#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” হাত-পা ভেঙে আমিও আপনাকে বিছানায় ফেলে রাখতে পারি। নেহাত আমি আপনার মতো বেয়া’দব নই, তাই এখনো পর্যন্ত বাড়াবাড়ি কিছু করিনি। আপনি যদি আমার বড় না হতেন না তাহলে সম্পর্কে আপনি আমার কি হন তা দেখতাম না। ঠাটিয়ে দু’টো থা’প্পড় মেরে দিতাম।”
” তৃধা। মুখ সামলে কথা বলো।”
” মুখ আপনি সামলে কথা বলুন। মুখ খুলতে আপনারা আমাকে বাধ্য করছেন। আজ তো মাত্রারিক্ত করে ফেলেছেন আপনি। আপনার কি নুন্যতম লজ্জা নেই, সারাজীবন বাপের বাড়ি পড়ে থাকেন। বিয়ের ছ’বছর হতে চললো, প্রথম থেকেই দেখে আসছি সারাজীবন বাপের বাড়িতে পড়ে আছেন। তাও কিছু বলিনি কিন্তু আপনি কোন অধিকারে আমার সংসার জীবনে হস্তক্ষেপ করেন? কে অধিকার দিয়েছে আপনাকে আমার সংসার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য? খুব তো টাকার গরম দেখান। তো আপনার স্বামীর কি টাকা অভাব পড়েছে যে সারা বছর বাপের বাড়িতে এসে পড়ে থাকেন? নাকি স্বামীর কাছে টাকা চাইলে দেয় না?”
” তৃধা তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছো।”
” আরো করবো৷ আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো। খুব তো বলেন আমি অলক্ষী, আপনাদের সংসারে নজর দিয়েছি। তো বউ করে এনেছেন কেন আমাকে? আমি বা আমার পরিবার কি সেঁধে আপনাদের কাছে এসেছিলাম নাকি আপনার ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম? নিজেরাই তো বউ করে এনেছেন, তাহলে কোন মুখে এই কথা বলেন? ভালো মতোই জানি আমার চাকরি দেখে লোভে আমাকে ঘরে তুলেছিলেন কিন্তু আমাকে তো চিনতে পারেননি আপনারা। আর বাচ্চা দেওয়ার মালিক উপরওয়ালা, ওনার অনুমতি ব্যতিত গাছের পাতাও নেড়েনা। বিয়ের এতো বছর পর আমি মা হতে পেরেছি এতে আপনাদের খুশি হওয়ার কথা কিন্তু আপনারা উল্টো আমাকে ট্রমাতে ফেলে দিয়েছেন। বাচ্চা দেরি হওয়ার পেছনে আমার কোন হাত ছিলোনা, দোষ আপনাদের ছেলেরই ছিলো। কিন্তু সব জেনেও আপনারা আমাকেই দোষ দিয়েছেন।”
” তৃধা চুপ করো।” নিচুস্বরে বললো তেজবীন। তার থেকে ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো তৃধা।
” নিজের সমস্যা কথা শুনে এখন খুব গায়ে লাগছে তাই না? তাহলে ভেবে দেখো দোষ না থেকেও এতোগুলা দিন খোঁটা শুনতে আমার কিরকম লেগেছিলো। আমি প্রথম থেকে চেষ্টা করে গিয়েছি সবার মন জুগিয়ে চলার, যখন যেভাবে পেরেছি সাহায্য করেছি কিন্তু পারিনি আপনাদের মন মতো হতে, একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছি৷ বউ হয়েছি বলে কি আমি মানুষ নই? বউ হওয়ার আগে আমিও একজন মানুষ, কোন রোবট নয় যে সবকিছু আমি সহ্য করতে পারবো। কি করিনি আমি আপনাদের জন্য বলুন? সারাদিন রাত এই সংসারের জন্য শ্রম দিয়ে এসেছি, আপনাদের শরীর খারাপ করলে নিজের সব একপাশে রেখে আপনাদের সেবা করেছি৷ যখন যা চেয়েছেন সার্মথ্য অনুযায়ী দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এমনকি নিজের রক্তের কেউ না হওয়া স্বত্তেও ঝুঁকি নিয়ে আপনার ছোট মেয়ের সম্মান, আপনাদের সম্মান রক্ষা করেছি। মা আপনি নিজে একজন মেয়ে, আপনার নিজেরই দু’টো মেয়ে আছে তাহলে কি করে আপনি আমার মেয়ে হয়েছে বলে এরকম আচরণ করতে পারলেন? আপনার নিজের প্রথম সন্তানই তো মেয়ে, আমার শশুড় কি আপনাকে ছেড়ে দিয়েছো? কই আপনি তো দিব্বি আপনার স্বামীর সাথে ছিলেন, পরবর্তীতে আরো দু’সন্তানের জননী হয়েছেন আপনার থেকে তো এধরণের ব্যবহার আশা করা যায়না।”
” আমার…….” ফাতেমা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই নন্দিনী ওনাকে ইশারায় চুপ করতে বললেন।
” শোন তোমার এসব জ্ঞান আমি শুনতে চাইনা। সোজাভাবে বলছি এসব চাকরি ছেড়ে দাও, আমার ভাইয়ের তোমাকে খাওয়ানোর মতো ক্ষমতা আছে। যা দরকার হবে ওকে বলবে ও এনে দেবে। এখন যাও এসব প্লেটগুলো ধুয়ে রাখো। রান্নাঘরে হয়তো কালকের কিছু রান্না আছে ওগুলো খেয়ে নাও।”
