বইছে আবার চৈতী হাওয়া ১২

0
237

১২.

অনুষ্ঠানের দিন প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। আয়োজকরা ভীষণ ব্যস্ত। আশিকের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। অনেক কাজ করতে হচ্ছে। মীরা ও ডেকরেসানের কেনাকাটা নিয়ে আছে। এসব ঝামেলায় বাড়িতে আর ফোন করার সুযোগ পায়নি, অবশ্য ইচ্ছে করেই করেনি। মাঝে একবার সৌরভকে ফোন করেছিল। ওর সঙ্গে কথা বলে মীরার আরো মন খারাপ হয়েছে। মায়ের সঙ্গে বড়চাচির তুলকালাম ঝগড়া হয়েছে। এক পর্যায়ে মা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা তুলল তখন বড় চাচা এসে কথা দিয়েছে যে, সৌরভের সঙ্গেই মীরার বিয়ে হবে। আর সবাই এই বাড়িতেই থাকবে। এর অন্যথা হবে না। এই কথা শোনার পর বড় চাচি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে।

শুভর সাথে ও টুকটাক কথা হয়েছে এর মধ্যে। শুভ আর এ প্রসঙ্গে কিছু জানতে চায়নি। মীরা ও ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি। বাড়ির ঝামেলা আর শুভর শীতল আচরণ, এই দুটোকে এড়ানোর জন্য মীরা নিজের মন প্রাণ ডুবিয়ে দিল অনুষ্ঠানের কাজে।

অনুষ্ঠানের আগের রাতে ছেলেরা ক্যাম্পাসেই ছিল। সারারাত ধরে ডেকোরেশনের কাজ করেছে। মিরা ভোরবেলা উপস্থিত হয়ে দেখল স্টেজের কাঠামো দাঁড় করানো হয়ে গেছে। দেরি না করে কাজে লেগে পরলো ও। প্রায় দু ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর স্টেজ থেকে নেমেএকটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল।নাহ! খুব একটা খারাপ হয়নি। মীরা নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। আশিক সহ অন্যান্যরা সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মীরা শেষ মুহূর্তের কিছু টুকিটাকি ফিনিশিং টাচ দিয়ে আশিকের কাছে এসে বলল
-ভাইয়া কাজ হয়ে গেছে। আমি এবার যাই, রেডি হয়ে আসি
-তুমি খেয়েছো কিছু?
-না হলে যেয়ে খাব
-খেয়ে যাও। সবার জন্যই খাবার আনা হয়েছে
-দেরি হয়ে যাবে
– তাহলে নিয়ে যাও
স্টেজের পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার ফিরে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলো আশিক। অবাক কন্ঠে বলল
-তুমি এটা কি করেছো মীরা?
-কেন ভালো হয়নি?
-ভালো? এতো অসাধারণ জিনিস হয়েছে। রীতিমতো মাস্টারপিস
মিরা একটু লজ্জা পেল। আশিক সেটা লক্ষ্য করলোনা। বলেই যেতে লাগল

-আমি তো তোমাকে নবীন কনসেপ্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু আউটকাম যে এত চমৎকার হবে ভাবতেই পারিনি। তাও এত কম বাজেটে

মীরা আরক্ত হলো। বলল
-আরেকটু সময় পেলে আরো আকয়েকটা জিনিস অ্যাড করতাম

-আর কিছু করার দরকার নেই। একেবারে পারফেক্ট হয়েছে। চলো তোমাকে রিক্সা করে দেই।

– লাগবে না। আমি চলে যাবো।
– আচ্ছা তাহলে খাবারটা নিয়ে যাও

মীরা আর কিছু বলল না। খাবার নিয়ে চলে গেল। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। মীরা হলে ফিরল সাড়ে আটটা নাগাদ। নবীন কন্সেপ্ট বলে সবাইকে সবুজ রঙের ড্রেস পরতে বলা হয়েছে। মীরা স্নান সেরে একটি সবুজ তাতের শাড়ি পরল। নিজের বানানো গয়না পরে ,হালকা করে সেজে ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

শুভর সঙ্গে কথা হয়নি বেশ কদিন। গতকাল ওর আই এল টি এস পরীক্ষা ছিল। সাধারণত পরিক্ষার আগে ফোন করলে ও বিরক্ত হয়। ইয়ার ফাইনালের সময় ও কখনো ফোন করে না। মীরাই মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজখবর নিত। এবার মিরা আর ফোন দেয় নি। ভেবেছিল হয়তো অনুষ্ঠান শুরু হলে আসবে, কিন্তু দুপুর পর্যন্ত শুভকে দেখা গেল না।

পুরো প্রগ্রাম খুব ভালো হয়েছে। চেয়ারম্যান স্যার আয়োজকদের প্রতি ভীষণ সন্তুষ্ট। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের স্টেজে ডেকে ধন্যবাদ জানানো হলো। মীরা ওখান থেকেই শুভকে দেখতে পেল অডিয়েন্সের মাঝামাঝি বসে থাকতে। স্টেজ থেকে নেমে ও আর শুভর কাছে গেল না। ফিরে যাবার জন্য গোছগাছ করতে লাগলো। তারপর সব গুছিয়ে আশিকের কাছে গিয়ে বলল
-ভাইয়া আমি আজকে আসি
– এখনি চলে যাবে?
– আর কোন কাজ আছে?
-না কাজ নেই। এখন তো সেলিব্রেশন হবে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মীরা। তুমি না থাকলে এত সুন্দর করে কাজটা শেষ করা যেত না।

