#বসন্তের_একদিন
#পর্বঃ১৪_১৫(অন্তিম_পর্ব)
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
#পর্বঃ১৪
পরেরদিন,
একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা।সে বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে তাকে কি কি করতে হবে।
” তুমি কেন এমন করলে তিথি?বাড়ির সবাই তোমাকে কত বিশ্বাস করে আর তুমি তাদের বিশ্বাসের মূল্য এভাবে দিচ্ছো?না তিথি আমি তোমাকে ভুল পথে যেতে দেবোনা।তুমি আমাকে আপন না ভাবলেও আমি তোমাকে নিজের ছোটবোন ভাবি।তাই তোমাকে ভুল পথে যাওয়া থেকে আটকাতে আমি যা করার সব করবো,সব।”
তৃধা ধীর পাশে হোটেলের দিকে আসতে থাকে।তিথি হোটেলের ভিতরেই আছে।আসলে কাল তৃধা তিথির ফোনে মেসেজটা দেখে খুবই অবাক হয়।
” কাল সকাল ১০ঃ০০ টায় ‘……..’ এই হোটেলে চলে এসো।আমরা একা সময় কাটাবো।জলদি চলে এসো কিন্তু সোনা।”
মেসেজটা দেখেই তৃধা বুঝে যায় কি হলে চলেছে।তাই যখন আজ সকালে দেখলো তিথি বাড়ি থেকে বের হচ্ছে তখন তৃধাও সকলের চোখের আড়ালে তিথির পেছন পেছন বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে,
” কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো রোহান।আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে।এই অসময়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি কেউ জানতে পারলে আমাকে ছাড়বেনা।”
” আরে বেবি এতো তাড়া কিসের?মাত্রই তো এলে।এখনোতো অনেক কাজ বাকি।”
তিথির কাছে ঘেঁষতে ঘেঁষতে বলে রোহান।তিথি দূরে যেতে চাইলে রোহান থাকে আটকে দেয়।
” কি করছো রোহান?”
” তুমি তো বুঝতেই পারছো কি করতে চাইছি আমি।তাহলে আবার প্রশ্ন করছো কেন?”
” দেখো রোহান এসব এখন না এগুলো বিয়ের পরে।এখন এসব করা ঠিক হবেনা।যদি কোন অঘটন ঘটে যায় তো?না রোহান এগুলো এখন না।”
” আরে কিছু হবেনা।আমি সব ব্যবস্থা করেই এসেছি।প্লিজ তুমি আজ বাঁধা দিওনা।”
” না রোহান আমি এসবের জন্য প্রস্তুত না।তুমি থাকো আমি গেলাম।”
তিথি উঠে চলে যেতে নিলে রোহান তার হাত ধরে তাকে আটকে নেয় আর বিছানায় ফেলে দেয়।তিথি পিছাতে থাকে কিন্তু সে যত পেছনে যাচ্ছে রোহান ততই এগিয়ে আসছে।
” রোহান প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”
” না আমি কিছু শুনবোনা আজ।আজ তো তোমাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো।”
রোহান হুট তিথির দুটো হাত ধরে ফেলে।তিথি মোচড়ামুচড়ি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারেনা।
” ঠক….ঠক….”
” এখান আমার কে এলো?ধুর এই কাজের সময় কে ডিস্টার্ব করে?” বিরক্তি নিয়ে বলে রোহান।
” ঠক….ঠক…..”
” আরে বাবা আসছি।”
রোহান গিয়ে দরজা খুলে দেয়।বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর মেয়েটা আর কেউ নয় তৃধা।
” কে আপনি?এখানে কি চায়?”
