#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ২১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
দরজা খুলতেই আচমকা থা’প্পড় পড়লো নন্দিনীর গালে। হতভম্ব হয়ে গেলো সে। দরজার ওপারে তৃধাকে দেখে সে যেমন অবাক হলো তেমনি থা’প্পড় দেওয়ার কারণে রেগে আগুণ।
” শা*লী তুই আমাকে থা’প্পড় মেরেছিস। তোর এতো বড় সাহস আমার গায়ের হাত তুলেছিস তুই? আজ তো তোকে আমি খু’ন করবো।” রেগে দিক বেদিক ভুলে চিৎকার করে উঠলো নন্দিনী। তার চিৎকার শুনে ফাতেমা বেগম ভেতর থেকে কি হয়েছে বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন। তৃধা চুপচাপ রাগে গিরগির করছে।
” এই তুই কোন সাহসে আমার মেয়েকে মেরেছিস? এতোদিন পর এসে আবার কোন নাটক জুড়ে দিয়েছিস তুই?”
তৃধা হাতে থাকা কিছু একটা দু’জনের মুখে ছুঁড়ে মারলো। মা-মেয়ে নিচে থাকিয়ে চমকে গিয়ে একদম অপরজনের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। এতোক্ষণ চেহারায় যে তেজ ছিলো তা নিমেষেই উবে গিয়ে একটা চোরাভাব দেখা গেলো। এখনো রাগে কাঁপছে তৃধা। বুক ধকধক করছে তার। এখনো কানে বাজে চলেছে তার ভাইয়ের বলা কথাগুলো।
” তোদের রুম থেকে এই তাবিজটা পেলাম, বালিশের কভারের ভিতরে ছিলো। দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম সুবিধা নয় কারণ আমরা কেউই এধরনের কিছু ব্যবহার করিনা। তাই আমি সেদিনই একজন তা’ন্ত্রিক এর কাছে নিয়ে যায়।”
ভাইয়ের কথা শুনে তৃধার বুক ধক করে উঠলো।
” কি বলেছেন তিনি?”
” তন্বীর উপর কা’লোজা’দু টাইপ কিছু করা হয়েছে।”
ভাইয়ের কথা শুনে তৃধা আরেকটু হলেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতো।
” তুমি এসব কি বলছো ভাই!”
” হুম। এটার কারণেই তন্বী কান্না করছে। ছোট বাচ্চা, ওরা অ’শুভ শক্তি দিয়ে ওকে ভয় দেখাচ্ছে। এছাড়াও….”
” এছাড়াও কি ভাই? আমার তন্বীর বড় কিছু হবে না তো?”
” এই তাবিজটার কারণে তন্বী মা’রাও যেতে পারে।”
ভয়ে এবার তৃধা কান্না করে দিলো।
” তুমি এসব কি বলছো ভাই? আমার তন্বী সাথে এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই টের পেলাম না!”
” কান্না করিস না বোন। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে এখন আগে আমাদের এই সব থেকে তন্বীকে বের করতে হবে। বাকিটা পরে দেখা যাবে।”
তৃধা আর একমুহূর্তে দেরি না করে ভাইয়ের সাথে সেই তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে সব নিয়ম মেনে তন্বীকে সেই কা’লোজাদুর প্রভাব থেকে বের করতে সক্ষম হলো। তবে তা সহজ ছিলোনা, বেশ কয়েকদিন তাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিলো।
” কি ভেবেছিলেন আপনারা? এই তাবিজ দিয়ে জাদু-টোনা করে আমার মেয়ের ক্ষ’তি করবেন?”
তৃধা মুখে তাবিজের কথা শুনে তাদের আর বুঝতে বাকি নেই তৃধা সব জেনে গিয়েছে। তাও না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,
” তাবিজ! কোন তাবিজের কথা বলছো তুমি?”
” নাটক করে লাভ নেই। আপনারা সেদিন কেন আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন তা এবার বুঝতে পারছি। আমরাই ভুল, আমার সেদিন ভালো করে ঘরদোর দেখার দরকার ছিলো। কিন্তু যাই করুন না কেন আমার মেয়ের আমি কোন ক্ষতি হতে দেবোনা। লজ্জা থাকলে এই থা’প্পড়টার কথা মনে করে নিজেকে সুদরে নেবেন। ভাবেন না আমি ছেড়ে দিচ্ছি, আপনাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে আবার আসবো আমি।”
.
