#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৫
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
পরেরদিন সকালে তৃধা উঠে চুপচাপ নিজের কাজ গুছিয়ে তন্বীকে তৈরি করে বেরিয়ে পড়লো। আজ সে অন্যদিনের তুলনায় বেশ আগেই বেরিয়ে পড়েছে। অন্যসময় তৃধা রান্না করে নিজে খেয়ে, দুপুরের খাবার নিয়ে যেতো। তবে আজ সে রান্নাও করলো না আর না খেলো কিংবা নিয়ে গেলো।
ঘুম থেকে উঠে ঘরে কাউকে না দেখে কিছু মূহুর্তের জন্য চিন্তায় পড়ে গেলো তেজবীন। তারপর তার মনে পড়লো কাল রাতে সে রুমে একাই ঘুমিয়েছিলো। হাত-পা ছেড়ে ঘুম কাটিয়ে হেলেদুলে বাথরুমে চলে গেলো সে।
ঘুম থেকে উঠে ফাতেমা বেগম প্রতিদিনের মতো সোফায় আরাম করে বসলেন। গলা ছেঁড়ে হুকুম করে বললেন,
” বউমা চা নিয়ে এসো।”
একমিনিট, দু’মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরেও তৃধাকে দেখতে না পেয়ে তিনি আবার ডাকলেন। টিভি ছেড়ে সিরিয়াল দেখতে লাগলেন তিনি। এক পর্ব শেষ হয়ে বিরতি দেওয়ার পরেও চা না পেয়ে তিনি ছ্যাঁতে গেলেন। ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ভাবখানা এমন যেন তৃধাকে পেলে তার এই ভুলের দু-চারটে থা’প্পড় মারবেন। কিন্তু হায়, ওনার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। তিনি তো আর জানেন না তৃধা সেই কবেই চলে গিয়েছে৷
রান্নাকে কাউকে না দেখতে পেয়ে তিনি সোজা তেজবীনের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। তেজবীন তখন বেশ যত্ন সহকারে মাথায় চিরুনি চালাচ্ছিলো।
” তোর বউ কোথায়? নবাবজাদি কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।”
” আমি জানিনা৷ তিথির রুমে গিয়ে দেখো নয়তো অন্যকোন রুমে। কাল রাতে তো এই রুমে আসেনি সে।”
” কি দু’পয়সা কামাই করছে তাতেই এতো তেজ। না জানি বড় ডাক্তার, ব্যারিস্টার হলে কত অহংকার থাকতো। আরে বাবা বাচ্চা পড়বে, ব্যথা পাবে তবেই না তারা বড় হবে। কি একটু ব্যথা পেয়েছে, কপালে দু’টো সেলাই পরেছে এমনভাব করছে যেন হাত-পা খুলে পড়ে গিয়েছে। তুই থাক আমি দেখছি ওই বেডি কোথায়।”
তৃধা বাড়িতে আছে মনে করে ফাতেমা বেগম সবজায়গা খুঁজলেন কিন্তু কোথাও তাকে না পেয়ে তিনি ভীষণ অবাক হলে। এদিকে রুম থেকে বের হতে হতে তেজবীন গলা ফাটিয়ে তৃধা উদ্দেশ্য করে বললো,
” তৃধা নাস্তা দাও, দুপুরের খাবার তাড়াতাড়ি ব্যাগে দাও।”
” কাকে বলছিস তুই এসব? তোর বউ তা বাড়িতেই নেই। না জানি এই সকাল বেলা কোথায় চলে গিয়েছে।”
” আচ্ছা ওসব পরে দেখা যাবে। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি খাবার দাও, আমার না হয় দেরি হয়ে যাবে।”
ফাতেমা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে কাপ, বাটি সব ধুয়ে যখনই ঢাকনা খুললেন তখন খালি পাত্র দেখে চমকে গেলেন। একে একে সব ঢাকনা তুলে একই দৃশ্য দেখে থমকে গেলেন তিনি। এমনকি ফ্ল্যাক্সে চা পর্যন্ত বানানো নেই। তিনি আরো বার দুয়েক উল্টে দেখলেন এই আশায় যে উনি হয়তো ভুল দেখছেন কিন্তু ফলাফল সেই একই দেখে ভীষণ হতাশ হলেন তিনি, সেইসাথে ওনার মনের এককোণে ভয়ের আঁচও পাওয়া গেলো। তবে তিনি এসবের কোনটাতেই পাত্তা না দিয়ে নিজের রাগী রুপটা নিয়েই তেজবীনের সামনে এলেন।
” বাবু আজ তোর খাওয়া হবেনা। তুই খালি পেটেই অফিস চলে যা, পথে কিছু খেয়ে নিস।”
” কেন মা?”
” তোর বউ তো তেজ দেখিয়ে রান্না করেনি। পাতিলের তালায় একটা ভাতের কণাও নেই।”
ওনার কথা শুনে তেজবীনও আঁতকে উঠলেন। তবে দেরি হয়ে যাবে চিন্তা করে আপাতত ঝামেলা করলোনা।
” হয়তো অফিসের জরুরি কাজে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে। তুমি আমাকে চা-বিস্কুট দাও৷ কিছু না খেয়ে গেলে সারাদিন খালি পেটেই থাকতে হবে।”
হতাশাভরা নিঃশ্বাস নিয়ে ফাতেমা বেগম চা বানানো শুরু করলেন। তেজবীন চেয়ারে বসে তৃধার কথা ভাবতে লাগলো। কিছুসময় পর ফাতেমা বেগম চা নিয়ে এলেন তেজবীন কোনরকমে দু’টো বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লো। ফাতেমা বেগমও চা-বিস্কুট খেয়ে রুমে গিয়ে টিভি দেখতে বসে পড়লো।
মেয়েকে প্রতিদিনের মতো মায়ের কাছে রেখে টেবিলে বসে পড়লো তৃধা।
” মা কিছু খেতে দাও তো। আর আমাকে দুপুরের খাবারও প্যাক করে দিও।”
ট্রে-তে নাস্তা সাজাতে সাজাতে শায়লা খাতুন মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিরে আজ এতো তাড়াতাড়ি এলি আবার কিছু খেয়েও এলি না। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে নাকি?”
