সংসারের_সাতকাহন পর্ব ১

0
290

সাদিক পর্ব

– বাবা, আজ চার বছর হয়ে গেল তুই দেশে আসিস না। কতদিন তোকে দেখিনা। এক মাসের জন্য হলেও আয়রে বাপ।

– দেশে গেলেই তোমরা বিয়ের কথা বল, আমার ভালো লাগেনা। আর তাছাড়া বউ দেশে ফেলে প্রবাসে থাকা আমার পছন্দ না। এখন আমার এবিলিটি এমন হয়নি যে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসব। তার চেয়ে থাক এভাবে। আমিতো ফোন করিই প্রতিদিন, কথা তো হচ্ছেই। প্রতিমাসে ছবিও পাঠাই।

– বাবারে, বাপ হইলে বুঝতি সন্তানের ছবি দেখে সাধ মিটেনা। সন্তানকে বুকেও জড়িয়ে ধরতে মন চায়। আমার কপাল খারাপ তাই বাধ্য হয়ে তোকে সংসারের হাল ধরতে বিদেশে পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের উপর অভিমান থেকেই যে আসিস না সেটা তো বুঝিই। আচ্ছা যা তকে কথা দিলাম, তুই এসে ঘুরে যা। বিয়ের কথা বলব না।

– ঠিক আছে আব্বা, আমি দেখি ছুটি পাওয়া যায় কি না।

ফোনটা রেখেই হু হু করে কেঁদে উঠল সাদিক। কতদিন মায়ের মুখটা দেখেনা। কিশোর ছোট ভাইকে রেখে এসেছিল, গত মাসে পাওয়া ছবিতে দেখে সে রীতিমত যুবক হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাইয়ের বেড়ে উঠাটা মিস করে সাদিক। বোনটা চোখের সামনে ছিল এই দেশে, সেও দেশে ফিরে গেছে গত বছর।

পরিবারের বড় সন্তান ও বড় ছেলে সাদিক। ছোট এক ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে, সেও প্রবাসী। পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবে ওর বোন ওকে নিজের কাছে নিয়ে যায়। বোন জামাইয়ের সহযোগিতায় আর নিজের যোগ্যতায় ভালো একটা জব পায় সাদিক। দেশে টাকা পাঠিয়ে যা থাকে তার থেকে অল্প অল্প টাকা জমায় সাদিক। স্বপ্ন একটা নিজের রেস্টুরেন্ট দিবে। স্বপ্নের পথেই হাঁটছিল সাদিক। কর্মক্ষেত্রে কেউ কখনও ওর নামে কোন অভিযোগ করতে পারেনি বরং ওর শেখার আগ্রহ ও কাজের প্রতি ডেডিকেশন দেখে ভালো ভালো জায়গাতেই কাজের অফার পায় সে। এভাবেই মরুভূমির দেশে প্রবাসে এসে ৬ বছরের মধ্যে নিজেকে নিয়ে যায় পাঁচ তারকা চেইন হোটেল গুলোর মধ্যে নামকরা এক হোটেলে।

এখন তার ৮ বছর চলে প্রবাসে। এই দূর প্রবাসে কতজনের কত রঙ, কত কাহিনী দেখল সাদিক। দেখল কত চরিত্র স্খলনের ঘটনা। কিন্তু সবার অনেক কূটকৌশল বা কুপরামর্শেও কখনও সাদিককে টলাতে পারেনি একচুল। কোন মেয়ের সাথে রিলেশন দূরে থাক কারও দিকে চোখ তুলেও তাকায় না সাদিক কখনও। এইসব কারণে ওকে নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করে। তাতেও কিছু যায় আসেনা সাদিকের, ওর মাথায় শুধু ওর মায়ের বলা একটা কথাই ভাসে।

সাদিক প্রবাসে আসার আগে ওর মা ওর হাত দুইটা ধরে বলেছিলঃ “বাবা সারাজীবন অনেক কষ্ট করছি, পরের বাড়িতে ভাড়ায় থেকে। তোর কাছে আমার একটাই আবদার নিজের একটা বাড়ি চাই, আর কিছুনা। টিনশেড হলেও চলবে কিন্তু নিজেদের বাড়ি।”

মায়ের এই আকুতি কিভাবে ফেলবে সাদিক? তাই একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছে যাতে দেশে গিয়ে একেবারে জায়গা কিনে মায়ের পছন্দমতো বাড়ি করে দিয়ে আসতে পারে। কি হবে এখানে অন্যের পিছনে কষ্টের টাকা নষ্ট করে? যে পরিমান টাকা সাদিক আয় করে ওর লিভিং স্ট্যান্ডার্ড দেখে কেউ বুঝবেনা। মনে করবে কোনমতে কষ্টে দিন চালায়। বেতন যা পায় তার থেকে দেশে টাকা পাঠিয়ে বাকি প্রায় সবটাই সঞ্চয় করে মায়ের স্বপ্নের বাড়ি আর ওর নিজের স্বপ্নের রেস্টুরেন্টের জন্য।

