#বৈধ_দৃষ্টি
#পর্বঃ২৭
#ফাতেমা_জান্নাত
—“পরকালে যদি জান্নাতে যাই আপনি স্বামী হিসেবে কাকে চাইবেন রাফিয়া? আমাকে না কি সাইফ ভাইয়া কে”?
সাফওয়ান এর কথায় রাফিয়া সাফওয়ান এর দিকে বিস্মিত নেত্র যুগোল নিয়ে তাকিয়ে থাকে।হয়তো সাইফ এর থেকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সে ভাবেনি কখনো।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সাফওয়ান।রাফিয়া আয়নার মধ্যে থেকে -ই সাফওয়ান এর দিকে তাকিয়ে আছে।সাফওয়ান ও আয়নার মাঝে দিয়ে রাফিয়া কে দেখে হেসে দেয়।পরোক্ষণে -ই মুখ এর হাসি মিলিয়ে নিয়ে সাফওয়ান রাফিয়া কে কথা টা বলে।সাফওয়ান এখনো তাকিয়ে আছে রাফিয়ার দিকে।
—কি হলো বলছেন না যে?
সাফওয়ান ফের কথা বলায় রাফিয়া সম্বিত ফিরে আসে।সাফওয়ান এর দিকে তাকায় সে।সাফওয়ান এর প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া মন উদগ্রীব হয়ে আছে স্ত্রীর মুখ এর কথা টা শুনার জন্য।কিন্তু রাফিয়া তো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।রাফিয়া কি বুঝতে পারছে না?রাফিয়ার এমন নিশ্চুপ থাকায় সাফওয়ান এর হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।শার্ট দ্বারা আবৃত শরীর টার মধ্যে থেকে ঘাম ঝরছে শিশির বিন্দুর মতো।অবশ্য সেটা রাফিয়ার চক্ষু আড়ালে রয়ে গেছে।
বেশ খানিক সময় পার হতে- ই রাফিয়া মৃদু স্বরে বলে,
—পরকালে আমরা কে কোথায় যাবো জানি না শুধু আল্লাহ সুবাহানাল্লাহু তায়ালা ছাড়া।কে জান্নাতে যাবো আর জাহান্নামে যাবো সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা -ই ভালো জানেন। তবু ও ইনশাল্লাহ যদি আমি আপনি,আপনার ভাইয়া তিন জনে- ই আলহামদুলিল্লাহ জান্নাতে যেতে পারি তাহলে আমি আপনাকে -ই চাইবো।বর্তমানে একমাত্র কাজ হচ্ছে জান্নাতে যাওয়ার আল্লাহ কে খুশি করার জন্য আমল করতে হবে।আমি আশা রাখছি আপনি ও ইনশাল্লাহ আল্লাহ তায়ালার
খুশির জন্য কাজ করে যাবেন।
—ইনশাল্লাহ।
বলে-ই সাফওয়ান চুপ করে যায়।রাফিয়ার মুখোচ্চরিত “আপনাকে চাইবো” কথা টা শুনে সাফওয়ান দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে।নিশ্বাস টা এতক্ষণ আটকে ছিলো যেন।সাফওয়ান মুচকি হেসে দেয়।রাফিয়া কে আর জিজ্ঞেস করেনি সাইফ ভাইয়া কে না চেয়ে ওকে চাইছে কেন?রাফিয়ার তাকে চাওয়ার কারণ টা তার ও যে অবগত নয়।
সাফওয়ান ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি আর নিজ এর হলার টাই টা হাতে নিয়ে রাফিয়ার সামনে দাঁড়ায়। রাফিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।সাফওয়ান এক হাত বাড়িয়ে রাফিয়ার থুতনি তে রেখে মুখ টা উপরে তুলে।হেসে দিয়ে বলে,