.
কিভাবে নন্দিনীকে শাস্তি দেওয়া যায় তাই ভাবছে তৃধা। তৃধা আর তার ভাই ছাড়া বাড়ির কেউ এখনো এই বিষয় সম্পর্কে জানেনা। এরই মাঝে একদিন তিথি ফোন করে কান্না করতে লাগলো যা শুনে তৃধা ঘাবড়ে গেলো।
” কি হয়েছে তিথি? কান্না বন্ধ করে আমাকে বলো।”
” ভাই ভাইয়াকে বাঁচাও।”
” তেজবীনের কি হয়েছে? তুমি কান্না বন্ধ করে আমাকে কি হয়েছে তা খুলে বলো।”
” আমি রুমে এসে দেখি ভাইয়া মাথা ঘুরে পড়ে আছে, নাকে রক্তও লেগে আছে। বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার খুব ভয় লাগছে ভাবী।”
তিথির কথা শুনে তৃধা নিজেই ঘাবড়ে গেলো। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে তিথিকে বললো আশেপাশের মানুষের সাহায্যে তেজবীনকে হসপিটালে নিয়ে যেতে সে আসছে। তিথিও তার কথা মতো তেজবীনকে হসপিটালে নিয়ে এলো।
তেজবীনের জ্ঞান ফিরেছে কিছু সময় আগে। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে তৃধা।
” নাক দিয়ে রক্ত কখন থেকে পড়ছে আপনার?”
” দু’মাস।” তৃধার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললো তেজবীন৷ তার কথা শুনে সূক্ষ্ণচোখে তার দিকে তাকালো তৃধা।
” এর আগে কখনো মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন?”
” না তবে প্রচন্ড মাথা ব্যথা হতো। মনে হতো কেউ শক্ত কিছু দিয়ে ভারী দিচ্ছে।”
ভাইয়ের কথা শুনে তিথি বিচলিত হয়ে পড়লো তবে তৃধা ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
” কোন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?”
” না।”
” আপনাদের এতোটা কেয়ারলেস হওয়া উচিত হয়নি। এগুলো মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি, রিপোর্ট এলে দেখিয়ে যাবেন।”
টেস্ট করানোর পর তাদের দু’জনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে তৃধা বাড়িতে ফিরে এলো। তিথি অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারেনি।
.
.
টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিলো তৃধা। ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করবে সেই মূহুর্তে তিথি তাকে ফোন করলো।
” তিথি আমি রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছি। বেরিয়ে তোমাকে জানাচ্ছি।”
” ভাবী তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।”
কিন্তু তার জরুরি কথা তৃধার শোনা হলোনা। পরের রোগীদের দেরি হচ্ছে বিদায় সে ফোন কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
তেজবীনের লক্ষ্মণগুলো দেখে তৃধা ভেবেছিলো হয়তো জটিল কোন রোগ হয়েছে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার জানালো তেজবীন কোন সমস্যাই নেই, সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
” রিপোর্ট ঠিক আছে তো ডাক্তার? আপনার সামনেই তার রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছে, সে নিজেই তার সমস্যার কথা বলেছে। এতো কিছুর পরেও সে সুস্থ! তাহলে এগুলো কিসের লক্ষ্মণ? কোন রিপোর্ট ভুল হয়নি তো?”
” ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই তবে আপনার সন্দেহ থাকলে অন্য হসপিটাল থেকে আবারো করিয়ে আনতে পারেন।”
বারবার তিথির ফোন আসাতে তৃধা কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো।
” তোমার ভাই…..”
