#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৪
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” আমি অ’ভদ্র, অ’শি’ক্ষিত! বাহ্! তাহলে আপনি কতটা শিক্ষিত মিসেস নন্দিনী?” নন্দিনীর দিকে হালকা ঝুঁকে বললো রুদ্র। বিরক্তি নিয়ে বিরবির করে তাকে একটা কু’রুচি পূর্ণ কথা বলতে ভুললো না নন্দিনী।
” এখানে কেন এসেছো? তোমাকে না বলেছি এখন আসবে না। আমি এখন ও বাড়ি ফিরে যাবোনা।”
” তোমাকে আমি যেতে বলেছি নাকি? সত্যি বলতে তুমি না থাকলেই আমি খুশী থাকি। আমি তো আমার শশুড়বাড়িতে জামাই আদর খেতে এসেছি।”
ঘরের ভেতরে ঢুকে এদিক সেদিক তাকিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। শার্টের উপরে কয়েকটা বোতাম খুলে বললো,
” আজ বাড়ি এতো নিরব কেন? অন্যসময় হলে তো এতোটা নিরব থাকতো না। বাড়িতে নতুন অতিথি এসেছে, এই সময় বাড়ি থাকবে ব্যস্ততা পূর্ণ। কই ভেবেছিলাম এসে দেখবো চারিদিকে মানুষের ভিতর, নানান পদের বাহারি খাবার কিন্তু এসে দেখি তো উল্টো।”
” কোন খুশিতে এসব করবো? আমাদের কপালে কি এতো সুখ আছে যে একটু আনন্দ করবো।”
” তাও বটে। আচ্ছা তৃধা সাহেবা কোথায়? ওনাকে দেখছি না যে? শুনলাম হসপিটাল থেকে নাকি রিলিজ করে দিয়েছে। কোথায় এখন? ঘুমাচ্ছেন নাকি?”
” শোন রুদ্র তোমার এসব ছ্যাঁ’চড়ামি না বন্ধ করো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে শরীরে একটাও হাড়গোড় রাখবোনা। নিজের বউয়ের খবর নেবে সে দিকে ধ্যান নেই, সে শা’লার বউয়ের খোঁজ নিচ্ছে। যত্তসব ঢং।”
রুদ্রকে একা রেখেই ঘরে চলে গেলো নন্দিনী। তার কথা রুদ্র একটুও গায়ে মাখলোনা। কিছুক্ষণ সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে থেকে পকেট থেকে ফোন বের করে সে অবস্থাতেই চালাতে লাগলো।
.
.
বাচ্চাকে দেখার জন্য তৃধাদের বাড়িতে এখন হরহামেশাই নানান লোকজনের ভীড় জমে থাকে। তেমনি আজকেও তৃধার দূরসম্পর্কের কয়েকজন চাচী তাদের দেখতে এসেছে৷ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বেশ কিছুসময় পর্যবেক্ষণ করলেন।
” শুনলাম বাচ্চা নিয়ে তোর শাশুড়ী নাকি হসপিটালে সবার সামনে ঝামেলা করেছে?”
চাচীর কথা শুনে তৃধা কিছুটা অবাক হলো। কারণ এই খবর যে এতো দূরপর্যন্ত চলে গিয়েছে সেটা তার ধারণা ছিলোনা। বাইরের মানুষের মুখে এধরণের কথা শুনে তৃধা কিছু বিব্রত হয়ে পরলো। যা দেখে মনে হয় চাচীরা বেশ মজাই পেয়েছেন। তাই তো তাকে আরেকটু বেশি বিব্রত করার চেষ্টায় বললেন,
” তা মেয়েকে কি মেনে নিয়েছে নাকি এখনো ঝা’মেলা চলছে?”
” জামাইকে তো দেখলাম না। আসেনি না? জামাই মেয়েকে দেখেছে?”
