#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৭
সাদিক রিকশা ডাকতেই সাইফ বলে তোমরা দুজন রিকশায় করে ঘুরে আসো কিছুক্ষন। একে অপরের সাথে আরো সময় কাটাও, ভালো লাগবে। সোনিয়া একটু জোরেই না বলে উঠে। সাদিকও ওর না শুনে বলে আল্লাহ চাইলে রিকশায় ঘুরার অনেক সময় পাওয়া যাবে। বলে নিজেই রিকশার হুড তুলে হুক ঠিক করে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে সাবধানে নিয়ে যেতে বলে রিকশার নম্বরটা লিখে নেয়। সাদিকের এই কেয়ারটুকু ভালো লেগে যায় সোনিয়ার।
সোনিয়া বাসায় ফিরে দেখে ওর বাবা মা বাইরে যাবার জন্য রেডি হয়ে ওর অপেক্ষা করছেন। সোনিয়া যে পজিটিভ সেটা পরাগ আগেই জানিয়ে দিয়েছে। সোনিয়া বাসায় ফিরলেই একার দায়িত্বে ওকে রেখে সোনিয়ার মা বাবা যায় ওর নানা মামাদের খবর দিতে। একা ওকে জিজ্ঞেস করে কি কথা হল দুজনের মধ্যে? সোনিয়া যতটুকু মনে ছিল বলে। কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করে একা। কেন জানি সত্যিটা বলতে ইচ্ছে হলনা সোনিয়ার, ও মিথ্যে করে কয়েকটা আইটেমের নাম বলে।
সন্ধ্যার পরে, তখনও সোনিয়ার মা বাবা ফিরেনাই। একা আর সোনিয়া চায়ের কাপ নিয়ে গল্প করছে, নাবা পাশে বসে টিভি দেখছে। এই সময় সাদিক কল দিয়ে সোনিয়াকে বাইরে বের হতে বলে, সোনিয়া অসম্মতি জানালে একা ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে জিজ্ঞেস করে সাদিককে কি হয়েছে? সাদিক তখন বলে এমনিতেই এদিক দিয়ে যাচ্ছিল তাই সোনিয়াকে দেখতে ইচ্ছে করল সেজন্য কল দিয়েছে বাসার বাইরে যেতে। একা তখন সোনিয়াকে বলে চল আমিও যাব তোমার সাথে।
ওরা বের হয়ে দেখে সাদিক আর সাইফ দুই ভাই দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাসার সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে। একাকে দেখে সাদিক একটু লজ্জা পেয়ে যায়। এটা বুঝে একা সোনিয়াকে বলে ওদিকে সরে সাদিকের সাথে কথা বলতে, সে সাইফের থেকে কিছু ইনফরমেশন নিবে সাদিকের ব্যাপারে। সোনিয়া সাদিকের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চায় কেন বাইরে ডেকেছে?
সাদিক একটু ইতস্তত করে বলে, “চুল কাটিয়ে এলাম, দেখতো ঠিক লাগছে কি না?”
সোনিয়া হেসে দেয় সাদিকের কথা শুনে। সাদিক আরো লজ্জা পেয়ে যায় সোনিয়ার হাসি দেখে। তখন নিজেকে সামলে নিয়ে বলে “তুমি আইসক্রীম পছন্দ কর দেখলাম তাই তোমার জন্য আইসক্রীম এনেছি।” বলে একটা পলিব্যাগ দেয় সোনিয়ার হাতে। সোনিয়া দেখে ১ লিটারের দুই ফ্লেভারের দুইটা আইসক্রীমের বক্স। আইসক্রীম গলে যাবে তাই বাসায় ফ্রিজে রাখার জন্য সোনিয়া যেতে চাইলে একা ওর হাত থেকে নিয়ে ফ্রিজে রেখে আসে। ফিরে এসে একটু বুদ্ধি করে সোনিয়াকে বলে “বিকেলে আমার ফোনে ফ্লেক্সিলোড দিয়েছিলাম, এখনও টাকা আসেনি। একটু দেখে আসবা কি সমস্যা?”
