সাদিক দৌড়ে গিয়ে ওর মা কে জড়িয়ে ধরতেই ছেলের হাতের উপরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মোস্তারী বেগম, উনি ভাবতেই পারেননি আজ তাহাজ্জুদে করা দুয়া আল্লাহ এতো তাড়াতাড়ি কবুল করবেন। সাদিক ওর মাকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। রাদিক আর মালা তাড়াতাড়ি পানি এনে মায়ের মুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। আচমকা এসব দেখে লাম, মীম দুই ভাই বোন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
একটু পড়ে মোস্তারী বেগম একটু সুস্থ বোধ করলে সাদিকের মুখটা ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দেন আর বলতে থাকেন – “আমার প্রথম সন্তান, আমার জীবন তুই বাবা। পরিবারের স্বার্থে তোকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু তোকে ছাড়া আমি ভালো নাই বাবা”। মালা, রাদিকের দিকে তাকিয়ে উনার খেয়াল হয় উনার সন্তানেরা সারারাত জেগে বাসে করে এসেছে। তিন সন্তানকেই বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিয়ে বিছানা ছাড়েন মোস্তারী বেগম। ছেলেমেয়েরা হা হা করে উঠেন, কিন্তু গায়ে লাগান না উনি।
আগামীকাল থেকে রোজা শুরু। পুরো এক মাস তিনি সন্তানদের জন্য দুপুরের খাবার বানাতে পারবেন না, আর এখন শুয়ে থাকবেন তা কি হয়? মায়ের তাড়াহুড়ো দেখে সাদিক রাদিকের হাতে টাকা দিয়ে পাঠায় নামকরা ও ওর প্রিয় হোটেল থেকে ওর পছন্দে তান্দুর রুটি ও নেহারী আনতে। মা কে বুঝিয়ে বলে, “মা আমি এতোদিন পড়ে এলাম একটু আমার সামনে বস। কথা বলি, সকালের নাস্তা আনতে রাদিককে পাঠিয়েছি। নাস্তা খেয়ে দুই ভাই একসাথে বাজার গিয়ে বাজার করে আনব, তখন তুমি রান্না করিও। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না মা”।
রাদিক নাস্তা নিয়ে এলে পুরো পরিবার একসাথে বসে নাস্তা করে। তারপর সাদিক লাগেজ খুলতে গেলে মানা করেন মোস্তারী বেগম, বলেন দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে ধীরে সুস্থে রাতে দেখবেন ছেলের লাগেজ। আস্তে আস্তে আশেপাশের সবাই জেনে যায় সাদিক দেশে এসেছে। সবাই হুড়মুড় করে আসতে থাকে সাদিকের সাথে দেখা করতে। মালাকে সবার জন্য চা বানাতে বলে সাদিক সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। সবাইকে বিদায় করে দুই ভাই যায় বাজারে। বাজার করে এনে মায়ের হাতে দেয়। মোস্তারী বেগম ব্যাগ খুলে দেখতেই চোখে পানি এসে যায় উনার। সব উনার পছন্দের খাবার নিয়ে এসেছে ছেলে। সবাই ভুলে যায় উনার কি খেতে পছন্দ কিন্তু উনার সাদিক এতো বছর মায়ের থেকে দূরে থেকেও ভুলেনি মায়ের পছন্দের খাবার কি কি?
দুপুরে খেয়ে ৩ ভাই বোন ঘুমায়, সারারাত জার্নি করে এসেছে আবার এখানে এসে এতো মানুষের সাথে বলে ক্লান্ত। পানের বাটা হাতে ঘুমন্ত সাদিকের পাশে গিয়ে বসেন মোস্তারী বেগম। আস্তে আস্তে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মায়ের আদরে ঘুমের অতলে ডুবে যায় সাদিক। মোস্তারী বেগম মনে মনে ভাবেন ছেলেকে এবার একটা বিয়ে করাতে পারলে বেশ হয়। মেয়ে তো উনি দেখেই রেখেছেন মনে মনে। কিন্তু ছেলে শর্ত দিয়ে এসেছে বিয়ের কথা বলা যাবেনা। কিভাবে ছেলের কাছে বিয়ের কথা পাড়বেন ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে যায় আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। আল্লাহ পাক বলেছেন ইফতার সামনে নিয়ে দুয়া করলে দুয়া কবুল হয়। আর এখন তো তাহাজ্জুদ পরার আরও সুবিধা। আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে ছেলের মন নরম করার জন্য, এছাড়া আর কোন রাস্তা নাই।
সোনিয়া পর্ব
স্কুল শিক্ষক দম্পতি ইয়াকুব আলী আর আলেয়া বেগমের প্রথম সন্তান সোনিয়া। দ্বিতীয় সন্তান মুনিয়া স্বামীর হাতে খুন হয়। এরপর অনেকদিন সোনিয়া বোনের শোকে পাগলপ্রায় ছিল। পরপর তিনবার স্যুইসাইড এটেম্প নেয়ার পরে সোনিয়ার ছোট মামা ওকে ঢাকায় নিয়ে যান। ছোট মামার ছেলে রাইয়ান তখন ৮ মাস বয়সী। বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সোনিয়া আবারও প্রাণ ফিরে পায় রাইয়ানের মধ্যে। ওর মানসিক অবস্থা বুঝেই ওর মামা মামী রাইয়ানের সব দায়িত্ব ওর উপর ছেড়ে দেন। ভাইয়ের গোছল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে ওর সাথে খেলা সবকিছুই সোনিয়ার দায়িত্বে।
