#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
” ও বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন আপনারা?”
” বলে দিয়েছে তাহলে।” খেতে খেতে জবাব দিলো নন্দিনী।
” অবশ্যই বলবে, এটা বলার মতো কথা নয় কি? আপনারা যে যাবেন তা তো আমাকে আগে বলেননি।”
” এখন কি কোথাও যাওয়ার আগে তোমাকে ব়লে যেতে হবে?” কিছুটা রেগে বললেন ফাতেমা বেগম।
” আমি কি তা বলেছি মা? আপনাদের তো আবার ভরসা করা যায় না, ও বাড়িমুখো হওয়া আপনাদের ক্ষেত্রে তো স্বাভাবিক নয়। তাই আমার তো জানা প্রয়োজন কেন গিয়েছিলেন।”
” তোমাকে বলতে বাধ্য নয় আমরা।”
” আ…. চুপ করবে তোমরা? খাবার খেতে বসেছো খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরো৷ এতো কথা বলছো কেন? তৃধা ওরা গিয়েছে শেষ, এতো কিছু জিজ্ঞেস করার কি আছে? আর তোমরাও সোজাসুজি উওর দিলেই পারতে। কেন সবসময় এতো কথা বাড়াও বলো তো? মুখটাকে তো একটু শান্তি দিতে পারো।” বেশখানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললো তেজবীন।
তার কথা শুনে তিনজনেই চুপ হয়ে গেলো। তৃধা থমথম করে চুপচাপ খেতে বসে পড়লো।
.
.
বেশ কিছু মাস পর,
রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আচমকা তীব্র দরজা ধাক্কানোর শব্দে বাড়ির প্রতিটি মানুষ কেঁপে উঠলো। আচমকা শব্দে তৃধা ভয়ে তন্বীকে কোলে তুলে নিলো। এতো রাতে এধরণের শব্দ শুনে চিন্তা এবং ভয়ে তেজবীনের বুক কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। সে একা ছেলে, বাড়িতে এতগুলো মেয়ে আছে। অনাঙ্ক্ষিতভাবে কিছু হয়ে গেলে সে কিভাবে পরিস্থিতি সামলাবে সেটা ভেবেই তার গলা শুকিয়ে এলো।
” তেজবীন যা দরজাটা খুলে দে।” ভয়ে ভয়ে বললো নন্দিনী।
” হুম বাবু, তুই যা। দেখ কে এভাবে দরজা বারি দিচ্ছে। এই সময় আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা।”
ধুরধুর বুকে এগিয়ে গেলো তেজবীন, ভয়ে ভয়ে ডোর হোল দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্ধকার থাকায় বৃথা হলো সে।
” কি হলো? কিছু দেখতে পেলে?”
” না, অন্ধকারে কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। দাঁড়াও আমি দেখছি অপরপাশ থেকে কেউ সাড়া দেয় কিনা। কে বাইরে? কে দরজায় বারি দিচ্ছে?”
” তেজবীন তাড়াতাড়ি দরজা খোল।”
চাপা স্বরটি শুনে সবাই বুঝতে পেরে গেলো এটা রুদ্র। চিনতে পেরে দ্রুত দরজা খুলে দিলো তেজবীন। তবে দরজা খুলে যে রুদ্রকে বিধস্ত অবস্থায় দেখবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে ভেতরে এনে বসালো। তিথি রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো, তৃধা সেখান থেকে সরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো।
রুদ্রের এই বেহাল দশা দেখে ফাতেমা বেগম বেশ উতলা হয়ে উঠলেন, চিন্তার ভাজ পড়লো তেজবীনের কপালে।
” বাবা কি হয়েছে তোমার? তোমার এই অবস্থা হলো কি করে?”
” কিছু হয়নি আমার, আমি ঠিক আছি। ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে আর কিছু না।”
” কি বলো কিছু হয়নি? দেখোতো হাত থেকে রক্ত পড়ছে, গালে কেটে গিয়েছে। কিরে বাবু দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দ্রুত গিয়ে ওষুধ, তুলো নিয়ে আয়।”
মায়ের কথা শুনে তেজবীন দ্রুতের রুম থেকে ওষুধের বক্সটা নিয়ে এলো। ফাতেমা বেগম তার থেকে বক্সটি নিয়ে নন্দিনীর হাতে ধরিয়ে তাকে রুদ্রের পাশে বসিয়ে দিলেন।
” আরে কি করছো তুমি?”
” তুই জামাইকে ওষুধ লাগা, আমি ওর জন্য খাবার গরম করে আনছি৷ তেজবীন বাবা তুই ঘুমতে চলে যা।”
” তোমাদের আর কি লাগবে?”
” না তুই যা না। এই যে বউমা আর দাঁড়িয়ে না থেকে ঘুমতে যাও। না হলে সকালে আবার ঘুম থেকে উঠার সময় নাটক করে।”
তেজবীন এবং তৃধাকে একপ্রকার ঠেলে রুমে ঢুকিয়ে দিলেন ফাতেমা বেগম। তারাও আর বাড়তি কোন কথা না বলে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।
” কি এমন রাজকার্য করতে গিয়েছো যে এই অবস্থা হলো?” বিরক্তি নিয়ে র’ক্ত পরিষ্কার করতে করতে জিজ্ঞেস করলো নন্দিনী।
” বলেছি না এক্সিডেন্টে হয়েছে।আ…. আস্তে।”
তুলোয় ওষুধ লাগাতে লাগাতে নন্দিনী আবারো বললো, ” আমাকে কি তোমার দুধের বাচ্চা মনে হয়? কার বাসায় চু’রি করতে গিয়ে মা’র খেয়েছো? নাকি অন্যের বউয়ের সাথে ফুর্তি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছো?”
