বুঝবি। তুই রাতে আমি এলে তখন একবার আমার সামনেই ফোনটা দেখে নিস।’

কথাটা বলে নীলা উঠে পড়ে, পরাজিত মানুষের মতো নিজের রুমে চলে আসে।

টুকুনের ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে আম্মু আর আব্বুর যে কি হয়েছে ও কিছুই বোঝে না। ও শুধু বোঝে ওদের পরিবারটা আর আগের মতো নেই। ওর কথা কেউ ভাবে না। আম্মু কেন ওর ফোনটা নিয়ে গেল? একটা মন খারাপ নিয়ে টুকুন ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে নীলা অফিসে যাবার আগে দিলারার রুমে গিয়ে ওর রুটিন কথাগুলো বলা শেষ করে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, বলে, ‘মা, আপনার ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট তো শেষ হয়ে যাবার কথা। আজ আনব?’

দিলারা বেগম গম্ভীরমুখে বলেন, ‘না লাগবে না। আবিরকে বলেছি, ও নিয়ে আসবে।’

নীলা একটা ধাক্কা খায়, এই এতটা বছর শাশুড়ি মা ওদের সাথে। নীলা যতটুকু পেরেছে খেয়াল রাখতে। কখনও অসম্মান করে একটা কথাও বলেনি, উনিও অবশ্য সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। ওনার সব প্রয়োজনীয় জিনিস নীলাই নিয়ে আসত। কিন্তু আজ? এখন থেকে কি ওকে আর উনি কিছু বলবেন না? এতটাই দূরের মানুষ হয়ে গেল ও! একটা কষ্ট চেপে ধরে বুকে। মন খারাপ গলায় বলে, ‘আচ্ছা মা, আমি যাই। টুকুন এলে ফোন দেবেন।’

২.
সেদিন নীলা সকালে অফিসে বসে মনযোগ দিয়ে একটা রিপোর্ট দেখছিল। এমন সময় হঠাৎ একটা ফোন আসে। নীলা তাকিয়ে দেখে টুকুনের স্কুল থেকে। ভ্রু কুঁচকে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে, ‘আপনি টুকুনের আম্মু? আমি ওর স্কুলের প্রিন্সিপাল নাহিদ আফরোজ বলছি।’

টুকুন একটু ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, কী হয়েছে, বলুন তো?’

ওপাশ থেকে নাহিদ বলেন, ‘আপনি একটু কষ্ট করে স্কুলে আসুন। সামনাসামনি বলতে হবে। পারলে আজ ছুটি নিয়ে নিন।’

এবার নীলা সত্যিকারের ভয় পায়, আকুল গলায় বলে, ‘আমার টুকুন ভালো আছে তো?’

ওপাশ থেকে নাহিদ আশ্বস্ত করে বলে, ‘না, না, ওসব কিছু না। ও ভালো আছে, আমার সামনেই আছে। আপনি ধীরে সুস্থেই আসুন।’

নীলা ফোনটা রেখে এক গ্লাস পানি খায়, তারপর ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়ে। গাড়িতে যেতে যেতে ভাবে, টুকুন কি কোনো অপরাধ করল?

ঘন্টাখানেকের মধ্যে নীলা স্কুলে পৌঁছে যায়। সরাসরি প্রিন্সিপালের রুমে চলে যায়। সালাম দিতেই প্রিন্সিপাল নাহিদ মুখ তুলে তাকান, তারপর একটু হেসে বলেন, ‘প্লিজ বসেন।’

নীলা একটা অস্বস্তি নিয়ে বসে, টুকুনকে দেখা যাচ্ছে না।
নাহিদ একটা রিপোর্ট কার্ড বের করে, তারপর নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা টুকুনের পরীক্ষার রেজাল্ট, আপনারা দেখেছেন?’

নীলা অবাক চোখে রিপোর্ট কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে, টুকুনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিছুদিন আগেই। কিন্তু ওর যে রেজাল্ট দিয়েছে একবারও বলেনি তো! নীলা এবার রিপোর্ট কার্ডটা দেখে, চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ও কী ভুল দেখছে!

নীলার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই প্রিন্সিপাল নাহিদ যা বোঝার বুঝে ফেলেন, হতাশ সুরে বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই দেখেননি, তাই তো। আমারও তাই মনে হয়েছে, অভিভাবকের স্বাক্ষরটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছে।’

নীলা ঠোঁট দুটো চেপে ধরে সিগনেচারটা দেখে, কচি হাতে ওর নামটা লেখা, যে কেউ দেখলেই বুঝে ফেলবে। নীলা বিশ্বাসই করতে পারছে না টুকুন ওর সই নকল করেছে, রেজাল্টের কথা বলেইনি ওকে। কিন্তু কেন?

নাহিদ এবার সহানুভূতির সুরে বলে, ‘দেখুন, টুকুন ক্লাশের প্রথম দিককার স্টুডেন্ট, ও এবার এত খারাপ করেছে দেখেই আমার কৌতুহল হয়েছিল। এখন এই স্বাক্ষরটা আরও ভাবিয়ে তুলছে। আপনি মা, আপনি হয়ত ভালো বুঝবেন কেন টুকুন এমন করল। একটা কথা বলি নীলা, সন্তানদের খেয়াল সবচেয়ে বেশি মাকেই রাখতে হয়। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ওকে ইদানীং প্রায়ই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, এক বেণি করে চুল বেঁধে আসার জন্য। আমাদের স্কুলে দুই বেণি করে আসার নিয়ম করেছি কিছুদিন আগেই।’

নীলার বুকের ভেতরটা যেন ভেঙ্গেচুড়ে যায়, ওর টুকুন ওকে কিছুই শেয়ার করে না! এই যে দুই বেণি করে দিতেও বলেনা। টুকুন এমন করে দূরে সরে যাচ্ছে! এভাবে একে একে সবাইকে ও হারাবে?

এরপর টুকুনকে ডাকতেই ওকে নিয়ে আসা হয়। নীলা খেয়াল করে টুকুনের মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। বুকটা মুচড়ে ওঠে, কাছে গিয়ে এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘থ্যাংক ইউ প্রিন্সিপাল। ওকে আজ নিয়ে যেতে পারি?’

উনি অনুমতি দিতেই ওরা বেড়িয়ে পড়ে।

টুকুনের বুকটা ধুকধুক করছে, আম্মু আজ ওকে অনেক বকবে। বকলে বকুক, ও কিচ্ছু বলবে না। আব্বু আম্মু সারাদিন ঝগড়া করে, কাউকেই ওর নিজের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করে না।

নীলা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকায়, নাহ, ওকে কিছু বলা যাবে না। একটু ভেবে বলে, ‘টুকুন, চল আইসক্রিম খাব আজ।’

টুকুন মাথা নিচু করে বসেছিল। মায়ের কথা শুনে অবাক চোখে মুখ তুলে তাকায়, বিশ্বাস হয় না, বলে, ‘সত্যি?’

নীলা ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ তো। চল।’

সেদিন নীলা টুকুনকে নিয়ে একটা শপিং মলে ঢুকে। ওর জন্য দেখে দেখে চুলে ব্যান্ড, ক্লিপ কেনে। তারপর মা মেয়ে মিলে দুটো আইসক্রিম নিয়ে আনন্দে খেতে থাকে। টুকুনের খুব খুশি লাগছে, কতদিন পর আম্মুর সাথে ঘুরছে। আম্মুকে এখন অনেক আপন লাগছে, সেই আগের আম্মুটা।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরে নীলা টুকুনের সিলেবাসটা নিয়ে একটা রুটিন করে ফেলে। তারপর ওকে নিয়ে পড়তে বসে। পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে নীলা একটা চিরুনি নিয়ে বলে, ‘এদিক আয় তো, তোর চুলটা আঁচড়ে দুই বেণি করে দেই।’

টুকুন একটু চেয়ে থাকে, তারপর মায়ের দিকে পেছন ফিরে বসে। নীলা পরম মমতায় মেয়ের মাথায় চিরুনি বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’ চুলে শ্যাম্পু করিস না কতদিন? একদম রুক্ষ হয়ে আছে চুলগুলো।’

নীলা একটু তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে সুন্দর করে দুটো বেণি করে দেয়। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! টুকুনকে ও কোনোদিন দূরে সরে যেতে দেবে না। যে মানুষটার জন্য আজ এই অবস্থা সেই তাহসানকে ভালো শায়েস্তা করেছিল। নীলা ওর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ বন্ধুকে সব খুলে বলেছিল, বিশেষ করে টুকুনকে ছবি পাঠানোর কথাগুলো। বন্ধুটা কি করেছিল তা ও জানে না, কিন্তু এরপর আর কোনো ফোন বা মেসেজ আসেনি।

