#অবেলায়_তোমার_আকাশে
#পর্ব_১১
#লেখিকা_N_K_Orni
— কি হয়েছে ভাইয়া? ভালো করে বলো তো।
— এই ছবি আমি একটা জায়গায় দেখেছি।
অভ্রর কথা শুনে বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে উঠল,
— কোথায় দেখেছ তুমি আমার ছবি?
— একবার আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম কলেজ থেকে। তখন আমি পড়া শেষ করে কলেজে জয়েন করেছি। তা সেই সময় একদিন আমি আর শ্রাবণ স্যার কথা বলছিলাম। তখন স্যারের ফোনে কল আসে। স্যার তারপর কেটে দেন কলটা। তখন ফোনের ওয়ালপেপার ভেসে ওঠে। আর স্যারের ওয়ালপেপারে একটা মেয়ের ছবি ভেসে ওঠে। আর সেই ছবিটা অন্য কোনো ছবি নয় বরং এই ছবিটাই।
অভ্রর কথা শুনে বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে উঠল,
— অসম্ভব। হতেই পারে না। স্যারের ফোনের ওয়ালপেপারে আমার ছবি কেন থাকবে? ওটা হয়তো অন্য কারো ছবি। তুমি হয়তো ভুল দেখেছ।
— না ওটা এই ছবিটাই ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে।
— কিন্তু স্যারের ফোনে আমার ছবি কি করে আসবে?
— সেটাই তো আমি বুঝতেছি না। সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে আমার।
অভ্রর কথা শুনে বৃষ্টি কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সে তো শ্রাবণকে ঠিকমতো চেনেই না। তাহলে তার ছবি কিভাবে শ্রাবণের ফোনে থাকবে? বৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
— ভাইয়া আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি রুমে গেলাম।
— আচ্ছা আয়।
বৃষ্টি ওখান থেকে বেরিয়ে তার রুমে চলে এলো। রুমে গিয়ে বৃষ্টি এই কথাটাই চিন্তা করতে লাগল। সে কিছুতেই বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। রাতে বৃষ্টি তার বাবা রাদিব সাহেবকে কল দিল। কয়েকবার বাজার পর রাদিব সাহেব কল ধরলেন। বৃষ্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
— হ্যালো বাবা।
বৃষ্টির গলা শুনে রাদিব সাহেব খুশিতে বলে উঠলেন,
— হ্যালো! বৃষ্টি মা তুই কেমন আছিস মা?
— আমি ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?
— তোকে ছাড়া আমি কিভাবে ভালো থাকি রে? যাইহোক, তোর কলেজে ভর্তির কি খবর?
— আমি গতকাল অভ্র ভাইয়ার সাথে গিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছি। আর আজকে আমার প্রথম ক্লাস ছিল।
— কেমন হলো ক্লাস?
— খুবই ভালো। এসে ভাবলাম একবার তোমাকে কল দেই।
— আচ্ছা ভালো করেছিস। আমি তোকে কল দিতে চেয়েও দিতে পারিনি। নিজের ভেতরে বড্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে। আমার জন্য শুধুমাত্র আমার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।
— না বাবা তোমার কোনো দোষ নেই। যা দোষ সবই আমার।
— না রে মা তুই সবটা জানিস না। যাইহোক ওসব বাদ দে। এবার বল ওখানে তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
— না বাবা আমার এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ফুফি ফুপা খুবই ভালো। ফুফি আমার খুব খেয়াল রাখে। অভ্র ভাইয়া আর আয়না দুজনেই আমাকে নিজের বোনের মতো ট্রিট করে।
— ওহহ তাহলে তো ভালো কথা। আচ্ছা মা রাখি তাহলে। পরে কথা হবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করিস আর নিজের খেয়াল রাখিস।
— হুম।
বলেই বৃষ্টি কল কেটে দিল। বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পাশে রেখে দিল। সে নিজেই নিজেকে বলতে লাগল,
— নিশ্চয়ই বাবার কিছু হয়েছে? বাবার প্রতিটা কথায় যেন অন্য রকম আভাস পাচ্ছি। হয়তো আমার এই অবস্থার জন্য বাবা নিজেকে দোষী ভাবছেন। কিন্তু বাবার তো কোনো দোষ নেই। আমার কপালটাই খারাপ। ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই তো হবে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বৃষ্টি আবার বলে উঠল,
— আচ্ছা আসিফ কি আমাকে ভুলে গেছে? হয়তো? আমি তো এখন প্রয়োজনহীন। আমার কোনো দরকারই নেই তার কাছে। সে তো সায়েরার সাথে ভালোই আছে।
বলতে বলতে বৃষ্টির দুই চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বৃষ্টি হাতের এক আঙ্গুল দিয়ে পানি মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। বাইরে হালকা বাতাস বইছে। সে বাতাস বৃষ্টির গায়ে এসে লাগছে। বাতাসে বৃষ্টির ওড়নার পেছন দিক উড়ছে সাথে পেছনে থাকা চুলগুলো। আর সামনে দিকের অবাধ্য চুলগুলো প্রতিবারের মতো বাতাসের আভাস পেয়ে মুখে সামনে এসে খেলা করছে।
চারপাশ শুনশান, নীরব হয়ে আছে। এই নিস্তব্ধ প্রকৃতি যেন বৃষ্টির দুঃখেই কষ্ট পাচ্ছে সেটাই জানান দিচ্ছে। রাতের আকাশের ঠিক মাঝে অর্ধেক চাঁদ ফুটে আছে। আর সেই চাঁদের চারিদিকে সোভা পেয়েছে অসংখ্য তারা। কিছু কিছু তারা একজোট হয়ে আছে। আর কিছু কিছু তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো আকাশ জুড়ে। বৃষ্টি আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে আজকে তার ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে।
কোমা থেকে ফেরার পর সে যখন একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছিল তখন প্রতিদিন মাকে দেখতে চাইত। ঘুমের মধ্যে বারবার মাকে ডাকত। বলত,
— মাম্মাম তুমি কই? আমার কাছে আসছ না কেন? আমি তোমাকে খুব মিস করছি। তুমি কোথায়?