” ভাবী আপু ভাইয়ার আবার বিয়ে দিচ্ছে। ভাইয়াও কিছু বলছেনা। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
” আবার বিয়ে দিচ্ছে মানে? আমাদের তো এখনো ডির্ভোস হয়নি আর না আমরা এধরনের কোন কার্যক্রম শুরু করেছি।”
” আমি বুঝতে পারছিনা কিছু, তুমি তাড়াতাড়ি এসো। কিছুক্ষণ পরেই নাকি বিয়ে, আমি লুকিয়ে তোমাকে ফোন দিয়েছি।”
ফোন কেটে দিয়ে তৃধা কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ারে বসে রইলো। আচমকাই হিসেব মিলে গেলো তার। সে দ্রুত হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিতে রওনা হলো।
.
.
কাজী সাহেবকে বারবার তাড়া দিচ্ছে নন্দিনী। হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে সবার আড়ালে বিয়ে দিচ্ছে সে। তেজবীন চুপচাপ বসে আছে, যেন সে একটা পুতুল। কাজী সাহেব “কবুল” বলতে বলার সাথে সাথে তেজবীন তোতাপাখির মতে তা বলে দিয়েছে। দেরি করছে কনে, যা দেখে নন্দিনী ভীষণ বিরক্ত।
” এই মেয়ে কান্নাকাটি পরে করো, এখন তাড়াতাড়ি কবুল বলো।”
” আরে এতো তাড়াহুড়ো কিসের? আগে আমরা একটু হিসেবটা মিটিয়ে নি, তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে।”
আচমকা পুলিশকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো সবাই।
রুদ্র এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনারা এখানে কেন এসেছেন? এখানে বিয়ের মতো একটা পবিত্র কাজ চলছে, যদি কোন কিছু বলার তাকে তো পড়ে আসবে।”
রুদ্রের এই ভাব পুলিশের মোটেও পছন্দ হয়নি। কোন ফর্মালিটি না দেখিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন তারা। বসা থেকে কলার টেনে দাঁড় করানো হলো তেজবীনকে।
” বউ, বাচ্চা রেখে আবারো বিয়ে করা শখ হয়েছে না খুব? তোর আবারো বিয়ে করা শখ আমি মোটাচ্ছি। ঘরের বউকে নি’র্যা’তন করে বাচ্চাসহ বের করে দিয়ে এখন আবার আরেকটা মেয়ের জীবন বরবাদ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস। সবগুলোকে আজ জেলেরঘানি টানাবো।”
মেয়ে এবং তার দু-তিন কাছের মানুষ ছাড়া সবাই পালিয়ে গিয়েছে। পুলিশ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো তারা জানতো তেজবীন আগে থেকে বিবাহিত কিন্তু তার যে ডির্ভোস হয়নি এটা সে জানতো না। তবে তার পরিবার নাকি জানতো, তবুও তারা লোভে পড়ে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছিলো। পুলিশ তাদেরকেও ধরে নিয়ে যেতে চাইলে মেয়েটার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো।
তেজবীনকে নিয়ে যেতে চাইলে নন্দিনী এবং ফাতেমা বেগম বাঁধা দিলো।
” আমার ভাইকে ছেড়ে দিন। ওই বেয়াদব মেয়ে পুলিশকে মিথ্যা কথা বলেছে। আমার ভাই কাউকে নি’র্যা’তন করেনি। বরং ওই বে’শ্যা, ঘরের জনকে দিয়ে হয়না তার, তাই তো চাকরির নাম করে ছেলেদের সাথে ঘুরতো। এসব জানতে পেরে আমার ভাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার ভাই ভালো তাই ওই মেয়ের নোংরা কাজ কেউ জানার আগেই তাকে নিরবে বিদেয় দিয়েছে।”
নন্দিনীকে নিরদ্বিধায় এতোবড় মিথ্যা করতে বলতে দেখে তিথি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। সে প্রতিবাদ করতে যাবে তার আগেই ফাতেমা বেগম তাকে টেনে ঘরে বন্ধ করে রাখলো।
” কিন্তু ওদের তো এখনো ডির্ভোস হয়নি।”
” হয়নি, হয়ে যাবে। এটা আমাদের পারিবারিক ব্যপার এতে আপনাদের মাথা না দিলেও চলবে৷ কত লাগবে বলুন, আমরা তাই দিতে রাজি। নিজের ভাগটা নিয়ে বেরিয়ে যান, নয়তো আপনাকে আর এই শহরে দেখা যাবেনা।” বেশ ভাব নিয়ে বললো রুদ্র।
