বৈধ_দৃষ্টি #পর্বঃ১৬ #ফাতেমা_জান্নাত

0
300

#বৈধ_দৃষ্টি
#পর্বঃ১৬
#ফাতেমা_জান্নাত

ফেইরি লাইট মরিচ বাতির আলোয় চার দিকে ঝিকিমিকি করছে।কৃত্রিম আলোর ঝলকানি তে পুরো রাতের পরিবেশ এখন আলোড়ন মুখর।বিয়ে বাড়ি তে রাত এর পরিবেশ হলো অধিক মানুষ এর উপস্থিতি তে জন সমাগম অবস্থা।বাচ্চা দের হৈ হুল্লোড় এর চার দিকে আওয়াজ চার দিকে মুখোরিত হচ্ছে।
বাড়ির রাস্তা থেকে ঘর এর সামনে পর্যন্ত ঝিলিক বাতি লাগানো হয়েছে।আর বাড়ির রাস্তার মাথায় বিয়ের গেইট লাগানো হয়েছে।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগেই রাফিয়া সাফওয়ান রা রাফিয়ার মামার বাড়িতে এসে পৌছায়।গাড়ি থেকে নেমে- ই সাফওয়ান আর আমজাদ সাহেব আশে পাশের একটা মসজিদে মাগরিব এর নামাজ পড়তে চলে যায়।আসার পথে গাড়ি থামিয়ে আসর নামাজ পড়েছে।আর যোহর নামাজ পড়ে- ই বাড়ি থেকে বের হয়ে ছিলো। রাফিয়া, সাবিনা, চম্পা বাড়ির ভিতরে ঢুকে ব্যাগ নিয়ে।রাফিয়ার মামি আর রাফিয়ার মা তাদের দেখে এগিয়ে আসে।রাফিয়ার মামি সাবিনা কে সালাম দিয়ে মোলাকাত করে।তাকে নিয়ে ভিতরে নামাজ রুমে চলে যায়।রাফিয়া আর চম্পা তাদের পিছন পিছন যায়।রাফিয়া, সাবিনা, চম্পা তিন জনে- ই ওযু করে নামাজ রুমে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।এখন আর খোশ গল্প করে নামাজ এর ওয়াক্ত খোয়াতে চায় না।মাগরিব নামাজ এর ওয়াক্ত এমনি তেই সংকীর্ণ।

মাগরিব নামাজ শেষ হতে- ই সবাই মিলে নাস্তা করতে বসে।পুরুষ দের কে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েছে।আর মহিলারা সবাই ভিতরে।রাফিয়া নাস্তা করতে না বসে সুবর্ণার রুম এর দিকে অগ্রসর হয় সুবর্ণার সাথে দেখা করার জন্য।এসেছে থেকে সুবর্ণার সাথে কথা ও হয়নি দেখা ও হয়নি।

রাফিয়া সুবর্ণার রুম এর দরজা নক করতে- ই ভিতর থেকে সুবর্ণা বলে উঠে,

—কে?

রাফিয়া প্রতি উত্তরে বলে,

—আমি সুবর্ণা।আসবো ভিতরে?

—আয় আপু।

রাফিয়া অনুমতি পেয়ে রুম এর ভিতরে প্রবেশ করে।সুবর্ণা রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,

—আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছিস আপু?

—ওয়ালায়কুম সালাম।আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?

—আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আপু।

—খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে।বিয়ে বলেই কি এতো খুশি নাকি?

রাফিয়ার কথা শুনে সুবর্ণা মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।তার লজ্জা লাগছে ভীষণ। সুবর্ণা কে এত লজ্জা পেতে দেখে রাফিয়া বলে উঠে,

—এত লজ্জা পেতে হবে।ইশশ! লজ্জা পাচ্ছে উনি।

বলে- ই রাফিয়া হেসে দেয়।কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাফিয়া সুবর্ণার উদ্দেশ্যে স্বগতোক্তি করে বলে,

—মামা ওই দিন আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বলে ছিলো বড় কোনো আয়োজন করবে না বিয়ে তে।শুধু আত্মীয় স্বজন থাকবে।তাহলে আজ এসে যে দেখলাম বিশাল আয়োজন।

রাফিয়ার কথা তে সুবর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থাকে।মৌনতা কেটে দিয়ে বলে,

—বাবার প্ল্যান ছিলো ছোট আয়োজন করার।কিন্তু কিছুদিন আগে ছেলের বাড়ি থেকে ছেলের বাবা আমার বাবা কে ফোন করে বলে,”এই বাড়ি তে ও যাতে বড় করে গেইট লাগিয়ে আয়োজন করা হয়।ছোট খাটো আয়োজন করলে উনার আত্মীয় স্বজন নাকি মন্দ কথা বলবে।তাই বাবা এখন আবার এই সব ব্যবস্থা করেছে।

—আশ্চর্য কথা।এখানে মন্দ কথা বলার কি আছে?উনারা কি জানেন না স্বল্প খরচ এর বিয়ে তে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা বরকত দেয় বেশি।তাহলে কিসের এতো দুনিয়াবি সকল এর জন্য মন মতো আয়োজন করতে বলছে?

—জানি না রে আপু।বাবা চাই ছিলো এত আয়োজন এর জন্য না করতে।কিন্তু এখন তো কাবিন তো হয়ে গেছে।যদি এতে ছেলের বাবা রে’গে গিয়ে উলটা কিছু বলে।তাই বাবা আর কিছু বলেনি।থাক আপু তুই কাউ কে আর এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস না।বুঝিস-ই তো।পরে বিয়ে বাড়ি রাগা রাগি হলে উলটা বেশি ঝামেলা।

—আমার আর কিছু- ই বলার নেই।তবে ছেলের বাড়ির এমন কাজ আমার মোটে ও পছন্দ হয়নি।

—আমার হাজবেন্ড এর ও এতো আয়োজন পছন্দ না আপু।কিন্তু ওই যে উনার বাবার কারণে এখন তাদের বাড়ি তে ও বড় সড় করে আয়োজন চলছে।

—আল্লাহ হেদায়েত দান করুক এদের।

বলে -ই আর এক মুহূর্ত সুবর্ণার পাশে না থেকে রুম থেকে বের হয়ে আসে।সুবর্ণার রুম এর বাম পাশের এক রুম পরে- ই সাফওয়ান আর রাফিয়া কে থাকতে বলা হয়েছে।মাঝখান এর রুম টা তে সুবর্ণার নানু থাকে।রাফিয়া সুবর্ণার রুম থেকে বের হয়ে এসে নিজে দের বরাদ্দ কৃত রুম এর দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।মাঝখান এর রুম এর সামনে আসতে- ই ভিতর থেকে সুবর্ণার নানু রাফিয়া কে ডেকে উঠে।দরজা খোলা ছিলো বিধায় তিনি রুম এর ভিতর থেকে- ই রাফিয়া কে যেতে দেখেছে।

রাফিয়া মাথায় ওড়না টা ভালো ভাবে টেনে নিয়ে রুমের ভিতর এর দিকে পা বাড়ায়। রুমের ভিতরে সুবর্ণার নানু আর তার বোন বসে বসে পান খাচ্ছে।রাফিয়া দুই জন কেই একটু ভালো করে পরখ করে। পান খাওয়া ঠোঁট দুটো লাল হয়ে আছে।সব গুলো দাঁত নেই মাড়ি তে।যেই কয় টা আছে সেগুলো কিছু টা ভে’ঙে পড়া।মাড়ি তে লেগে থাকা অর্ধেক দাঁত গুলো লাল কালো রঙ এর সংমিশ্রণ হয়ে গেছে এত বছরে পান খাওয়ার কারণে। রাফিয়া যখন তাদের খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত তখন সুবর্ণার নানু হাত এর আঙুলে চুন নিয়ে মুখে দিয়ে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

—শুনলাম মেয়ে তুমি নাকি আবার বিয়ে করছো?

উনার কথায় রাফিয়ার ভাবনার চাদরে ফুটো হয়।রাফিয়া সম্বিত ফিরে এসে স্বগতোক্তি করে বলে,

—জি আলহামদুলিল্লাহ।

রাফিয়ার উত্তর পেতেই সুবর্ণার নানুর বোন বলে উঠে,

—এক স্বামী না ম’রতে আরেক বিয়া করি ফেললে।তর সয় না বুঝি আরেক বিয়া করার জন্য?

উনার কথা শুনে রাফিয়ার গা ঘিনঘিন করে উঠলে।একটা মেয়ে কি ভাবে আরেক টা মেয়ে কে এভাবে খারাপ কথা বলতে পারে।রুচি তে বাধেঁ না?বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে ও এটাই সত্য যে আমরা মেয়েরা -ই অন্য মেয়ে কে দেখতে পারি না।সারাদিন দোষ খুঁজে বেড়ায় নয়তো এটা ওটা বলে খোঁটা দিয়ে থাকি।
এসব ভাবতে -ই রাফিয়ার চোখ জ্বলে উঠলো। চোখ এর কোটরে পানি টই টম্বুর হলো।তবু ও দমে যাওয়ার চেষ্টা না করে উদ্যম গলায় স্বগতোক্তি করে বলে উঠে,

—মুখে মুখে উত্তর দেওয়ার জন্য মাফ করবেন নানু আপু।আমি যত টুকু জানি আপনি ও দুই বিয়ে করেছেন। আপনার প্রথম স্বামী আপনা কে ছেড়ে চলে গেছে।দ্বিতীয় স্বামী মৃ’ত। তো আমার ও তো প্রথম স্বামী মা’রা গেছে বিধায় আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি।তাহলে আপনি কেন আমাকে কথা শুনাচ্ছেন?আপনার আর আমার ক্ষেত্রে তাহলে কি পার্থক্য? আপনি ও তো আপনার প্রথম স্বামী চলে গেছিলো বিধায় দ্বিতীয় বিয়ে করে ছিলেন। তাহলে আমাকে কেন এত কথা বলছেন? তবে কি আপনার ও বুঝি সহ্য হচ্ছিলো না আরেক বিয়ে করা পর্যন্ত?

রাফিয়ার কথা শুনে সুবর্ণার নানু আর তার বোন দুই জনে- ই তেঁতে উঠে।সুবর্ণার নানু তার বোন কে রাফিয়া এভাবে কথা বলার কারণে কথায় তিক্ততা মাখিয়ে ক্ষে’পে উঠে বলে,

—এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না।আমার বোন কে অপমান করো।বড় দের মুখে মুখে কথার উত্তর দিচ্ছো?নিজ এর কোন রূপ দেখিয়ে দেবর কে বিয়ে করে ছিলে?যে তোমার দেবর ও বয়সের বড় একটা মেয়ে কে বিয়ে করেছে।

এদের এসব কথায় রাফিয়ার চোখ ফে’টে কান্না আসছে।মানুষ কি ভাবে এত নোংরা কথা বলতে পারে?রাফিয়া চুপ করে নজর ঘুরিয়ে কান্না আড়াল করার চেষ্টা করছে।

🌸🌸

বাইরে সকলের সাথে কাজ কর ছিলো সাফওয়ান। রাফিয়ার মামা তাকে জোর করে রুমে পাঠায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।জামাই মামা শ্বশুর বাড়ি এসে কাজ করছে।এটা লজ্জা জনক বলে মনে হলো তার কাছে।তাই দেখা মাত্র- ই সাফওয়ান কে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।

সাফওয়ান বাসার ভিতরে ঢুকে একবার ড্রয়িং রুমে চোখ ভুলিয়ে নেয়।নাহ! রাফিয়া এখানে।নেই।তাই আবার নজর ঘুরিয়ে হেসে দিয়ে উপরে উঠতে থাকে।বউ টা এমনি তে ও অভিমান করে আছে।এত কাজ আর মানুষ এর মাঝে তার সাথে থাকার দু দণ্ড সময় ও পাচ্ছে না।যদি ও সকলে কাজ করতে বারণ করছে তাকে।তবু ও বসে তো থাকা যায় না।ইদানীং রাফিয়ার কাছে কাছে থাকতে বড্ড বেশি- ই ভালো লাগে।রাফিয়া কে রাগিয়ে দিতে তার সাথে খু’ন শুটি তে মেতে থাকতে কথা বলতে ভালো লাগে।
এসব ভেবেই হাসতে থাকে সাফওয়ান। রুম এর দিকে পা বাড়াতে গেলে- ই সুবর্ণার রুমের পাশের রুম থেকে আসা কথা শুনে সাফওয়ান এর পা স্থির হয়ে যায়।রুমের আরেকটু সামনে গিয়ে পর্দার আড়ালে দাড়াতেই শুনতে পায় ভিতর থেকে সুবর্ণার নানু রাফিয়া কে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,

