বইছে আবার চৈতি হাওয়া ৩৭.

0
334

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৭.

আরিফ সাহেব রাতের খাবার খেতে বসে মীরার খোঁজ খবর নিলেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন আশিক বাড়ি ফেরেনি। খাবার টেবিলে বসেই উনি আশিককে ফোন করলেন ও স্বাভাবিকভাবেই কথা বলল। জানালো অনুষ্ঠানের আর কয়েকদিন বাকি আছে এবং কাজের অনেক চাপ, এমতবস্থায় কারো উপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। আরিফ সাহেব কথা বাড়ালেন না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মিরাকে ডেকে পাঠালেন।

মীরা ওড়নার আচল মাথায় তুলে দিয়ে আরিফ সাহেবের ঘরের এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফ সাহেব ওকে দেখে হেসে ফেললেন। তারপর বললেন
– তুমি এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন মা? আমার কাছে আফসিন যেমন, তুমিও তেমনি
– জী বাবা
– আলহামদুলিল্লাহ! এই যে তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকলে, আমাকে বাবাই ভাববে তাহলে আর এত অস্বস্তি বোধ করবে না। আমি জানি তোমার এবং আশিকের বিয়েটা কিরকম পরিস্থিতিতে হয়েছে। তবু তোমাকে একটা কথা বলব। তোমাদের মধ্যে যত কিছুই হোক, বাড়ির বাইরে যেন ছেলেটা রাত না কাটায় এটুকু লক্ষ্য রেখো। মিরা আবারও বলল
-জী বাবা
-ঠিক আছে তুমি যাও
– বাবা একটা কথা বলার ছিল
– হ্যাঁ বলো
– আমি কি আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করতে পারি?
আরিফ সাহেব আবারো হাসলেন। তারপর বললেন
– কেন পারবেনা? তোমাকে তো কেউ পড়াশোনা বন্ধ করতে বলেনি।
– থ্যাংক ইউ বাবা
– ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম

মীরা অনেক রাত পর্যন্ত আশিকের জন্য অপেক্ষা করল, তারপর একটা সময় বুঝতে পারল ও ফিরবে না। মীরা দরজা বন্ধ না করেই ঘুমালো, যেন আশিক ফিরলে ঘরে ঢুকতে পারে। কোন সমস্যা না হয়।

মীরার ঘুম ভাঙলো অনেক সকালে। সারা ঘর বারান্দা খুঁজে ও বুঝতে পারলে আশিক রাতে ফিরেনি। আজ রবিবার সকাল আটটায় ক্লাস আছে। তৈরি হয়ে বের হতে গিয়ে দেখল আফসিন টেবিলে বসে নাস্তা করছে। মীরাকে দেখে বলল
– ভাবী তুমি এত সকালে কই যাও?
– ক্লাসে যাই
– কয়টায় ক্লাস তোমার?
– আটটায়
– আমারও আটটায় ক্লাস। তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে নাও তারপর একসঙ্গে যাই।
– মীরা আপত্তি করলো না, খেতে বসে গেল। যদিও এত সকালে ওর কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। কেমন বমি বমি পায়। রোজিনা জিজ্ঞেস করার পরও তেমন কিছু খেলো না, শুধু একটা কলা নিল, তারপর বলল
-আমি এত সকালে খেতে পারি না। বাড়ি ফিরে খাবো। দুপুরের আগেই চলে আসব। বাবা জিজ্ঞেস করলে বলো।

