#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৫
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তৃধাকে ফোন করলো তেজবীন। তৃধা তখন ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত ছিলো।
” বলো।”
” ব্যাগপত্র নিয়ে রাস্তার মোড়ে এসো।” বেশ গম্ভীর স্বরে বললো সে। তৃধা বুঝতে পেরে যাই তেজবীন আজও তাদের বাড়িতে না আসার চিন্তা করছে। কিন্তু আজ সে সেটা হতে দেবে না।
” আমি একা এতো ভারী ব্যাগ আর বাচ্চা একসাথে নিয়ে এতটুকু পথ যেতে পারবোনা৷ ঘরে এসো, আমার আরো কিছুটা সময় লাগবে।”
” ঠিক আছে, তোমার হলে আমাকে ফোন দিও। আমি এখানেই আছি।”
তেজবীন তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দিলো। তৃধা কল ব্যাক করলোনা। নিজের মতো কাজ করতে লাগলো। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো তবে এখনো তৃধার কোন কল না পেয়ে নিজেই ফোন করলো। কিন্তু তৃধা রিসিভ করছেনা দেখে সে জে’দ করে চলে যেতে নিলেও কি মনে করে যেন তৃধাদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
বেলের শব্দ পেয়ে শায়লা খাতুন দরজা খুলে দিতেই তেজবীনকে দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। ওনার খুশী দেখে মনে হচ্ছে যেন লাখ টাকার হীরা পেয়েছেন। তেজবীনের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে বিয়ের এতো বছরের মধ্যে মোটে দুই কি তিনবারই তৃধাদের বাড়িতে এসেছিলো। তাও বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে। তার তো তৃধার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
” তৃধাকে ডেকে দিন। গেলে তাড়াতাড়ি আসতে বলুন, আমার অনেক কাজ আছে।”
” আরে এতো তাড়া কিসের? কতগুলো বছর পর তুমি এলে। এসো ভিতরে এসো। দেখো ঘেমে কি অবস্থা হয়েছে। তুমি বরং জামা-কাপড় গুলো ছেড়ে অন্য একটা শার্ট পড়ো। আমার ছেলের তো অনেকগুলো শার্ট আছে,সেখান থেকে একটা না হয় পড়লে।”
” না থাক, দরকার নেই। আপনি তৃধাকে ডেকে দিন।”
” সে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। জামা-কাপড় না পরিবর্তন করো অনন্ত ভিতরে এসে ফ্যানের নিচে বসো। গরমে না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
এতোটা সময় গরমে দাঁড়িয়ে থাকার পর আর বাইরে থাকতে ইচ্ছে করছিলোনা তেজবীনের। তাই সে ইচ্ছে না থাকার স্বত্তেও ভিতরে এসে বসলো। শায়লা খাতুন ফ্যান ছেড়ে দিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেলেন।
” বউমা তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাও, আমি ফল কাটছি। কতগুলো বছর পর জামাই বাড়িতে এসেছে। এবার ভালোই ভালোই সব মিটে গেলেই আমার শান্তি।”
মোহনা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে একবার তেজবীনকে দেখলো৷ কাজ করতে করতে বিরবির করে বললো,
” আমার ননদিনী দেখছি আসলেই রায় বাঘিনী।”
শায়লা খাতুন বেশ কয়েক ধরনের ফল, নাস্তা, শরবত এনে তেজবীনের সামনে রাখলো। তিনি অনেক সাধাসাধি করলেন, কিন্তু তেজবীন কিছুই খাওয়া তো দূর ফিরেও তাকালোনা৷
মেয়েকে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই তৃধা এই দৃশ্যটা দেখতে পেলো৷ ব্যাগটা এনে মাটিতে রেখে মায়ের পাশে দাঁড়ালো। প্রায় আটদিন পর তৃধা আর তেজবীন মুখোমুখি হয়েছে। তৃধার দিকে রে’গে তাকালো তেজবীন। হিংস্র বা’ঘের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই বুঝি থা’বা মা’রবে। তবে সে টুঁ শব্দ না করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। পেছন থেকে শায়লা খাতুন তাকে আটকে দিলেন।
” আরে বাবা কিছু একটু মুখে তো দিয়ে যাও। এভাবে চলে যেতে নেই৷”
” দরকার নেই এসব আমার। কারো আসতে হলে সে যেন আসে৷ এতোবার তোসামদ আমি করতে পারবোনা।”
তৃধা ঝুঁকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্ণটা খেয়ে ফেললো। খালি গ্লাসটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
” যে খেবেনা বলেছে তাকে একবার থেকে দু’বার বলতে নেই। তাহলে তার দাম বেড়ে যাবে। তখন খাওয়ার প্রয়োজন হলেও নিজের দাম রাখার জন্য না না করে। আমরা আসছি আজ৷ সাবধানে থেকো তোমরা। মোহনাও তো কিছুদিন পর চলে যাবে, তখন সাবধানে থেকো। আমি সব গুছিয়ে আবার আসবো। মোহনা আসছি, সাবধানে যাস।”
” আমাদের নিয়ে ভাবিস না, তুই মেয়ের খেয়াল রাখিস৷ জামাইবাবু খেয়াল রাখবেন কিন্তু। না হলে আমার পুলিশ ভাই তো আছেই। হাহাহা…..”