—আমার দিকে তাকান রাফিয়া। আমার দৃষ্টি তে দৃষ্টি মিলাতে এখনো কি আপনার মাঝে জড়তা কাজ করে রাফিয়া?আমাদের মাঝের সম্পর্ক টা আলহামদুলিল্লাহ এত কাছাকাছি আসার পর ও আপনার আমার চোখে তে তাকাতে জড়তা কাজ করে?রাফিয়া আপনাকে আমি আর কি ভাবে বললে আপনি বুঝবেন আমাদের দুই জনের দৃষ্টি বৈধ?এবার থেকে আমি যাই বলি আমার চোখে তে চোখ রাখবেন। এই চোখ এর মধ্যে থেকে আপনার জন্য গড়ে তোলা ভালোবাসা টা দেখবেন।
—জি আচ্ছা।
সাফওয়ান রাফিয়ার হাতে নিজ এর টাই টা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
—নিন এবার টা ঝটপট পরিয়ে দিন তো।
বলে -ই সাফওয়ান রাফিয়ার সামনে হালকা ঝুকে যায়,যাতে রাফিয়া নাগাল পেতে পারে।লম্বা কিনা সে তাই তো রাফিয়ার তাকে নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়।রাফিয়া হেসে দিয়ে সাফওয়ান এর গলায় টাই টা বেঁধে দেয়।বাঁধা শেষ হতে-ই সাফওয়ান রাফিয়ার হাতে চিরুনি টা দিয়ে বলে,
—একটা সুন্নত কাজ করে ফেলুন।চুল আছড়িয়ে দিন রাফিয়া।
রাফিয়া সাফওয়ান এর চুল আছড়িয়ে দেয়।বলা বাহুল্য সে নিজে ও জানে এই হাদিস টা।হাদিসে উল্লিখিত আছে যে,
“স্ত্রীর থেকে চুল আছড়ে নেওয়া সুন্নত”(বুখারী :২৯৫)।
সাফওয়ান রাফিয়ার কপালে আদর দিয়ে বের হয়ে যায়।স্ত্রীর কপালে আদর দিয়ে বের হওয়ার রেফারেন্স আছে যে,
“ঘর থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রীর কে চুমু দেওয়া সুন্নত”(ইবনে মাজাহ- ৫০২)
সাফওয়ান চলে যায় রুম থেকে। রাফিয়া বসে আছে।জান্নাতে সাফওয়ান চাই সে বিষয় টা নিয়ে সে ধ্যান মগ্ন হয়ে আছে।সে কোরআন আয়াত এবং কথা গুলো পুনরায় ভাবছে।
পরকালে কে কোথায় যাবে তা আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানে না।অনেক ক্ষেত্রে যে সকল নারীরা একাধিক বিয়ে করে।তারা ভাবে যে পরকালে জান্নাতে তারা কোন স্বামীর সাথে বসবাস করবে?এটা নিতান্ত-ই তাদের ভুল কাজ।তাদের উচিত এসব চিন্তা ভাবনা না করে স্বামী স্ত্রী উভয় আল্লাহ কে খুশি করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন এর রহমত পাওয়ার জন্য আমল করে যাওয়া।এই ক্ষেত্রে কুরানুল কারীমে বলা আছে,
মহান আল্লাহ বলেন,
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۖ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِم مِّن كُلِّ بَابٍ
“জান্নাতে আদন (অনন্তকাল বসবাসের জান্নাত)। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্ম শীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানেরা। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে।” [সূরা রা’দ: ২৩]
আরেকটা কথা,প্রশ্ন টা ছিলো যে,দুনিয়াতে কোনও নারীর একাধিক বার বিয়ে হয়ে থাকলে যদি সে সহ তার সকল স্বামী জান্নাতবাসী হয় তাহলে সে কার সাথে থাকবে?
এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের তিনটি অভিমত পাওয়া যায়। যথা:
★প্রথমত :তাদের মধ্যে যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো ছিল তার সাথে থাকবে।
★দ্বিতীয়ত :তাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে। সে তাদের মধ্যে যার সাথে থাকতে চাইবে তার সাথে থাকবে।
★তৃতীয়ত:সর্বশেষ স্বামীর সাথে থাকবে।
প্রথম মতের পক্ষে বর্ণিত হাদিসটি মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে সহিহ নয়। ইবনে আদি, কায়সারানি সহ অনেক মুহাদ্দিস তাকে মুনকার (যা মারাত্মক পর্যায়ের জইফ/দুর্বল) বলেছেন। আর ইবনুল জাওযী বলেন, এ হাদিসটি সহিহ নয়।
দ্বিতীয় মতের ও কোনো দলিল পাওয়া যায়নি।তাই দ্বিতীয় মত টাকে বিশ্বাস করা যায় না বা দ্বিতীয় মতের উপর ভিত্তি করে এই মনোভাব রাখা যায় না নিজের মধ্যে।
কিন্তু তৃতীয় মত টি তুলনামূলক অধিক বিশুদ্ধ বলে বলা হয়েছে।এই নিয়ে হাদিসে বলা হয়েছে,
“যে মহিলার স্বামী মৃত্যু বরণ করার পর অন্য স্বামীর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয় সে তার শেষ স্বামীর জন্য। ”[মুসনাদে আবি ইয়ালা–এর সনদের বর্ণনাকারীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য।”( সিলসিলা সহিহা, হাদিস-১২৮১)
তাছাড়া অন্য হাদিস এর আলোকে বলতে পারি,
“উম্মুদ দারদা আস সুগরা হুজাইমা বিনতে হুওয়াইকে মুয়াবিয়া রা. বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং জানায়, আমি আবুদ দারদা রা.-কে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নারী তার সর্বশেষ স্বামীর জন্য।” আর আমি আবুদ দারদার কোনও বিকল্প চাই না’। [ত্বাবারানী-সহিহ] যদিও এ হাদিসগুলোকেও কোনও কোনও মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন।
যাহোক, এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিসগুলোর মধ্যে শেষোক্ত হাদিসগুলো তুলনামূলক অধিক নির্ভরযোগ্য। কারণ অনেক মুহাদ্দিসের মতে সেগুলো সহিহ। সুতরাং এ বিষয়ে ৩য় মতটি তুলনামূলক অধিক বিশুদ্ধ ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং এই থেকে বুঝা যায় যে,আগে নিজ এর সর্বোচ্চ আমল করে জান্নাতে প্রবেশ করার পর সে কার সাথে বসবাস করে সেই হিসেব আসবে।
🌸🌸
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে জানান দিচ্ছে এখন রাত দশটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। রাফিয়া ব্যস্ত পায়ে ঘরে পায়চারি করছে।মূলত টেনশন এর কারণে ঘরে পায়চারি করছে রাফিয়া।সাফওয়ান এখনো বাসায় আসেনি,সেই জন্য -ই টেনশনে রাফিয়ার হাত পা বরফ হয়ে আসছে।প্রতিদিন সাফওয়ান বাসায় আসে পোনে নয়টা এমন সময়ে।কিন্তু আজ সাড়ে দশ টার বেশি বেজে গেলো এখনো সাফওয়ান এএ ছায়া টুকু দেখলো। কোনো বিপদ হলো না তো?ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।আল্লাহ রক্ষা করুক।
হঠাৎ ফোনের কর্কশ বিশ্রী শব্দে রাফিয়া ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।দ্রুত গিয়ে ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে সাফওয়ান এর নামটা জ্বলজ্বল করে ভাসছে স্কিনে।রাফিয়া তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করে বলে,
—আসসালামু আলাইকুম।কই আছেন আপনি?ঠিক আছেন তো আপনি?দেরি হচ্ছে কেন?
রাফিয়ার অস্থির গলা শুনে সাফওয়ান চমকায় না।যেন আগে থেকেই জানতো ফোন দিলে রাফিয়ার এমন অস্থির কণ্ঠ শুনতে পাবে।সাফওয়ান স্মিত হেসে ফোনের অপর পাশে।মিহি কণ্ঠে রাফিয়া কে সুধাল,
—আস্তে রাফিয়া। এত অস্থির হচ্ছেন কেন?আমি আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি।
সাফওয়ান ঠিক আছে শুনে যেন রাফিয়া সস্তি পেলো।মৃদু কণ্ঠে বলে,
—এখনো বাসায় আসছেন না কেন?