মীরা বেশ সাধারণ পোশাকেই ক্লাসে এসেছে। ওদের বিয়ের ব্যাপারটা কতজন জানে ওর ধারণা নেই। ক্লাসে ঢুকে ও কারো দিকে তাকালো না, এক পাশে বসে পড়লো। ক্লাস শুরু হবার কিছুক্ষণ পর টুম্পা এসে বসলো ওর পাশে। ক্লাসের মধ্যেই একটা খোঁচা দিয়ে বললো
-কিরে ভালোই তো আছিস।
মীরা জবাব দিল না। হাসলো একটু পাশে তাকিয়ে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে টুম্পার প্রসঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। মেয়েটা ভীষণ মজার। চোখে মুখে কথা বলে। কথার পিঠে কথা বলে ওকে হারানো মুশকিল। সাধারণত বোরিং ক্লাস হলে ওরা কাগজে লিখে লিখে কথা চালাচালি করে। মীরা পাশে তাকিয়ে দেখলো টুম্পা ওর খাতার মধ্যে লিখেছে
-তুই তো ট্রাম কার্ড পেয়ে গেলি রে। কেমন যাচ্ছে আশিক ভাইয়ের সঙ্গে?
মিরা একটু লাল হলো লজ্জায়। কিছু বলল না। কাগজে লিখলে
ফাজিল
টুম্পা আরো কি সব লিখছে। ওর মুখ হাসি হাসি। মীরা পাশে তাকিয়ে মনে করলো এই টুম্পাই ফাস্ট ইয়ারে থাকতে আশিকের প্রেমে পড়েছিল। সে কি উথাল পাথাল প্রেম। ক্লাস শুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছিল। তবে টুম্পা দমবার পাত্রী নয়। ক্লাসের দু একটা ছেলেকে দিয়ে আশিককে জানানোর চেষ্টা করেছিল।বিশেষ একটা লাভ হয়নি। আশিক তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এরপর টুম্পা একদিন ভয়ঙ্কর একটা কান্ড করেছিল।

ক্লাসের শেষে আশিক অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। চায়ের দোকানটা ডিপার্টমেন্টের পেছনেই। বেশ অনেকখানি খোলা জায়গা পেছনে সেখানেই ছোট একটা চায়ের দোকান। সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা। আশিক ওখানেই বসে ছিল চার পাঁচ জন বন্ধু নিয়ে। টুম্পা হঠাৎ ওখানে হাজির হয়ে বলল
– আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে আশিক ভাই
আশিক একটু অবাক হলো কিন্তু তেমন কিছু প্রকাশ করল না। আস্তে করে বলল
– বল
– আমি আপনাকে ভালোবাসি
আশিকের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। আশেপাশের ছেলে পেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওই করতে লাগলো। টুম্পা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশিক বলল
– আর কিছু বলবে?
– আপনি তো আমার কথার জবাব দিলেন না?
– তুমি তো কোন প্রশ্ন করনি যে আমি জবাব দেবো।
টুম্পার গলা কাঁপছে তবে ও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার মতন মেয়ে নয়। আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মীরা ওর একটা হাত ধরে বলল
– টুম্পা চল এখান থেকে
আশিক একটা হাত তুলে বলল
– ইটস ওকে। টুম্পা তুমি চা খাবে?
টুম্পা একটু সহজ হলো, তারপর বলল
– আমি চা খাই না
– কার্জন হলের সামনে নতুন আইসক্রিমের গাড়ি এসেছে। আইসক্রিম খাবে?
এবার টুম্পার মুখে হাসি ফুটল। বলল
– চলেন
আশেপাশের ছেলেগুলো তখনও মুখ চাওয়াচারি করছে। আশিক উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে দোকানীকে টাকা দিয়ে বললো
– রেখে দাও, বাকিটা পরে হিসাব করে নেব, তারপর টুম্পার কাছে গিয়ে বলল
-চলো
টুম্পা মীরার হাত ছেড়ে দিয়ে আশিকের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো।

সেদিন আশিক টুম্পাকে কি বলেছিল কেউ জানে না। তবে এরপর থেকে টুম্পার মাথা থেকে প্রেমের ভুত নেমে গিয়েছিল। অথচ দুজনের সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে দেখা হলেও আশিক হাসতে হাসতেই বলত
কি খবর টুম্পা, ভালো তো?
টুম্পাও হেসে জবাবে বলত
জি ভাইয়া
মীরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে। টুম্পা এড়িয়ে গেছে। বলেনি কিছু।

