বইছে আবার চৈতী হাওয়া
চতুর্থ পর্ব
৭
-পাস করে কি করবে কিছু ঠিক করেছ ?
আশিক ভাতের গ্রাস মুখে তুলে ,কাঁচা মরিচে আলতো করে একটা কামড় দিল I তারপর হালকা গলায় বলল
– এখনও সেরকম কিছু ঠিক করিনি I
ছেলের ভাবলেশহীন আচরণ দেখে আরিফ সাহেব প্রচন্ড বিরক্ত হলেন I ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর মনে মনে আশা করেছিলেন ,হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওর পরিবর্তন হবে I হয়তো জীবনের প্রতি সিরিয়াসনেস বাড়বেI কবিতার ভূত মাথা থেকে নামবে I কিন্তু আদতে সেটা হয়নি I আশিকের পড়াশোনায় মন নেই I রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় I মদ গাঁজা ও খায় বোধ হয় I রাত করে বাড়ি ফেরে আজকাল I উনি গলাখাকারি দিয়ে আবার কথা শুরু করলেন
– চাকরি করতে চাও না ব্যবসা ?
– আপাতত কিছুই করতে চাই না I পরীক্ষা শেষ করে একটু ব্রেক নিব I কয়েক জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে I
– ব্রেক এর উপরেই তো আছে I পড়াশোনা আর করলে কখন ? তা কোথায় যাবে ঠিক করেছ ?
– কলকাতা ,শিলিগুড়ি, ঝাড়গ্রাম, ডুয়ার্সের জঙ্গল I আমার প্রিয় উপন্যাসের কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখব Iএই আর কি I
– সব জায়গাই ইন্ডিয়াতে দেখছি I
– সেরকম কিছু না I দেশের গুলো সব দেখে শেষ করে ফেলেছিI আর এরচেয়ে দূরে কোথাও যাবার মত টাকা এখনো জোগাড় করে উঠতে পারিনি I
– তা এই ইন্ডিয়া ট্যুর এর টাকা কোথায় পাবে ?
আরিফ সাহেব বলতে চাচ্ছিলেন যে পরীক্ষার পর আর এক পয়সাও হাত-খরচ তোমাকে দেয়া হবে না I কিন্তু সেটার আর সুযোগ পেলেন না I তার আগেই আশিক বলল
– টিউশনির কিছু জমানো টাকা আছে I আপাতত তাই দিয়ে চলে যাবে I খুব লাক্সারিয়াস ট্যুর হবে না I তবে মোটামুটি হয়ে যাবে I
আরিফ সাহেব মোটামুটি ধাক্কার মতন খেলেন I আশিক টিউশনি করে এই খবর তার জানা ছিল না I প্রতিমাসে উনি পাঁচ হাজার টাকা আশিকের একাউন্টে পাঠান তার হাত-খরচ বাবদ I সেদিন ম্যানেজার সাহেব বলছিলেন ওর অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো ট্রানজাকশন হয়না I তারমানে ও টিউশনি করে চলে ? এটা কি এক ধরনের প্রতিবাদ নাকি প্রতিশোধ ? কিংবা এমনও হতে পারে এক ধরনের তাচ্ছিল্য বা অবহেলা I বিগত বছরগুলোতে আশিকের সঙ্গে উনার দূরত্ব দিনকে দিন বেড়েছে I বিশেষত আশিয়া মারা যাবার পর I আগে ও যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সেরকম কিছু নয় I উনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন I ছেলেটার জগত ছিল মাকে নিয়ে I বাবা-মায়ের সম্পর্কের না টানাপোড়েনটা ও দেখেছে I আফসিন তখন অনেক ছোট ছিল I ওর হয়তো সেরকম করে কিছু মনে নেই I আশিয়া মারা যাবার পর তিনি আফসিনকে বুকে টেনে নিয়েছেন I দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা ভাবেননি I কিন্তু ছেলেটাকে আর কাছে টেনে নিতে পারেননি I একটা অদৃশ্য দেয়াল দুজনের মধ্যে থেকেই গেছে I এবং দিনকে দিন সেটা আর ও পুরু হয়েছে I
শুধুমাত্র আশিকের কথা ভেবে উনি একটা নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন I আশিক ভ্রমণপ্রিয় , সৃজনশীল ধরনের ছেলে I তাই ওর কথা মাথায় রেখে একটা ডিজাইন হাউস আর গিফট আইটেমের ব্যবসা শুরু করেছেন I পল্টনে একটা অফিস ও দেখে রেখেছেন I অনেকদিন ধরে ভেবে রেখেছিলেন একটু আয়োজন করে ছেলের সঙ্গে কিছুটা ভালো সময় কাটাবেন I সেই সময় তাকে এই সুসংবাদটা দেবেন I আজ আশিক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসায় , একসঙ্গে খেতে বসতে বলেছিলেন I আশিক একটু অবাক হলেও মানা করেনি I ভেবেছিলেন খেতে খেতে ছেলেকে সারপ্রাইজ দেবেন ,নতুন অফিসের কথা বলে I কিন্তু এখন ওর ভাবলেশহীন আচরণ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে I
বলবেন না বলবেন না করেও আরিফ সাহেব বলে ফেললেন I
তোমার জন্য একটা ডিজাইন হাউস করেছিলাম Iভেবেছিলাম পাস করে তুমি সেখানে বসবে I
ডিজাইন হাউস ?