২.
আবির ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে মুসলিম বিবাহ আইনে ডিভোর্সের নিয়মগুলো দেখছিল। মাঝে মাঝেই ওর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায়, তাহসান নামের ওই লোকটার সাথে নীলা বিদেশ গিয়েছিল এটা মানতেই পারে না। মাঝে মাঝেই ভাবে ডিভোর্স ফাইলটা করেই ফেলে। কিন্তু টুকুনের কথা ভাবতেই মনে হয় মা ছাড়া ও থাকবে কী করে? বাইরের কেউ এখনও ওদের ব্যাপারটা জানে না। একবার ডিভোর্স হয়ে গেলে সবাই জেনে যাবে, টুকুনের জীবনটাকে নরক করে তুলবে এই সমাজ। কথাটা ভাবতেই ও কম্পিউটারে খুলে রাখা ডিভোর্সের ওয়েবপেজটা বন্ধ করে। ভাবে, হয়ত একদিন সব ভুলে নীলার সাথে আবার ওর মিল হয়ে যাবে কিন্তু একটা অবিশ্বাস, একটা ক্ষত সারাজীবন ওকে বয়ে বেড়াতে হবে। আগের সেই সুরটা আর কখনোই ঠিকঠাক তাল লয়ে বেজে উঠবে না।

আজ একটা বিশেষ দিন, ওর প্রমোশন হয়েছে। আগের গাড়িটা চেঞ্জ করে নতুন গাড়ির চাবি দিয়েছে, কিন্তু ওর কোনো উচ্ছ্বাস নেই। আগে হলে সবার আগে নীলাকে ফোন করে জানাত। কিন্তু আজ একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না।
*********

নীলার মনটা আজ ভীষণ খারাপ, সকালেই আবিরের সাথে ঝগড়া হলো। সকালে শাড়ি পরে ও যখন চোখে কাজল দিচ্ছিল, ঠিক তখন পাশ থেকে ফোড়ন কেটে আবির বলছিল, ‘কি, আজ আবার কারও সাথে দেখা করার প্ল্যান আছে নাকি?’

নীলার আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়াল ডিনার প্রোগ্রাম ছিল, সে কথাটা বলতে ইচ্ছে করেনি। মুখ বুজে খোঁচাটা হজম করেছিল। জানে, উত্তর দিলেই আরও কিছু কুৎসিত কথা শুনতে হবে। তা আবিরকে ও দোষ দেয় না। সব দোষ যে ওর।

রাতে নীলা যখন বাসায় ফেরে, শরীরটা যেন ভেঙ্গে আসছে। ডিনার প্রোগ্রাম ছিল, কিন্তু কিছুই খায়নি। তার মধ্যে কাল অনেক রাত জেগেছিল টুকুনের পড়া শেষ করতে। এখন শরীরটা কেমন যেন দূর্বল লাগছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। নিশ্চয়ই গ্লুকোজ কমে গেছে ওর, ভাবে নীলা।

নীলা বাসায় ঢুকেই ফ্রিজ খুলে দেখে মিষ্টি। এত মিষ্টি কিসের? একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই দিলারা আনন্দিত গলায় বলেন, ‘আবিরের প্রমোশন হয়েছে, তার মিষ্টি। ও নতুন গাড়িও পেয়েছে।’

টুকুনও এর মধ্যে চলে এসেছে, আনন্দিত গলায় বলে, ‘আম্মু, বাবার গাড়িটা কী যে সুন্দর!’

নীলা মিষ্টিটা হাতে নিয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বাসার সবাই জানে, শুধু ও জানে না! কেউ ওকে খবরটা দেবার প্রয়োজনই বোধ করল না! এতটাই অপাঙক্তেয় ও সবার কাছে? এক সাগর অভিমান ঘিরে ধরে, চোখটা ভিজে ওঠে। মিষ্টিটা রেখে বেসিনে হাত ধুতে যেতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, ভারসাম্য হারিয়ে ধড়াম করে বেসিনে মাথা ঠুকে পড়ে যায়।

টুকুন ‘আম্মু’ বলে জোরে একটা চিৎকার দেয়।

৩.
নীলা গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখে একটা সুন্দর ফুলের বাগান। টুকুন দৌড়ে খেলা করছে। হঠাৎ আকাশ থেকে একটা বড় শকুন উড়ে এসে ছো মেরে টুকুনকে নিয়ে যেতে থাকে। নীলা চিৎকার করে ওঠে।

আবির হাসপাতালে নীলার বেডের পাশে বসেছিল। হঠাৎ খেয়াল করে নীলা কেমন একটা গোঙানির শব্দ করছে। ঝুঁকে নীলার কপালে হাত রাখতেই ও ধীরে ধীরে চোখ খোলে, এক দৃষ্টিতে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝাপসা দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়, আবিরকে ওর দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকতে দেখে।

চোখ খুলতে দেখেই আবির নরম গলায় বলে, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছিল?’

নীলা কী ভুল শুনছে নাকি ও এখনও স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু আবির যে নীল শার্ট পরে আছে সেটা দেখতে পাচ্ছে। স্বপ্নে তো কেউ রঙ দেখতে পায় না, কোথায় যেন পড়েছিল। আবির সত্যিই ওর কষ্ট হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করছে?

নীলার বুকটা যেন সুখে ভরে যেতে থাকে, সব অভিমানের হিমবাহ গলে যেতে চায়। কত ছোট্ট একটা কথা, কিন্তু কত বেশি ভালো লাগা। এমন সত্যিকারের সুখ রেখে ও মিথ্যে সুখের মরীচিকায় ভুল পথে হেঁটেছিল। যার শাস্তি ও পেয়েছে অনেকই।

আবির এবার অনুতাপের গলায় বলে, ‘তুমি গত ক’টা মাস খাওয়া দাওয়ায় অনেক অনিয়ম করেছ। ডাক্তার সাহেব বললেন শরীরে অপুষ্টি, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। খুব বকলেন ডাক্তার। আমারই ভুল, তোমার কোনো খবরই রাখিনি। যেভাবে বেসিনের উপর মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে, আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। মাথার আঘাতটা ক্ষতিকর হতে পারত, বড় একটা দূর্ঘটনা হয়ে যেত। টুকুন ভীষণ ভয় পেয়েছে।’

নীলার শুনতে খুব ভালো লাগছে, ওর বিশ্বাস হচ্ছে না আবির কথাগুলো বলছে। তাহলে এখনও একটু হলেও ওর জন্য মায়া আছে আবিরের।

ধরা গলায় বলে, ‘মারা গেলেই খুব ভালো হতো। আমি তোমাকে ঠকিয়েছি, টুকুনকে ঠকিয়েছি। একটা ভুল আমাকে আমার সব মূল্যবান যা ছিল তা কেড়ে নিয়েছে। আমি সব হারিয়ে ফেলছি।’
আবির চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ‘নীলা, কিছুই হারিয়ে যায়নি। পরিবারের বন্ধনটা এমনই শক্তিশালী যে আমরা হাজার ভুল করলেও কেউ কাউকে ফেলে দেই না। সবসময় আঁকড়ে ধরে রাখি। এই যে আমাদের টুকুন, ও যদি কোনোদিন বড় কোনো ভুল করে ওকে কী আমরা ফেলে দেব? পৃথিবীর সবাই ফেলে দিলেও আমরা পারব না। পরিবারটা ঠিক এমনই একটা মায়ার জায়গা, ভরসার জায়গা। শুধু একটু পরস্পরের সম্মানের জায়গাটা থাকা উচিত, যেন আমরা আমাদের দায়িত্বটা ভুলে না যায়।’

নীলার চোখ বেয়ে জল পড়ছে, নাকটা টেনে বলে, ‘হ্যাঁ, আবির। আমি এখন বুঝি, তুমি, টুকুন আমরা একটা পৃথিবী। সেই পৃথিবীটা যেন সবুজ থাকে, সতেজ থাকে তার দায়িত্ব যে আমাদেরই। এই ক’টা মাস আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম, আজ আবার সব ফেরত পেলাম।’

ওর কথা শেষ হতেই টুকুন ওর দাদুর সাথে রুমে ঢোকে। নীলা দূর্বলভাবে হেসে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, টুকুন মায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। নীলা দুটো হাত দিয়ে মেয়েকে ঝাপটে ধরে, মিষ্টি একটা গন্ধ টুকুনের গা জুড়ে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে এই ঘ্রাণটার সাথে ওর পরিচয়। অনেক সুখের, অনেক ভরসার ঘ্রাণ যে এটা। আবির নীলার একটা হাত চেপে ধরে। নীলা চোখটা বন্ধ করতে করতে ভাবে ওর টুকুন আছে, আবির আছে, ও আর কখনোই কোনো চোরাবালিতে ডুবে যাবে না। ওর প্রিয় মানুষেরা তা কখনোই হতে দেবে না।

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
৩১/০৭/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here