#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৬
সাদিকের সাথে সোনিয়ার কথা হয় ৪২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। যেহেতু সোনিয়ার খুব ঘুম পাচ্ছিল সেহেতু তার চেষ্টা ছিল কথা সংক্ষেপ করার। আর সাদিকের সারা জীবনের ইচ্ছা ছিল অন্য কোন মেয়েদের সাথে কথা না বলে যার সাথে বিয়ে হবে তার সাথেই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কথা বলবে।
সোনিয়া বলে – আমি রান্না করতে পারিনা।
উত্তরে সাদিক বলে – সেটা সমস্যা না, আমি রান্নাই করি, সারাজীবন তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো।
সোনিয়া বলে – আমি ঘরের কাজ করতে পারিনা।
সাদিক বলে – আমি বুয়া বিয়ে করছি না, আমি জীবনসংগী চাই।
সোনিয়া বলে – আমার রাগ খুব বেশি।
সাদিক বলে – আমার রাগ নাই। আর তুমি রেগে যাও এমন কিছুই আমি করব না।
এভাবেই চলতে থাকে ওদের কথা। এক পর্যায়ে সোনিয়া কাগজে লিখে একাকে বলে – আপনি না বলেছেন এই ছেলে কথা কম বলে, কোন মেয়েদের সাথে কথা বলেনা। এই তার নমুনা?
একাও লিখে উত্তর দেয় – যেকোন মেয়ে আর তুমি এক হইলা? সোনিয়াকে একটু বাঁকা কথা বলা দেখে একা ওকে বলে লাউড স্পীকার দিতে। তখন সাদিক ওকে পরদিন বাইরে দেখা করার কথা বলে কিন্তু সোনিয়া স্কুলের কথা বলে এড়িয়ে যেতে চায়। একা লিখে দেয় পরদিন স্কুলের শেষে সাদিকের সাথে দেখা করার কথা। সোনিয়া না লিখলেও একার বারবার বলায় সে সম্মত হয় পরদিন স্কুলের শেষে সাদিকের সাথে দেখা করতে।
সাদিক সোনিয়াকে জানায় ওকে তার এতোটাই পছন্দ হয়েছে যে ওর মাথায় এখন একটাই কথা ঘুরছে কখন ওদের বিয়েটা হবে? সাদিকের ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ ও নাই হয়ে গেছে। এই কথায় সোনিয়া জোরে করে হেসে দেয়, কারন বড় হবার পর থেকে বিভিন্নজনের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে এই কথা এতোবার শুনেছে যে এখন সত্য কথাও হাস্যকর লাগছে ওর কাছে। সাদিক হাসির কারন জানতে চাইলে সোনিয়া এই কথাটাই ওকে জানায়। তখন সাদিক বলে ও প্রমাণ করে দিবে ও আর দশজনের চেয়ে আলাদা।
কথা শেষ করে ঘুমিয়ে পরে সোনিয়া। পরদিন স্কুলের সময়ের আধাঘন্টা আগে সোনিয়াকে ঘুম থেকে ডেকে দেয় একা। এর মধ্যে সে নিচে গিয়ে সোনিয়ার মা বাবাকে বলে এসেছে আজ স্কুলের পরে ওরা দুজন বাইরে দেখা করবে। আর উনারা যেন বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন।
সোনিয়া ঘুম থেকে উঠে খেয়ে রেডি হয়ে নাবাকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয়। একটু সামনে যেতেই দেখে সাদিক একজনের সাথে বাইক নিয়ে ওদের গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। সোনিয়া কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়, এটাকে ওর হ্যাংলামি লাগে যখন সে দেখে কিছুদুর পর্যন্ত সাদিক বাইক চালিয়ে পিছনে আসে। সোনিয়া ভেবেছিল সাদিক হয়ত স্কুল পর্যন্ত ওকে ফলো করবে, তাই সে বিরক্ত হয় কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে উল্টোপথ ধরে সাদিক। সোনিয়া এর সবই ফোন করে একাকে জানায়।
দুপুর আড়াইটায় স্কুল ছুটি হয় সোনিয়ার। একা নাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আর সোনিয়াকে বুঝায় সবাই খুনী না, ভালোমানুষের সংখ্যা দুনিয়ায় বেশি, সোনিয়া যেন মুনিয়ার কথা ভেবে সব বানচাল করে না দেয়। সোনিয়া প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুল থেকে বের হয়েই দেখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাদিক, সাইফ ছাড়াও ওদেরই বয়সী আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গেলে সাদিক ওর মামা বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। সোনিয়া সালাম বিনিময় করলে সাইফ প্রস্তাব দেয় যেহেতু দুপুর বেলা তাই কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসার। সাদিক দীর্ঘদিন পরে দেশে আসায় জানত না কোনটা ভালো হবে তাই সে সাইফের উপরেই দায়িত্ব দিয়েছিল রেস্টুরেন্ট চুজ করার।