” তোরা কবে শশুর বাড়িতে ফিরে যাবি? আধো ফিরে যাওয়ার চিন্তা আছে নাকি…? শোন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যা। ওসব তো একটু আকটু হয়। আমাদের বেলাও এরকম কত হয়েছে। কই আমরা কি ছেঁড়েছুঁড়ে চলে এসেছি? আমাদের সময় তো বাপের বাড়ির চেহারা দেখতাম ৪/৫ বছর পর পর, তাও ১/২ দিনের জন্য। এখন তো তোরা মাসে মাসেই বাপের বাড়িতে এসে থেকে যাস। বাচ্চা হয়েছে না দেখবি সব সমস্যা নিমেষেই মিটে গিয়েছে।”
চাচীদের কথা শুনে তৃধা হালকা হাসলো। ঘুমন্ত বাচ্চাকে আস্তে করে বিছানায় শুয়ে দিয়ে আরাম করে বসলো।
” আমাদের নিয়ে আপনাদের এতো চিন্তা দেখে ভালো লাগলো চাচী। কিন্তু কি বলুন তো আমি না কারো ফ্রী উপদেশ তেমন একটা নেই না। নিজের বিবেক যা সঠিক বলে তাই করি। আর এটা তো আমারই বাড়ি, আমি তো অতিথি নয় যে দু-তিন দিন থাকলে তাদের জায়গা কম পড়ে যাবে। শশুড়বাড়িতে তো থাকলাম এবার না হয় একটু বাপের বাড়িতেও থাকি। আমি হচ্ছি নতুন মা। আমি বাপের বাড়ি, শশুর বাড়ি, নানার বাড়ি ঘুরবো না তো কে ঘুরবে আপনিই বলুন। ভাবছি আপনাদের বাড়িতেও দু’দিন দু’দিন ভাগ করে একটু থেকে আসবো।”
” আচ্ছা যাস, কে বারণ করেছে? তবে জামাইকে ছাড়া আবার যাস না।”
” একদম চিন্তা করবেন না চাচী, পারলে আপনার জামাইকে সেখানে রেখেই চলে আসবো।”
” এতো বড় বড় মুখ করে বলছিস তা যাওয়ার বেলায় জামাই যাবে তো? না মানে যে জামাই শশুর বাড়ি আসেনা সে আবার তোর আত্নীয়ের বাড়িও যাবে তাই আর কি বললাম।”
কথা হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা দ্বারা যেমন কারো মন ভালো কথা যায় তেমনি কথার ধার দিয়েই মানুষকে সহজেই ক’ষ্ট দেওয়া যায়। চাচীর কথা শুনে তৃধা চুপ হয়ে গেলো।
.
.
মেয়েকে ভাইয়ের ছেলে আদ্র এবং ভাবী মোহনার কাছে রেখে রুমে এসে বসলো তৃধা। নীরবে কিছু একটা ভেবে কাউকে ফোন করলো।
অফিস থেকে ফিরে তেজবীন মাত্রই জামা-কাপড় পরিবর্তন করে বিছানায় বসেছিলো। ফোনের শব্দে সে না দেখেই ফোনটা রিসিভ করে ফেললো। কিছু বলার পূর্বেই অপর পাশের কথা শুনে চুপ থেকে গেলো সে।
” বউ আর মেয়েকে ছাড়া অনেক মজায় আছো তাই না?”
” হ্যাঁ বেশ ভালোই আছি। ঝা’মেলা থেকে পিছু ছাড়াতে পারলে কে না ভালো থাকে?”
” ঝা’মেলা? বেশ ভালোই বি’ষমন্ত্র তোমার কানে দিয়েছে দেখছি। আর কি কি বলেছে আমাদের ব্যপারে বলো তো?”