আস্তে আস্তে বৃষ্টি যতটা সুস্থ হচ্ছিল ঠিক ততটাই মাকে দেখার জন্য বায়না করছিল। বৃষ্টির শরীর তখনও বেশ দূর্বল ছিল। তবুও সে মাকে দেখার জন্য জেদ করত। তাই একদিন রাদিব সাহেব উপায় না পেয়ে বৃষ্টিকে হুইল চেয়ারে করে বারান্দায় নিয়ে যায়। সেদিনও আকাশে এমন অর্ধেক চাঁদ উঠেছিল। রাদিব সাহেব আকাশে থাকা সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটিকে দেখিয়ে বলেছিল,
— ওই যে দেখছ আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। ওটাই তোমার মা।
সেদিন বাবার কথা শুনে অবুঝ বৃষ্টি বলেছিল,
— কিন্তু ওটা তো একটা স্টার। ওটা কিভাবে মাম্মাম হতে পারে?
— তোমার মাম্মাম স্টার হয়ে গেছে।
— তাহলে কি মাম্মাম আমার কাছে আর আসবে না?
— না। মাম্মাম তোমাকে ওই দূর থেকে দেখবে। তুমি যদি দুষ্টুমি করো বা বাবার কথা না শোনো তাহলে কিন্তু মাম্মাম তোমার উপর রাগ করবে।
— আমি আর কখনো দুষ্টুমি করব না। তোমার সব কথা শুনব ঠিকমতো ওষুধও খাব। তুমি প্লিজ মাম্মামকে বলো যেন আমার উপর রাগ না করে। আর তাড়াতাড়ি স্টার থেকে মানুষ হয়ে যায়।
— কিরে বৃষ্টি এখানে দাঁড়িয়ে কি করিস? বাইরে তো বেশ ঠান্ডা বাতাস। ঠান্ডা লেগে যাবে তো?
কারো গলার আওয়াজে বৃষ্টি বাস্তবে ফিরে এলো। পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির চোখে পানি চলে এসেছিল। সে দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে পেছনে ফিরে তাকাল। সে দেখল মিসেস রায়া দাঁড়িয়ে আছেন।
— ফুফি কিছু বলবে?
— হ্যাঁ তোকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম।
— আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি।
— আচ্ছা।
বলেই মিসেস রায়া রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বৃষ্টি নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ মুখে পানি দিয়ে এলো। এরপর বৃষ্টি খেতে চলে গেল। খেয়ে এসে একটু পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কাল সকালে আবার কলেজ আছে। তাই বেশি রাত জাগল না।
সময় তার আপন গতিতে চলতে লাগল। দেখতে দেখতে দেড় মাস কেটে গেছে। প্রতি দিনের ধরা বাধা নিয়মের সাথে বৃষ্টি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। সবকিছুর মাঝে বৃষ্টি তার বাবার সাথে যোগাযোগ চালিয়ে গেছে। তবে তার সৎ মা আর বোনের কথা জিজ্ঞাসা করলে তার বাবা প্রতিবার এড়িয়ে যায়। তারপরও সে বারবার তাদের কথা জিজ্ঞাসা করে। কারণ তারা তাকে না মানলে সে তাদের আপন ভাবে।
এদিকে বৃষ্টি না থাকায় মিসেস সানিয়ার বেশ সমস্যা হচ্ছে। যদিও বাসায় সার্ভেন্ট আছে তবুও যেসব টুকটাক কাজ তিনি বৃষ্টিকে দিয়ে করাতেন ওগুলো তার নিজের করতে হচ্ছে। যার জন্য তিনি বেশ অতিষ্ঠ। তিনি যখন শুনেছিলাম বৃষ্টি তার ফুফির বাসায় মেডিকেল পড়ার জন্য গিয়েছে তখন তিনি বেশ রাগ করেন। আর এই নিয়ে তার আর রাদিব সাহেবের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। অন্য দিনের মতো মিসেস সানিয়া ঘরের কাজ শেষ করে সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। তখনই হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। মিসেস সানিয়া বেশ মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছিলেন। কলিং বেলের শব্দে তার দেখায় ব্যাঘাত ঘটল। তিনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললেন। সামনের দিকে তাকিয়ে তার ভ্রু দুটি কুচকে এলো।
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )