#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৪
সোনিয়া যখন নাস্তা রেডি করতে উঠে যায় সেই সুযোগে মালা একার কাছে বলে সাদিকের সাথে সোনিয়ার বিয়ের কথা। মালা জানায় সে এসেছিল মূলত সোনিয়ার মায়ের সাথেই কথা বলতে, যেহেতু উনি নাই সেহেতু একা যেন মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব নেয়। একা সানন্দে রাজি হয়ে যায় কারন সে অনেক দিন ধরেই সোনিয়ার বিয়ের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সন্ধ্যায় সোনিয়ার মা ফিরলে একা নিচে নামে দেখা করতে। এক ফাঁকে জানায় সোনিয়ার বিয়ের প্রস্তাব। সোনিয়ার মা বলে, “আমরা তো কোনটাতেই অরাজি না, কিন্তু মেয়েই তো রাজি হয়না”। তখন একা বলে তাহলে আগে সোনিয়াকেই রাজি করাই। তখন সে সোনিয়াকে উপরে নিয়ে যায়। এটা সেটা বলার এক ফাঁকে বলে রাদিক মালার বড় ভাই সাদিকের সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ও রাজি কি না। সোনিয়া আগে থেকেই মালা আর রাদিককে পছন্দ করে তাই হালকা সম্মতি জানিয়ে বলে, “আম্মু আব্বু রাজি থাকলে আমার আপত্তি নাই”।
একা সাথে সাথেই ওর হাত ধরে নিচে এসে ওর মায়ের সামনে নিয়ে যায়, বলে “মেয়ে এইবার রাজি হইছে, আপনি কি বলেন?” সোনিয়ার মা জানায়, “ওরা বাপ বেটি রাজি থাকলে আমার না নাই। আমিতো মেয়েকে বিয়েই দিতে চাই।” একা এক হাতে সোনিয়া আরেক হাতে ওর মাকে ধরে সোনিয়ার বাবার সামনে নিয়ে গিয়ে বলে, “রাদিকের বড় ভাইয়ের সাথে সোনিয়ার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আপনি কি বলেন ভাই? আপা আর সোনিয়া দুজনেই রাজি”। সোনিয়া রাজি শুনে আর অমত করেননা ওর বাবা। তাড়াতাড়ি হ্যাঁ বলে দেন, আবার যদি মেয়ের মত ঘুরে যায়।
একা জানায় তাহলে তারপর দিন রবিবার একা যাবে সাদিকের বাসায় ওদের সম্মতি জানাতে। সোনিয়া সেদিন ঘুমানোর সময় একাকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে রাখে।
সেই সময় একা ওর স্কুলের চাকুরি আর সেলাইয়ের টাকা জমিয়ে সদ্য মোবাইল ফোন কিনেছে। সকালে উঠে সোনিয়ার ম্যাসেজ পেয়ে থম হয়ে যায় একা।
সোনিয়া একাকে ম্যাসেজ দিয়েছে – “আপনি যাচ্ছেন যান কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বিয়েটাও হবেনা।” ম্যাসেজ দেখে একা আর যায়না সাদিকদের বাসায়। সন্ধ্যার দিকে সোনিয়া একার কাছে আপডেট জানতে চাইলে একা জানায় সোনিয়ার ম্যাসেজ দেখে সে আর যায়নি। উত্তরে সোনিয়া বলে, “আমার বলার আমি বলছি, তাই বলে আপনি যাবেন না? আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করেন।” এই কথায় দুজনে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে নিচে আসে। সোনিয়ার মা একাকে আপডেট জিজ্ঞেস করলে জানায় যে সময় পায়নি যাওয়ার, পরদিন সোমবারে যাবে ইনশাআল্লাহ্।
পরদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে একা নিচে এসে জানায় ও গিয়েছিল সাদিকদের বাসায়। সেখানে সাদিকের মা ও সাদিক দুজনের সাথেই কথা হয়। সাদিক অত্যন্ত ভদ্র নম্র একজন ছেলে। পাড়ায় ওর নামে কেউ কোন বাজে রিপোর্ট দিতে পারবেনা। একই পাড়ার হওয়ায় সাদিকের ব্যাপারে এই কথা সবাই জানত যে সে উঠতি বয়সেও কখনও কোন মেয়েকে টিজ করাতো দূর কারও দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। পাড়ার মধ্যে যদি একজনও ভালো ছেলের সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য হয় তাহলে সেটা সাদিক এটা ওরা সবাইই জানত।
একা সাদিকের সাথে কথা বললে সাদিক বলে, “এখনও নিজেদের একটা বাড়ি বানাইনি, ভাড়া বাড়িতে থাকি, এখনই বিয়ে করার ইচ্ছে নাই। দেশে আসছিও সেই শর্ত দিয়েই। কিন্তু এখন সবাই জেদ করতেছে। আমি নিজেও আসলে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কি করব?”
উত্তরে একা বলে, “নিজের বাড়ি সবারই থাকেনা, তাই বলে কি কেউ বিয়ে করেনা? সোনিয়াদেরও নিজেদের বাড়ি নাই, সুতরাং তোমাকে তো আর সে বাড়ি নিয়ে কোন খোঁটা দিবে না।” এরপর মোস্তারী বেগমের উদ্দেশ্যে বলে, “সোনিয়ার ছোট বোন মুনিয়া খুন হয়েছে স্বামীর হাতে এটা তো জানেন? তারপর বেশ কিছুদিন ও আপসেট ছিল এটাও জানেন। ৩ বার আত্নহত্যার এটেম্প নিয়েছিল সেটাও জানেন। সব জেনে আপনারা আগ্রহী হয়েছেন সুতরাং আমাকে কথা দিতে হবে যে এই ব্যাপারে ভবিষ্যতে সোনিয়াকে কোন কথা শুনাবেন না বা ওর সামনের জীবনে এর ইফেক্ট পরতে দিবেন না।”
মোস্তারী বেগম উত্তরে একাকে বলেন, “আমি সবই জানি ওর ব্যাপারে। মেয়েটা মনের দিক থেকে সাদা। রাগ একটু বেশি, সেটা অনেকেরই থাকে। এতাও জানি সে সবার সাথে খোলা মনে মিশে, ওর মনের মধ্যে কালো নাই। আমার ছেলে চুপচাপ, কথা বলেনা বেশি আর সোনিয়া দিলখোলা মেয়ে। দুজনের জুটিটা পারফেক্ট হবে। মেয়েটা চাকুরি করে, তার আগে বিজনেস করত। তার মানে সে সংসারী আছে। আমার ছেলেটা বোকা, হাতে টাকা পয়সা রাখতে পারবেনা। আমি বেঁচে না থাকলেও সোনিয়া সাদিকের ঢাল হয়ে থাকতে পারবে এই ব্যাপারটা আমি ওর সাথে কয়দিন কথা বলেই বুঝতে পেরেছি।”
সব শুনে একা সোনিয়ার মা বাবার সাথে কথা বলে সব জানাবে এটা বলে চলে যায়। সাদিকদের বাসায় কি কথা হয় তা হুবহু সোনিয়া ও তার বাবা মার সামনে বলার পরে একা জানতে চায় তাদের কি অভিমত? সোনিয়ার বাবা ভাবার জন্য সময় চাইলে একা বলে সাদিকের ছুটি আর অল্প কয়দিন আছে। সুতরাং বেশি সময় নষ্ট করার দরকার নাই।
সোনিয়া সকালে উঠে দেখে রাদিক এসেছে। সোনিয়াকে দেখেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে – কি খবর?