—আজ কে কাজের অনেক প্রেশার রাফিয়া। আসতে আসতে বারো টস বাজতে পারে।আপনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
রাফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
—মাথা ব্য’থা করছে আপনার?না মানে কণ্ঠ একটু কাতর মনে হলো।
সাফওয়ান এবার একটু শব্দ করে হেসে বলে,
—মাথা ব্য’থা কে বলেছি অফিসে বউ নেই।এখন যাতে না আসে।আসলে মাথা টা ম্যাসাজ করে দিবে কে এখন?কিন্তু মাথা ব্য’থা শুনেনি আমার কথা।ঠিক- ই এসেছে।মাথাটা ব্য’থায় যেন ফে’টে যাচ্ছে রাফিয়া।
সাফওয়ান এর মুখে হাসি।কিন্তু কণ্ঠে কাতরতা। রাফিয়া বুঝতে পারছে সাফওয়ান এর মাথা ব্য’থা টা আজ বেশি- ই।রাফিয়া বলে,
—বস কে বলে নাহয় চলে আসুন।
—বস ছাড়বে না রাফিয়া। আজ উনি ও সব এমপ্লয় দের অফিসে আছে।উনার বউ বাপের বাড়িতে গিয়েছে।তাই নিজে ও বসে আছে আমাদের ও ধরে রেখেছে।
সাফওয়ান কথা শুনে একটু আগের খারাপ লাগার মধ্যে রাফিয়া ফিক করে হেসে দেয়।সাফওয়ান রাফিয়ার হাসি শুনে মেকি রা’গ করার সুরে বলে,
—আপনি হাসছেন রাফিয়া?আর এই দিকে আমার কান্না করতে ইচ্ছে করছে।বউ ছেড়ে অফিসে বসে আছি।শা”লার চাকরি করা টাই ভুল।বউ এর কাছ থেকে দূরে রাখে।
রাফিয়ার হাসি পাচ্ছে সাফওয়ান এর কথা শুনে।তবু ও নিজের হাসি চেপে সাফওয়ান কে বলে,
—আচ্ছা সরি আর হাসবো না।আপনি ব্ল্যাক কফি খেয়ে নিন।ইনশাল্লাহ মাথা ব্য’থা কমবে।
—আচ্ছা।
—আচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।
রাফিয়া কান থেকে ফোন সরিয়ে কাটতে যাবে এমন সময় সাফওয়ান বলে উঠে,
—রাফিয়া!
রাফিয়া ফোন পুনরায় কানে চেপে ধরে স্বগতোক্তি করে সুধাল,
—জি বলুন।
সাফওয়ান খানিক ক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
—ভালোবাসি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে।
সাফওয়ান এর কথার বিপরীতে রাফিয়া কিছু বলে না।চুপ করে থাকে।সাফওয়ান জানে আজ ও তার প্রেমময় বাক্যের পাল্টা উত্তর আসবে না।তাই তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
—আচ্ছা।রাফিয়া রাখছি।আল্লাহ হাফেজ।
—আসসালামু আলাইকুম।
বলেই রাফিয়া খট করে ফোনটা কেটে দেয়।সাফওয়ান ফোনের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
‘‘যেই মানুষ টা আমার অনুপস্থিতিতে অস্থির হয়ে পড়ে,আর যাই হোক সে মানুষ টা আমাকে ভালোবাসে না।তা বড্ড হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই না।আপনার নিরবতা তেই ভালোবাসা লুকিয়ে আছে রাফিয়া।’’
বলেই সাফওয়ান হেসে দিয়ে আবার কাজে মনোযোগ স্থির করে।
চলবে ইনশাল্লাহ।
ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন।সবার প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্য এর আশা করছি। আসসালামু আলাইকুম