প্রেম_প্রেম_পায় #স্বর্ণালী_সন্ধ্যা পর্ব বারো

0
536

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব বারো

১২.
মা বের হওয়ার পরই অপরাজিতা হাফ ছেড়ে বাচলো। না জানি তার কপালে কি আছে। আপাতত তো বাচলো। এখন ব্যাপারটা ডাক্তারকে জানাতে হবে। জানালে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা ভেবেই কুল পাচ্ছে না অপরাজিতা। তার মায়ের মতিগতিও বুঝছে না। কি এক অশান্তি উফফ!!ভাবতে ভাবতেই ঠাস করে শুয়ে পড়লো সে।

ফায়াদ বাসায় পৌছাতেই দেখলো রাফিয়া আর রিজু বসে আছে তার রুমে। রাফিয়া তার রুমের এদিকওদিক ঘুরছে। আর রিজু বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন দিয়ে ফোন চাপাচ্ছে। এদেরকে হঠাৎ নিজের রুমে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো।

‘তোরা হঠাৎ এখানে কি করিস?’

কণ্ঠ শুনে রাফিয়া ফায়াদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল,
‘ভাইয়া তোমার রুমটাও তোমার মতো নিরামিষ। কিসব পড়াটড়া দিয়ে ভরা।’

ফায়াদ গম্ভীর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘শাট আপ’

রাফিয়াকে ছোট থেকে ফায়াদ অনেক আদর করেছে৷ যার কারনে মেয়েটা এখন বাদর এ পরিণত হয়েছে। ফায়াদকে একটুও ভয় পায় না। ফায়াদ ওকে ওর মতো ছেড়ে রিজুকে বলল,
‘একাই আসছিস?’

রিজু ফায়াদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘মা আছে ফুপির সাথে। তোমার জীবন নিয়ে বড্ড ব্যস্ত আছে দুই নারী’

ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ফেসে গেলাম!’

রাফিয়া ফায়াদের কাছে এসে বলল,
‘ভাইয়া তোমার ফোন দাও’

বের করে ফোন টা দিয়ে দিল ফায়াদ। তারপর সে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুম গেল ফ্রেশ হতে। রাফিয়া আরাম করে বসলো বিছানায়।তারপর ভিডিও কল দিল দূরে অবস্থান করা এক ব্যক্তি কে। ফোন রিসিভ হতেই রাফিয়া ভীষণ নাটকীয়ভাবে বলল,
‘ইশ এই হ্যান্ডসামে ছেলেটা কবে যে আসবে দেশে। তোমার জন্য আমি আজও বিবাহ করি নি।’

উচ্চস্বরে হাসি ভেসে আসলো অপর পাশ থেকে। রিজু থাপ্পড় মারলো রাফিয়ার মাথায়।তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ফারাজ ভাইয়া কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ আছি ভালো। আর রাফিয়া শুন!তোর জন্য তো দেশে একটা রেখে এসেছি!’

রাফিয়া নাক মুখ কুচকে বলল,
‘ওইটা খালি দেখতেই সুন্দর। ডাক্তার মানুষ তো! একেবারে আনরোমান্টিকের ডিব্বা।তার থেকে বড় কথা ওটাকে আমি বড় ভাই মেনে নিয়েছি। ‘

ফারাজ আবারো হাসলো,
‘পাকনা বুড়ি’

রিজু বলল,
‘ওর কথা শুইনো না তো ভাইয়া! আজেবাজে কথা বলে বেশি। তুমি কবে আসবে। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি।’

দেশে আসার কথা শুনে খানিকক্ষণ চুপ থাকলো ফারাজ। তারপর বলল,
‘দেখি’

রাফিয়া বুঝলো ফারাজের আবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।সে রিজু কে সরিয়ে বলল,
‘ধুরু ভাইয়া তুমি আমার গুরুত্বপূর্ণ কথাই তো শুনলে না।’

ফারাজ নিজেকে চট করে স্বাভাবিক করে বলল,
‘হ্যা হ্যা বল’

‘ফায়াদ ভাইকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে সবাই। এতো চেষ্টা করছে কিন্তু ভাই বিয়ে করে না’

‘তারপর?’

‘আচ্ছা! তুমি তো তার ভাই তুমি একটু বলো তো ভাইয়া কি মেয়েদের পছন্দ করে না?ছেলেদের প্রতি আবার—‘

বলার সাথে সাথে কানে টান খেল রাফিয়া।

‘আয়ায়ায়া ছাড়ো ভাইয়া ছাড়ো! আর৷ বলবো না!’

ফায়াদ রাগী ভাবে বলল,
‘বেশি পেকে গেছিস!’

ফোনের স্ক্রিন থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।হাসতে হাসতে বেচারার অবস্থা খারাপ।ফায়াদ ফোন টা নিয়ে বলল,
‘শাট আপ ফারাজ!’

ফারাজ নিজেকে থামিয়ে বলল,
‘স্যরি ভাই’
পরক্ষণেই আবার হাসা শুরু করে দিল। ফায়াদ এর নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করলো। তবে ফারাজকে হাসি খুশি দেখে ভালো লাগছে।
তার এখন মনে হচ্ছে ফারাজ দেশে আসলেই ভালো থাকবে। পরিবারের সাথে থাকলে আবার আগের মতো হাসি খুশি থাকতে পারবে। এভাবে তো জীবন চলে না।

রাতের খাবার খেয়ে অপরাজিতা রুমে গিয়ে গেট লাগালো। এখন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ফায়াদকে ফোন দেওয়া। ফোনটা হাতে নিতেই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনলো।বিরক্তি ছেয়ে গেছে তার মেজাজে। মাত্রই তো আসলো রুমে৷ এখন আবার কী।
দরজা খুলে দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে আছে সাথে তার ছোট ভাই। তাও আবার ওটার কোলে কোলবালিশ। তাদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুচকালো সে। মায়ের দিকে প্রশ্নাত্নক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
রামিসা স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘আবির তোর সাথে ঘুমাবে আজ থেকে। ‘

অপরাজিতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
‘কি?কেন?’

‘এমনি। যা বাবা বিছানায় শুয়ে পড়।’

শেষ কথা টা আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন। অপরাজিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন তিনি। অপরাজিতা বিরক্তি নিয়ে আবিরের দিকে তাকালো।তারপর জোরে শ্বাস নিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো।আজ আর কথা বলা হবে না বুঝতে পেরেছে সে।
আবির বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপু একটা গল্প শুনাও’

অপরাজিতা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা দাতে দাত চেপে বলল,
‘চুপচাপ ঘুমা নাহলে থাপ’ড়িয়ে তোকে মায়ের চামচামি করা ছুটাচ্ছি!ঘুমা!!’

আবির ভয় পেয়ে কোলবালিশ নিয়ে অপরপাশ ফিরে গেল।
অপরাজিতার তো মাথায় আগুন ধরে আছে। সে আজ ডাক্তার এর সাথে কথা বলতে পারছে না। তার ভালোমতো জানা আছে মা তার উপর নজর রাখার জন্যই এই ছোট রিপোর্টারকে তার কাছে রেখে গেছে।
কাল ছাড়া উপায় নেই বুঝতে পারলো অপরাজিতা। এখন তার কাজ হলো ফায়াদের ভাবনায় ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া।

————–

‘স্যার আমার মনে হয় আপনার দেশে যাওয়া উচিত’

ফাইল দেখছিল ফারাজ। কথাটা শুনেই মাথা তুললো,
‘হঠাৎ?’

‘আমি জানি আমার বলা উচিৎ না তবুও বলছি আপনার এতো সুন্দর একটা পরিবার আছে। কেন তাদের থেকে দূরে থাকছেন?’