সোনিয়ার সেদিনই স্কুল খোলে তাই রাদিককে সময় দিতে পারেনা, নাবাকে নিয়ে স্কুলে চলে যায়। রাদিকের সাথে কথা বলে একা। রাদিক জানায় একার ল্যান্ডফোন নম্বর নেয়ার জন্য ওকে পাঠিয়েছে। সাদিকের মা কথা বলতে চায় একা ও আলেয়া বেগমের সাথে। রাদিক নম্বর নিয়ে যাবার ১০ মিনিটের মাথায় ফোন দেয় মোস্তারী বেগম। একাকে জানায় “ওদের বাসায় সবাই বলতেছে সাদিক যেহেতু মত দিয়েই ফেলেছে তাহলে সোনিয়াকে দেখে আসুক। নইলে তো কথা আগানো যাবেনা।” ইয়াকুব সাহেবের সাথে কথা বলে জানাবে বলে ফোন রেখে দেয় একা।
সোনিয়ার অনুপস্থিতিতে কথা বলে ওর মা বাবার সাথে। জানায় মুনিয়ার ব্যাপারে সব কথা বলে নিয়েছে। ওদের কোন ব্যাপারেই আপত্তি নাই। ওরা শুধু সোনিয়াকে চায়। ইয়াকুব সাহেব অনুমতি দিলে আজ ওরা সোনিয়াকে দেখতে আসতে চায়। যেহেতু সোনিয়া মত দিয়েছে, তাও পুরোপুরি না, তারপরও নিম হ্যাঁ করেছে তাই সোনিয়ার বাবাও আর দেরি করতে চাননা। সন্ধ্যায় আসতে বলেন সাদিকদের। একা উপরে ফিরে গিয়ে সাদিকের মাকে জানালে উনি বলেন সন্ধ্যার পরে সাদিকেরা ৩ ভাই বোন, সাইফ আর জুঁই যাবে সোনিয়াকে দেখতে।
এদিকে স্কুল থেকে ফিরে সাদিকদের আসার কথা শুনে আবারও বেঁকে বসে সোনিয়া। ও যতই বিয়ের জন্য মন প্রস্তুত করতে চায় ততই ওর সামনে ভেসে উঠে মুনিয়ার মৃতমুখটা। আর মনে পরে স্বামীর হাতে খুব হয়েছে মুনিয়া, সেও যদি খুনীর হাতে পরে? অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠে ওর। মুনিয়ার কথা মনে হলেই টপাটপ কয়েকটা ঘুমের মেডিসিন খায় সোনিয়া, আত্নহত্যার উদ্দেশ্যে না, ঘুমিয়ে গেলে যদি ভুলে থাকা যায় এই জন্য। আজ ঘুমের মেডিসিন না পেয়ে ৫টা মাইগ্রেনের মেডিসিন খেয়ে ফেলে একসাথে। মাইগ্রেনের মেডিসিন একটা খেলেই সে পরবর্তী ১৪/১৫ ঘন্টা উঠতে পারেনা, উঠলেও নেশাগ্রস্তের মতো টলতে থাকে, সেখানে ৫টা খেয়ে ফেলে। তবে ওর এই মেডিসিনের সুবিধা হল মাইগ্রেনের পেইন না থাকলে এটা কাজ দেয়না, ১০/১২ টা খেলেও না। কিন্তু মাইগ্রেনের পেইনের সময় খেলে একটাতেই গভীর ঘুম হয় বেহুঁশের মতো। ঘুমের মধ্যেই ব্যাথার তীব্রতার সময়টা পার হয়ে যায়।
সোনিয়া মেডিসিন খেয়ে ঘরের দরজা দিয়ে শুয়ে থাকে, ওর মা ওকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করে তাও দরজা খুলেনা। এই কথা শুনে একা নিচে নেমে আসে। একার কথায় দরজা খুলে দেয় সোনিয়া। একা ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনেক কিছু বোঝায় আন্তরিক স্বরে, ওর মায়ের মতো চিল্লাচিল্লি করে না। একা বলে, “সাদিক যে ভালো ছেলে এটা পাড়ার প্রতিটা মানুষ বলবে। ওরা নিজেরা তোমাকে ভালোবেসে নিয়ে যাচ্ছে, মুনিয়ার সব কথা উনারা জানে। ওরা শুধু তোমাকে চায়। সাদিক প্রথমে বিয়ে না করার শর্ত দিয়ে দেশে এসেছে। এখন তোমাকে না দেখেই শুধু তোমার প্রশংসা শুনে মত দিয়েছে, তারমানে তোমাকে না দেখেই ভালোবেসেছে। দেখ তুমি মুনিয়াকে হারিয়ে একা হয়ে গেছ, আল্লাহ তোমাকে বোন রূপে মালাকে দিচ্ছে, ভাই রূপে রাদিককে যাকে তুমি ছোট থেকে আদর করে এসেছ। সাদিক খুবই নম্র ছেলে, আস্তে ধীরে কথা বলে। তুমি দেখ, দেখলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোন কথা নাই। তোমার মা বাবা এক মেয়েকে হারিয়েছেন, এখন তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। তুমিও যদি এমন কর তাহলে কেমনে হয়?”
একার কথা শুনে একটু নরম হয় সোনিয়া। কিন্তু শর্ত দিয়ে বসে………………
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৪
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