#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
মেয়েকে এতো রাতে বাচ্চাসহ দেখে থমকে গেলেন শায়লা খাতুন। তৃধার হাতে থাকা ব্যাগটা দেখে চমকে গেলেন তিনি।
” কিরে এতো রাতে আবার এলি যে? জামাই কই? এই মাঝরাতে একা এতোটা পথ পেরিয়ে কেন এলি?”
” মা দয়া করে আর কিছু বলোনা। আমার মাথা অনেক গরম, বিরক্ত করোনা। নাহলে মুখ ফসকে অন্যকথা বলে ফেলবো। অনেক ক্লান্ত আমি, আমাদের একটু বিশ্রাম নিতে দাও। যা বলার কাল সকালে বলো।”
” কিন্তু…. ”
” মা প্লিজ এখন আমাকে একটু শান্তি দাও।”
মেয়ের অসহায় কন্ঠ শুনে শায়লা খাতুনও আর জোর করার সাহস পেলান না। ব্যাগপত্রগুলো সরিয়ে রেখে তিনি ঘুমতে চলে গেলেন।
.
.
তেজবীন এখনো থম মেরে সোফায় বসে আছে। রুম থেকে বেরিয়ে নন্দিনী তার সামনে বসলো।
” শোন ওই মেয়েকে আর এই বাড়িতে তুলবিনা। তেজ দেখিয়ে গিয়েছে তো? এবার সারাজীবন বাপের বাড়িতে পঁচে ম’রুক। আমি তোর দুলাভাইকে বলেছি মেয়ে দেখার জন্য। এবার আমি আমার পছন্দ মতো বিয়ে দেবো। মা তো একটা ভালো মেয়ে খুঁজতে পারেনি তাই এবার আমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে।”
” আপু তুই নিজে একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে এসব কথা বলতে পারিস? তোকে যদি আজ দুলাভাই কোন কারণ ছাড়া ঘরের থেকে বের করে দেই তোর কেমন লাগবে? আমি বুঝতে পারছিনা কেন তুই শুধু শুধু এতো অশান্তি করছিস? আমার কথায় কিছু মনে করিস না কই তোরও তো বিয়ের তিনবছর হতে চললো এখনো পর্যন্ত তো তোর কোন বেবি হয়নি। তুই কেন এই বাড়িতে থেকে মায়ের কান ভাঙাচ্ছিস? কেন শুধু শুধু ভাইয়ের সংসারে আগুণ লাগাচ্ছিস? কি মজা পাচ্ছিস তুই এসব করে? তোর কোন কিছুই আমার সুবিধার লাগছেনা। বন্ধ কর আপু, বন্ধ কর। এতো অন্যায় করিস না যেন কারো দীর্ঘশ্বাস তোর উপর পড়ে। পরে কিন্তু কেঁদেও কুল পাবিনা৷ উপরে কিন্তু একজন আছে ভুলে যাসনা।”
” তিথি তুই রুমে যা। ওই বেয়াদবের সাথে থাকতে থাকতে তোরও কথা বেড়ে গিয়েছে দেখছি। বড়দের সাথে মুখে মুখে কথা বলছিস।”
” মা কারো সাথে থেকে আমার মুখ বেড়ে যাইনি। আমি তোমাদের মতো চোখে কাপড় বেঁধে চলছিনা। ঠিক ভুল বোঝার বয়স হয়েছে আমার। কিন্তু তোমরা সামনে গর্ত দেখেও হেঁটে চলেছো। মা তোমাকে আমি আবারো বলছি কিছু ঠিক হচ্ছে না। বড়ো বিপদে পড়তে চলেছো তোমরা। আপুর কিছুই আমার সুবিধার লাগছেনা।”
কথাগুলো বলে তিথি চলে গেলো। তবে তার কথা শুনে নন্দিনীর মুখে একটা চিন্তার রেখা দেখা গেলো।
.
.
তৃধা ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে শুনে শায়লা খাতুন প্রচুর ক্ষেপে গেলেন। ওনার কথায় তৃধা কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের কাজ করে চলেছে।
” তোকে এতো পড়াশোনা করিয়েছি কি এইদিন দেখার জন্য? শিক্ষিত হয়ে কি তুই নিজেকে বড় কিছু মনে করছিস? শোন এই সমাজে স্বামী ছাড়া চলা চাট্টিখানি কথা নয়। ছেলেদের চাকরি আর মেয়েদের স্বামী ছাড়া এই সমাজে কোন মূল্য নেই। এসেছিস খেয়ে-দেয়ে রাতে চলে যাবি। জামাইয়ের সাথে না হয় আমি কথা বলবো।”
” আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তবেই এখানে এসেছি। আত্মসম্মান আর খোয়াতে চাইনা। যাই হয়ে যাকনা কেন আমি আর ফিরছিনা।”
তৃধা শান্তস্বভাবে উওর দিলেও শায়লা খাতুন খুব রেগে গেলেন।
” যাবি না মানে? তোর যেতেই হবে। বিয়ে হয়ে গিয়েছে মানে ওটাই তোর বাড়ি। মর, বাঁচ যাইহোক না কেন ওখানেই তোর থাকতে হবে। আজকেই তুই তোর মেয়েকে নিয়ে ওবাড়িতে ফিরে যাবি। এমনিতেই বাচ্চা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়, সেখানে তুই আরো তামাশা করে ঝামেলা বাড়াচ্ছিস। তুই কি চাইছিস তোর জন্য খোঁটা শুনে আমরা সারাজীবন বাঁচি? মানুষ জানলে তো আমাদের থুথু দেবে, হাসাহাসি করবে। বলবে খুব তো মেয়েকে শিক্ষিত করেছো এখন বুঝো মজা। এমনিতেই তোর এতো পড়াশোনা, চাকরি করা নিয়ে আশেপাশের মানুষ খোঁটা দেয়, তোমার বাবার জেদের কারণে তোকে চাকরি করতে দিচ্ছি। না হলে আমি তো অর্নাস শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে করিয়ে দিতাম। শোন মা আর ঝামেলা না বাড়িয়ে সব মিটিয়ে নে, জামাইকে ফোন করে বাড়িতে ডাক। আমরা বুঝিয়ে বলবো।”