” প্রস্তাব দিচ্ছেন নাকি হুমকি?” হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ।
” আপনার যেটা মনে হয়। আপনার পাওয়ার থেকেও আমার হাত অনেক লম্বা।”
” তাই নাকি? তাহলে দেখি তো আপনার গাল কতটা শক্ত।” বলেই সজোড়ে রুদ্রকে থা’প্পড় মেরে দিলেন তিনি। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো রুদ্র। অবস্থা বেগতিক দেখে নন্দিনী তাকে উঠানোর বদলে আস্তে করে সরে যেতে চেয়েও পারলোনা। পুলিশের লোক রুদ্রের কলার ধরে তাকে দাঁড় করালো।
” তোর শা’লাবাবু নিজের বউয়ের সাথে বনিবনা করে, হাতে পায়ে ধরে বেরিয়ে আসতে পারলেও তুই এই জন্মে আর জেল থেকে ছাড়া পাবিনা। একসাথে যে দু’টোকে ধরতে পারবো তা কখনোই ভাবতে পারিনি।”
” কিসব বলছেন আপনি? আমি কি করেছি? আমি আমার বউকে কোন নির্যা’তন করিনি আর না দ্বিতীয় বিয়ে করেছি।ছাড়ুন আমাকে, আমি নির্দোষ।”
” ওরে আমার ছোটখোকা। তুই নির্দোষ হলে নকল ওষুধ, ড্রাগস কি তোর বাপে বিক্রি করতো? কোন চাকরি না করেও কি করে একবছরের মধ্যে নতুন দু’টো বিল্ডিং বানালি?”
রুদ্র বুঝতে পেরে গিয়েছে সে ধরা পড়ে গিয়েছে তাও সে পুলিশকে লোভ দেখাতে লাগলো।
” এসব লোভ দেখিয়ে কোন কাজ নেই। উপর থেকে বলা হয়েছে তোদের সব কথাটাকে জেলের ভেতরে ঢুকাতে। এখন আমি যদি তোদের সাথে মিলে যাই আমার নিজেরই ক্ষ’তি৷ যদি ছাড়া পেয়ে যাস তবে নেক্সট টাইম অফারটা দিস।”
সবাইকে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুসময় পর তৃধা এসে তিথিকে বের করে আনলো।
” ভাবী পুলিশ এসে সবাইকে নিয়ে গিয়েছে। তুমি প্লিজ কিছু করো।”
” ওনাদের আমিই পাঠিয়েছি।”
” তুমি!”
” হুম, আমার ভাবীর ভাই পুলিশে আছেন। ওনার মাধ্যমেই এখানের থানায় যোগাযোগ করেছি।”
” কিন্তু পুলিশই কেন? আমরা তো পারিবারিকভাবে সমাধান করতে পারতাম।”
” তুমি যা ভাবছো বিষয়টা অতোটাও সহজ নয় তিথি। জল অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে, সুতো অনেক জটিলভাবে পেঁচিয়ে গিয়েছে।”
” বুঝতে পারেনি ভাবী।”
তেজবীনের রির্পোটগুলো তিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে তৃধা তাকে তন্বীর ব্যপারে বললো।
” তোমার মা এবং বোন এতোদিন তেজবীন একপ্রকাশ ব’শ করে রেখেছিলো। কেন রেখেছিলো, কি কারণে রেখেছিলো তা আমি জানিনা। তবে তাদের কারণেই তেজবীনের মাঝে এই পরিবর্তন। পুলিশকে যদি আমি এসব বলতাম তারা বিশ্বাস করতো না, আর না তাদের তেমন কোন শাস্তি হতো। নারী নি’র্যাতন কেস অনেক সেন্সেটিভ, তাই আমি এই কেসটাই করেছি।”
” কিন্তু এটাই কেন ভাবী? এর কারণে তো ভাইয়ার সারাজীবন জেলও হতে পারে।”
” আমি কি মিথ্যা কোন কেস করেছি তুমিই বলো? এতোবছর তোমরা আমার উপর যা করেছো তা কি নারী নির্যা’তনের মধ্যে পড়ে না? ওরা আরো একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিলো। আমি কি করে তা হতে দিয়? আমার সিদ্ধান্তে আমার কোন আফসোস নেই।”
” এসবের মাঝে দুলাভাইকে কেন নিয়ে গেলো? দুলাভাইতো তোমার সাথে কিছু করেনি।”
হালকা হেসে তৃধা বললো,
” কে বলেছে কিছু করেনি? তার ওই নোংরা চোখের দৃষ্টির কথা ভাবলে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠে। তবে তার বিরুদ্ধে আমি কোন কেস করিনি, তিনি তো নিজের মহৎ কাজের জন্য এমনিতেই জেলে যেতেন। অসৎপথে টাকা রোজগার করে বড়লোক হতে চেয়েছিলো তারই ফল এটা। যাইহোক সাবধানে থেকে, বলা তো যাই না তোমার উপরও জাদু টোনা করে রেখেছে তারা।”
” ভাবী ভাইয়া কি ঠিক হবেনা? এই কা’লো জা’দু থেকে কি বের হওয়া যায় না?”