আশিক প্রথমে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তারপর হেসে ফেলল I হাসতে হাসতেই বললো
আমার জন্য আপনাকে কিছু করতে হবে না I আমি আমার একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেব I
আরিফ সাহেবের রাগ করা উচিত I অপমানিত হওয়া উচিত I কিন্তু কিছুতেই পারছেন না Iছেলের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে সব রাগ অভিমান কোথায় উড়ে যাচ্ছে I ছেলেটা এত সুন্দর করে হাসে I ঠিক ওর মায়ের মতন I আশিয়া কে কোনদিন এই কথাটা বলাই হয়নি I কেন যে মানুষ বেঁচে থাকতে মনের কথাগুলো বলা হয়না I
৮.
মীরার মন খারাপ ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না I বিকেলের দিকে মনে হল একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা দরকার I এভাবে মন খারাপ আঁকড়ে ধরে বসে থাকার কোন মানে হয়না I সামনেই বিজয় দিবস I লাল সবুজ বেইজ করে কিছু গয়না বানানো যেতে পারে I কোন একটা দোকানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে ভাল হত I রুমে কেউ না এলে, কাউকে দেখানো যায়না আইটেমগুলো I মাঝে মাঝে পরিচিতজনদের ছবি তুলে পাঠায় I অনেকদিন ধরে একটা ফেসবুক পেজ খুলবে ঠিক করেছে Iকিন্তু ঠিক হয়ে উঠছে না I
মিরা তৈরি হয়ে নিউ মার্কেটে চলে গেল I আজ ছুটির দিন বলে সবাই ব্যস্ত I সঙ্গে নেবার মতো কাউকেই পেল না I অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে লাল সবুজ কাঠের পুতি টারসেল , লকেট কিনলো I কেনাকাটা শেষ করে ভাবল কোথাও বসে এক কাপ চা খাবে I কিন্তু তার আগেই অঘটনটা ঘটল I দোকান থেকে বের হবার সময় একটা লোক ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরে বসলো I ঘটনাটা ঘটলো অত্যন্ত দ্রুত I কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল I মেজাজ খারাপ হওয়া উচিত কিন্তু কেন যেন মীরার চোখে পানি এসে গেল I এটা যে ওর সঙ্গে প্রথম হল তা নয় I এর আগেও হয়েছে I একদিনতো শুভ সঙ্গে থাকা অবস্থাতেই হলো I মিরা কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করেছিল এবং আশ্চর্যের বিষয় শুভ ঠিক একই আচরণ করেছিল I এই লোক গুলো বোধহয় জানে যে কোন মেয়ের সঙ্গে এরকম করা যাবে I কারা প্রতিবাদ করবে না I
সিঁড়ি দিয়ে নেমে মীরা চোখ মুছলো I চা খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে I মীরা হলে যাবার জন্য রিকশা খুঁজতে লাগল I ঠিক তখনই শুভর ফোনটা এলো I ফোনটা আসাতে হঠাৎ কেন জানি খুব ভালো লাগলো মীরার I
তুমি কোথায় মীরা ?
নিউমার্কেটে
আমাকে বললে না কেন ? আমিও আসতাম
তুমিতো শুক্রবারে বের হও না I তাই আর ফোন করিনি
ও আচ্ছা I শোনো, তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার জন্য ফোন করেছি
কি বলো
মীরা ভেবেছিল শুভ হয়তো ওদের আগামী পাঁচ বছরের প্ল্যান নিয়ে কিছু বলবে কিন্তু সে কথা ওর মনেই নেই I ও বলল
নবীন বরণের স্টেজ ডেকোরেশন এর জন্য আশিক কাউকে খুজছে I ক্রিয়েটিভ কিছু করতে যাচ্ছে i তুমি কি একটু হেল্প করতে পারবে ?
মিরা একটু অবাক হলো I সাধারণত ওর ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক এর ব্যাপারে শুভ কখনো কোনো আগ্রহ দেখায়নি I স্কুলে কলেজে থাকতে মিরা সব সময়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্টেজ ডেকোরেশন করেছে I বাড়িতে থাকতে, কারো গায়ে হলুদ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলেও সবসময় ওরই ডাক পড়তো I বরাবরই মীরা আগ্রহ নিয়ে এই কাজগুলো করে I শুভ হয়তো ওর মন ভালো করার জন্য এটা করেছে , এই ভেবে মীরা একটু খুশি হয়ে গেল I কিন্তু পরমুহুর্তেই হতাশ হলো I শুভ বললো
– আসলে ওদের বাজেট খুব কম I ডেকোরেটর হায়ার করতে পারছে না I
মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
– কখন যেতে হবে ?
