#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৮
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
প্রায় দু’ঘন্টা কাপড় ধুয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে তৃধা। এতো কাপড় একসাথে ধুয়ে ক্লান্তি হয়ে গিয়েছে সে। পুরো শরীর ব্য’থা হয়ে গিয়েছে তার। বড় দু’টো বালতিতে সব কাপড় রেখে বেরিয়ে এলো তৃধা। বাথরুম থেকে বের হতেই শুনতে পেলো তন্বী কান্না করছে। দ্রুত তিথির রুমে গিয়ে দেখলো তন্বীকে থামানোর চেষ্টার করছে সে।
” ভাবী দেখোনা কত করে চেষ্টা করছি থামানোর কিন্তু থামছেই না।”
” খিদে পেয়েছে তাই কান্না করছে৷ আমাকে দাও, তুমি এখন নিজের কাজ করো।”
মেয়েকে নিয়ে খাইয়ে দিলো তৃধা। খিদে মিটে যেতেই তন্বী একদম শান্ত হয়ে গেলো। তাকে কোলে নিয়ে ফাতেমা বেগমের রুমের দিকে হাঁটা দিলো সে। নন্দিনী বিছানায় বসে মোবাইল চালাচ্ছিলো এবং ফাতেমা বেগম সুপারিশ কাটচ্ছিলেন।
” আপনারা কি ব্যস্ত আছেন?”
নিজেদের রুমে আচমকা তৃধার আগমনে দু’জনেই চমকে গেলো। কপাল কুচকে তৃধার দিকে তাকালো দু’জনে।
” এখানে কি? কেন এসেছো আমার রুমে?”
” কাজেই এসেছি৷ মনে তো হচ্ছে না কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন আপনারা। বাথরুমে কিছু কাপড় আছে, আমি ধুয়ে দিয়েছি। যদি একটু সেগুলো ছাদে মেলে দিয়ে আসতেন তাহলে ভালো হতো। বাচ্চাকে একা রেখে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এতো ভারি বাতিল একা ছাদে নিয়ে যাওয়া এখন আমার জন্য ঠিক নয়।”
” এই মেয়ে আমাদের দেখে কি তোমার কাজের মেয়ে মনে হয়? আমার মা আমাকে কখনো কাজ করতে বলেনি আর সেখানে কিনা তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছো? তোমার সাহস তো কম না। তুমি ফ’কিন্নি ঘর থেকে আসতে পারো আমি নয়।”
তৃধা বেশ বিনয়ীভাবে তাদের সাথে কথা বলেছিলো কিন্তু নন্দিনীর কথা শুনে তার মেজাজ আবারো গরম হয়ে গেলো। তৃধা প্রথম থেকে দেখছে নন্দিনীর কথা ধরণ মোটেও ঠিক না। কথা বলাও একধরনের শিল্প, যা দ্বারা সহজেই মানুষকে ইমপ্রেস করা হয়। যা নন্দিনীর মধ্যে নেই। তার কথা বলার ধরণ খুবই বা’জে, যা শুনে যে কারোরই তার উপর বিতৃষ্ণা চলে আসবে।
” নিজের কাজ করলে কেউ ফ’কির হয়ে যাই না। নিজের কাজ নিজে করাটা কমনসেন্স এর মধ্যে পড়ে। আপনার বাবা-মা কখনোই কাজ করতে দেয়নি ঠিক আছে কিন্তু এখন তো বিবেকের জন্য হলেও কিছু কাজ করুন। বাবা-মা নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস গড়ে তুলেনি বলেই তো শশুড় বাড়িতে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারেন না। তাই তো আপনার মা আপনাকে বাড়িতে এনে বসিয়ে রাখে।”
” তৃধা, মুখ সামলে কথা বলো। তুমি আমাকে খোঁটা দিচ্ছো? এটা আমার বাপের বাড়ি, তোমার কোন অধিকার নেই আমাকে কথা শোনানোর।” চোখ গরম করে বললো নন্দিনী।
