বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩৬.

0
230

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৬.

আশিক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষটাকে কেমন অচেনা লাগছে। এই ঝকঝকে আলোতে মীরাকে মনে হচ্ছে অন্য কেউ। আশিক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। লজ্জা, অপমান সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল ওর বিস্ময়, এবং কয়েক মুহূর্তেই সেটা পরিণত হলো তীব্র অভিমানে।

আশিক একটা কথাও বলল না। কোন কৈফিয়ত দিল না। কোন কিছু জানতেও চাইল না। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

মীরার সমস্ত শরীর কাঁপছে। চোখ ছল ছল করছে। ও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। সমস্ত শরীর মন তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে আছে। আশিকের অন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটা ও দেখল। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নাটা হঠাৎ করেই বেরিয়ে এল। মিরা দুই হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদলো। আশিকের এই সত্যটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিছুতেই না। এতটা কষ্ট তো ওর তখনও হয়নি যখন শুভ ওকে সন্দেহ করেছে। ওর সঙ্গে এত কুৎসিত আচরণ করেছে। মুখোশ খুলে যাওয়া শুভর বীভৎস চেহারাটা দেখেও অবাক হয়নি ও। আশ্চর্যজনকভাবে সেরকম কষ্টও পায়নি। কিন্তু আশিক এমনটা করতে পারে এটা ওর বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই আশিক? যাকে কিনা ও এতটা বিশ্বাস করে, এতটা শ্রদ্ধা করে? মীরা বিশ্বাস করতে পারছে না। মনের একটা অংশ বলছে আশিক এমনটা করতে পারে না। আর মস্তিষ্কের একটা অংশ বলছে এটাই যৌক্তিক।

মীরা সারারাত ছটফট করল। কিছুতেই ঘুমাতে পারলো না। কান পেতে রইলো কিন্তু পাশের ঘর থেকে কোন শব্দ এলো না। হালকা একটা আলোর রেখা দরজার নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে। ব্যাস অতটুকুই। শেষ রাতের দিকে একটু ঝিমুনীর মতন এলো। মিরা বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সারা ঘর আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ভার হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে মীরা বিছানার উপর উঠে বসলো। চট করে কিছু বুঝতে পারল না। হঠাৎ খেয়াল হলে পাশে তাকিয়ে দেখল লাইব্রেরির দরজাটা খোলা। বিছানা থেকে নেমে উকি দিয়ে দেখলো ঘরে কেউ নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে দশটা বাজে। কি সর্বনাশ! এত বেলা পর্যন্ত ও ঘুমিয়ে আছে? মীরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। বাড়িটা একদম নিরব, শুধু রান্নাঘর থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসছে।

মীরা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, রোজিনা দুপুরের রান্না বসিয়েছে। মীরাকে দেখে একগাল হেসে বলল
– গুড মর্নিং ভাবি। নাস্তা দেই?
মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-বাকিরা কোথায়?
– আপামনির জরুরী পরীক্ষা আছে তাই ভার্সিটি গেছে। আর খালুজান একটু আগে কোর্টে গেলেন।
মীরা অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল
– আর তোমার ভাইয়া?
– ভাইজান তো সেই সকালেই বাইর হয়ে গেছে। আপনারে নাস্তায় কি দিব?
– সবাই যা খেয়েছে তাই দাও।
– এইখানে সবাই ভিন্ন ভিন্ন জিনিস খায়। আপনি কি খাইবেন বলেন, বানায়া দেই।
– ভিন্ন ভিন্ন মানে?
– আপা দুধ সিরিয়াল খায়। খালুজান পরোটা ভাজি। ভাইজানের ঠিক নাই। কোনদিন খায়, কোন দিন সময় না থাকলে না খাইয়াই বাইর হইয়া যায়।
মীরার অস্বস্তি আরো বাড়ল। ও আস্তে আস্তে বলল
– আজকে কি খেয়ে গেছে?
– না, কিছু বইলাও যায়নি।

মীরার কিছুই ভালো লাগছে না। কিন্তু খিদেও পেয়েছে। কাল কখন খেয়েছিল মনে নেই। রাতে অবশ্য ওরা জানতে চেয়েছিল কিছু খাবে কিনা। মীরার খুব লজ্জা লাগছিল, তাই মানা করে দিয়েছে। মিরা টেবিলে বসে গ্লাসে পানি ঢাললো। রোজিনা কাছে এসে বলল
-পরোটা ভাজি দেই?
– দাও
প্রচন্ড খিদে নিয়েও মিরা বিশেষ একটা খেতে পারল না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে বারবার গলার কাছটায়। মীরা চা নিয়ে উপরে চলে গেল। হলে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। কালকে আশিকের সঙ্গে যে ব্যবহার করছে তাতে ওর সঙ্গে চোখ মেলাতে ইচ্ছে করছে না। যা শুনেছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে ওর সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। মীরা ঘরে এসে বিছানা পত্র গুছিয়ে রাখল। তারপর আস্তে আস্তে লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেল। এত সুন্দর ঘর ও আগে কখনো দেখেনি। বোঝা যাচ্ছে যে এটা তৈরি করেছে তার রুচিবোধ এবং সৃজনশীলতা যথেষ্ট উন্নত। দেয়াল জোড়া বইয়ের তাক। একপাশে বড় জানালা তার গা ঘেসে একটা বড় ইজি চেয়ার। তার ঠিক পাশেই একটা ছোট্ট টি টেবিল। মিরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল আশিক বোধহয় রাতে এই চেয়ারটাতেই ঘুমিয়েছে। টি টেবিলের উপর একটা নোটপ্যাড রাখা। পাশে একটা কলম পড়ে আছে। কিছু কি লেখা নোটপ্যাডের মধ্যে? এটা কি কাল রাতে লিখেছে আশিক? মীরা নোটপ্যাডটা তুলে নিল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা

“ আঁধারের কাছে নতজানু আমি
শঙ্কিত আজি আলোতে
তিমিরে আমার, ভয় নাই আর
বিব্রত আমি আলোতে”

মীরা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল লেখাটার দিকে। ওর চোখ ভিজে উঠছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে ও কোনমতে কান্নাটা আটকালো।

চলবে…..

আজকের কবিতাটা আশিকের মানে আমারই লেখা। এই পর্বটা অনেক ছোট হয়েছে। কালকে আরেকটা পর্ব দেয়ার চেষ্টা করব। বইমেলার শেষ দিন সবার কেমন কাটলো জানাবেন। যারা যারা বই হাতে পেয়েছেন অবশ্যই ছবি দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here