নিভৃত_কুহক (পর্ব ৬)

0
349

#নিভৃত_কুহক (পর্ব ৬)

নভেম্বর, ২০০২

১.
রেহনুমার মনটা আজ খুব ভালো। বহুদিন পর মনে হলো কেউ একজন ওকে নিয়ে ভাবে। আজ আরিফ এসেছিল। ঘুরে ঘুরে ওর জন্য একটা সুন্দর গাঢ় নীল রঙের মোবাইল কিনে দিয়েছে। দামটা অনেক, ওর সারা মাসের রোজগারের প্রায় সমান। একটু খচখচ করছিল মনের ভেতর, কিন্তু আরিফ ওকে বুঝিয়ে বলেছিল এটা ওর বিজনেসে এক রকমের ইনভেস্টমেন্ট। ও যেমন সুঁই কেনে, সুতা কেনে, কাঁচি কেনে ঠিক তেমন দোকান চালাতে গেলে মোবাইলও লাগে। এখন প্রযুক্তির যুগ, তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এর সুবিধেটুকুও নিতে হবে।

এই কথার পর ওর মনের দ্বিধাটুকু কেটে গিয়েছিল। কেনা শেষে আরিফ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কেমন করে চালাতে হয়, নাম্বার সেভ করতে হয়। বিশেষ করে ক্যালকুলেটর আছে এটা জেনে রেহনুমা বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে ওঠে।

আরিফ যাবার সময় ওর নাম্বারটা সেভ করে দিয়ে বলেছিল, ‘এখন থেকে যেদিন পুকুর পাড়ে বসবেন আমার এই নাম্বারে পর পর দু’বার মিস কল দেবেন। আমি ঠিক চলে আসব। শুধু শুধু কল করে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই।’

রেহনুমা হেসেছিল, ওর জন্য আরিফের এই ভাবনাটুকু ভালো লেগেছিল।

বাসায় এসে সবার আগে ছোট বোন সুমিকে মোবাইল দেখায়। সুমি আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠে, ‘আপু, তুই মোবাইল কিনেছিস! কী সুন্দর মোবাইলটা!’

সুমির চিৎকারে মা মনোয়ারা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেনে, উদবিঘ্ন গলায় বলেন, ‘অ্যাই, কী হয়েছে রে? চিল্লাছিস কেন?’

সুমি উচ্ছ্বাসের সাথে বলে, ‘মা দেখো, আপু নতুন মোবাইল কিনেছে।’

মনোয়ারা বেগম অবাক চোখে সুমির হাতে চৌকোনা লম্বাটে যন্ত্রটা দেখেন।

তারপর ভ্রু কুঁচকে রেহনুমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুই মোবাইল কিনেছিস? তোর কি কোনো আক্কেল নাই? আগামী মাসেই সুমির বিয়ে, কত টাকা খরচ হবে। কই টাকা জোগাড় করবি তা না এত টাকা খরচ করে নিজের জন্য মোবাইল কিনে আনলি। এত স্বার্থপর কেন তুই? নিজের বিয়ে হচ্ছে না বলে ছোট বোনের বিয়েটাও ঠিক করে হতে দিবি না? তোকে যে তোর বাবা বলেছিল পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে সেটা মনে আছে?’

রেহনুমার মনে হয় কেউ যেন ওর কানে গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ও স্বার্থপর! ছোট বোনের বিয়েতে ও ঈর্ষান্বিত! ওর বিয়ে হচ্ছে না বলে ও ওর আদরের ছোট বোন সুমির বিয়ে ঠিক করে হতে দেবে না! বুক ফেটে কান্না আসে, গলা বুজে আসে। মা কেন ওর সাথে এমন করে?