” এটা আমার শশুড় বাড়ি। আপনারও কোন অধিকার নেই আমার সংসারে নাক গলানোর। আমি কাউকে খোঁটা দিচ্ছি না, ইচ্ছেও নেই। শুধু ভুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কাপড়গুলো ছাদে মেলে দিয়ে আসলে উপকার হবে। আর না দিলেও সমস্যা নেই আমি বরং সন্ধ্যাবেলা তেজবীন এলে তাকেই পাঠাবো। কারণ এতো ভারি বালতি নিয়ে আমার তো আর ছাদে যাওয়া সম্ভব না। আমারো শরীর বলতে কিছু আছে।” বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তৃধা।
পান চিবোতে চিবোতে ফাতেমা বেগম কিছু চিন্তা করলেন। তারপর গলা খাকড়িয়ে বললেন,
” নন্দু চল ছাদে কাপড়গুলো মেলে দিয়ে আসি।”
” মা তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? আমি কিনা যাবো কাপড় মেলে দিতো! জীবনে কখনো আমাকে এসব করতে দেখেছো? তারউপর ওই বে’য়া’দব মেয়েটা যেভাবে কথা শুনিয়ে গিয়েছে, এরপর তুমি ভাবলে কি করে যে আমি কাপড় মেলে দিতে যাবো? দরকার হলে কাপড়গুলো বাথরুমেই পচে যাক, তাও আমি তা ছুঁয়ে দেখবোনা।”
ফাতেমা বেগম বসা থেকে উঠে নন্দিনীর পাশে বসলো।
” আমরা এখন যদি কাপড়গুলো ছাদে মেলে দিয়ে না আসি তাহলে ওই মেয়ে জীবনেও যাবেনা। তুই তো জানিস ওই মেয়ে কতটা ঘাড় ত্যাড়া। একবার যখন বলেছে তখন আমাদেরই যেতে হবে। না হলে তেজবীনকে দিয়েই সে কাজটা করাবে।”
” যা হচ্ছে করুক, আমি ম’রে গেলেও কাপড়গুলো ছুঁয়ে দেখবোনা।”
” আরে বোকা মেয়ে বুঝতে পারছিস না কেন? তেজবীন যদি এসে দেখে তাহলে তো আমাদেরই ক্ষ’তি। ওই মেয়ের প্রতি তার মনোভাব আরো নরম হয়ে যাবে, সেটা কি তুই চাস?”
” আমি কেন চাইবো?”
” তাহলে যা বলছি তাই কর৷ চল এখন আমার সাথে ছাদে, তিথিকেও ডেকে নে। যা যা তাড়াতাড়ি যা।”
নন্দিনী মুখ ভার করে তিথিকে ডাকতে চলে গেলো। সে যেতেই ফাতেমা বেগম রেগে বললেন,
” আমাকে হুকুম দেওয়া না? দাঁড়া তোর মজা তো আমি পরে দেখাচ্ছি।”
.
.
বেল বাজতেই নন্দিনী দৌড়ে দরজা খুলতে গেলো। তৃধা রান্নাঘর থেকে এটা দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো।
” এনার আবার কি হলো? এনাকে তো সারাদিন গলা ফাটিয়ে বলেও কোন কাজ করানো যাই না আর আজ কিনা নিজে থেকেই দরজা খুলতে চলে গেলো। বাহ্! আজ হঠাৎ এতো উন্নতি কিভাবে হলো?” নিজেকেই বললো তৃধা।
দরজা খুলে আজকে বড় বোনকে দেখে তেজবীনও অবাক হলো। তৃধার মতো তার মনেও একই প্রশ্ন জাগলো।
” আরে বাবু এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আয় আয়, এতোটা সময় অফিস করে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিস৷”
তেজবীন জুতো জোড়া সেল্ফে তুলে রেখে ভিতর এসে দেখলো আজ টিভিও বন্ধ আর ড্রইং রুম খালি। গতানুগতিক দিন থেকে আজকের চিত্র ভিন্ন দেখে তেজবীন কিছুটা অবাক হলো তবে কিছু জিজ্ঞেস করলোনা৷ চুপ রুমে গিয়ে জামা-কাপড় পরিবর্তন করে নিলো।
তেজবীনের জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে একপাশে রেখে ভাতের মাড় ফেলছিলো তৃধা। এই কাজ শেষ করেই সে যেতো কিন্তু নন্দিনী এসে তাকে জিজ্ঞেস না করেই গ্লাসটা নিয়ে চলে গেলো।