সোনিয়া দেখল সাইফ যে রেস্টুরেন্টের নাম বলেছে সেখানে যেতে হলে রিকশায় যেতে হবে, যেহেতু মানুষ ওকে নিয়ে চারজন তাহলে ওকে হয়তো সাদিকের সাথে রিকশায় উঠতে হবে যেটা সে চায়না। আত্নীয় ছাড়া অন্য কারো সাথে এক রিকশায় উঠাটা ওর পছন্দ না আর সেটা ঠিক ও না। তখন সোনিয়াই বলে ওর স্কুলের হাঁটা দূরত্বে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, নাম লিলিয়ান। সবাই সেখানেই যাওয়ার সম্মতি দেয়।
সেই রেস্টুরেন্ট বাছার সোনিয়ার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল যে সেই রেস্টুরেন্টের নীচের তলায় ওর ফুপাত ভাইয়ের শোরুম আছে, উলটাপালটা কিছু হলেই সে ভাইকে ডাকতে পারবে। (এইটুকু পড়ে পাঠক ভাববেন যে এটা কেমন কথা? কিন্তু যার আপন ছোটবোন স্বামী নামক পশুর হাতে খুন হয়েছে তার পক্ষে কি চট করে কাউকে একবারের দেখায় বিশ্বাস করা সম্ভব?) সোনিয়া ইচ্ছে করেই ওর ভাইয়ের শোরুমের সামনে একটু হাঁটা ঢিল দেয়, ৩জন পুরুষের সাথে ওকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই ওর ভাই ওকে জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার? তখন সোনিয়া সংক্ষেপে যা বলার জানিয়ে বলে “আপনি আব্বুকে কল দিয়েন আর আমি নীচে না নামা পর্যন্ত আপনি শপ ছেড়ে কোথাও যাবেন না।”
রেস্টুরেন্টে গিয়ে সাইফ চারজনের উপযোগী একটা টেবিল বেছে বসে। ইচ্ছে করেই সোনিয়া আর সাদিক কে পাশাপাশি বসায়। খাবারের অর্ডার দিয়ে সাদিকের মামা আর সাইফ অন্য একটা টেবিলে গিয়ে গল্প করে ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে। সেদিন ছিল ১ নভেম্বর, ২০০৬, বুধবার। কথা শুরু করে সাদিক।
“আমার ছুটি তো খুব কম। আড়াই মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম। এক মাস তো চলেই গেল। তাই আমি বলছিলাম তোমাদের বাসায় যদি খুব সমস্যা না হয় তাহলে পরশু শুক্রবার আমরা বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। আমাদের বাসায় সমস্যা হবেনা। সবাইইতো রাজি, আমিই রাজি ছিলাম না, কিন্তু কাল তোমাকে দেখার পর থেকে সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন দেরি করে কি লাভ?” সাদিক বলে।
উত্তর দেয়ার আগে সোনিয়া সাদিকের কথা শুনছিল আর ভাবছিল যে – এই সংকীর্ণ জায়গায় বসেছে ওরা। সাদিক চাইলেই এটা সেটা অযুহাতে ওর হাত স্পর্শ করতে পারত বা ওর দিকে চেপে এসে বসলেও সেই সময় ও কিছুই বলতে পারত না। কিন্তু সাদিক সবসময়ই সচেতন ছিল যেন সোনিয়ার গায়ে স্পর্শ না লাগে। আর সে একবারেও সোনিয়ার চোখ ছাড়া অন্য কোন দিকে তাকায়নি। এই ২৬+ বয়সে কম পুরুষ মানুষ তো দেখেনি। চাকুরি ক্ষেত্রে বা পড়াশুনার জন্য যাদের সাথেই কথা বলতে গেছে তাদের বেশিরভাগই কথা বলেছে শরীরের অন্যান্য জায়গায় তাকিয়ে। সে বোরখা পরে থাকলেও অন্যেরা যেন চোখের দৃষ্টিতেই তাকে গিলে খেয়েছে। কিন্তু সাদিক তাদের চেয়ে সম্পুর্ণ আলাদা একটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। অথচ ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, দুদিন পরেই বিয়ে হয়ে যাবে। অন্য কেউ হলে এখন থেকেই চোখ দিয়ে গেলা শুরু করত। এই ভেবে সাদিকের প্রতি প্রথম ওর একটু মন নরম হয়।
একা বারবার করে ওকে বলে দিয়েছিল যেন ৩ তারিখ শুক্রবারেই বিয়ের ডেট করে ওরা সেটা কনভিন্স করতে। কিন্তু সাদিক নিজেই সেই ডেট বলায় সোনিয়ার আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কনভিন্স করতে হয়না। সোনিয়া বলে, “৩ তারিখটা আমার জন্য শুভ। আমার জন্ম ৩ তারিখে, বিয়েটাও ৩ তারিখে হলে মন্দ হয়না।” সাদিক ক্যালেন্ডারের দিকে খেয়াল না করেই বলে “৩ তারিখ তো অনেক দেরি হয়ে যাবে, এমনিতেই আমার আর ছুটি আছে মাত্র ৪১ দিন।”
সাদিকের এই কথা শুনে সোনিয়া পূর্ণদৃষ্টিতে সাদিকের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। সোনিয়ার হাসি দেখে সাদিক লজ্জা পেয়ে যায়, ঠিক তখনই সাইফ একটা ছবি তুলে ওদের দুজনের। সোনিয়া হাসতে হাসতেই বলে – “আজ ১ তারিখ, পরশু ৩ তারিখ, মানে শুক্রবার।”
এই সময় খাবার আসা শুরু হয়। তখন সোনিয়া দেখে শুধু থাই স্যুপ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। সকাল ১১টা থেকে বাচ্চাদের সাথে ক্লাস করছে সে, তখন বাজে দুপুর প্রায় ৩টা। ক্ষুধায় তার অস্থির অবস্থা। এই সময় শুধুমাত্র স্যুপ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দেখে সোনিয়া হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়না। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা কিন্তু নতুন মানুষের সামনে মুখে কিছু বলতে পারেনা। ভদ্রতার খাতিরে ধিরে সুস্থে একটু একটু করে মুখে তুলছে আর গল্প করছে।
কথা বলে যখন দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় বিয়েটা ৩ তারিখ শুক্রবারেই হবে তখন সাদিক জিজ্ঞেস করে সোনিয়া আইসক্রীম খাবে কি না। সোনিয়া সম্মতি জানালে একটা আইস্ক্রীম অর্ডার করে সাদিক। তখন সোনিয়া সৌজন্য করে বলে আপনি খাবেন না? সাদিক উত্তরে জানায় তুমি যদি দাও।
তখন সোনিয়া ভেবে দেখল যেহেতু বিয়ের জন্য দুজনেই রাজি, দুই পরিবারও রাজি, আল্লাহ চাইলে বিয়েটা হলে শুধু একটা আইসক্রীম কেন অনেক কিছুই শেয়ার করতে হবে, তাহলে শেয়ারিং এখন থেকেই শুরু হোক। তখন সোনিয়া আইসক্রীম একটু খেয়ে সাদিকের দিকে এগিয়ে দেয়।
এদিকে সাদিক মনে মনে ভাবে এই মেয়ে তো মুখে কনফার্ম বলতেছে না আমাকে সে পছন্দ করেছে কি না? কালও জিজ্ঞেস করলাম, এড়িয়ে গেল, আজও তাই। তাহলে অন্যভাবে পরীক্ষা করে দেখি সে আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করছে নাকি পরিবারের চাপে? কিন্তু যখন সোনিয়া আইসক্রীম শেয়ার করতে রাজি হয় তখন সাদিক পুরোপুরি শিউর হয় যে সোনিয়া তাকে পছন্দ করেছে, নইলে একটা মেয়ে যার তার সাথে খাবার শেয়ার করত না।
এক সময় সোনিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। সাড়ে চারটা বাজে প্রায়, ওকে বাসায় যেতে হবে। সাদিককে জানালে সাদিক সাইফকে ডেকে ওর মানিব্যাগ দিয়ে বিল পে করতে বলে সোনিয়াকে নিয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে সোনিয়ার ফুপাতো ভাই পরাগ এর মধ্যেই ওদের বাসায় কথা বলে সব জেনে নিয়েছে। সোনিয়াকে নামতে দেখে পরাগ এগিয়ে আসে, সোনিয়া সাদিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভাই বোনে চোখে চোখে কথা হয় নেগেটিভ না পজিটিভ। কারন সোনিয়াকে পরাগও অনেক ছেলে দেখিয়েছে, সে সবাইকেই না করেছে। সোনিয়ার কাছে থেকে পজিটিভ সাইন পেয়ে পরাগ সোনিয়া বাসায় পৌঁছার আগেই জানিয়ে দেয়।
সাদিক রিকশা ডেকে সোনিয়াকে তুলে দেয়। তখন সাইফ বলে…………
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৬
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