#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
কেটে গেলো কিছুদিন। এখনো কিছুই স্বাভাবিক হয়নি। নতুন নিয়ম অনুযায়ীই তৃধা নিজের সময় মতো উঠেছে। ঘুম ঘুম চোখে বাথরুমে গিয়ে সে মুখ ধুবে তখন বেসিনের উপর কিছু দেখে থমকে গেলো। বেসিনে মুখ না ধুয়ে বালতির পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে আবারো বেসিনের দিকে তাকালো। বেসিনের কোণায় লাল ফোঁটা ফোঁটা কিছু লেগে আছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও তৃধা বুঝতে পারলো না জিনিসটা কি। হাত দিয়ে তা স্পর্শ করার আগেই কেউ দরজায় কড়া নাড়লো। ফোঁটাগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে তৃধা দ্রুত বেরিয়ে এলো।
.
.
” আরে বাবা আসছি তো। বেলটাতো মনে হয় আজ শেষ হয়ে যাবে। আসছি, আসছি।”
দরজা খুলে বড় মেয়েকে দেখে আজ নরম কন্ঠে কথা বলার বদলে ধমক দিলেন তিনি।
” তোর এই বাজে স্বভাবটা কবে যাবে? কতবার বলেছি এভাবে অভদ্রের মতো বেল বাজাবিনা। উফ…. কান মনে হয় আর ঠিক নেই।”
” সরো তো আর ঘ্যান ঘ্যান করো না।” বিরক্তি নিয়ে ফাতেমা বেগমকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো নন্দিনী।
হাতে থাকা ব্যাগ গুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে বড় থেকে একটা নিঃশ্বাস নিলো।
” ও বাবা, এতোক্ষণে হাত দু’টোতে শান্তি লাগছে। আমাকে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দাও তো। গলাটা শুকিয়ে পুরো কাঠ হয়ে গিয়েছে।”
শরবত বানিয়ে নন্দিনীর সামনে রেখে ব্যাগ গুলোতে কি আছে দেখতে লাগলেন ফাতেমা বেগম। ব্যাগ খুলতেই ওনার নাকে সুন্দর একটা গন্ধ এসে বারি খেলো। দ্রুত হাতে জিনিসগুলো বের করতেই দেখলেন অনেক গুলো খাবারের প্যাকেট। এতো ভালো ভালো খাবারের প্যাকেট দেখে তো ফাতেমা বেগমের এর চোখ ঝলমল করে উঠলো।
” এতো খাবার! ভালো করেছিস এগুলো এনে। ঘরের খাবার খেতে খেতে মুখে বিতৃষ্ণা চলে এসেছে।”
শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে নন্দিনী বললো,
” এই কথাটা আমাকে এখন পর্যন্ত শতবার বলেছো। তোমার জামাইয়ের কানে গিয়েছে, তাই সে এগুলো কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
” তাই নাকি! কি কপাল আমার। এতো ভালো একটা জামাই পেয়েছি, পুরো হিরের টুকরো। কিন্তু আমার পোড়া কপাল এমন একটা বউ পেলাম যার তেজের কারণে ধারের কাছেও যাওয়া যাইনা। সবসময় গুনে গুনে বেতন আমার হাতে তুলে দিবে। না জানি কোন পা’প করেছিলাম যে এমন ডা’ইনি আমার বউ হলো। যখন থেকে আমার সংসারে পা দিয়েছে আমার সুখের সংসারে ওর কুনজর লেগে গিয়েছে।”
” ওই বেয়াদবের কথা আর বলবে না। যেই আমি কিছুদিনের জন্য ও বাড়ি গেলাম ওমনি ঢং শুরু করে দিয়েছে। আজ আসুক এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো তুমি চিন্তা করো না মা। এখন তুমি দু প্যাকেট খাবার গরম করে ফেলো, বাকিগুলো তুলে রাখো। আমি জামা-কাপড়গুলো রেখে আসি।”
কথাগুলো বলে নন্দিনী তো চলে গেলো কিন্তু তার কথা শুনে ফাতেমা বেগমের মুখ ভার হয়ে গেলো। এই গরমে আবারো রান্নাঘরে যেতে হবে ভাবতেই ওনার কপাল চাপড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
.
.
আজও ওবাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে তৃধা। চুপচাপ ঘুমন্ত মেয়েকে বিছানায় রেখে জামা-কাপড় পরিবর্তন করতে চলে গেলো। বেরিয়ে এসে দেখলো টেবিলে হরেক রকমের খাবার সাজাচ্ছেন ফাতেমা বেগম। সে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে এতো খাবার কোথা থেকে এলো৷ হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে রান্নাঘরে থাকা ময়লার বালতির দিকে তাকিয়ে দেখো বেশ কয়েকটা প্যাকেট সেখানে রাখা।
” এভাবে খাবারের দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থেকে তাতে নজর দিচ্ছো কেন? অবশ্য দেবে নাই বা কেন? কোনদিন এসবের স্বাদ গ্রহণ করেছো? তোমার বাপ-দাদা এজন্মে কোনদিন এসব তোমার মুখে তুলে দিতে পেরেছে?”