” কাজটা সহজ নয় তবে আমি তান্ত্রিককে বলে এসেছি। উনি ওনার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবেন বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।”
তৃধা বেরিয়ে গেলো, তিথির কানে এখনো তৃধার বলার কথা গুলো বেজে চলেছে। ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে সে।
.
.
সময় নিজের গতি চলছে। তন্বীর উপর থেকে যত সহজে এসবের প্রভাব কাটানো গিয়েছে তেজবীনের উপর থেকে এখনো পুরোপুরি কাটানো যায়নি। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তার উপর এসবের প্রভাব ছিলো। এরমাঝে বেরিয়ে এসেছে আরেক ভয়ানক তথ্য। শুধু তন্বী আর তেজবীন নয় ফাতেমা বেগমকেও ব’শ করা রাখা হয়েছিলো যা আর কেউ নয় বরং নন্দিনীই করেছে। মায়ের রুমে তিথি সেই একই ধাঁচের কালো সুতো, তাবিজ এসব পেয়েছে। দেরি না করে সে তৃধার কাছে গিয়ে তার সাহায্য চাই। মনের মধ্যে একটা ক্ষো’ভ থাকলেও মানুষ হিসেবে তৃধা ওনাকেও সাহায্য করেছে৷
রুদ্রের ছাড়া পাওয়ার কোন আশা নেই, কোন শক্ত প্রমাণ না থাকায় নন্দিনী এবং ফাতেমা বেগম অনেকের হাত ধরে বেরিয়ে আসতে পারলেও তেজবীন আপাতত জামিনে বাইরে আছে তবে কেস চলছে, পুলিশের নজর এখন তাদের উপর। কা’লোজাদুর প্রভাব কাটানোর চেষ্টার ফলে তেজবীন আগে থেকেও অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ফাতেমা বেগম তো বলতে গেলে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন।
নন্দিনীকে আবারো এই বাড়িতে দেখে তিথি তো রেগে আগুণ। দিক বেদিক না দেখি সে নন্দিনী সজোড়ে ধাক্কা দিলো।
” লজ্জা নেই তোমার? এতোবড় কান্ড করেও কি করে আবার এই বাড়িতে ফিরে এসেছো? আমার তো ইচ্ছে করে তোমাকে খু’ন করতে।”
” তিথি আমার কথা শোন।”
” চুপ একদম। কেমন মেয়ে তুমি? কেমন বোন তুমি? আরে তুমি তো মানুষ হিসেবেও কলঙ্ক। কি করে পারলে নিজের ভাইয়ের সাথে এধরণের বিপদজনক কাজ করতে? আমার ভাইটা ম’রা’র মুখ থেকে ফিরে এসেছে। তুমি এতোটা পাষাণ যে নিজের মাকে পর্যন্ত ছাড়োনি! নিজের রক্তের সাথে তুমি কি করে এধরণের জ’ঘন্য কাজ করতে পারলে? নিজের সাথে আমার মা’কে টাও এই পাপের ভাগিদার করেছো তুমি। কি কারণে এধরণের নিম্নমানের কাজ করেছো তুমি? শুধু মাত্র ভাবীকে তুমি পছন্দ করোনা এই কারণে?”