– কাল কথা বলে নিও I তোমার ক্লাস শেষে ফোর্থ ইয়ারের রুমে চলে এসো I
– আচ্ছা
– ঠিক আছে রাখছি তাহলে
৯.
আশিককে ফার্স্ট ইয়ার থেকেই চেনে মীরা I ডিপার্টমেন্টের যে কোন অনুষ্ঠানে ওর অংশগ্রহণ সক্রিয় Iএর আগে অনেকবারই দেখছে ,কিন্তু কখনোই কথা হয়নি I শুভ বললো
-আশিক , নবীন বরণের স্টেজ সাজানোর জন্য তুই কাউকে খুঁজছিলি না ? ও এই কাজগুলো খুব ভালো পারে I ওর সঙ্গে পরিচয় আছে ?
আশিককে আগেও দেখেছে মীরা I আজ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো I লম্বা ,শ্যামলা মতন একটা ছেলে I মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল, পরিশ্রমী চেহারা I হাসিটা খুব অমায়িক I আশিক অপরাধী মুখ করে বলল
নাম ভুলে গেছি, দুর্বল মেধা
স্মরণে রেখেছি মুখ;
কাল রজনীতে চিনিব তোমায়
আপাতত স্মৃতিভুক ।
-তোর গার্লফ্রেন্ড না ?
– হ্যাঁ i শুভ মাথা নেড়ে বলল
-ভাইয়া ,আমার নাম মীরা
-পারবে তুমি ,আপু , কাজটা করতে ?
-পারবো ভাইয়া I আমি আগে করেছি
-তাহলে তো ভালোই হলো
-কি ধরনের থিম করতে চান ভাইয়া ?
-এখনো পুরোটা ফাইনাল করিনি I কালকে বিকালে বসো আমাদের সঙ্গে I তোমাকে লেআউট দিয়ে দেব I আর তোমার কি কি ম্যাটেরিয়াল লাগবে আমাকে জানিয়ে দিও I তবে আগেই বলে রাখছি আমাদের বাজেট খুবই কম I অবশ্য কম বললে ভুল হবে I ডেকোরেশন এর জন্য কোন বাজেট নেই I শুধুমাত্র স্টেজ তৈরি করার জন্য যেটুকু লাগবে , তাই দেয়া হয়েছে I
– সমস্যা নেই I হয়ে যাবে I কালকে কখন আসবো ভাইয়া ?
– তোমার ক্লাসের পরে আসো I আমরা সাধারণত টিএসসিতে বসি I
– জি আচ্ছা
মিরা বিদায় নিয়ে চলে গেল I
রাসেল রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল
– আরে মামু ,এইবার তো নবীন বরণ এর আগে থেকেই তোমার আশেপাশে সুন্দরী মাইয়ারা ঘুরতাছে I
কথা অবশ্য মিথ্যা নয় I প্রতি বছর নবীন বরণের পর কিছু মেয়ে আশিকের প্রেমে পড়ে I ওর সাবলীল উপস্থাপনা ,সুন্দর কণ্ঠস্বর , আর আন্তরিক ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করে I আশিক অবশ্য বিশেষ পাত্তা দেয় না I এসব পিচ্চি মেয়েদের চোখে ঘোর থাকে I দুদিন পরেই সে ঘোর কেটে যায় I
কথা শুনে ও বিরক্ত গলায় বলল
– আরে ধুর I এটাতো শুভর গার্লফ্রেন্ড
– শুভর ভাই রাম কপাল I এমন একটা মাল পাইছে I যেমন চেহারা তেমন ফিগার
– চুপ থাক I ফালতু কথা বন্ধ কর I আশিক ধমকের সুরে বলল
– চেতস্ কেন্ I তোর গার্লফ্রেন্ডরে তো আর কই নাই
– আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এই কথা বললে ,আমি তোর মুখ ভেঙ্গে দিতাম
রাসেল একটু চামকালো I কিন্তু কিছু বললো না I আশিক ওই রকমই I দিয়াশলাই এর মত I এমনিতে ঠিকই থাকে ,হঠাৎ করেই দপ করে জ্বলে ওঠে I বিশেষত মেয়েদের ব্যাপারে কোন ধরনের বাজে কথা ও একেবারেই সহ্য করতে পারে না I রাসেল পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল
– মাফ চাই দোস্ত I তোরে মামু কই তোর গার্লফ্রেন্ডরে মা কমু I খুশি তো ?
আশিক কিছু বলল না I তবে ওর মাথা গরম ভাবটা আজকে কেন যেন দূর হলো না I
চলবে……….