আচমকা পেছন থেকে এধরণের কথা শুনে চমকে উঠলো তৃধা। নন্দিনীর অনাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বরে বসে অবাক হলো।
” যেভাবে বললেন যেন আপনার বাবা কোন রাজামহারাজা ছিলেন আর আমার বাবা ছিলেন ওনার প্রজা? আমাদের স্ট্যাটাস বলতে গেলে কিন্তু একই। এমন না যে আপনারা অনেক বড়লোকে, একশ কোটি টাকার মালিক আপনারা। আমরা যেমন মধ্যবিত্ত, কষ্ট করে কামাই করে খাই আপনারাও ঠিক সেই ধাঁচের। তাই মিছে মিছে আমার সামনে এসব বড়লোকি দেখানো এবার বন্ধ করুন।”
তৃধার কথা শুনে নন্দিনী তেঁতে গেলো তবে কিছু বলতে না পেরে চুপ করে থাকতে বাধ্য হলো।
বড় বোনকে দেখে পেয়ে তেজবীন বা তিথির মধ্যে কোন বিশেষ অনুভূতি দেখা গেলোনা। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, এমন তো না যে সে বছরে ছয়মাসে একবার ঘুরতে আসে।
” এগুলো তুমি এনেছো?”
” আমি না আনলে আর কেই-বা আনবে বাবু? তোর বউ তো আমার মাকে না খাইয়ে খাটিয়ে মারার প্লান করছে। আমি মেয়ে হয়ে কি করে তা মেনে নি? তোর জামাইবাবু এসব শুনে এতোসব খাবার পাঠিয়ে।”
” এসবের কোন দরকার ছিলো না আপু। মা তোমার খেতে ইচ্ছে হলে আমাকে বলতে, আপুকে কেন বললে?”
” বলেছি তো কি হয়েছে? তুই তো আমার কষ্ট চোখে দেখছিস না। এতোদিন আমি গরমে থেকে থেকে তিনবেলা রান্না করছি, ঘরের কাজ করছি কই একবারো তো তোর বউকে কিছু বললিনা। আমি ভালো বলে তোর বউ এখনো জ্যা’ন্ত আছে। আমাদের সময় এতো তেজ দেখালে আমার শাশুড়ী হাত-পা ভে’ঙে রেখে দিতো। তোর বাপ তো তার মায়ের কথা ছাড়া একপাও চলতো না কিন্তু আমার কি আর সে কপাল আছে।”
” মা তোমার নিজের সংসার জীবন সুখী ছিলো না বলে কি তুমি অন্যের সংসারে নজর দেবে! তুমি যেভাবে বলছো তোমার জানা আছে একটা মেয়ের সাথে এরকম হলে তার কিধরণের অনুভূতি হয় সেখানে তুমিই কিনা এসব বলছো? তোমার আচার-ব্যবহারে আমি না মাঝে মাঝে অনেক অবাক হই।” তিথি বললো।
” চুপ করতো তোরা। এনেছি চুপচাপ খেয়ে নিবি, খেতে ইচ্ছে না করলে চলে যা। এতো কথা বলা আমার পছন্দ না।”
বড় বোনের ধমকে তিথি চুপ হয়ে গেলো, তেজবীনও পরবর্তীতে কিছু বলতে পারলোনা। খাবার শেষ তারা দু’জনেই খেয়াল করলো সব খাবার শেষ। তাে দেখে তেজবীন কিছু না বললেও তিথি নিচু করে বললো,
” সব খাবারই শেষ করে ফেলেছো?”
” কেন? তোর পেট ভরেনি নাকি? আজ হঠাৎ এতো খিদে পেলো কেন?”
” আমার খাওয়া শেষ, আমি ভাবীর জন্য বলছিলাম।”
তিথির কথা শেষ হওয়া বাকি তবে নন্দিনীর বাজে ব্যবহার করতে দেরি নেই।
” অসভ্য মেয়ে আমার আনা খাবার খেয়ে এখন আবার ওই শা*লীর জন্য পরাণ পুড়তেছে। এতো বেশি পরাণ পুড়লে ওই বেডির কাছে গিয়ে ম’র। ফকিন্নির জন্য এতো দরদ কেন তোর? তোরেও কি ব’শ করে ফেলেছে নাকি? শোন বেশি দরদী দেখাতে যাস না, না হলে লা’ত্থি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেবো নয়তো কোন ফকির-মিসকিন এর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
বড় বোনের মুখে এধরণের জ’ঘন্য কথা শুনে লজ্জা এবং অপমানে তিথির চোখে পানি জমে গেলো। তিথির জানতো বড় বোন মায়ের সমান, বড় বোন মানে আরেকটা ভরসার স্থান কিন্তু নন্দিনীর মধ্যে এসবের কোন কিছুই তিথি কখনো দেখতে পাইনি। যা পেয়েছে তা শুধুই নিজস্বার্থ।
” শোন তেজবীন তোর বউকে বল এসব রংতামাশা না করতে৷ এতোবছর পর বাচ্চা পেটে ধরতে পেরেছে কিন্তু তাও মনমতো কোন ফল দিতে পারেনি৷ তোর বউকে বল চুপচাপ চাকরি ছেড়ে ঘরের কাজ করতে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাত-পা ভেঙে আমিই ওকে বাড়িতে ফেলে রাখবো। ও এখনো বুঝতে পারেনি নন্দিনী কি জিনিস।”
” কিন্তু আপু……”
” চুপ। তোর বউকে বলবি কালকেই চাকরি ছেড়ে দিতে না হলে ওকে আর ওর মেয়েকে বাড়ি থেকে লা’ত্থি মেরে বের করে দিবো। সংসার করার শখ জন্মের মতো ঘুছিয়ে দেবো। তখন সারাজীবন বাপের বাড়িতে পড়ে থেকে মানুষের ঝাঁটা-জুতা খাবে। তোর বউ মেনে নিলে তো ভালোই না হলে তোমাদের ডির্ভোস করিয়ে আমি আবার তোর বিয়ে দিবো।”
নন্দিনীর শেষোক্ত কথা শুনে তিথি এবং তেজবীনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। অবিশ্বাস্য চোখে দু’জনে নন্দিনীর মুখপানে তাকিয়ে আছে। তবে ফাতেমা বেগম সবসময়ের মতো মেয়ের কথাতেই সহমত পোষণ করলেন।
চলবে……….