নন্দিনীর কথা শুনে রুদ্র থমকে গেলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, ” এসব কি আজেবাজে কথা বলছো তুমি? বলেছিনা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আ…. লাগছে।”
রুদ্রের কথায় পাত্তা না দিয়ে কাঁ’টা স্থানে আরো জোড়ে চাপ দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তুই যার কাছেই মা’র খা আমার কিছু যাই আসেনা। দরকার হলে হাত-পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাক তাও আমার কিছু যায় আছে না। তবে ভুলেও হাজার বেডিমানুষের সাথে মিশে আমার কাছে আসবি কিংবা আমাকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করলে এরফল ভালো হবেনা। ভালো মতোই জানিস আমি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারি, নিজের কাজ ঠিক রাখার জন্য আমি খু’ন করতেও দ্বিধা করবো না। যাই করবি কর কিন্তু কথাগুলো ভুলে যাস না।”
ওষুধের বক্স রুদ্রের হাতে ধরিয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো নন্দিনী। তার এমন হুমকিমার্কা কথা শুনে রুদ্রের মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো।
ফিরে এসে রুদ্রকে একা বসে থাকতে দেখে ফাতেমা বেগমের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।
” এই মেয়েকে দিয়ে কিছু হবেনা৷ অর্কমার ঢেকি একটা।” বিরবির করে বললেন তিনি।
” বাবা এসো খাবার খেয়ে নেবে।”
” না মা আমার খিদে নেই, আপনি রেখে দিন।”
” না না তোমাকে খেতেই হবে। তাড়াতাড়ি এসো।”
শত বারণ করলেও ফাতেমা বেগম তার কোন কথা শুনলেন না। জোড় করে সব খাবার খাইয়ে ছাড়লেন। বিরক্ত হয়ে রুদ্র মনে মনে বললো,
” মা-মেয়ে দু’টো অসহ্যকর।”
.
.
কেটে গেলে বেশকিছু মাস। বলতে গেলে তেমন কিছুই পরিবর্তন হলোনা। সময়ের সাথে সাথে তন্বী বেড়ে উঠতে লাগলো। এখন সে নিজে উঠে বসতে পারে, মাটিতে হাত-পায়ের সাহায্য একটু একটু এদিক-ওদিক চলাফেরা করতে পারে।
দ্রুত হাতে থালাবাসন পরিষ্কার করছিলো তৃধা। আচমকা বিকট একটা শব্দে কেঁপে উঠলো সে, কিছু সেকেন্ড পরেই তন্বীর তীব্র কান্না শুনে বুক ধক করে উঠলো তার। থালাবাসন ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে এলো সে।
মাটিতে বসে গলা ফাটিয়ে কান্না করছে তন্বী। কপাল এবং মুখ থেকে অনবরত রক্ত পড়ছে। রুমে এসেই এধরণের দৃশ্য দেখে কোন মা’ই নিজেকে ঠিক করতে পারবে না, তৃধা পরলো না। দ্রুত মেয়েকে কোলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল চেপে ধরলো।
” মা, তিথি কোথায় তোমরা? এদিকে তাড়াতাড়ি এসো।” চিৎকার করে ডাকতে লাগলো তৃধা। আঁচল দিয়ে চেপে ধরে তৃধা কোনবতে ওষুধের বক্সটা খুঁজে বের করলো। এখনো কেউ না আসাতে সে আবারো ডাকলো।
” তিথি তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছোনা। মা এখন তো ঘর থেকে একটু বের হন। সেই ঘরে আপনার কোটি টাকার সম্পত্তি নেই যে কেউ নিয়ে যাবে।” রেগে চিৎকার করে বললো তৃধা।
তন্বীকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে রক্তগুলো পরিষ্কার করতে লাগলো। ব্যথায় ছোট্ট তন্বী গলা ফাটিয়ে কান্না করছে। মেয়ের যে অনেক কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পেরে তৃধার অনেক কান্না পাচ্ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলোনা। ব্যান্ডেজ গড়িয়ে র’ক্ত পড়তেই লাগলো। ঠোঁটের র’ক্তগুলো পরিষ্কার করে তৃধা তেজবীনকে ফোন দিলে। প্রথমবার ধরলো না, দ্বিতীয় রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই তৃধা তাকে চুপ করিয়ে দিলো।
” দ্রুত বাসায় আসো। কোন বাহানা শুনতে চাইনা। ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি এসো। বস ছুটি না দিলে ফোন ওনাকে দাও আমি কথা বলছি। আধাঘন্টার মধ্যে তুমি বাড়িতে না এলে আজকের পর তোমরা আর কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না।”
তেজবীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেটে দিলো সে। সেই কাপড়েই তন্বীকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো তৃধা। তার বুকে যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমনি মাথায় আগুন জ্বলছে৷
চলবে……..