সুমি ততক্ষণে মোবাইলটা রেখে পাশের রুমে চলে গেছে। মা তখনও চিৎকার করে যাচ্ছিল, ‘বড় বোন হয়ে কী করে ছোট বোনের শত্রু হয় মানুষ? এত হিংসা তোর মনে। তোর যেমন গায়ের রঙ কালো মনটাও কালো।’

রেহনুমার মনে হয় বুকের ভেতর কেউ যেন একটা ভোঁতা ছুরি নিষ্ঠুরভাবে বসিয়ে দিল। টের পায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ভেঙেচুরে যাচ্ছে সব। এত দিনের মায়ার বাঁধন যেন এখন ফাঁসির দড়ির মতো চেপে বসছে গলায়।

নিজেকে সামলায়, তারপর শান্ত গলায় বলে, ‘মা, এবার থামো। সুমির বিয়ের জন্য আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়েছিলে, সেটা আমি ব্যবস্থা করেছি। তুমি ভেব না, সময়মতো টাকা পেয়ে যাবে। সুমি তো আমার আপন ছোট বোন, ওর জন্য যা করার দরকার আমি সব করব। আর মোবাইলটা দোকানের জন্যই কেনা, ব্যবসায় কাজে লাগবে। দোকানটা ঠিক করে না চললে তো সবই থেমে যাবে।’

মনোয়ারা বেগম থমকে যান, রেহনুমার কথা সত্যি। ওর বাবার টাকায় তো সংসার চালানোই মুশকিল। রেহনুমা যদি প্রতি মাসে টাকা না দিত তাহলে যে কী হতো! আসলে ছোট মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। পাত্রপক্ষ বড়লোক, ছেলে সরকারি চাকুরে। নেহায়েত সুমি দেখতে শুনতে সুন্দর বলে ছেলে প্রেম করে বসেছে। এমন ভালো পাত্র যে কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। এদিকে পাত্রের বাড়ির সাথে পাল্লা দিতে যেয়ে ওদের অবস্থা সংগিন। আলাদা ক্লাব ভাড়া করে বিয়ে দিতে হবে। আর গয়নাগাটির খরচ তো আছেই। তাই এই সময়ে মোবাইল কিনে টাকা খরচ করতে দেখে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। নাহ, মেয়েটাকে বেশিই বলে ফেলেছেন। ওর মনে যে এমনিতেই অনেক কষ্ট! কেন যে মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না।

কাছে এসে মন খারাপ গলায় বলেন, ‘জানিসই তো, তোর বাবা কেমন দিশেহারার মতো টাকার জন্য ছুটছে। তুই আমার কথায় মন খারাপ করিস না। গোসল করে আয়, ভাত বাড়ছি।’

রেহনুমা একটা বিষণ্ণ হাসি হাসে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা আমি আসছি গোসল করে।’

বাথরুমে ঢুকেই ও কলটা ছেড়ে দেয়। ঠান্ডা পানির স্পর্শে শরীরটা একবার কেঁপে ওঠে। ঝরনা থেকে পানি ঝরছে, সাথে ওর চোখ থেকেও। রেহনুমা কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে, সেটা নভেম্বরের ঠান্ডা পানির জন্য নাকি বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্টগুলোর জন্য তা সঠিক বোঝা যায় না।

রাতে যখন ঘুমোতে যাবে ঠিক তখন সুমি এসে লাজুক গলায় বলে, ‘আপু, তোর ফোনটা একটু দিবি?’

রেহনুমা কিছু জিজ্ঞেস করতে যেয়েও থেমে যায়, নিশ্চয়ই সোহেলকে ফোন করবে। ওর হবু বর।

সস্নেহে হেসে বলে, ‘নিয়ে যা।’

সুমি কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘থ্যাংকিউ আপু।’

ফোনটা নিয়ে সুমি বারান্দায় চলে যায়। একটু পরেই ফোন আসার শব্দ পাওয়া যায়, সোহেল হয়তো। রেহনুমা বারান্দা থেকে সুমির নিচু গলায় কথা শুনতে পায় সাথে চাপা হাসির শব্দ। কেন জানি রেহনুমার মনটা আবার খারাপ হতে শুরু করে। ওর কি এই জীবনে এমন করে কারও সাথে লুকিয়ে কথা বলা হবে না?

পরদিন সকালে রেহনুমা যখন দোকানের জন্য বের হচ্ছিল মনোয়ারা বেগম একটা ছোট বাক্স নিয়ে ওর সামনে আসেন। বলেন, ‘একটু বোস, তোর সাথে কথা আছে।’

রেহনুমা বাক্সটা চিনতে পারে, মায়ের একমাত্র যক্ষের ধন। কিছু গহনা আছে এটাতে।

মনোয়ারা বেগম দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে সাবধানে কাঠের বক্স থেকে দেড় ভরি ওজনের একটা সোনার হার বের করেন। তারপর বলেন, ‘তুই এটা কষ্ট করে কৃষ্ণা জুয়েলার্সে পালিশ করতে দিয়ে আসবি, যাতে দেখে নতুন মনে হয়। সুমির বিয়েতে তো সোনার তেমন ভারী কিছু দিতে পারলাম না।’

রেহনুমা অপলক চেয়ে থাকে হারটার দিকে। হঠাৎ করে মনে পড়ে, অনেক আগে যখন ওর বিয়ের কথা চলছিল তখন মা বলেছিল এই হারটা ওর বিয়েতে দেবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেহনুমা ভাবে ভালোই হয়েছে, ওর তো আর বিয়ে হবে না। হারটা সুমিরই দরকার।

মনোয়ারা বেগম রেহনুমার মুখের পরিবর্তনটা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। আমতা আমতা করে বলেন, ‘তুই চিন্তা করিস না, তোর বিয়ের সময়ও এমন একটা হার গড়িয়ে দেব। আপাতত সুমিকে পার করি।’

কথাটা বলার জন্যই বলা। ওদের আর্থিক অবস্থা যা তাতে করে নতুন সোনার হার বানানোর প্রশ্নই আসে না। বানালে ওকেই বানাতে হবে। কিন্তু সে সুযোগও হয়ত আসবে না। ইদানিং মা পর্যন্ত ওর গায়ের রঙ নিয়ে হা হুতাশ করেন। কেন জানি এসব এখন সয়ে গেছে। জীবনের এই পরাজয়গুলো, হীনমন্যতাগুলো ও মেনে নিয়েছে।

রেহনুমা বিষণ্ণ একটা হাসি হাসে, হারটা সাবধানে ব্যাগে নিয়ে বলে, ‘ঠিক বলেছ মা, হারটা সুমির জন্যই দরকার। আমি সুন্দর করে পালিশ করে আনব, দেখে কেউ বুঝতেই পারবেনা এটা পুরনো হার।’

রেহনুমা বের হয় রাস্তায়, হাঁটে আনমনে। বড় রাস্তার মোড়েই কৃষ্ণা জুয়েলার্স। বাতাসে শীতের ছোঁয়া, তাতে একটু কেঁপে উঠে ও।
দোকানটায় পৌঁছাতে পাঁচ মিনিটও লাগে না। ওদের কাছে হারটা দিয়ে মানি রিসিট নিয়ে শাহবাগের পথ ধরে।

সেদিন দুপুর পর্যন্ত টানা কাজ করে রেহনুমা। ওকে চুপচাপ দেখে ওর দোকানের সাহায্যকারী মেয়েটা বার কয়েক জিগ্যেস করে শরীর খারাপ কি না। রেহনুমা মাথা নেড়ে না করে।

দুপুরে লাঞ্চ বক্স বের করে ভাত খেয়ে দোকানের সামনের বারান্দায় বসে। নভেম্বর শেষ হয়ে এলো, শীত আসছে। দুপুরের রোদের তেজ মরে এসেছে, একটা কোমল মায়া। রেহনুমা মন খারাপ করে ভাবে আচ্ছা ওর জন্য কোথাও কেউ বসে নেই বুঝি? শুধু ওর জন্য কেউ ভাবে না। মা পর্যন্ত ওকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। ও শুধুই এখন সংসারের জোয়াল টানার নতুন মানুষ। কিন্তু ওরও তো একটা মন আছে, একটু মায়া চায়। মনটা আজ ভীষণই খারাপ লাগছে, একটা নিঃসংগতা ঘিরে ধরে।

কী মনে হতে মোবাইল বের করে। একটা দ্বিধা মনের ভেতর কিছুক্ষণ আটকে রাখে। তারপর সব দ্বিধা কাটিয়ে ফোনটা দেয়। কী মিষ্টি একটা শব্দ হচ্ছে ফোনের ভেতর। রেহনুমা ফোন কানে চেপে ধরে রাখে। হঠাৎ ওপাশ থেকে ভারী একটা কন্ঠ শোনা যায়, ‘রেহনুমা, জরুরি কিছু?’