তিথির কথা শুনে হাসতে লাগলো নন্দিনী।
” পাগল মেয়ে, এই দু’টাকার মেয়ের জন্য আমি এতোবড় ঝুঁকি নেবো কি করে ভাবলি? আচ্ছা যা সব যখন জেনেই গিয়েছিস এটাও বলে দি। কারণ এইসবের জন্য আইনি কোন শাস্তি নেই আর না কোন প্রমাণ আছে। তোরা কেউ আমার নিজের রক্ত না। হ্যাঁ আমাদের বাবা এক কিন্তু মা ভিন্ন। তোরা তিনজনের কেউই আমার নিজের না।”
নন্দিনীর কথা শুনে থমকে গেলো তিথি। পড়ে যেতে নিলে দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বললো,
” তুমি মিথ্যা বলছো তাই না আপু?”
” ধুর এতোসব কিছুর পরেও তোর মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি? সত্যি বলছি আমার ছোট বোন, তোরা কেউ আমার না। আমি তোদের সৎ বোন, তোর মায়ের কারণে আমার মা আ’ত্মহ’ত্যা করেছিলো। আমার মা বেঁচে থাকা স্বত্তেও তোর মা লোভে পড়ে আমার বাবাকে নিজের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে। সেই দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মা বি’ষ খেয়েছিলো। বাবা বলেছিলো আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসবে কিন্তু তোর মা রাখতে দেয়নি। অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সবাইকে বুঝিয়েছিলো তিনি মা ম’রা মেয়েটাকে আদরযত্নে মানুষ করবে। কিন্তু সবার আড়ালে তোদের মা আমার সাথে অমানুষের মতো ব্যবহার করতো। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে সেই ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারিনি৷ তখনই আমার মনে প্রতিশোধের বীজ তৈরি হতে শুরু করেছিলো। ভেবেছিলাম এটাই হয়তো মেয়েদের জীবন, তাই চুপচাপ সব সহ্য করে গিয়েছি। কিন্তু আমার প্রতিশোধের চারায় পানি দিয়ে তাকে গাছে পরিনতি করেছিলো আমার বাবা। সে তার সব সম্পত্তি তেজবীনের নামে করে দিয়েছে, অবশ্য এতে তোদের মায়ের হাতই বেশি। সেদিন থেকেই আমি ঠিক করি তোদের আমি শান্তিতে থাকতে দেবোনা। এসবের মাঝে তোকে আমি জড়াতে চাইনি কারণ তুই সবসময় আমার নেওটা ছিলি, ছোট মানুষ তুই। তবে এবার আর ছোট মানুষ বলে ক্ষমা করবো না। আমার রাস্তায় এলে আমি তোকেও সরিয়ে দিতে পারি আমার ছোট বোন।”
নন্দিনীর স্পর্শে তিথি কেঁপে উঠলো। এতো কম সময়ে এতো কিছু তার ছোট মস্তিষ্কে নিতে পারছেনা। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে সে।
.
.