ফ্লেক্সিলোডের দোকান ওদের বাসা থেকে বেশ দূরে, হেঁটে গেলে ১০/১২ মিনিট লাগে। সোনিয়া বলে “এখন রাত হয়ে গেছে, আমি কেমনে যাবো?” তখন সাদিক বলে “চল আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।” ওরা দুজন হাঁটা শুরু করলে একা সাইফকে বলে “মুনিয়ার মৃত্যুর জন্য সোনিয়া কোন পুরুষকে বিশ্বাস করেনা। বিয়ে করতেই রাজি না কোনভাবেই। অনেক বুঝিয়ে ওকে সাদিকের জন্য রাজি করাইলাম। এখন ওরা একে অপরের সাথে একটু বেশি বেশি কথা বলুক, সময় কাটাক তাহলে দুজনেরই মন নরম হবে দুজনের জন্য, জাস্ট এজন্যই ওদের পাঠালাম।”
সাইফ বলে “আমিও সেকারণেই সাদিককে বললাম সোনিয়াকে ডেকে কথা বল। কারণ সেও বিয়ের কথায় রাজি না। ওর ভয় যদি বউয়ের জন্য মা বাবা ভাই বোনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়। সোনিয়াকে পুরো পরিবারের পছন্দ বলেই ও রাজি হয়েছে। কিন্তু বিয়ে তো শুধু পরিবারের জন্য না। ওদের দুজনকেই দুজনের সাথে জীবন কাটাতে হবে। সেজন্যই ওদের মধ্যে ভালোবাসা বোধ আসাটা জরুরী। গতকাল রাতে যখন কল দিয়েছিল সাদিকের আরো কথা বলার ইচ্ছে ছিল সোনিয়ার সাথে কিন্তু বাসায় ওর মা বাবা ছিল তাই লজ্জায় ফোন রেখে দিয়েছে। আজ আমি সাদিককে আমার ওখানে নিয়ে যাব যাতে ওর যতক্ষণ মন চায় কথা বলতে পারে। আপনিও সোনিয়াকে বলে দিয়েন।”
কথা বলতে বলতেই দেখে সোনিয়া আর সাদিক ফিরে আসছে। ওরা একে অপরের কাছে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই সোনিয়ার মা বাবা ফিরে আসে। সোনিয়ার বাবা সোনিয়াকে ডেকে বলেন ও সত্যিই মন থেকে রাজি কি না? সোনিয়া জানিয়ে দেয় সে রাজি।
সোনিয়া সত্যিই তখনও পর্যন্ত মন থেকে পুরপুরি রাজি হতে পারছিলনা। কেমন জানি একটা খচখচানি ছিল ওর মনে। শুধু পরিবারের কথা চিন্তা করে সোনিয়া সায় দিয়েছিল। সোনিয়াদের বাসায় একটাই মোবাইল ফোন, সোনিয়ার কাছে। সেটাতেই ওর মামা চাচারা কল দিচ্ছে। ওর বাবা সেটা দিয়েই সবার সাথে কথা বলছে, জানাচ্ছে সোনিয়ার বিয়ের ব্যাপারে।
রাতে খাওয়াদাওয়া করে সবাই বিছানায় গেলে সাদিক কল দেয় সোনিয়াকে। কথা বলে প্রায় এক দেড় ঘন্টা। কথা বলতে বলতে সাদিকের ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে সোনিয়া ফোন দেয়। কথা বলতে বলতে ওরা একে অপরের কাছে সহজ হয়ে আসে। আচমকা একটা কথায় সোনিয়া সাদিককে তুমি বলে উঠে। সাথে সাথেই সাদিক ওকে ধন্যবাদ জানায়। সোনিয়া ধন্যবাদের কারন জানতে চাইলে সাদিক বলে সে সোনিয়াকে জাস্ট বলতেই যাচ্ছিল ওকে তুমি করে বলার জন্য।