” ভাবী তুমি এখানে?” ভয়ে ভয়ে বলে তিথি।
তৃধা বুঝতে পেরে যায় যে ছেলেটা তিথিকে জোর করেছে।তৃধার এখন প্রচুর রাগ হচ্ছে।সে রুমের মধ্যে ঢুকে তিথিকে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়।
” ভাবী।”
” চুপ একদম চুপ।তোমাকে আমার এই চড়টা আরো আগে মারা উচিত ছিলো।ছিঃ তুমি এরকম সেটা আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।মেসেজটা পড়েই তো তোমার বুঝতে পেরে যাওয়ার কথা ছেলেটা তোমাকে আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে তাও তুমি চলে এলে।আসলে আমার কি মনে হচ্ছে জানো শারীরিক চাহিদা শুধু ছেলেটার না তোমারও আছে।তাই তো চলে এলে।”
” ভাবী।” রেগে বলে তিথি।
” গলা নামিয়ে কথা বলো।লজ্জা করেনা এত বড় একটা জঘন্য কাজ করেও তুমি আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছো?আজ যদি আমি না আসলাম তাহলে কি হতো একবারো ভেবে দেখেছো?ছেলেটা যা করার তা করে ফেলতো তবে তুমি কিছুই করতে পারতেনা।সারাটাজীবন পঁচে মরতে হতো তোমাকে।তোমার জন্য তোমার ভাই,মা,বোন সবার মানসম্মত মাটিতে মিশে যেতো।এইখানে আসার আগে তুমি একবারো ভাবলেনা যে এরপরে কি হবে?”
তৃধার কথা শুনে তিথি মাথা নিচু করে কান্না করতে থাকে।তৃধা চোখ সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাই,তারপর তাকেও একটা থাপ্পড় মেরে দেয়।
” আপনার এতো বড় সাহস?আপনি আমাকে থাপ্পড় মারলে।”
” গলা নামিয়ে কথা বলো।তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।এতো বড় জঘন্য একটা কাজ করতে যেয়ে ধরা খেয়েছো তাও তোমার নূন্যতম লজ্জাবোধ নেই।এই ছেলে এই তোমার বাবা-মা কি তোমাকে এসব কাজ করার জন্য পড়াশোনা করাচ্ছে?হ্যাঁ?এতই যদি গায়ের জ্বালা থাকেনা তাহলে পতি***** যাও।শুধু শুধু কেন মেয়েদের জীবন নষ্ট করছো?পতি***** যাও এতে তোমারও চাহিদা মিটবে আর তাদেরও লাভ হবে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তৃধা আবারো বলে,
” আমি তিথিকে নিয়ে যাচ্ছি তবে এটা ভেবোনা তুমি বেঁচে গিয়েছো।আমি হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছি আমি বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ওনারা আসবেন।তোমার বাবা-মাকে ফোন করে তোমার কান্ডকীর্তি সব জানবে।তবে এটা ভেবোনা তুমি ওনাদের টাকা খাইয়ে চলে যেতে পারবে।উু… ভুলেও ভেবোনা।যদি ওনারা তোমাকে ছেড়েও দেয় আমি ওনাদের ছাড়বোনা।কোট পর্যন্ত নিয়ে যেতেও দুবার ভাববোনা।তাই ওনারা নিজেদের বাঁচাতে তোমাকে ছেড়ে দেবেনা।”
তৃধা এবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকাই।তারপর তার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাহিরে নিয়ে আসে।
সারা রাস্তা তৃধা তিথির সাথে কোন কথা বলেনি আর তিথি সারা রাস্তা ফুপাতে ফুপাতে এসেছে।
” এই মেয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে হ্যাঁ?তোমাকে আমি সারা বাড়ি খুঁজেছি।তোমাকে না তেজ বাইরে যেতে বারণ করেছে তাও তুমি কেন বাইরে গিয়েছো?আমি কি তেজকে বলবো?” নন্দিনী বলে।
” বাইরে কাজের জন্য গিয়েছিলাম,আমার সাথে তিথিও ছিলো।আমার এতো চিন্তা করার জন্য ধন্যবাদ।তবে এতো চিন্তা করতে হবেনা আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”
একবার তিথির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুমে চলে আসে।
রাতে,
সবাই নিচে খাবার খাচ্ছে।তৃধাকে তেজবীন আগেই খাইয়ে দিয়েছে,এখন তৃধা রুমে বসে তেজবীনের জন্য অপেক্ষা করছে।তখন সেখানে তিথি আসে।সে কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর হুট করেই তৃধাকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