মাঝে প্রায় একবছরের মতো সময় পেরিয়ে গিয়েছে। চট্টগ্রাম ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে ভাবীর কাছে কক্সবাজার চলে এসেছে তৃধা। তন্বী আরেকটু বড় হওয়া পর্যন্ত সে এখানে থাকবে তারপর সবার থেকে আরো দূরে চলে যাবে।
রুদ্র এখনো জেলেই আছে, নন্দিনী অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও এখনো তাকে মুক্ত করতে পারেনি। ফাতেমা বেগম এখনো শয্যাশায়ী, তেজবীন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ আছে তবে তার উপর কেসের দাগ এখনো মেটেনি, এখনো সে জামিনেই বাইরে আছে। তৃধাকে ফিরে আনতে চেয়েছে সে বহুবার কিন্তু তৃধা ফিরে যায়নি। তার একটাই কথা,
” সজ্ঞানে হোক কিংবা অন্যের প্ররোচনায়, তেজবীন যা করেছে তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। সে করেছে এটা তো অস্বীকার করা যাবেনা।”
এই টানাপোড়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তিথির। কোন দোষ না করেও ভুগছে সে। নন্দিনীর সেইদিনের কথাগুলো তার উপর খুব বাজে প্রভাব ফেলে, ফলে সে মানসিকভাবে অনেকটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছেনা সে। অবস্থা বেগতিক দেখে তার মামারা তাকে নিজেদের সাথে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছে। ইতিমধ্যেই পরিবারের সবাই নন্দিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। যেন সে আরো অসুস্থ হয়ে না পড়ে তাই ফাতেমা বেগম, তেজবীন কিংবা নন্দিনী কাউকেই তার সাথে দেখা করতে দিচ্ছেন না তারা।
মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো তৃধা। পুরো আকাশ কালো, খালি আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বললো,
” সবচেয়ে সুন্দর ঋতু হচ্ছে বসন্ত। বসন্তে গাছে গাছে হরেক রকমের ফুল ফোঁটে, নতুন পাতা গজাই, পাখিরা গান করে৷ প্রকৃতি নতুন এক সাজে সজ্জিত হয়। কিন্তু বসন্তের এই সুন্দর মুহূর্তের আগে আসে রুক্ষ শীত। শীতের আগমনে গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে, প্রকৃতিতে মন খারাপের একটা ছোঁয়া লেগে যায়। বসন্ত সবার জীবনে আসেনা, এই যে আমার জীবনে এখন সেই রুক্ষ শুষ্ক শীতের ছোঁয়া লেগেছে। জীবন থেকে মুছে গিয়েছে ফুলের মতো রঙিন সব অধ্যায়, ঝড়ে গিয়েছে সব সুন্দর সম্পর্ক। ফুল-পাতা বিহিন হয়ে গিয়েছে জীবন। কিন্তু শীতের পর আসে বসন্ত। আমিও অপেক্ষা করবো আমার জীবনে বসন্তের আগমনের। অপেক্ষা করবো সেই রঙিন ফুলপাতা দিয়ে সাজানো বসন্তের একদিনের জন্য সেদিন আমি আবার হাসতে পারবো, আবারো রঙিন সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারবো।”
” প্রিয় বসন্ত,
তোমার প্রতিক্ষায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় রইলো এক অভাগী নারী।”
~ তৃধা।
___________________ সমাপ্ত ____________________
( বসন্তের একদিন দু’টো সিজনই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া৷ দু’টো সিজনের প্রায় চরিত্র একই হলেও ঘটনা এবং সময় ভিন্ন। সিজন ১ এ আমি বলেছিলাম আমি মাঝে অনেকখানি ঘটনা উল্লেখ করিনি। সেই না বলা ঘটনাগুলোর কিছু অংশ নিয়েই মূলত সিজন ২ লেখা। তবে আলাদা ভাবে পড়লেও দু’টো সিজনের কাহিনীই আপনারা বুঝতে পারবেন। “বসন্তের একদিন” দু’টো সিজনই লেখা হয়েছে ” তৃধা” নামক একজন মানবীর জীবন নিয়ে। এই গল্পের এক এবং একমাত্র মূল চরিত্র হলো তৃধা, যা অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেননি। এই গল্পে কোন নায়ক নেই, কোন অন্যান্য কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। ” বসন্তের একদিন” গল্পটা তৃধার গল্প, সেই সময়ের বেশিরভাগ নারীর গল্প।
সিজন ২ এর অনেক ঘটনায় গল্পের স্বার্থে আমি পরিবর্তন এনেছি। তবে একটা কথা আপনাদের জানার স্বার্থে বলা তন্বী এবং তেজবীনের উপর যা করা হয়েছে তা একদম সত্যি, এই বিষয়ে কোনরূপ পরিবর্তন আমি আনিনি তবে নন্দিনীর বলা কারণটা বাস্তবে কিছুটা ভিন্ন। যাইহোক সিজন ১ এবং সিজন ২ এর সমাপ্তি একদম আলাদা, দু’টো সিজনের সমাপ্তি মিলাতে গেলে আপনারা ঘটনা মিলাতে পারবেন না। গল্পটা যারা শেষ পর্যন্ত পড়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। কেমন লেগেছে জানাবেন আশা করি, সেইসাথে ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিলে পরবর্তীতে তা খেয়াল রাখবো। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। ঈদ মোবারক।)