ফাইল ঘুছিয়ে রাখলো ফায়াদ। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আসুন নীতি।আমার একটু রিফ্রেশমেন্ট লাগবে।চলুন পাশের কেফএ যাই’

দুজন এ বসে আসে একে অপরের বিপরীত চেয়ারে। কফি দিয়ে গেল একজন এসে। ফারাজ খুব মনোযোগ দিয়ে কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। নীতি বুঝার চেষ্টায় আছে ফারাজ আসলে কি বলতে চায়।

কফি শেষ হতেই ফারাজ প্রশ্ন ছুড়লো,
‘আমি বিবাহিত জানেন এটা?’

নীতি অবাক হলো।
ফারাজ নীতির অবাক হওয়া চেহারা দেখে হেসে উঠলো।
‘আপনি স্বভাবে যে শান্তশিষ্ট ব্যক্তি দেখেন ওটা মোটেও আমি না। আমি ছিলাম অনেক চঞ্চল। এমন একটা দিন যেত না যে আমার মায়ের কাছে বিচার না যেত। মারামারি করতাম প্রচুর। মজা মাস্তিতে ব্যস্ত থাকতাম৷ সিরিয়াস শব্দটা আমার ডিকশিনারির বাহিরে ছিল।’

নীতি ক্ষণে ক্ষনে অবাক হচ্ছে৷ ফারাজ আবার বলা শুরু করলো,
‘ভার্সিটি উঠে এক মেয়ের পাল্লায় পড়েছি।মেয়েটা আমার থেকে সিনিয়র এক ক্লাস এর। আমার স্বভাবের সম্পুর্ণ বিপরীতে। কিন্তু ওই যে বলে না? যে বিপরীত জিনিসে আকর্ষণ বেশি। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।মেয়েটার আশে পাশে ঘুরতাম। কয়েকবার প্রোপোজ করেছি। তার সাথে থাপ্পড় ও খেয়েছি৷ আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই যে আছে তার কাছে বিচারও দিয়েছেন সেই মহারানী।কিন্তু আমি তো আমি। পিছু তো আমি ছাড়বোই না।’

ফারাজ কথা গুলো বলছে আর তার মুখে খেলা করছে এক মৃদু হাসি। নীতি দেখলো সে হাসি। লোকটা যেন এক কল্পনা তে বিরাজ করছে।

‘একটা টাইমে মেয়েটা আমার প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়৷ কিন্তু আমার কাছে স্বীকার করে না।আমার উপর এক অদৃশ্য অধিকার দেখাতো। আমি প্রচুর সিগারেট খেতাম৷ ধমকিয়ে সেই সিগারেট ছাড়ালো আমাকে। পড়াশোনায় লাড্ডু ছিলাম। মার্কস কম পেলেই কান ঝালাপালা করা শুরু করলো।মারামারি করার স্বভাব ছিল। মারামারি তে দেখলেই সে এসে আগে চড় মারতো আমাকে। বাজে অভ্যাস গুলো সব ছুটতে লাগলো।’

নীতি বিস্মিত হয়ে বলল,
‘আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি এরকম ছিলেন।’

ফারাজ হাসলো।
‘সময় বদলায়। মানুষ বদলায়। তারপর শুনো!
শুনলাম তাকে একদিন দেখতে আসছে। রাগে আমার অবস্থা খারাপ। ভাই তখন বুঝালো। রাগলে সমাধান হবে না কিছু। ধৈর্য্য ধরতে বলল আমাকে। পরে শুনলাম সেই সম্বন্ধ টা ভেঙে গেছে। ছেলে নাকি ভালো ছিল না। সেদিন বাসায় গিয়ে মাকে বললাম বিয়ে করবো। মা তো অবাক। সব বললাম মা কে। আমার মা-বাবা দুজনেই ভীষণ ফ্রেন্ডলি। তাদের মতো পেরেন্টস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।মা বলল পড়াশোনা শেষে বিয়ে করতে কিন্তু আমার তো তর সয় না। তার উপর সে আমার এক ইয়ার এর সিনিয়ার।বিয়ের বয়স তো বসে নেই। ভাইও মাকে বুঝালো।শেষ এ উপায় না পেয়ে তার বাসায় গেল। বিয়ে টা সুন্দর ভাবেই হয়ে গেল কোনো এক সুন্দর দিনে। নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য পড়াশোনা চলা কালেই বিয়ে বসলাম।’

বলেই হেসে দিল ফারাজ। নীতি মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
‘তারপর?’