” আই এম সরি ভাবী,আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম,আমি ভেবেছিলাম ওকে বোঝালে ও বুঝবে কিন্তু ও তো…..।” আর কিছু বলতে পারলোনা তিথি।
” কান্না বন্ধ করো তিথি।” তিথির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে তৃধা। ” দেখো তিথি তুমি ভালেবাসো ঠিক আছে তবে ভালোবাসা মানে তার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা নয়।তুমি যদি চোখ বন্ধ করে চলো তাহলে একসময় না একসময় তুমি কোথাও ধাক্কা খাবেই।তেমনিই ভালেবাসাও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করাটা ঠিক নয়।হ্যাঁ ভালোবাসায় বিশ্বাসটা খুবই জরুরি তবে অন্ধবিশ্বাস নয়।অন্ধবিশ্বাস যে বড়ই ভয়ংকর।মানুষ ভুল করে আর সেই ভুল থেকেই শিক্ষা নেয়।আমি আশা করি তুমিও তোমার এই ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।”
তৃধার কথা শুনে তিথি নিজের ভুলটা আরো ভালো করে উপলব্ধি করতে পারে।তিথি লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।
৩ মাস করে,
ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তেজবীন,তিথি,রুদ্র।নন্দিনী আর ফাতেমা বেগম একটা চেয়ারে বসে আছে।কিছুক্ষণ পরেই একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।আর এটা শুনে তেজবীনের মুখে হাসি ফুটে উঠে।
” মিসেস তৃধা বাড়ি থেকে কে আছেন?” একজন নার্স বলে।
” আমরা।আমি ওর হাসবেন্ড।”
” এই নিন আপনার বাচ্চা।”
তেজবীন খুব যত্ন সহকারে তার বাচ্চাটাকে কোলে নেয়।
” দেখি দেখি সর সর আমি আমার নাতিটাকে একটু দেখি।বাবু দেতো আমাকে আমার নাতিকে।”
ফাতেমা বেগম খুবই আগ্রহ সহকারে বাচ্চাকে কোলে নেন কিন্তু বাচ্চাটাকে কোলে নিতেই ওনার মুখটা কালো হয়ে যায়।তিনি বাচ্চাটাকে তেজবীনের কাছে দিয়ে দেয়।
” কি হয়েছে মা?তুমি দিয়ে দিলে যে?”
” এই মেয়েকে আমি আমার ঘরে তুলবোনা।” রেগে বলেন ফাতেমা বেগম।
” মানে?”
” মানে তোমার মেয়ে হয়েছে।আর আমি এই মেয়েকে চাইনা।যার পেট থেকে বের হয়েছে একে তাকেই দিয়ে আয়,তাকেই পালতে বল।আমার বাড়িতে এই মেয়ের জায়গা হবেনা।”
” আমার মেয়ে হয়েছে?”
” হ্যাঁ।”
মেয়ে হয়েছে শুনে তেজবীনের চোখে পানি জমে যায়।সে বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের সাথে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে।
” আমার মেয়ে,আমার রাজকন্যা এটা।আমার মেয়ে তন্বী।”
” তুই নামও ঠিক করে ফেলেছিস?”
” তো করবোনা,আমার মেয়ে বলে কথা।”
” শোন তেজবীন আমি এই মেয়েকে ঘরে তুলবোনা।একে এর মায়ের কাছে দিয়ে আয়।যদি এর মা একে চাই তো আমি তোদের ডির্বোস করিয়ে দেবো।আর যদি সংসার চাই তো ওই মেয়েকে কোথাও ফেলে দিয়ে আয়।”
” হ্যাঁরে তেজ,মা যা বলছে ঠিক বলছে।এই মেয়েকে পালা মানে শুধুই খরচ।আর মেয়ে মানে কোন কাজের না।তার পেছনে শুধু সারাজীবন খরচই করতে হয়।ছেলে হলে তো বড় হয়ে বাবা-মাকে খাওয়াবে।তাই মা যা বলছে সেটা শোন।এই মেয়েকে নিজের ঘাড়ে নিসনা।” নন্দিনী বলে।
” চুপ করো তোমরা দুজন।ছিঃ তোমরা যে আমার মা আর বড় বোন তা ভাবতেই আমার লজ্জা করছে।কে বলেছে মেয়েদের পেছনে শুধু খরচ আছে?মেয়েরা বাবা-মাকে কিছু দেয়না?মেয়েরা যে বড় হয়েছেও বাবা-মার খেয়াল রাখতে পারে,তাদের ভরনপোষণ করতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ তো ভাবী।আর তোমাদের এই কথাগুলো বলতে একবারো বিবেকে বাঁধলোনা?তোমরা দুজনও তো মেয়ে,তাহলে কি করে আরেকটা মেয়ের ব্যাপারে এরকমটা বলতে পারছো?মা তোমারও তো দুটো মেয়ে আছে।তুমি কি আমাদের জন্মের সময় বলেছিলে যে আমাদের কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে?বলেনি তো?উল্টো আমাদের আদরযত্নে মানুষ করেছো।এখনো আপু বাসায় আসলে তোমার আনন্দের সীমা থাকেনা।আর আপু আজ যদি তোরও মেয়ে হতো তাহলেও কি তুই এধরনের কথা বলতে পারতিস?পারতিস না তাহলে ভাবীর বেলায় কেন তোমরা এরকমটা করছো?ভাবী অন্যের মনে বলে?মা ভুলে যেও না তোমরাও কিন্তু দুটো মেয়ে আছে।তুমি অন্যের সাথে যা করবে প্রকৃতি কিন্তু সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমার সাথেও করবে।তাই কিছু করার আছে ভেবেচিন্তে করো।” এবার তিথি একটু থামে।
” ভাইয়া ছেলে-মেয়ে সব আল্লাহর দান।তিনি যেটা দিয়েছেন নিশ্চয়ই তোমার ভালোর জন্যই দিয়েছেন।তাই তার দানকে অবহেলা করোনা।ছেলে হোক বা মেয়ে সবচেয়ে বড় সত্যি সে তোমার সন্তান।আশাকরি বুঝতে পেরেছো আমি কি বোঝাতে চাইছি।” তিথি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যায়।তেজবীন এখনো বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে।
#পর্বঃ১৫
১ বছর পর,
বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে আছে তেজবীন।তন্বী তিথির কাছে আছে।তৃধা এসে তেজবীনের পাশে বসে।
” দুপুরে খাবে না?”
কিন্তু তেজবীন কোন কিছু বলেনা।তেজবীনের উওর না পেয়ে তৃধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
” প্লিজ তেজবীন এবার নিজের শক্ত করো।তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে কি করে হবে বলো?যার চলে যাওয়ার সে তো যাবেই।পৃথিবী ছেড়ে সবাইকেই একদিন না একদিন যেতেই হয়।আমি,তুমি আমাদের সবাইকেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতেই হবে।”
তেজবীন উঠে বসে তবে কিছু বলেনা।সে মাথানিচু করে বসে থাকে।তবে কিছুক্ষণ পরেই হুট করে তৃধাকে জরিয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো কান্না করে দেয় সে।
” প্লিজ তেজবীন কান্না করোনা।”
” মা তৃধা আমার মা।”
” নিজেকে সামলাও তেজবীন।তুমি এভাবে কান্না করলে তো মাও কষ্ট পাবে।উনি কিন্তু আমাদের উপর থেকে দেখছেন।উনি যদি তোমাকে এভাবে কান্না করতে দেখেন তাহলে কিন্তু উনিও কষ্ট পাবেন।”
তেজবীন এবার কান্না বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে।
” এইতো ভালো ছেলে।যাও এবার মুখ হাত ধুয়ে এসো।আমি খাবার রেডি করছি।”
চোখ মুছে তেজবীন ওয়াশরুমে চলে যায়।তৃধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আজ ১ মাস হতে চললো ফাতেমা বেগম মারা গিয়েছে।ঘুমের মধ্যেই তিনি তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।তৃধা এবার ভাবা বন্ধ করে দিয়ে খাবার রেডি করতে চলে যায়।
তেজবীন আর তিথি খাচ্ছে।তৃধা ছোট তন্বীকে খাওয়াচ্ছে।হঠাৎ করেই বাড়ির বেলে ভেজে উঠে।তৃধা উঠতে চাইলে তিথি তাকে বসিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দেয়।
” কে এসে তিথি?”
” মিস্টার তেজবীন।”
অপরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনে তৃধা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়,তেজবীনও উঠে দাঁড়ায়।লোকগুলোকে দেখে তৃধা,তিথি,তেজবীন সবাই ঘাবড়ে যায় কারণ লোকগুলো পুলিশের লোক।
” আপনারা এখানে কেন?”
” আমরা মিস্টার তেজবীনকে এরেস্ট করতে এসেছি।ওনার বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্টও আছে।”
” কিন্তু কেন এরেস্ট করবেন ওকে?কি করেছে ও?”
” উনি চুরি করেছেন।একজনকে জোর করে তার সম্পত্তি ওনার নামে করে নিয়েছেন।”
” কিসব বলছেন আপনি?আমি এরকম কিছুই করিনি।”
” চুরি করার পর সবাই এটাই বলে।”
” কিন্তু উনি কার কি চুরি করেছেন?আর কে ওনার নামে কেইস করেছেন?”