প্রথম প্রথম রাইয়ান সোনিয়ার কাছে যেতে চাইতো না। বাচ্চারা অচেনা কাউকে দেখলে যেমন রিএক্ট করে, ঠিক তাই। সোনিয়াও কোলে নেয়ার জন্য চাপাচাপি করত না, আশেপাশেই থাকত রাইয়ানের। আস্তে আস্তে চিনে ফেলে যখন তখন এমন অবস্থা হয় যে সোনিয়াপু ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। সোনিয়াও সন্তানের মতো ভালোবাসে ওর ২১ বছরের ছোট এই ভাইটাকে।
রাইয়ানের ধারণা হয়ে গেছিল ওর যেমন সোনিয়াপু আছে তেমনই সব বাবুদেরই আম্মু আব্বু ছাড়াও একটা করে সোনিয়াপু থাকে। সমবয়সী বাবুদের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করত তোমার সোনিয়াপু নাই? যখন সে উত্তর দিত নাই, তখনই রাইয়ানের চেহারা দেখলে মনে হত ও রাজ্যজয় করেছে আর ভালোবাসার রাজ্য হল সোনিয়াপু।
একবার যখন রাইয়ানের বয়স ৪+ তখন একদিন সোনিয়া ওর আরেক মামাতো ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ দেখে রাইয়ান মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে “তুমি ফোনে কাকে ভাইয়া বলেছ? আমি ছাড়া কাউকে ভাইয়া বলবেনা”। রাইয়ান আর সোনিয়া, দুই অসম বয়সী ভাইবোন, একে অপরের সঙ্গী হয়ে উঠে সময়ের সাথে সাথে।
রাইয়ানের যখন ৫+ বয়স তখন হঠাৎ করে সোনিয়ার বাবা সোনিয়াকে বগুড়া ফিরে যেতে বলেন। ওর বাবার ফোন পেয়ে ওর মামাও আর কিছু বলেন না। যেদিন সোনিয়া বগুড়া চলে যায় সেদিন রাইয়ানকে ছেড়ে আসতে মনে হয় কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল সোনিয়ার।
বগুড়া ফিরে এসে কয়দিন খুব মন খারাপ থাকে সোনিয়ার। আসার পর থেকেই দেখে বাড়িওয়ালার মিসেসের সাথে ওর মায়ের খুব ভালো রিলেশন। এটা পছন্দ হয়না সোনিয়ার। মাকে বুঝায় বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়াটিয়ার অতো সখ্যতা ভালো না। ওর মা ওকে জানায় এই মহিলা অনেক ভালো।
সোনিয়া ফেরার পরে একদিন ওদের বাড়িওয়ালী বিকেলের চায়ে ওকে ডাকে। ভদ্রতার খাতিরে উপরে যায় সোনিয়া। বাড়িওয়ালার বাসা দোতলা। উপরে উনারা থাকতেন আর নিচে সোনিয়ার মায়েরা। বাড়িওয়ালার মেয়ে রাইয়ানের বয়সী, নাম নাবা। সোনিয়া উপরে গেলে নাবা ওর মায়ের পিছনে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সোনিয়াকে দেখে, কাছে আসেনা। সোনিয়াও দূর থেকে দেখে। বাচ্চাদের আকৃষ্ট করার ওর অব্যর্থ হাতিয়ার হল ইগনোর করা, কাছে নেয়ার জন্য চাপাচাপি না করা।
বাড়িওয়ালীর সাথে গল্প করে জানতে পারে ওদের পরিবার আগে থেকেই চেনা কিন্তু যোগাযোগ না থাকায় দূরত্ব এসে গেছে। বাড়িওয়ালাকে ছোট থেকেই চিনে ওরা, ওর বাবার পরিচিত তাই আংকেল বলে ডাকত। বাড়িওয়ালীর বয়স অনেক কম, সোনিয়ার চেয়ে খুব বেশি হলে ৬/৭ বছরের বড় হবে। উনাকে আন্টি ডাকতে সংকোচ হচ্ছিল সোনিয়ার কিন্তু আংকেল পূর্বপরিচিত হওয়াই মায়ের নির্দেশে উনাকে আন্টি ডাকা শুরু করে। উনার সাথে কথা বলে দেখে আসলেই আন্টি অনেক আন্তরিক।
পরদিন সকালে ঘুম ভাংগে ছোট্ট হাতের পরশে, রাইয়ান ভেবে চমকে উঠে দেখে নাবা পাশে বসে ওর মুখ নাড়ছে আর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আন্টি। সোনিয়ার ঘুম ভেঙে গেলে হেসে বলেন, “তুমি রাইয়ানের জন্য মন খারাপ করে আছ আর নাবা তোমার কাছে আসতে চায়”। এই কথা শুনে কি যে হয় সোনিয়ার, নাবাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে। আস্তে আস্তে আন্টির সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে সোনিয়ার। ওহ আন্টির নামই বলা হয়নি। আন্টির নাম একা।
এরমধ্যেই একটা মোড় আসে সোনিয়ার জীবনে…..
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ২
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