প্রথমটায় কেমন একটা ধন্দ হয়, এটা কি আরিফের গলা? অবশ্য ফোনে কখনও ওনার গলা শোনা হয়নি। নিতান্ত অপরিচিত মানুষের মতো লাগছে।

রেহনুমা অস্ফুটে বলে, ‘আপনি একটু শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে আসতে পারবেন?’

আরিফ চিন্তিত গলায় বলে, ‘এখনই?’

রেহনুমা ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, এখুনি। আচ্ছা সমস্যা থাকলে আসার দরকার নেই।’

আরিফ এবার সময় নেয় না, দ্রুত বলে, ‘না না, সমস্যা নেই কোনো, আমি আসছি।’

শহীদুল্লাহ হলের পুকুরটা উত্তর দক্ষিণে বেশ লম্বা। মাঝে মাঝে সিমেন্টের বেঞ্চি, সাথে নারিকেল গাছ। ওরা পুকুরের পশ্চিম দিকটায় বসে যে পাশটায় লাল রঙের হলটা। এপাশে এখন ছায়া পড়েছে। সামনে পুকুরের নিস্তরঙ্গ জল। আধা ঘণ্টা হলো ওরা বসে আছে। এখন পর্যন্ত রেহনুমা একটা কথাও বলেনি, জলের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ টের পায় ওর ভেতরে একটা অস্থিরতা আছে, যেটা ও পুকুরের এই জলকে দিয়ে একটু বুঝি শান্তি পেতে চায়। আরিফ অবশ্য একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন এখানে আসতে বলেছে। মন খারাপ সেটা ও জানে, কিন্তু কেন সেটা জিজ্ঞেস করেনি। অপেক্ষা করছে, নিশ্চয়ই রেহনুমা বলবে।

কিন্তু রেহনুমা কিছু বলে না। আরিফ এবার নিজে থেকেই কথা বলে, ‘আচ্ছা, আপনাকে না বলেছিলাম দু’টো মিস কল দেবেন। তাতেই আমি বুঝে যাব যে এখানে আসতে হবে। শুধু শুধু টাকা খরচ হলো আপনার।’

রেহনুমা পাশ ফেরে তাকায়, চোখেমুখে এই প্রথম হাসির আভাস দেখা যায়। বলে, ‘আমার জন্য বুঝি খুব ভাবেন?’

আরিফ একটু থতমত খেয়ে যায়, বোকার মতো হেসে বলে, ‘বাহ, এটুকু ভাবনা তো ভাবতেই পারি।’

রেহনুমা তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘ওহ, আপনি শুধু এটুকুই ভাববেন। বেশি ভাবতে যাবেন না কিন্তু আমাকে নিয়ে। তাহলে আপনাকে আবার ঘন ঘন এই পুকুর পাড়ে এসে বসে থাকতে হবে।’

আরিফ হাসে, তারপর নরম গলায় বলে, ‘উল্টোও তো হতে পারে। দেখা গেল, আমার বেশি ভাবনার জন্যই আপনাকে আর কখনো এই পুকুর পাড়ে এসে বসে থাকতে হচ্ছে না।’

কোথাও শিউলি ফুল ফুটেছে। বাতাসে সেই ঘ্রাণ ভেসে ভেসে বুকের ভেতর, চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কোথা থেকে একটা মিষ্টি বাতাস এলো আবার!

হঠাৎ করেই রেহনুমার সব মন খারাপেরা ছুটি নেয়। পৃথিবীর সবাইকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে। ফিসফিস করে ও বলে, ‘আপনি সত্যিই বলছেন? এমন কখনও হয়?’

আরিফ ওর দিকে তাকায়, গভীর গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো।’

রেহনুমা গভীর মায়া নিয়ে আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন বাচ্চাদের মতো ও বলল, ‘হ্যাঁ তো’, কী সুন্দর দু’টো শব্দ!

সেদিনের পর থেকে সারাজীবনের জন্য এই দু’টি শব্দের মায়ায় জড়িয়ে পড়ল রেহনুমা।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২১/০৪/২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here