” দেখো তৃধা সারাদিন অফিস করে, বসের হাজারটা কথা শুনে এখন তোমার এধরণের কথা শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছেনা। তোমারা আমার কথাটা একটু চিন্তা কারো। আমিও মানুষ, আমারো ভালো থাকতে ইচ্ছে হয়। আমারো ইচ্ছে হয় এসব ঝা’মেলা ছাড়িয়ে একটু শান্তিতে থাকতে।”
” আমার বুঝি হচ্ছে হয়না? তোমার কি মনে হয় প্রতিদিনের এসব নাটক আমার ভালো লাগে? আচ্ছা তেজবীন বলোতো আমি কি কম চেষ্টা করেছি তোমাদের খুশী করার? কম চেষ্টা করেছি মানিয়ে নেওয়ার? কিন্তু চেষ্টা শুধু আমিই একা করে গিয়েছি। তোমরা কেউ আমাকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা তো দূরে থাক ভাবনাতেও আনোনি। সবসময় তোমরা চেয়েছো আমার উপর শা’সন চালিয়ে যেতে। বাকিদের কথা বাদ দিলাম তুমি বলোতো, তুমি পারবে বুকে হাত দিয়ে বলতে যে তুমি কখনো আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছিলে? অন্যসময়ের কথা একপাশে রাখলাম এই সময় তোমার উচিত আমার পাশে থাকা কিন্তু তুমি? আমার মেয়েটাকে একবার দেখতে পর্যন্ত এলেনা। আজ ছয়টা দিন পেরিয়ে গেলো, আমার মেয়েটা তার বাবাকে দেখতে পেলোনা। বুঝতে পেরেছো তেজবীন ভালো থাকতে চাই মুখে বললেই হয়না, নিজেকেও একটু চেষ্টা করতে হয়। সংসার জীবনটা একজনের উপর ভরসা করে চলে না। এই জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সবার সমান পরিশ্রম, ভরসা, ভালোবাসা প্রয়োজন।”
তৃধার কথার বিপরীতে তেজবীন কিছু বলতে পারলোনা শুধু শক্ত মুখ করে শুনেই গেলো।
” আর কোন জ্ঞান দেওয়া বাকি আছে?”
প্রতিউওর শুনে তৃধা হতাশা ভরা নিঃশ্বাস নিলো।
” শোন পরশুদিন বিকেলবেলা আমাদের বাড়িতে আসবে আমাকে আর বাবুকে নিতে।”
” পারবোনা। আসতে হলে নিজেই আসবে। নিজেই তো দে’মাগ দেখিয়ে গিয়েছিলে এখন কেন আমাকে আসতে বলছো?”
” তুমি আসবে মানে তুমিই আসবে। তুমি ভালো করেই জানো আমি যা বলি তা করিয়েই ছাড়ি। এখন তুমি ভালোই ভালো আসলে ভালো, না হলে আমি অন্যরাস্তাও নিতে পারি।”
” বলছিনা আমি পারবোনা। আমার এতো বেকার ন’ষ্ট করার মতো সময় নেই। আসতে না পারলে তোমার ভাইকে বলো দিয়ে যেতে।”
” আসার আগে বাড়িতে সন্দেশ রেখে আসবে। আমি গিয়ে সন্দেশ খাবো। পরশুদিন ঠিক বিকেল বেলা আমাদের তুমি আসবে।”
পরবর্তীতে তেজবীনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিলে তৃধা ফোনটা কেটে দিলো। তেজবীন বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে তৃধা মনে মনে বললো,
” তোমরা কি ভেবেছো আমি বুঝি এবার নরম হয়ে যাবো? মোটেও না। এবার আমি আরো দ্বিগুণ শক্ত হয়েছি। এখন আমাকে শুধু নিজের জন্য না নিজের মেয়ের জন্য তোমাদের সাথে শীতল ল’ড়াই করতে হবে৷ এতোদিন তোমরা আমাকে আ’ঘাত করলে আমি প্রতিবাদ করেছি বউ হিসেবে এবার তোমরা আমার মেয়ের উপর আঙ্গুল তুলেছো। এবার দেখবে একজন মা নিজের মেয়ের জন্য কতটা কঠিন হতে পারে।”
চলবে……