চায়ের বিস্কিট ডুবিয়ে তৃধা বললো,
” না এমনিতেই তাড়াতাড়ি এসেছি। কেন বিরক্ত করলাম নাকি?”
” এসব কি বলছিস তুই? বিরক্ত হব কেন? এই সত্যি করে বল তো কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?”
” না কিছু হয়নি। তুমি টিফিট বক্সে আমাকে দুপুরের খাবারটা দিয়ে দাও, আমি একটু বসি।”
চায়ের কাপ ধুয়ে রেখে তৃধা তন্বীর পাশে একটু শুয়ে আরাম করে নিলো। সময় হয়ে এলে সে মাকে সাবধানে থাকতে বলে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
দুপুরে খাবার খেতে গিয়ে টনক নড়লো ফাতেমা বেগমের। তিনি তো নিত্য দিনের মতো নিশ্চিন্তে টিভি দেখতে বসে পড়েছিলেন কিন্তু তার তো খেয়ালই ছিলো আজ যে তৃধা রান্না করে যাইনি। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি চুলায় ভাত বসিয়ে আলু কাটতে লাগলেন। কোনবতে চলে যাওয়ার মতো ডাল, আলু ভর্তা দিয়ে খেয়ে নিলেন তিনি। খেতে খেতে তৃধাকে কয়েকটা বিশ্রি গা’লি দিতে ভুললেন না।
.
.
বাড়ি ফিরে আজো তৃধাকে দেখতে না পেয়ে তেজবীন মনে করলো সে বোধহয় পাশের বাড়িতে তন্বীকে আনতে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সে জামা-কাপড় পরিবর্তন ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো।
অনেক্ক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন সে তৃধাকে দেখতে পেলো না তখন বেরিয়ে এলো।
” মা তৃধা কোথায়? আজ তো আমাকে লেবুর শরবতও দিলো না।”
” তোর বউ বাড়ি থাকলে না শরবত দেবে। নবাবজাদি এখনো বাড়িতেই ফিরে আসেনি। কবে বেরিয়েছে কে জানে, রাতের দশটা বাজতে চললো এখনো ফেরার নাম নেই। আজ আসুক, পিঠের উপর দু’টো না দিলে তেজ কমবে না দেখছি। অনেক বাড় বেড়ে গিয়েছে।”
এবার তেজবীনেরও রাগ হলো। সেও অপেক্ষা করতে লাগলো তৃধার ফিরে আসার।
তৃধা ফিরে এলো, তবে অন্যদিনের তুলনায় অনেক দেরিতে। রাত প্রায় তখন এগারোটা, তিথি দরজা খুলে দিয়েছে। রুমে এসে তন্বীকে বিছানায় রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই চুলে টান খেলো সে। পেছনে ফেরার আগেই তেজবীন হুংকার দিয়ে বললে উঠলো,
” খুব তেজ বেড়ে গিয়েছে না তোর? কয়েকদিন ধরে ভালো ব্যবহার করছি বলে কি মনে করেছিস তোর এই রংতামাশা আমি সহ্য করবো। বেশি বাড়াবাড়ি করবি মা-মেয়ে দু’টোর পিঠের চা’মড়া তুলে ফেলবো।”
” দে আরো দে। নবাবের ঝি এর তেজে মাটিতে পা পড়ছে না। কত বড় সাহস সকাল বেলা রান্না না করে বেরিয়ে গিয়েছে, এখন এতো দেরি করে ফিরেছে। চাকরির দেমাগ দেখাচ্ছে, যেন দু’পয়সা কামাই করে বহুত কিছু করে ফেলেছে।” দরজার কাছ থেকে বললেন ফাতেমা বেগম।
তিনি চুপ করতেই তৃধা ধাক্কা মেরে তেজবীনকে সরিয়ে দিলো৷
” কাল তো খুব বলেছে তোমরা আমি আমার মেয়ের খেয়াল রাখিনা, মা হওয়ার যোগ্য না তখন তো আমি বলেই ছিলাম আমি আজ থেকে ঘরের কোন কাজ করবো না। আমার মেয়েটার এখন অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন। সেখানে তোমরা কি করে ভাবলে আমি আজ সব ভুলে বেহায়ার মতো তোমাদের মতো অমা’নুষদের জন্য রান্না করবো? তোমাদেরও কি একটুও লজ্জা নেই? কাল আমাকে এতো কথা শোনালে, আজ আবার আমার হাতের রান্না খেতে তোমাদের কি আত্মসম্মানেও লাগবে না? আমার খাবার তো তোমাদের গলা দিয়েও নামা উচিত না। আমি ঘরের কোন কাজ করো না মানে করবো না, শুধু মাত্র তন্বী কাজ আমি করবো। এখন তোমরা কি খাবে, কিভাবে কি করবে আমি জানিনা। আমার থেকে আশা করবো না যে আমি তোমাদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াবো। হ্যাঁ সাথে এটাও মনে করো না আমি তোমাদের সাথে জিদ করে না খেয়ে উপোস আছি। আমি তিনবেলা আমার খাবার ঠিকই খেয়েছি। কোথাও খাবার পাই কিংবা না পাই, আমার নিজের কষ্টের টাকা দিয়ে খাবার জোগাড় করার সামর্থ্য আমার আছে।”
চলবে……….