তিনটা ক্লাস পরপর হল, কোন গ্যাপ ছাড়াই। মীরা অন্য কারো সঙ্গে আর কথা বলল না। পুরোটা সময় টুম্পার সঙ্গেই থাকলো। শেষ ক্লাসের মাঝখানে মোবাইলে একটা মেসেজ এল আফসিনের কাছ থেকে। ও লিখেছে আর এক ঘন্টা পর ওর সব ক্লাস শেষ হয়ে যাবে। একসঙ্গে ফিরবে কিনা জানতে চাইল।
মীরা জবাবে লিখল একসঙ্গেই যাবে। ক্লাস শেষ করে আর দাঁড়ালো না মীরা। আফসিনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেল। গাড়িতে উঠে দেখলে টুম্পা মেসেজ পাঠিয়েছে।
– শালী! তুই কিছু না বলে চলে গেলি। তোরে হাতের কাছে পাই খালি।

প্রথম রাতের পর আফসিনের সঙ্গে আর কথা হয়নি। পুরো পথ জুড়ে বকবক করল মেয়েটা। আফসিন একটু আহ্লাদী ধরনের। বাবা আর ভাইয়ের খুব আদরের বোঝা যায়। অন্যদিকে মীরা বাড়ির বড় মেয়ে। ওর কাছে সহজেই প্রশ্রয় পেয়ে গেল। ফেরার পথে বলল
– চলো ভাবি আইসক্রিম খাই।
দুজনে আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।

ঘরে ঢুকেই মীরা বুঝতে পারল কেউ একজন ঘরে এসেছিল। যেমনটা সবকিছু রেখে গিয়েছিল সেই মতো আর কিছু নেই। অনেক পরিপাটি গোছানো। মীরার জামা কাপড়ের ব্যাগটা নেই। আলমারি খুলে দেখল আলমারির একটা পাশ খালি। সেখানে ওর ব্যগটা রাখা। মীরা অস্থির পায়ে আবারো পুরো ঘর বারান্দা খুঁজে দেখল। অশিককে কোথাও দেখা গেল না। মিরা ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এল। রোজিনাকে জিজ্ঞেস করল
তোমার ভাইয়া এসেছিল?
রোজিনা জানাল, আশিক এসেছিল গোসল করে ভাত খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। মীরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আশিকের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। এভাবে তো একসঙ্গে থাকা সম্ভব না। আশিক যদি চাইছে না ও এখানে থাকুক সেক্ষেত্রে ও হলে চলে যেতে পারে। ওর কারণে একজন নিজের ঘরেই আসতে পারছে না এই ব্যাপারটা ভালো দেখাচ্ছে না।

মীরা দুপুরেও ঠিকমতো খেতে পারলো না। কোনমতে একটু খাবার মুখে গুঁজে ঘরে চলে গেল। কিছু ভালো লাগছে না। সেদিন আশিকের উপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। ভেবেছিল ওকে দু চার কথা শোনালে হয়তো শান্তি পাবে, কিন্তু কিছুই হলো না। এত অস্থির লাগছ এখন। মীরা আস্তে আস্তে লাইব্রেরীর ভেতর ঢুকলো। এই ঘরটা এত বেশি সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়। মীরা আনমনে চেয়ারটায় বসে পাশে তাকিয়ে চমকে উঠল। নোটপ্যাড এর মধ্যে আরেকটা কবিতা দেখা। এটা কি আজকে লিখে রেখে গেছে ও ?

থাকুক তোমার দখিন হাওয়া
আমার থাকুক ঝড়
তোমার তরে তরুর ছায়া
আমার তেপান্তর

চলবে………..

আজকের কবিতাটা কবি নজরুলের লেখা । কবিতার নাম মনে নেই, কেউ যদি জানেন একটু জানাবেন প্লিজ ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here