বইছে আবার চৈতী হাওয়া
১৩.
বারংবার আপত্তি করা সত্ত্বেও শুভ মীরাকে হলে যেতে দিল না। একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। আজ মীরাকে কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। বারবার ওর দিকে চোখ আটকে যাচ্ছে। গাঢ় সবুজ শাড়ি, ঘন-ভ্রু-পল্লব আর ভেজা গোলাপী ঠোঁটের কোণে ঈষৎ ঝরে পড়া অভিমান। মনের কোনো নিষিদ্ধ কিছু ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছে বারবার।
কোনার দিকে একটা টেবিল খুঁজে মীরাকে নিয়ে বসল শুভ।
– কিছু খাবে?
– না।
– জুস খাও।
– ইচ্ছা করছে না। তুমি ইচ্ছে হলে খাও।
– তাহলে চা দিতে বলি?
একটু অবাক হলো মীরা। শুভ সাধারণত এত কেয়ারিং ভাব দেখায় না। মীরা এবার একটু নরম হলো। বলল,
– হ্যাঁ , চা খেতে পারি।
শুভ একগাদা খাবার অর্ডার করলো। কথা আরম্ভ করতে যাবে, তখনই মীরার ফোন-রিং বাজলো। মীরা ফোন বের একটু অবাক হয়ে গেল। শুভ চোখের ইশারায় জানতে চাইল কে। মীরা ফোন ধরার আগেই বলল আশিক ভাই। বিরক্ত লাগছে শুভর। এতক্ষণ তো ওদের সংগেই ছিল। আবার ফোন করার কি হল।
মিরা কল রিসিভ করে বলল,
– জি আশিক ভাই।
– শুভ কি তোমার সঙ্গে আছে মীরা?
– জি আছে।
-ওকে একটু দাও তো।
দিচ্ছি।
মীরা ফোন এগিয়ে দিল। শুভ ফোনটা কানে ঠেকিয়ে বলল,
– হ্যালো।
– হ্যাঁ শুভ, কালকে আমরা প্রোগ্রামের সাকসেস সেলিব্রেট করছি। সন্ধ্যার সময় চলে আসিস।
– তোরা এনজয় কর। আমি এসে কি করব?
-তোকে ছাড়া তোর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এনজয় করবো? এত সাহস আমাদের আছে নাকি? চলে আসিস সন্ধ্যাবেলা।
মীরা অন্য পাশের কথা কিছু শুনতে পাচ্ছেনা, তবে শুভকে দেখে বেশ বুঝতে পারছে যে ও খুশি হয়েছে। মিরা জানতে চাইলে ও হালকা গলায় বলল,
-তেমন কিছু না। প্রোগ্রামের সাকসেস সেলিব্রেশন হবে। সন্ধ্যায় আমাকে যেতে বলেছে তোমার সঙ্গে।
মীরার খুব ভালো লাগলো। আশিকের এই ব্যাপারগুলো ওর বেশ লাগে। কেমন একটা প্রচ্ছন্ন দূরত্ব বজায় রাখে সবসময়। এই এতগুলো দিন ধরে একসঙ্গে কাজ করেও, একটুও অস্বস্তি বোধ করেনি। মনে আছে প্রথম যেদিন টিএসসিতে একসঙ্গে বসলো সবাই। আশিক তখনও এসে পৌঁছায়নি। রাসেল সহ আরো দুজন ছিল। সেদিন ক্যফেটেরিয়ায় বসা হয়নি, খোলা চত্বরে বসে ছিল গোল হয়ে। মারুফা আর রিপন গল্প করছিল। মীরাকে দেখে শুধু হেসেছিল একবার তাকিয়ে। রাসেল খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,
-বস মীরা।
মীরাএকটু দূরত্ব রেখে বসলো। এই ছেলেটার চাহনি ওর ভালো লাগেনা। ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে রাসেল ওকে আপাদমস্ত স্ক্যান করছে। মিরা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-ভাইয়া আমি একটু ক্যাফেটারিযা থেকে আসছি।
চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাই। চা খাবা তো?
মিরা কি বলবে বুঝতে পারল না। তবে সামনে তাকিয়ে দেখল আশিক হেঁটে আসছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। আশিক কাছাকাছি এসে বলল,
-তোরা এখানে কি করিস? চল ক্যাফেটারিয়াতে যাই।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত মিটিং হয়েছিল। যেহেতু মীরার কাজটা স্টেজ নিয়ে, আর স্টেজের কাঠামো কেমন হবে সেটা ঠিক না হলে বাকি কাজগুলো ঠিক করা যাচ্ছিল না। তাই মীরার অংশ বেশি থাকায়, ওকে থাকতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
সব শেষ করে বেরোতে বেরোতে প্রায় দশটা বেজে গেল। আশিক ওকে হল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। গেটের ভেতর ঢুকে হঠাৎ পিছন ফিরে মীরা দেখেছিল, হলের উল্টোদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশিক। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট; গায়ে জড়ানো গেরুয়া চাদর। আকাশে সেদিন ঘোলাটে চাঁদ। পৌষের নিরালা রাতে খুব অদ্ভুত লেগেছিল দৃশ্যটা মিরার কাছে।
-মিরা।
মিরা চমক ভেঙে তাকালো।
– কি এত ভাবছো? শুভ জানতে চাইল।
– কিছু না।
– চা খাও। ঠান্ডা হচ্ছে তো।
মীরা চায়ের কাপে চুমুক দিল। অতিরিক্ত চিনি দেয়া ঠান্ডা চা। খেতে বিচ্ছিরি লাগছে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না। দামি রেস্টুরেন্টের চা খারাপ; অথচ রাস্তার পাশের দোকানের চা ভালো। একথা শুনলেই বিরক্ত হয় শুভ। ও সবকিছুর গুণের পরিমাপ করে টাকা দিয়ে। যে জিনিস যত দামি, তার গুণগত মান তত ভালো। এই ব্যাপারটা মীরার ভালো লাগে না। ওর নিজের বানানো জিনিসগুলো খুব সস্তা ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করা, কিন্তু তবু মীরার ভালো লাগে। জিনিসগুলোর মধ্যে একটা স্বতন্ত্র আছে। দু একবার শুভর সঙ্গে এ নিয়ে কথাও বলেছিল। দেখিয়েছিল খুব আগ্রহ করে। শুভ পাত্তা দেয়নি। তারপর থেকে আর দেখায় না।
– তুমি এত অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ কেন আজকে?