মীরা জবাব দিলো না, ওর ফোনে একটা টেক্সট এসেছে। মীরা ফোন বের করে দেখলো। শুভ মেসেজ পাঠিয়েছে। লিখেছে
প্রোগ্রাম নিয়ে এতই ব্যস্ত যে আমাকে দেখতে পাও না
মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। ও নিজেই যোগাযোগ করছে না উল্টো এখন মীরাকে শোনাচ্ছে। মীরা মেসেজ সিন করে রেখে দিলো, রিপ্লাই দিলো না। আশিক কে বলল
-আসি ভাইয়া
তারপর আর দাঁড়ালো না। মীরাকে গেটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে শুভ দৌড়ে এসে ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল
-কি ব্যাপার মেসেজ করলাম রিপ্লাই করলে না যে?
মীরার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, তবুও দাড়ালো, তারপর থেমে থেমে বললো
– গত তিন দিন তুমি আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করনি। আর এখন আমাকে শোনাচ্ছো। তোমার পরীক্ষা ছিল বলে আমি বিরক্ত করিনি।

মীরার কন্ঠের অভিমান শুভ টের পেল। নরম গলায় বলল
– আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে। আসলে এত টেনশনে ছিলাম। চলো কোথা বসি।
– আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি হলে যাব
– আচ্ছা তাহলে আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি

মীরা কিছু বলার সুযোগ পেল না ,তার আগেই দেখল রাসেল দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। এগিয়ে এসে হাপাতে হাপাতে বলল
– মীরা, শুভ তাড়াতাড়ি আয়। আশিক ডাকছে

আশিক যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ছোটখাটো একটা জটলা। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওরা এগিয়ে যেতেই আশিক বলল
– গাইজ, দুটো গুড নিউজ আছে

সবাই হই হই করে উঠলো। কারোই আর তর সইছে না। এতক্ষণ ধরে সবাই অপেক্ষা করেছিল। আশিক হাত তুলে বলল
প্রথমটা হচ্ছ চেয়ারম্যান সার এই প্রগ্রামের এক্সট্রা ফান্ড এলকেট করেছেন। কাজেই আমরা যে যা খরচ করেছি সেটা পেয়ে যাব। আর দিতীয়তা হল সামনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরো বৃহৎ পরিসরে একটা অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে। এবং আমাকে এই টিম নিয়েই কাজ করতে বলেছেন সার। তো, গাইজ আগে আমরা পাচ জনের টিম ছিলাম। আমি, রাসেল, সুমন, মারুফ, রিপন, আর এবার থেকে আমাদের নতুন টিম মেম্বার মীরাকে সবাই ওয়েলকাম কর।সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। হঠাৎ করেই মীরার মনে জমে থাকা কদিনের সমস্ত মেঘ কেটে গেল।মেঘ কেটে গেল ঠিকই তবে বর্ষন শুরু হল। মীরা টের পেল ওর চোখ ভিজে উঠছে। মনে হচ্ছে এই জিবনে এই প্রথম বার কেউ ওকে, ওর কাজকে মূল্যয়ন করছে।

ক্যাম্পাস জুড়ে শীতের সন্ধ্যা নেমেছে। একটু আগেও ডিপার্টমেন্টের পেছনের বারান্দায় হইচই আর উল্লাসে মেতে ছিল একদল ছেলে। সন্ধ্যা নামতে নামতে তারা যেন কেমন নেতিয়ে পড়েছে। অনেকেই উঠে গেছে শেষ বাসটা ধরবে বলে। এখনো গুটি কতক ছেলে আবছা অন্ধকারে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে।

সিগারেটটা হাত বদল করে চোখ মেলল আশিক। চোখের সামনে কুয়াশা না ধোয়া ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। কেমন রহস্যঘন লাগছে। বারান্দার সামনে একটা খোলা চত্বর। কয়েকটা কাঁঠালচাঁপা গাছ। মৃদু সুগন্ধ ভেসে আসছে।আশিক আবার চোখ বুজলো। চোখের সামনে একটা অস্পষ্ট অবয়ব ভেসে ওঠে। আজকাল চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ওকে। খোলা চুলের ওপর সোডিয়াম লাইটের সোনালী আভা আর ছিপছিপে গড়ন। চিনতে ভুল হয়না। সেদিন মীরাকে হলে পৌছে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। না, সে আসেনি। দেখতে পেলে ভালো হতো। মাথার মধ্যে এলোমেলো হয়ে ঘুরতে থাকা টুকরো টুকরো শব্দেগুলো কি করে যেন একে একে এসে জুড়ে যায়। কবিতার লাইনগুলো ফুটে উঠে। আশিক ইচ্ছা করেই খোজেনা ওকে। থাক। আড়ালেই থাক না। অনেকটা ওই কবিতার মতন

তোমাকে যখন দেখি, তার
চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না।
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয় সে এসেছে,
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি-
এলাচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো!
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি-
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি।
হেসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!

চলবে …..
আজকের কবিতাটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘তুমি যেখানেই যাও থেকে নেয়া হয়েছে।

মাঝে কিছু সমস্যার কারণে গল্পটা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এখন থেকে প্রতি দিন একটা করে পর্ব দেয়ার ইচ্ছা। কিন্তু আমার অভিমানী পাঠকরা সবাই কোথায় হারিয়ে গেল? একটু সুন্দর কমেন্ট না পেলে কি করে লেখার উৎসাহ পাব?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here