নন্দিনী পেছন ফেরার আগেই আচমকা একটা শব্দ হলো। রাগে তৃধা গিরগির করে কাঁপছে৷ মাটিতে কাঁচের প্লেটের ভাঙা অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
” হায় হায়, তুমি এটা কি করলে? আমার মেয়ে প্রিয় প্লেট ছিলো এটা।”
” কথা আছে না কুকুকের লেজ কখনো সোজা হয়না তেমনি আপনারাও কখনো সোজা হবেন না। কি করে ভাবলেন যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও আমি অন্যের কাছে হাত পাতবো। যেখানে সংসারে টাকা দেওয়ার পরেও আমাকে কোন মূল্য দেওয়া হয়না সেখানে বেকার বসে থাকলে আমার সাথে কি ধরণের ব্যবহার করা হবে তা আমি জানি।”
তেজবীনের সামনে দাঁড়িয়ে তৃধা বললো,
” উপরওয়ালা বৃথাই আমাকে মুখ দিয়েছে। এই কথাবলার শক্তি তোমাকে না দিয়ে অন্যকোন ব্যক্তিকে দিলে অনেক ভালো হতো। কারণ তুমি তো মুখ থাকতেও বোবা। সব দেখছো, শুনছো কিন্তু বোবার মতো মুখ বুঝে আছো। আমি যদি বিয়ে আগে জানতাম তুমি এতোটা কাপুরুষ, মেরুদণ্ডহীন তাহলে বিয়ে তো দূর ওই সময় তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম। বদ্ধ করে বউয়ের উপর অধিকার ফলাফলেই সে পুরুষ হয়ে যায়না। প্রকৃত পুরুষ নারীদের সম্মান করতে জানে।”
” তৃধা চুপ করো।”
” হ্যাঁ এটাই তো বলবে। এতোগুলা বছর তো তাই করে এসেছো, এটা ছাড়া তুমি আর কি বলবে, কাপুরুষ একটা। এতোই যখন মা-বোনের কথায় চলো তাহলে বিয়ে করলে কেন? সারাজীবন মা-বোনের সাথে থাকতে। অনন্ত আমার জীবনটা বেছে যেতো।”
কিছুসময় চুপ থেকে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তৃধা আবারো বললো,
” তেজবীন আমি না এবার হাঁপিয়ে গিয়েছি। প্রতিদিনের এই ঝামেলা আমি আর বইতে পারছিনা। এসব একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।”
” কি বলতে চাইছো তুমি?” ব্রু-কুচকে জিজ্ঞেস করলো তেজবীন।
” আমি আর এই সংসারে থাকতে চাইনা। আমি আজ, এখুনি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাবো।” একদম শান্ত স্বরে জবাব দিলো তৃধা। তার এধরণের কথা শুনে তিথি চমকে গেলো, নন্দিনী এবং ফাতেমা বেগমের মুখে অদ্ভুত এক হাসির দেখা মিললো। তবে অবাক করার বিষয় তেজবীন একদম বিচলিত হলোনা৷ যা দেখে তৃধা আরো অবাক হলো। মানুষ নির্বোধ হয়, মেরুদণ্ডহীন হয় তাই বলে এইধরনের কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া করবো না এমনও হতে পারে তৃধা আসলেই কল্পনা করেনি।
” তুমি ভেবেচিন্তে বলছো তো? জানি তোমার মাথা গরম, তাই বলছি ঘরে যাও। ঘুমাও, কাল সকাল দেখবে তুমি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছো।”
” ভাবী তুমি এসব কি বলছো? হ্যাঁ আমি জানি তোমাদের মধ্যে প্রতিদিন ঝামেলা হয়ে থাকে কিন্তু কোন সংসারে এধরণের ঝামেলা হয়না তুমিই বলো? এটা কোন ছোটখাটো সিদ্ধান্ত নয়। এই সময়ে এসে তুমি চলে গেলে সবাই তোমার উপরই হাসাহাসি করবে। আর কিছু না হোক অন্তত তন্বীর কথা একবার ভাবো। তুমি কি ওকে ওর বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে? তুমি মা হয়ে কি করে মেয়েকে তার বাবার থেকে দূরে সরাতে পারো?”
তিথির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে তৃধা তাচ্ছিল্যেভাবে হেসে বললো,
” আমি তন্বীকে তার বাবা থেকে আলাদা করছিনা। সে তো এখনো পর্যন্ত তার বাবা থেকে কোন আদর-ভালোবাসা পাইনি। এতোগুলা মাস পেরিয়ে গেলো তার বাবা তো একবারো নিজ থেকে তাকে কোলে পর্যন্ত তুলে নেইনি৷ তাহলে কিসের ভিত্তিতে বলছো আমি তন্বীকে তার বাবা থেকে আলাদা করছি? আমি চাইনা আমার মেয়ে এতো অবহেলায় বড় হোক। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি কি করবে তুমি ভেবে দেখো।”
রুমে এসে ব্যাগপত্র গুছিয়ে এই রাতেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তৃধা। তিথি অনেক চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারেনি।
” ভাইয়া তুই কি আসলেই নিজের মধ্যে আছিস? তোর বউ-বাচ্চা তোকে ছেড়ে চলে গেসে, এখন অন্তত একটু চোখ কান খোল।” তেজবীনকে ধাক্কা দিয়ে বললো তিথি।
চলবে………