কথা বলার এক পর্যায়ে সোনিয়া জানায় ওর খুব ইচ্ছে নিজের বিয়ের শাড়ি নিজেই পছন্দ করে কেনার। মালা শপিং এ যাবার সময় যেন সোনিয়াকে সাথে নেয়। সাদিক রাজি হয়। অনেক রাতে, দুজনের ফোনেরই ব্যালেন্স শেষ হলে ঘুমিয়ে পরে যে যার মতো।
২ নভেম্বর, ২০০৬, বৃহস্পতিবার। খুব সকালে সোনিয়ার ঘুম ভাংগে ফোনের আওয়াজে। স্ক্রিনে দেখে ওর মামা কল করেছে, রিসিভ করলে ওর মামা জানায় ওর মায়ের সাথে কথা বলবে। ফোন দিয়ে এসে একটু চোখ না লাগতেই দেখে আবারও ফোনে রিং হচ্ছে। এবারে চাচা কথা বলবেন সোনিয়ার বাবার সাথে। এদিকে সোনিয়ার মা আর সাদিকের মা ফোনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয় এখন যেহেতু প্রস্তুতি নেয়ার সময় কম সেহেতু ওদের বিয়েটা পরিয়ে রাখা হবে, সাদিক পরের বার দেশে এলে সোনিয়াকে অনুষ্ঠান করে তুলে নেয়া হবে।
রাদিক আগে থেকেই জানে ওর স্যারের অবস্থা ভালো না তাই ওর মাকে বলে বরযাত্রী হিসেবে একান্তই যাকে না নিলেই না তাকে ছাড়া বাহুল্য কাউকে না নিতে। ২০ জনের বেশি যেন না হয় ওরা সহ। এদিকে সোনিয়ার বিয়ের কথা শুনে ওর ক্লোজ এক কাজিন রওনা দিয়েছে বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য। রাতেই কথা বলার সময় সাদিক সোনিয়াকে জিজ্ঞেস করে বিয়ে পরানোর সময় কি পরে আসবে ও, কমপ্লিট না পাঞ্জাবী? সোনিয়া পাঞ্জাবী পরে আসতে বলে।
পরদিন সকালে রাদিক আসে সাদিকের ৩টা পাঞ্জাবি নিয়ে সোনিয়াকে দেখাতে যে কোনটা পরবে। বাসায় ঢুকার সময় শুনে সোনিয়া ওর মাকে বলছে ওর ফোনে টাকা তুলে দিতে, ওর ফোনে টাকা নাই। রাদিক পাঞ্জাবি নিয়ে ভিতরে এলে সোনিয়ার মা বলে আমার বড় মেয়ের বিয়ে, আমার খুব শখ জামাইকে শেরওয়ানি পরা দেখব। তখন রাদিক পাঞ্জাবি ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সাদিকের মা ফোন দেয় সোনিয়াকে, বলে “সাদিকের খালার খুব শখ সাদিকের বিয়ের শাড়ি উনি দিবেন, তাই উনি শাড়ি কিনেই রেখেছেন। আমাদের এখন শপিং করার মতো কিছু নাই কারন অনেক জিনিসই সাদিক বাইরে থেকে এনেছে। তুমি অনুষ্ঠানের সময় তোমার মনমতো শপিং করিও।” এই কথা শুনে সোনিয়ার মন খারাপ হলেও আর কিছু বলেনা।
এদিকে একা সোনিয়ার স্কুলে ফোন দিয়ে জানায় শুক্রবারে সোনিয়ার বিয়ে তাই ও স্কুলে যেতে পারবেনা। আচমকা সোনিয়ার ফোনে একটা বড় এমাউন্টের রিচার্জ হয়। সোনিয়া প্রথমে অবাক হলেও বুঝতে পারে এটা সাদিকেরই কাজ। ও ফোন দিয়ে সরাসরি সাদিককে জিজ্ঞেস করে – তুমি আমার ফোনে রিচার্জ করে দিলে কেন? উত্তরে সাদিক জানায় “আর ২৪ ঘন্টা পরেই যখন তোমার আমার আলাদা কিছু থাকছেনা তাহলে ফোন রিচার্জ তো খুব সামান্য ব্যাপার।”