– অন্যমনস্ক না; টায়ার্ড লাগছে। তোমার পরীক্ষা কেমন হলো?
– সেটাই তো এতক্ষণ ধরে বলার চেষ্টা করছি।
মীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-বলো।
– আমার স্কোর ৬ হলেই চলতো কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ৮.৫ এসেছে।
– বাহ ভালো তো।
– তোমার সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাইছিলাম।
– আমার সঙ্গে? মীরা বেশ অবাক হলো। সাধারণত এসব ব্যাপারে শুভ ওর মতামতকে গুরুত্বই দেয় না।
– কি বলো।
– আমি বলছিলাম কি তুমিও পরীক্ষাটা দিয়েই ফেলো।
– আমি? আমি কেন পরীক্ষা দেব?
– দেখো আমার ফাইনাল পরীক্ষার আর ছয় সাত মাস বাকি আছে। এরপরেই আমি অ্যাপ্লাই করে ফেলবো। তোমার পরীক্ষা দেয়া থাকলে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এপ্লাই করতে সহজ হবে।
– আমাকে সঙ্গে নিয়ে এ কথাটার মানে কি?
– মানে স্পাউস ভিসা পাওয়া সহজ হবে আর কি।
-স্পাউস ভিসা পেতে গেলে আগে বিয়ে করা লাগবে। তুমি বাসায় কিছু জানিয়েছ?
-সে জানিয়ে দেবো।
-না, এভাবে হবে না।
– দেখো কাগজপত্রে বিয়েটা হয়ে থাকলে তো এপ্লাই করে ফেলতে পারি।পরে যা হবে দেখা যাবে।
– এভাবে আমি চাই না।
– তাহলে কি চাও? আমি তোমাকে রেখে চলে যাই?
– দরকার হলে যাবে, কিন্তু আমি এভাবে পড়াশোনার মাঝখানে যেতে চাই না।
– তুমি ওখানে গিয়ে আবার পড়াশোনা করতে পারবে।
মীরা খুব ভালো করেই জানে, এভাবে পড়াশোনার মাঝখানে যদি ও চলে যায়, তাহলে ওর আর পড়াশোনা হবে না। এমন অনেক মেয়েদের কথা ও জানে; যারা এমনিভাবে পড়াশোনার মাঝখানে দেশের বাইরে চলে গেছে। এখন হয়তো কোন কফি-শপে বা রেস্টুরেন্টে কাজ করে বেঁচে আছে। দেশের সবাই জানে তারা খুব ভালো আছে, কিন্তু সে রকম জীবন মীরা চায় না। ওর খুব ইচ্ছে, ছোট দুই বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। সুমনা পড়াশোনায় খুব ভালো। ওর খুব ইচ্ছা ডাক্তারি পড়ার। মীরা এমন একটা কান্ড করলে ওর দুই বোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ও সেটা কিছুতেই হতে দেবে না। ওর খুব ইচ্ছা ছিল, পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি নিয়ে, মা আর দুই বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসার।
– তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না?
শুভর কথায় আবারও চমক ভাঙল ওর। মীরা স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল,
– তুমি আগে তোমার বাসার সবার কাছে আমার কথা জানাও। পারিবারিকভাবে সবকিছু হোক। তারপর দেখা যাবে।
শুভ কেমন যেন চুপসে গেল। এম্নিতে মীরা নরম-সরম, কিন্তু ওর মধ্যে এমন একটা প্রখর ব্যক্তিত্ব আছে যে, শুভ ঠিক ওর সামনে দাঁড়াতে পারে না। খুব করে ভেবে রেখেছিল আজকে মিরাকে রাজি করিয়েই ফেলবে, কিন্তু হলো না। শুভ খুব ভালো করেই জানে, ওর মা-বাবা কখনোই মিরাকে মেনে নেবে না। ও বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বড় দুই বোন ডাক্তার। একজন ইউকেতে, একজন অস্ট্রেলিয়ায় আছে। শুভকে নিয়ে ওর বাবা-মায়ের অনেক আশা। ওর বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। তাছাড়া মিরার বাবা নেই। ও চাচার বাড়িতে থাকে।সেই চাচাও কাপড়ের ব্যবসা করে। সহজ ভাষায় যাকে বলে দোকানদার। এইরকম একটা ফ্যামিলিতে শুভর বাবা-মা ওর বিয়েটা কিছুতেই মেনে নেবে না। শুভ ভেবেছিল একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তখন উভয়পক্ষকেই ম্যানেজ করা সহজ হবে। কিন্তু মীরা রাজি হচ্ছে না। যাক কতদিন আর এরকম করবে? শুভ ঠিক ওকে ম্যনেজ করে নেবে।
– চলো উঠি। মীরা ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল। শুভ আর কথা বাড়ালো না। মিরাকে রিকশা করে দিল। মীরা ইচ্ছা করেই হলের উল্টোদিকে নামলো। ব্যাগ থেকে চাদরটা বের করে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে। তারপর ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে গেটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।