‘তারপর খুনসুটি তে চলছিল আমাদের দিন। আমাকে আমার মা মজা করে খোচা মারতো যে ভালোবাসায় পাগল হয়ে বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করে ফেলেছি। যদিও সে আমার থেকে কিছু মিনিটের বড়। বিসনেস এ মন ঢুকলো। সেটাও বুঝার চেষ্টা করতাম বাবার সাথে মাঝে মধ্যে। আর আমার ভাই তখন ডাক্তারি পড়ছিল। ভবিষ্যৎ ডাক্তার ছিল যে কিনা এখন বর্তমান ডাক্তার! সে আমাকে অনেক সাপোর্ট করতো।’

‘সে এখন কোথায়?আপনার ওয়াইফ?’

চুপ রইলো ফারাজ কিছুক্ষণ।তারপর মুখ খুলে বলল,
‘সে এখন নেই ‘
বলতেই এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।হাত দিয়ে মুছে ফেলল চট করে। নিজেকে ভীষণ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
‘মরণব্যাধি! দুই বছর পর ক্যান্সার ধরা পড়েছে তার।আমার সামনে একটু একটু করে নেতিয়ে গিয়েছে আমার সেই মানুষটা। কতো চেষ্টা করেছি! কত ডাক্তার দেখিয়েছি হিসাব নেই! তবুও সে রইলো না। প্রতি রাতে তাকে বুকে নিয়ে কান্না করতাম। সে আমার চোখ মুছে দিয়ে বলতো *ভালোবাসি তো!* তার রোগা দেহ আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। চোখের সামনে যখন তাকে ব্যথায় কাতরাতে দেখতাম তখন আমার বুকটা ভেঙে চূড়ে চূড়মার হয়ে যেত। এই কষ্ট বুঝানোর নয় নীতি।আমি চোখের সামনে আমার ভালোবাসার মানুষের শেষ দেখেছি একটু একটু করে। তার যাওয়ার পর আমি আমাকেই হারিয়ে ফেললাম মনে হয়। রাতে ঘুমোতে পারতাম না। বুকটা খালি খালি লাগতো। যেখানে তাকাতাম তার স্মৃতি শুধু।স্মৃতি গুলো পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে। মায়ের কাছে একদিন কান্না কর‍তে করতে বলেছিলাম মা আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ এখানের বাতাসে আমি শ্বাস নিতে পারি না। মা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল তার ছেলেটা ভালো নেই৷ একটু ভালো থাকার জন্য, একটু প্রানখুলে বাচার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দিল এই ভীনদেশে। মা আমাকে শেষ বার বলেছিল *যে যাওয়ার সে চলে গেছে৷ তুই নিজেকে সামলা। তোর ভালোবাসা নিশ্চয়ই তোকে ভেঙে যেতে শিখায় নি।মেয়েটা তোকে একটু একটু করে ভালো করেছে।* তার পর থেকে এখানে এসে ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জাস্ট মাঝে মধ্যে একটু হোচট খেয়ে যাই’

ফারাজ দেখলো নীতি মেয়েটা কান্না করছে। কখন থেকে কান্না করছে তার খেয়াল নেই। সে তো তার স্মৃতি তে বিচরন করছিল।কান্না করতে করতে মুখ লাল হয়ে গেছে নীতির। ফারাজ দেখলো সে কান্না। তার গল্প শুনে কাদছে এই মেয়েটা। অথচ সে এগুলো পাড় করে এসেছে। বুকটা আবারো ব্যথা করছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সুখের স্মৃতি গুলো। আবার উকি দিচ্ছে দুঃখের গুলোও। এই জীবনটা কী এভাবেই চলে যাবে? সুখ কি আর পাবে না সে?

(চলবে)

(গতকাল ডাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল🙂দুঃখিত!!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here