” আপনারা আসুন ভিতরে।”
দুটো মানুষ ভিতরে ডুকে কিন্তু মানুষগুলোকে দেখে তৃধা,তেজবীন আর তিথি তিনজনেই যেন আকাশ থেকে পড়ে।
” মিসেস নন্দিনী কেইস করেছেন।মিস্টার তেজবীন একসপ্তাহ আগে ওনার বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর করে ওনার আলমারি থেকে টাকা নিয়ে নিয়েছেন এবং সেইসাথে ওনাকে ভয় দেখিয়ে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছেন।”
নন্দিনী কাঁদোকাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।বড় বোনের এই রূপ দেখে তেজবীন খুবই অবাক হয়।সে কিছু বলার ভাষায় হারিয়ে ফেলেছে।
” আপু আপনি!”
” আপু তুই এসব কি বলছিস হ্যাঁ?তোর মাথা কি ঠিক আছে?তুই ভাইয়ার নামে এসব কি বলছিস?ও বুঝতে পেরেছি মা ভাইয়াকে সম্পত্তির বেশিভাগ দিয়েছে বলে তোর জ্বলছেনা,লোভ হচ্ছে না তোর।তাই তো তুই ভাইয়ার নামে এরকম মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস তাই না?” কান্না করতে করতে বলে তিথি।
নন্দিনী কিছু বলেনা।পুলিশ তেজবীনের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে তাকিয়ে নিয়ে যায়।
” ছিঃ আপু ছিঃ তুই যে আমার নিজের মা’য়ের পেটের বোন এটা ভাবতেই আমার ঘৃনা লাগছে।আজ থেকে আমি ভুলে যাবো আমার একটা বোন ছিল।” তিথি দৌড়ে উপরে চলে যায়।নন্দিনী একবার তৃধার দিকে তাকিয়ে রুদ্রকে নিয়ে চলে যায়।
৪ দিন পর,
তৃধা তাড়াহুড়ো করে ট্যাক্সি থেকে নেমে পুলিশ স্টেশনে ঢুকে।
” স্যার কোথায়?”
” আপনি বসুন স্যার আসছেন।”
” বলুন মিসেস তৃধা।”
” স্যার আপনি প্লিজ আমার হাসবেন্ডকে ছেড়ে দিন।ও কিছু করেনি।ও তো ওর বোনকে খুব ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে,তেজবীন এরকম কিছুই করতে পারবেনা।”
” দেখুন মিসেস তৃধা আপনি মুখে বললেই তো আর কিছু হয়না।প্রমাণ চায় আমাদের।মিসেস নন্দিনী আমাদের উপযুক্ত প্রমাণ দিয়েছে তাই আমরা ওনাকে এরেস্ট করে এনেছি।”
” প্রমাণ?আছে আছে প্রমাণ আগে আমার কাছে।”
তৃধা নিজের ব্যাগ থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে।
” এই নিন সব প্রমাণ এখানে আছে।”
১ ঘন্টা পর,
ইন্সপেক্টর এর সামনে বসে আছে তৃধা।এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী,রুদ্র,তিথি আর তার কোলে তন্বী।
” আমাদের এখানে কেন ডেকেছেন স্যার?” নন্দিনী বলে।
” আমরা মিস্টার তেজবীনকে ছেড়ে দিচ্ছি।”
” কেন?ও একটা চোর,আমার কতগুলো টাকা চুরি করেছে।”
” মিস্টার তেজবীন কি নিজে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলেন?”
” হ্যাঁ।” একটু ইতস্তত হয়ে বলে নন্দিনী।
” কিন্তু এই ফুটেজে যে দেখা যাচ্ছে মিস্টার তেজবীন সেদিন নিজের অফিসেই ছিলেন।”
কথাটা শুনে নন্দিনী আর রুদ্র ঘাবড়ে গিয়ে একে অপরের দিকে তাকাই।
” কনস্টেবল মিস্টার তেজবীনকে ছেড়ে দিন।”
তেজবীন বেরিয়ে আসে।তেজবীনকে বেরিয়ে আসতে দেখে তৃধা আর তিথি একটা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়।তেজবীন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে তাকাই।
” মিস্টার তেজবীন আপনি কি মিসেস নন্দিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান?”