—এক স্বামীর সাথে তো পাচঁ ছয় মাস সংসার করেছো। আরেক স্বামীর সাথে তো এখনো করছো। তাহলে এখনো বাচ্চা কাচ্চার মা হতে পারো নাই কেন?বাচ্চা নাও নি কেন?নাকি মা হতে পারবে না কখনো?

রাফিয়া নিরবে চোখ এর পানি ফেলছে।এতক্ষণ সে প্রতি টা কথার উত্তর দিলে ও এখন সে এই কথা শুনে চুপ করে গেছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে সাফওয়ান এসব শুনে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পর্দার আড়ালে থেকে- ই রাফিয়া কে ডেকে কাছে আসতে বলে।রাফিয়া তার কাছে আসতে- ই রাফিয়া কে নিয়ে পর্দার আড়ালে থেকেই সুবর্ণার দুই নানুর উদ্দেশ্যে সাফওয়ান বলে উঠে,

—অন্যের ব্যক্তি গত বিষয় নিয়ে কথা বলে টা নিশ্চয় নিজে কে মুর্খ হিসেবে পরিচয় দেওয়া বলে আমি বুঝি।আশা করি আমি কি বলতে চেয়েছি আপনারা বুঝেছেন।

বলেই সাফওয়ান রাফিয়া কে নিয়ে নিজে দের ঘরে ফিরে আসে।রুম এর দরজা আটকে দিয়ে রাফিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাফিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে অধর ছোঁয়া দেয়।জড়িয়ে ধরে রাখে রাফিয়া কে নিজের প্রশস্ত বক্ষে।রাফিয়া সাফওয়ান এর শার্ট ভিজাই চোখের পানি দিয়ে।সাফওয়ান সান্তনার সুরে রাফিয়া কে বকে উঠে,

—কাঁদবেন না রাফিয়া।এসব মানুষ দের এসব নোংরা কথা শুনে কাঁদতে নেই।এদের মন মানসিকতা টাই খারাপ। অন্যকে মন্দ কথা শুনানো এদের অভ্যাস। তাই এসব লোক দের কথা শুনে কাঁদবেন না।

রাফিয়ার কান্না থামার কোনো নাম নেই।এখন হেচকি তুলে কান্না করছে।সাফওয়ান এবার হাসি দিয়ে মৃদু কণ্ঠে রাফিয়ার কানের কাছে গিয়ে বলে,

—রাফিয়া আপনি এমন ভাবে কাঁদছেন মনে হচ্ছে আমি যএন সত্যি- ই চার বিয়ে করে ফেলেছি।আর আপনি তিনটা সতিন পেয়ে খুশিতে কান্না করছেন আমাকে জড়িয়ে ধরে।এখন আমি চিন্তা করছি আপনার এই কান্না আল্লাহ আবার কবুল করে সত্যি- ই না জানি আপনার তিনটা সতিন হয়ে যায়।

সাফওয়ান এর কথা শুনে রাফিয়া সাফওয়ান এর বুক থেকে মাথা তুলে তাকায়।সাফওয়ান ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে।রাফিয়ার চোখ আবারো ভিজে উঠছে। সাফওয়ান রাফিয়া কে কিছু বলতে নিবে রাফিয়া না শুনেই বেলকনি তে চলে যায়।রাফিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে সাফওয়ান হেসে দিয়ে বলে,

—আলহামদুলিল্লাহ আমার বউ রে’গে গেছে।

চলবে ইনশাল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। রিচেক দেওয়া হয়নি।আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here