তৃধা ধপ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখলো। চুপ থাকলেও রাগে তার হাত-পা কাঁপছে।
” আমি কি খুব সমস্যা সৃষ্টি করছি তোমাদের? হলে বলো আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যাবো। কখনোই এখানে আসতাম না, শুধু আমার মেয়েটাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই বলেই অপারগ হয়ে তোমাদের কাছে এসেছি। ভাবতেও অবাক লাগছে তোমরা নিজের মেয়ের কথা চিন্তা না করে মানুষের কথা চিন্তা করবো। আরে এতোগুলা দিন আমি যে ওই বাড়িতে ধুঁকে ধুঁকে মরেছি তখন কি তারা দেখেছে? আমার শরীরে এতোগুলা আঘাতের কালসিঁঁটে যে দাগ ছিলো সেগুলো কি তারা দেখেছে? আমার বিপদে কি তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো? তাহলে কেন আমি তাদের কথা চিন্তা করে ওই অসুস্থ পরিবেশে থাকবো? এমনতো না যে আমি চেষ্টা করিনি মানিয়ে নেওয়ার, সবরকম ভাবে চেষ্টা করেছি কিন্তু তাদের একটাই চিন্তাধারা ” আমি বাড়ির বউ, তাই আমাকে সবসময় তাদের পদতলে থাকতে হবে। তারা রাজার মতো আচরণে করবে আর আমি তাদের চাকরের মতো নিঃশব্দে সব মেনে নেবো।” নিজের আত্মসম্মান বির্সজন দিয়ে শুরুর দিকে তাই করেছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি দেখে গলা তুলেছি। ফলে আমি বেয়াদব, অহংকারী৷ এখন আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল, যা আমি আর পরিবর্তন করছিনা।”
তৃধা খাবার রেখেই উঠে গেলো। শায়লা খাতুন তাকে আবারো বোঝাতে যাবেন কিন্তু তৃধার ভাই তাকে আটকে দিলো।
” মা ওকে একটু একা থাকতে দাও। সবসময় কানের কাছে এক কথা বলে গেলে সে রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু করে বসবে। তখন সমস্যা আরো বেড়ে যাবে।”
ছেলের কথায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে শায়লা খাতুন এখন আর তৃধার কাছে গেলেন না।
.
.
” দুলাভাই আপনি আপুকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যান।” বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো তিথি।
” কেন আমার ছোট শালিকা? আজ হঠাৎ এধরণের কথা বলছো যে?” মজার স্বরেই বললো রুদ্র।
” দেখুন দুলাভাই আমি মজা করছিনা। সিরিয়াসলি বলছি আপুকে এখন নিয়ে যান। আপনিও কি ধরণের স্বামী বলুন তো? বউ সারাদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকে, আপনি খোঁজখবরও নেন না। যখনই আপনার কথা জিজ্ঞেস করি প্রায় সময় বলে আপনি নাকি বাড়িতে নেই, তাই তার ও বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনা। দুলাভাই আপনি কি এমন কাজ করেন যে মাসের অর্ধেক সময় আপনার খোঁজই পাওয়া যায়না? সত্যি বলছি আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর আচরণ না অনেকটা অদ্ভুত, কিরকম গা-ছাড়া ভাব আপনাদের।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কিছুদিনের মধ্যে তোমার বোনকে নিয়ে আসবো।”
তিথির ফোন কেটে দিয়ে রুদ্র তৎক্ষনাৎ নন্দিনীকে ফোন দিয়ে বকা দিতে শুরু করে। তিথি তার নামে রুদ্রকে অভিযোগ করেছে শুনে নন্দিনী বেশ খেঁপে গেলো।
তিথিকে তার রুম থেকে টেনে ড্রইং রুমে ফাতেমা বেগমের সামনে নিয়ে এলো।
” মা তোমার মেয়ের কিন্তু অনেক সাহস বেড়ে গিয়েছে।”
” ও আবার কি করেছে?”
” তোমার আদরের মেয়ে রুদ্রকে ফোন করে আমার নামে নালিশ করেছে। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে।”
ফাতেমা বেগম উঠে ঠাস করে তিথির গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো। আচমকা মায়ের এমন আচরণে তিথি থমকে গেলো।
” মা তুমি আমাকে এভাবে থা’প্পড় মারলে!”
” চুপ একদম। নন্দিনীর বিরুদ্ধে যাবি তো আরো খারাপ হবো। ও এখানে থাকবে, খাবে তোর কি? তোর ইনকাম খাচ্ছে? দেখ তুই আমার নিজের পেটে সন্তান তাই তোকে বোঝাচ্ছি। চুপচাপ নিজের মতো থাক না হলে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দেবো। এবার সং এর মতো না দাঁড়িয়ে বিদেয় হ।”
তিথি কান্না করতে করতে রুমে চলে গেলো। সে কখনো আশা করেনি তার মা এতোটা অতিরিক্ত করবে। আড়ালে নন্দিনী তৃপ্তির হাসি হাসলো।
চলবে…….