সবার থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলো তৃধা। ট্যাক্সি চলতে শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর তেজবীন নীচু স্বরে গম্ভীরভাবে বললো,
” ইদানীং বড্ড মুখ চলছে না?”
তার এধরণের কথা শুনে তৃধা কিছু বললোনা। হালকা হেসে বাইরে দৃষ্টি স্থাপন করে পরবর্তী পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করবে তাই ভাবতে লাগলো।
মা-মেয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলো। বেল বাজার শব্দ শুনেও দু’জনের কেউই যখন উঠলো না তখন বাধ্য হয়ে তিথিতেই পড়া ছেঁড়ে উঠতে এলো।
” কতোক্ষণ থেকে বেল বেজে চলেছে। টিভির সামনে থেকে উঠে দরজাটা তো একটু খুলতে পারো। টিভি দেখা থেকে দরজা খোলাটা গুরুত্বপূর্ণ বেশি।”
” উফ…. যা তো। বিরক্ত করিস না।”
দরজা খুলে তৃধাকে দেখে অবাক হলো তিথি, সেইসাথে খুশিও হলো। হালকা হেসে দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই তেজবীন বড় বড় পা ফেলে রুমে চলে গেলো। তেজবীনের এভাবে যাওয়াতে নন্দিনী এবং ফাতেমা বেগম কিছুটা চমকে গেলেন। ওনারা পুরো বিষয়টা বুঝবেন তার আগেই তৃধার তাদের সামনে এসে হাজির হলো।
” আসসালাম আলাইকুম শাশুড়ী মা আর ননদজী। কেমন আছেন? দিন কাল ভালো চলছে তো? ভালো না চললেও সমস্যা নেই আমি তো চলে এসেছি। ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?”
এই সময়ে যে তারা তৃধাকে দেখবে সেটা কখনোই আশা করেনি।
” তুমি! তুমি না তোমার বাপের বাড়িতে ছিলে?” বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো নন্দিনী।
” ছিলাম। আমি তো আবার কিছু মানুষের মতো বছরে বারো মাসের আটাশ দিনেই বাপের বাড়িতে পড়ে থাকিনা৷ তাই চলে এলাম। এতো অবাক হচ্ছেন যেন আমাকে আজকেই প্রথম দেখেছেন।”
” তুমি এই বাড়িতে কেন এসেছো? এসেছো মেনে নিলাম কিন্তু এই অলু’ক্ষণেটাকে কেন এই বাড়িতে এনেছো? তোমার মাকে না বলেছিলাম এখন না পাঠাতে। তাহলে কোন সাহসে তুমি আমার কথা অমা’ন্য করলে?”
” আমি আপনার কেনা সম্পত্তি নই শাশুড়ী মা। আপনি উচিত কথা বললে আমি শ্রদ্ধার সাথে তা পালন করবো কিন্তু অন্যায় অাবদার তো আর মানতে পারিনা। ওটা যেমন আমার বাড়ি এটাও আমার আরেকটা বাড়ি। কেউ আমার পর নয়। সে যাইহোক আমার এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি বরং রুমে যাই। আপনারা এখন মন টিভি দেখুন।”
চলে যেতে নিয়েই থেমে পিছন ফিরে তৃধা গা জ্বা’লানো একটা হাসি দিয়ে বললো,
” আমাকে কিন্তু আপনাদের আদরের ছেলে বাবুই নিয়ে এসেছে।”
কথাটা বলেই তৃধা রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। ফাতেমা বেগমের মুখশ্রীতে অবাকের রেশ কেটে রাগীভাব ফুটে উঠলো।
” মা দেখেছো ডাই’নিটা কেমন করে আবারো বাবুকে হাত করে নিচ্ছে। দড়ি পুরো নরম হওয়ার আগেই শক্ত করে ধরো, না হলে পরবর্তীতে তোমার কপালেই দুঃখ আছে। দেখা যাবে ও তেজবীনকে বশ করে বাড়িতে রাজত্য করবে, ওর বাবা-মাকেও এখানে নিয়ে আসবে। তারপর তোমার সাথে খা’রাপ ব্যবহার করবে। এখনই এতো ফটরফটর করে, বাবুও হাত থেকে বেরিয়ে গেলে না জানি তোমার সাথে কি করবে।” ফিসফিস করে ফাতেমা বেগমের কানে বললো নন্দিনী৷ মেয়ের কথা শুনে ফাতেমা বেগমের মুখে রাগের সাথে ভ’য়ের রেশও দেওয়া মিললো। মায়ের মুখোভাব দেখে আড়ালে মুচকি হাসলো নন্দিনী।
ফাতেমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছেলের কাছে যেতে নিলে তিথি আটকে দিলো।
” এখন আর কোন চিৎকার চেচামেচি করো না মা। মাত্রই ওরা বাড়িতে ফিরেছে। একটু জিরিয়ে নিতে দাও, জামা-কাপড় পরিবর্তন করতে দাও। ভুলে যেওনা এখন একটা ছোট বাচ্চাও আছে। দয়া করে এই রাত বিরেতে আর ঝামেলা করোনা। বাড়িটাকে একটু নিরব থাকতে দাও।”
কথাগুলো বলে তিথি ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চলবে….৷