বইছে আবার চৈতী হাওয়া ১৭.

0
388

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৭.

মীরা হলে ফিরল অনেক রাত করে। ভেবেছিল রুমে গিয়ে দেখবে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল বৈশাখী ছাড়া সবাই জেগে আছে। মিরার রুমটা দোতালায়। ও ছাড়া আরও তিনজন থাকে এই রুমে। সেকেন্ড ইয়ার বলে এখনো সিঙ্গেল রুম পায়নি, তবু ভালো ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেতো কমনরুমে থাকতে হতো। এখন চারজন একসঙ্গে থাকে। ঘরের মধ্যে চারটা খাট। মিরার খাটটা জানালার পাশে। ঘরেই অ্যাটাচ বাথরুম, সামনে পেছনে টানা বারান্দা। বেশ লাগে মিরার। ওর সঙ্গে সয়েল সাইন্সের মারিয়া, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মহুয়া আর বৈশাখী থাকে। মহুয়া ঘুমাতে যাবার আয়োজন করছিল, ওকে দেখে বলল
-কেমন হলো তোদের প্রোগ্রাম?
-ভালো
-কি খেলি?
– চা
মারিয়া বিছানায় হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল। ওর দিকে না তাকিয়েই বলল
– তোকে কে পৌঁছে দিল? তোর বয়ফ্রেন্ড?
– না, সিনিয়ার একজন
– কে, আশিক ভাই?
মীরা একটু চমকালো। অবাক কন্ঠে বলল
-তুই কিভাবে চিনিস?
-তোদের ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে দেখেছিলাম। আমি অবশ্য আগে থেকেই চিনি।
মীরা এবার যথেষ্টই অবাক হলো। মুখে কিছু বলল না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মারিয়া কিছু বলছে না, হাসছে মিটিমিটি। মিরা একটু বিরক্ত হয়ে বলল
-বললি না কিভাবে চিনিস?
-আমি ওনার একজন ভক্ত। পেইজের ফলোয়ার।
মীরা এবার সত্যিকার অর্থেই অবাক হল। আশিক ভাইয়ের পেজ আছে? আশ্চর্য তো! ও জানতোই না। মীরা আর কথা বাড়ালো না। চেঞ্জ করতে চলে গেল।

শীতের রাত। তবু মীরা সময় নিয়ে স্নান করল। আজকের ঘটনাটার পর কেমন একটা গা ঘিন ঘিনে অনুভূতি হচ্ছিল। ছেলেগুলো কি কুৎসিত ভাষায়…। সে যাক। আশিক ভাইয়ের ব্যবহারে খুব অবাক হয়েছে মীরা। অবশ্য আশিক ভাইয়ের চেয়েও শুভর ব্যবহারে বেশি অবাক হয়েছে। ছেলেগুলোর সঙ্গে যখন আশিক ভাইয়ের হাতাহাতি চলছিল ঠিক সেই সময় শুভ মিরার কাছে এসে বলেছিল
– মিরা তুমি ওকে আটকাও না। তোমার জন্যই তো সব হচ্ছে।
মীরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ও কি করে আশিককে আটকাবে বুঝতে পারছিল না। তবু এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই আশিক ছেলেটাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। ছেলেগুলো যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেছে, দেখে নেবে বলে।

ওরা চলে যাবার পর পাশের কাঠের বেঞ্চিটাতে ধপ করে বসে পড়েছিল মীরা। কেন যেন আর নিতে পারছিল না। আশিকের একটু সময় লেগেছিল ধাতস্থ হতে , তারপর মীরার কাছে এসে বলেছিল
– সরি মীরা
মিরা অবাক হয়ে বলল
-আপনি কেন সরি বলছেন? বরং আমার আপনাদেরকে সরি বলা উচিত। আমি না আসলে এই ঝামেলাগুলো হত না।
আশিক একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল

-আসলে এটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। যে অন্যায় করে আমরা তার দোষটা দেখি না। সবাই, এমনকি ভিকটিম নিজেও তার দোষটাই খুঁজে বেড়ায়। এখানে তোমার কোন দোষ নেই।
বাকীরা কেউ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর আশিক নিজে থেকেই বলল
– আজকের প্রোগ্রামটা বরং থাক
শুভ অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলছিল না। আশিকের কথার প্রেক্ষিতে হঠাৎ করে কাছে এগিয়ে এসে বলল
– হ্যাঁ সেটাই ভালো। আমি তাহলে আজকে যাই। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। মীরা যতটা না অবাক হল, তার থেকেও বেশি অবাক হল দলের বাকিরা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই একটু থমকে গেল। সবার প্রথম কথা বলল রাসেল
– আমি বরং মিরাকে এগিয়ে দিয়ে আসি
– না তুই থাক। আমি যাচ্ছি
মীরা হাফ ছেড়ে বাচল। আশিক কথাটা বলায়। রাসেলের সঙ্গে যেতে ওর ভীষণ অস্বস্তি হতো। আশিক সিগারেট হাত বদল করে বলল
-মারুফ, তোরা দেখে শুনে আরেকটা ডেট ঠিক কর। চলো মিরা।
মীরা স্লথ পায়ে আগালো। ওর অবস্থা বুঝতে পেরে একটা রিক্সা নিয়ে নিল আশিক। টিএসসি থেকে রোকেয়া হল যেতে দু মিনিটও লাগার কথা নয়, তবু রিক্সা ধীর গতিতে আগাচ্ছে। বয়স্ক রিক্সাচালক বলে আশিক আর কিছু বলল না। রোকেয়া হল পার হওয়ার পর রিক্সাচালক জানতে চাইল কোন দিকে যাবে। আশিক কিছু বলার আগেই মীরা হুট করে বলল
– ডানদিকে যান
আশিক আর কিছু বলল না। ডানদিকে ফুলার রোড। আলো আধারির মধ্যে দিয়ে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। আশিকের ভীষণ সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু মীরা বসেছে ওর বাম পাশে। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গেলে অহেতুক গায়ে হাত লাগবে। আশিক সেটা চাইছে না। রিক্সা যখন প্রায় ফুলার রোডের শেষ মাথায়, মীরা হঠাৎ করে বলল
-আপনার কি সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে? আপনি খেতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।
আশিক একটু চমকালো। পরমুহূর্তেই মনে হল হয়তো শুভর সংগে এমন ভাবে রিক্সা করে যাওয়ার সময় এমনটা হয়। কিন্তু শুভ তো সিগারেট খায় না। যাইহোক এত কিছু ভাবার সময় নেই। আশিক সাবধানে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। রিকশা ততক্ষণে চানখারপুলে উঠেছে।
-চা খাবে মীরা? এখানে পুরনো ঢাকায় একটা বিখ্যাত চায়ের জায়গা আছে। আমরা মাঝে মাঝে যাই
-চলেন যাই
আশিক রিকশাওয়ালাকে বলল
-মামা, আগামাসি লেন দিয়া যান
চায়ের দোকানের সামনে এসে মীরা অবাক হয়ে গেল। ছোট একটা দোকান কিন্তু তার সামনে এত ভিড়! এই এত রাতের বেলাও লোকজন এত চা খায়? আশিক নামলো না। চা আর পুরি নিয়ে নিল, তারপর রিক্সা ঘুরাতে বলল। পথে টুকটাক কথা হলো, আহামরি কিছু না, তবু মীরার খুব ভালো লাগলো। মনের মধ্যে যে মেঘটা জমে ছিল, সেটা কেটে গেল। আসলে এটার খুব দরকার ছিল। কি অদ্ভুত ! এই জিনিসটা তো শুভও করতে পারতো। মিরাকে নামানোর আগে আশিক খুব অদ্ভুত একটা কথা বলল। খুব আস্তে আস্তে বলল
-শুভর উপর রাগ করোনা মীরা। ও খুব নরম টাইপের ছেলে। এসব ভায়োলেন্স ঠিক নিতে পারেনা

মীরার ভীষণ হাসি পেল। আশিক ভাই শুভকে ডিফেন্ড করছে। আশ্চর্য তো!

বাথরুম থেকে বের হয়ে মিরা দেখল সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রুমের লাইট নেভানো। কাউকে বিরক্ত না করে, গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে বারান্দায় চলে গেল ও। এখন একটু শীত পড়েছে। ভেজা চুলটা মুছে বারান্দার রেলিংয়ে তোয়ালেটা মেলতে মেলতে বাইরের দিকে তাকালো মিরা। আজ কুয়াশা নেই। আকাশ বেশ পরিষ্কার। মীরা বারান্দার মোড়ায় বসলো চুল ছড়িয়ে। ফেসবুক ওপেন করে আশিকের প্রোফাইলে ঢুকলো। এইতো প্রোফাইলেই পেজের লিংক দেয়া। আগে কখনো দেখা হয়নি তো। পেজে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেল। এত কবিতা? অথচ ও আগে দেখেনি। শেষ কবিতাটা পোস্ট করা হয়েছে তিন দিন আগে

তোমাকে দেখেছি পৌষের রাতে, আধো আলো আধো ছায়াতে
জানিনা কে তুমি, তবুও মোহিত করেছ তোমার মায়াতে
রাত ভোর হয়, আবার রাতের পোশাকে আধার নামে
তোমাকে দেখার বাসনা লুকাই, হৃদয়ের নীল খামে

মীরা মুগ্ধ হয়ে যায় কবিতা পড়ে। আনমনে ভাবে, কি সৌভাগ্যবতী হবে সেই মেয়েটা যাকে আশিক ভাই ভালবাসবে।

চলবে….

আজকের কবিতাটা আশিকের মানে আমারই লেখা। এই গল্পটার পাঠক সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। পাঠকেরা কেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বুঝতে পারছি না। যাইহোক যে কজন পড়ছেন এবং সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করছেন তাদের জন্যই লিখব। আশিক চরিত্রটা আমার অসম্ভব প্রিয়। আপনাদেরও পছন্দ হবে আশা রাখি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here