” আরে? গ্লাসটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ওটা তেজবীনের জন্য ছিলো, আপনি খেয়ে ফেলবেন না।” তৃধা পেছন থেকে ডেকেও কোন লাভ হলোনা। সে দ্রুত পাত্রটা নিয়ে রেখে উঁকি দিয়ে দেখলো নন্দিনী গ্লাসটা নিয়ে তাদের রুমে ঢুকেছে। দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো তৃধা।
” হঠাৎ এতো পরিবর্তন হলো কিভাবে? সকালেও তো কাপড় শুকনো নিয়ে কতকিছু বললো আর সন্ধ্যা হতেই নিজে নিজে কাজ করছে? কেন যেন আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঝামেলা নিশ্চয়ই করবে। এতোগুলা বছর ধরে দেখে আসছে, কু’কুরের লেজের মতো এরাও সোজা হওয়ার নয়। বিষয়টা ঠিক সুবিধার লাগছেনা।” এসব চিন্তা করলেও পরক্ষণেই নিজেকে বললো,
” আরে এতোটা নে’গেটিভ ভাবে নেওয়ার কি আছে? হতেও তো পারে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। সবসময় এতো উল্টো চিন্তা যে কেন করি? অবশ্য না করেই বা উপায় আছে, তাদের সবকাজের পেছনেই তো কোন শ’য়তা’নি কারণ থাকে।”
আর তেজবীনের কাছে গেলো না তৃধা। পুনরায় রান্নায় মনোযোগ দিলো।
জামা-কাপড় পরিবর্তন করে বের হতেই শরবতের গ্লাস হাতে নন্দিনীকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো তেজবীন।
” আরে আপু তুমি? কিছু বলবে?”
” না তেমন কিছু না। ভাবলাম তুই এতোটা পরিশ্রম করে এলি, তোর জন্য একটু শরবত বানিয়ে আনি। কেন আমি কি আনতে পারিনা?”
” আরে না না, তা কখন বললাম? তুমি বসো, গ্লাসটা দাও।”
এক চুমুক শরবত খেয়েই তেজবীন বুঝতে পেরে গেলো এটা নন্দিনী নয় বরং তৃধা বানিয়েছে তবে সে কিছু বললোনা। চুপচাপ খেয়ে গ্লাসটা একপাশে রেখে দিলো।
ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
” মা কোথায় আপু? অন্যদিন হলে তো বসার ঘরে দেখতাম আজ দেখলাম না যে? কোথাও গিয়েছে নাকি?”
তেজবীনের কথা শুনে নন্দিনী কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
” আর কোথায় যাবে? বিছানায় শুয়ে আছে, কোমড়ের ব্য’থার জন্য উঠতে পারছেনা। না হলে মা কোনদিন তুই এলে বসে থাকতো?”
” হঠাৎ কোমড়ে ব্য’থা কেন?”
” আর বলিস না। ব্য’থা করবে না? শুধু কি মায়ের? আমার নিজেরও তো কোমড়, হাতে ব্য’থা করছে। তুই তো থাকিস না জানবি কি করে? তোর বউ তো তোর আড়ালে আমাদের দিয়ে ঘরের সব কাজ করাই। আমাদের হু’মকি দেই কাজ না করলে খেতে দেবেনা, ঘর থেকে বের করে দেবে। আমি না হয় শশুড় বাড়ি গিয়ে থাকতে পারবো কিন্তু মা, মা তো আর এই বয়সে বাড়ি ছাড়া হতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়েই কাজ করে। আমি তো মেয়ে, তাই মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমিও সাহায্য করি।” মিথ্যা কান্নাভাব এনে বললো নন্দিনী। বোনের কথা শুনে তেজবীনের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। নন্দিনী উৎসুকভাবে অপেক্ষা করছে তেজবীনের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।
চলবে…….