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তেজবীনের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
.
.
২৫ বছর পর,
পুরো বিল্ডিং আলোয় জ্বলজ্বল করছে।মানুষে ভরপুর পুরো বিল্ডিং।তৃধা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে নানা কাজ কাজে।আজ সে ভীষণ ব্যস্ত আর ব্যস্ত থাকবে নাই বা কেন।আজ যে তার মেয়ের বিয়ে।
.
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তেজবীন।চুলে তার হালকা পাক ধরছে,সেইসাথে চোখে চশমাও আছে এখন।তিথির বিয়ে হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।তার একটা ছেলে আছে,কলেজে পড়ে।নন্দিনীর সাথে সেইদিনের পর থেকে তিথি,তৃধা বা তেজবীনের কোন সম্পর্ক নেই।সেদিন তেজবীন নন্দিনীর নামে অভিযোগ না করলেও তিথি করেছিলো।তবে নন্দিনী এর পরের দিনই ছাড়া পেয়ে যায়।তৃধা ফ্রেশ হয়ে এসে তেজবীনের পাশে দাঁড়ায়।
” কি ভাবছো?”
” ভাবছি আমার ছোট তন্বীটা কত বড় হয়ে গেলো।আজ তার বিয়ে এসে গেলো।”
” হুম সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো।”
” হুম খুব।কিভাবে যে আমাদের দুজনের একসাথে তিরিশটা বসন্ত পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।আচ্ছা আমরা কি আরো পনেরোটা বসন্ত একসাথে কাটাতে পারবো?”
” যদি চাই তবে পনেরোটা কেন মৃত্যুর পরেও আমরা সব বসন্তে একসাথে থাকবো।বসন্তের একদিনে আমরা এক হয়েছিলাম,বসন্তেরই একদিনে আমাদের জীবনে তন্বী এসেছিলো।আজও বসন্তের একটা দিন।এই বসন্তের একটা সুন্দর দিনে আমাদের তন্বী তার নতুন জীবনে পা রেখেছে।আর বসন্তের একদিনেই না হয় আমরা দুজন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবো।”
তেজবীন একসাথে তৃধাকে জরিয়ে ধরে আর তৃধা তেজবীনের বুকে মাথা রেখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
___________________সমাপ্ত_____________________
গল্প এতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়া জন্য দুঃখিত।আমিও চাইনি এতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়ার জন্য,আরো বড় করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি।কয়েকদিন পর থেকেই আমার মডেল টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে।তার জন্য এখন পড়ার চাপ বেশি,সেইসাথে প্র্যাকটিকালও লিখতে হচ্ছে।সব মিলিয়ে গল্প লেখার সময়টা পাচ্ছিলাম না তাই তাড়াতাড়ি শেষ করে দিয়েছি।
আমি প্রথম পর্বেই বলেছিলাম গল্পটার কিছু অংশ বাস্তব থেকে নেওয়া হবে।এবার আপনাদের বাস্তবের তৃধার কথা বলি।
বাস্তবে যিনি তৃধা আছেন উনি এখনো চাকরি করছেন।ওনার একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে আছে।গল্পের মতো তেজবীন,ফাতেমা বেগম,নন্দিনী বাস্তবে তৃধার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন,সত্যি বলতে গল্পের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি করেছেন।তবে বর্তমানের তেজবীন অনেক ভালো।উনি এখন তৃধাকে অনেক সাহায্য করেন।এমনকি তৃধার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে উনিই অনেকটা ঘরের কাজ করে রাখেন।বাস্তবেও ফাতেমা বেগম আর নেই।সেই সাথে তেজবীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের ঘটনাটাও সত্য।বাস্তবেও নন্দিনীর সাথে এখন ওনাদের কোন সম্পর্ক নেই।তবে বাস্তবে তন্বীর এখনো বিয়ে হয়নি।সে এখনো পড়াশোনা করছে।গল্পের শেষটা যেমন সুখের হয়েছে বর্তমানে বাস্তবের তৃধা উনিও বেশ ভালো আছে।তবে ওনার জীবনে আরো অনেক খারাপ কিছু হয়ে।ভেবেছিলাম সেগুলোও লিখবো কিন্তু লিখা হয়ে উঠেনি।যাইহোক যারা গল্পটা পুরোটা পড়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য।