আজ বাবার সাথে কথা বলে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে সবাইকে দেখার জন্য। আজ কতগুলো দিন কোন আপনজনের মুখ দেখেনা সাদিক। বাবার দেয়া আশ্বাসবানী শুনে সিদ্ধান্ত নিল পরদিনই কর্মস্থলে গিয়ে ছুটির আবেদন দিবে। রাতে শুতে গিয়ে ভাবল আর দুমাস পরেই রোজা, তারপরেই ঈদুল ফিতর। কতদিন মা বাবা ভাইয়ের সাথে ঈদ করা হয়নি। বোনটা যখন এখানে ছিল তখন ওর সাথে ঈদে দেখা হত, এখন এক বছর ও একা। তখনই ভেবে নিল এমনভাবে দেশে যাবে যাতে পুরো রোজা কাটিয়ে একসাথে ঈদ করে ফিরে আসতে পারে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্মস্থলে গিয়ে রোজা ও ঈদ হিসেব করে ছুটির দরখাস্ত দেয়। গত ৪ বছর দেশে না যাওয়ায় আর পারত পক্ষে ছুটি না নেয়ায় একমাস বেশিই ছুটি মঞ্জুর হয় সাদিকের। ছোট ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওর আসার তারিখ। বারবার করে বলে দেয় যেন মা বাবাকে না জানায়। সারপ্রাইজ দিতে চায় ও মা বাবাকে।

সাদিকের দেশে ফেরার একদিন আগে ওর ছোট ভাই রাদিক জরুরি কাজের কথা বলে ঢাকায় যায় ভাইকে রিসিভ করতে। যেহেতু সাদিকের বোন মালাও ঢাকায় থাকে তাই ওর মা কোন সন্দেহ করেন না। কিন্তু সন্দেহ করে বসে মালা, কারন ও গত কিছুদিন ধরেই বলছিল রাদিককে ঢাকা আসতে কিন্তু রাদিক রাজি হচ্ছিল না। আসলে রাদিক চাচ্ছিল ভাই এলেই একেবারে ঢাকায় যাবে। সাদিক ফেরার দিন সকালে তাড়াহুড়ো করে নাস্তা খেয়ে বের হয়ে যায় রাদিক। মালা জিজ্ঞেস করলেও বলেনা কোথায় যাচ্ছে। জ্যাম ঠেলে এয়ারপোর্ট যেতে যেতে সাদিকের ফ্লাইট পৌঁছে যায়। ইমিগ্রেশনের সব ঝামেলা শেষ করে বাইরে এসেই দেখতে পায় ওর কলিজার টুকরো ভাই রাদিক দাঁড়িয়ে আছে, একদম ড্যাশিং হির লাগছে রাদিককে। রেখে গিয়েছিল ছোট্টটি। যেন শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি। দৌড়ে গিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দুই ভাই।

বারবার অস্থির কলিংবেলের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে ফ্রিজ হয়ে যায় মালা। মালা দরজা খুলেই দেখে ওর দুই ভাই দাঁড়িয়ে। রাদিকের থাকাটা বিশ্বাস হচ্ছে কিন্তু সাদিক কিভাবে? এক চিৎকার দিয়ে সাদিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে মালা। কত্তদিন পর ভাইকে পেয়েছে সে। হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যায় সাদিককে। রাদিক সাদিকের মালপত্রগুলো ঘরে আনতে আনতে মালাকে সাবধান করে দেয়, খবরদার যেন বাবা মা কিছুতেই না জানতে পারে।

মালার ছেলে লাম আর মেয়ে মীম দৌড়ে আসে মামাকে দেখে। লাম তো মামার জান। সাদিক হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করে মালাকে বলে ব্যাগ গুছাতে। মালা ওর হাসবেন্ডের অনুমতি নিতে চাইলে সাদিক জানায় সে সেই অনুমতি আদায় করেই এনেছে তাও ওর উচিৎ কথা বলা। মালার হাসবেন্ড রাসেল থাকে প্রবাসে, সেই নিয়ে গেছিল সাদিককে।

রাদিক আগেই টিকেট কেটে রেডি করে রেখেছিল। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ৩ ভাই বোন বাচ্চাদের নিয়ে বাসে উঠে পরে। মালা একেবারে ঈদ করে আসবে সেভাবেই অনুমতি নেয় রাসেলের কাছে। সাদিকের পথ মনে হয় শেষ হয়না।

সাদিকের বাবা সালাম সাহেবের অভ্যাস ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়ার। ঝড় হোক বৃষ্টি হোক তিনিই মসজিদের প্রথম মুসল্লী। কোন কোন সময় মুয়াজ্জিন সাহেবের আগেই পৌঁছে যান সালাম সাহেব। ফজর নামাজ পড়ে মসজিদেই কুরআন তেলাওয়াত করে ওজিফা পড়ে সকাল ৭ টায় উনি বাসায় ফিরেন। এটাই উনার রুটিন। এই সময় উনার স্ত্রী মোস্তারি বেগম বাসায় নামাজ পড়ে কুরআন পড়ে উনার জন্য চা বানিয়ে অপেক্ষা করেন।

সালাম সাহেব মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাসার কাছাকাছি যেতেই দেখেন উনার তিন ছেলেমেয়ে দুই নাতি নাতনী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সালাম সাহেব সাধারণত নামাজে যাবার সময় বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে যান। ছেলেমেয়েদের বিশেষ করে সাদিককে দেখে উনি বিশ্বাসই করতে পারেন না সত্যিই সে সামনে দাঁড়িয়ে। সাদিক যখন এগিয়ে এসে উনাকে জড়িয়ে ধরে তখনও উনি চন্দ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কিছুক্ষন পড়ে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন বুকের মধ্যে। আর চিৎকার করতে থাকেন সাদিকের মা শিগগিরই বের হও ঘর থেকে। মোস্তারি বেগম কেবলই নামাজ, তেলাওয়াত শেষে চায়ের পানি বসাতে যাচ্ছেন। স্বামীর এহেন চিৎকারে ভয় পেয়ে যান। ততক্ষণে রাদিক বাইরে থেকে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেছে। ওর মা হন্তদন্ত করে বাইরে বের হয়েই ফ্রিজ হয়ে যান, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেন না যে উনার বড় সন্তান উনার সামনে দাঁড়ানো।

সাদিক দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরতেই……………….
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ১
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here