হঠাৎ সাদিক কল দেয় মার্কেট থেকে, ঈদের পরপরই মার্কেটে ওর মাপমতো শেরওয়ানি পাচ্ছেনা। আরেক দফা মন খারাপ হয় সোনিয়ার। সাদিকের মা সোনিয়াকে কল দিয়ে বলে সাদিকের বাবা বেঁকে বসেছেন। তিনি সোনিয়াকে না দেখে ছেলের বিয়ে দিবেন না। যতই উনাকে বুঝানো হচ্ছে তুমি এই মেয়েকে আগেও দেখেছ কিন্তু উনার কথা আগে দেখেছি একভাবে, এখন দেখব ছেলের বউ হিসেবে। সোনিয়া যেন ওর মা কে বলে সন্ধ্যার পরে সাদিকের বাবা যাবে ওদের বাসায়। সোনিয়া সম্মতি দিয়ে ফোন রেখে ওর মা কে জানায়।
তখন সোনিয়ার বাবা বলে “অবশ্যই উনাদের আসতে হবে, শুধু ছেলেমেয়ের কথার উপর বিয়ে হবে নাকি? ছেলে মেয়ে যতই একে অপরকে পছন্দ করুক মুরুব্বিদের মধ্যে কথা না হলে বিয়ে হবেনা।” এদিকে সন্ধ্যার আগে দিয়ে সোনিয়ার দুই চাচা এসে যান ঢাকা থেকে। যখন সাদিকের বাবার সাথে বসা হবে তার আগে সোনিয়ার মামাদের ও নানাকে ডাকা হয়। সেই সময় একা সোনিয়ার এক বান্ধবীকে ডেকে এনে সোনিয়াকে মেহেদী দিতে বসিয়ে দেয়। একার কথায় সাদিক মেহেদী কিনে নাবার হাতে বাসায় পাঠায় দেয়।
সন্ধ্যার পরেই একার হাসবেন্ডও চলে আসেন উনার কর্মস্থল থেকে। এসেই দেখেন সোনিয়ার বাবা সাদিকের বাসা থেকে যারা আসবে তাদের জন্য শুধু চা নাস্তার ব্যবস্থা করছে। এটা দেখে উনি একটু রেগে যান। তারপর নিজেই বাজার করে এনে রাতের খাবারের জন্য রান্না করতে বলেন। সোনিয়ার এক মামী নিজেই নেন রান্নার দায়িত্ব। এশার নামাজের পরে সাদিকের বাবা, সাইফ আর সাইফের বড় দুলাভাই। সাদিকের বাবা বরাবরের নরম মানুষ। তাই কথা বলার জন্য দুলাভাইকে সাথে এনেছেন। উনি সোনিয়ার মামার সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক রাখেন। আর তাছাড়া মানুষ হিসেবেও অনেক বিচক্ষণ।
ড্রইং রুমে দুই পরিবারের কথা চলে, ভিতরের ঘরে সোনিয়াকে মেহেদী লাগানো হয়। দুই হাতে কনুই পর্যন্ত, দুই পায়ের পাতা গোড়ালি পর্যন্ত, পিঠে কোথাও বাদ নাই। মেহেদী দেয়ার এক পর্যায়ে সোনিয়ার চাচা ওকে ডেকে নেন পাশের রুমে। জানতে চান এই বিয়ে নিয়ে সোনিয়ার মতামত, ওর মত আছে নাকি? ছেলের সাথে কি কি কথা হয়েছে? সোনিয়া সবই জানায় ওর চাচাকে, এটাও জানায় ওর পূর্ন মত আছে এই বিয়েতে।
এর মধ্যেই হঠাৎ একা মুখ শুকনো করে সোনিয়ার রুমে ঢুকে। দেখেই সোনিয়া আঁতকে উঠে। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? একা তখন সোনিয়া ছাড়া সবাইকে রুম থেকে বের করে দেয়। সোনিয়ার কাঁধে হাত দিয়ে বলে “একটা খারাপ খবর আছে। তুমি মন শক্ত কর।” সোনিয়া জানতে চায় কি খবর? উত্তরে একা জানায়………
#সংসারের_সাতকাহন
পর্ব ৭
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