#রূপবানের_শ্যামবতী
#৪র্থ_পর্ব
#এম_এ_নিশী
বিষাদ মাখা মনমহলে রংধনুর আগমন? সাতরঙা রংধনু বিছিয়ে দিয়েছে কেউ? ওই ধূসর মেঘে ছেয়ে থাকা মন আকাশে? ঘরের দরজা ভেজিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে নিজেকে অবলোকন করে যাচ্ছে অরুনিকা।
কখনো কোনো পুরুষ তাকে এভাবে খোঁজেনি। ওমন চাহনি মেলে চায়নি। ওই চাহনিতে কিছু তো ছিলো যা অরুনিকার ভেতরে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কেন? তাকে কখনো দেখেনি সে। কে এই সুদর্শন পুরুষ? যার রূপের এতো তেজ, সেই মানুষ ওমন প্রেমভরা নয়নে কেন অরুনিকার মতো শ্যামবর্ণ মেয়ের দিকে চেয়ে ছিলো? কেন? উত্তর নেই কোনো।
ঠকঠক করে দরজায় কড়াঘাত পড়তেই চমকে ওঠে অরুনিকা। ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে সে। দরজার ওপাশ থেকে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো,
–কি রে, অরু? দরজা লাগিয়ে কি করছিস? খাবি না? আয় খেতে আয়।
মায়ের ডাক শুনে চট করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে অরু। আরজু বেগম পুনরায় শুধান,
–কি রে, কি হয়েছে?
অরু মাথা নুইয়ে এপাশ ওপাশ নেড়ে জবাব দেয়,
–কিছু না মা, চলো যাই।
এই বলে ছুটে চলে যায় সে।
এদিকে মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরজু বেগম বিরবিরিয়ে বলেন,
“অরুর আবার কি হলো?”
~~~
সেই সুনয়নার দেখা পেয়ে খুশি মন নিয়ে বাড়ির দিকে ফেরে আহরার।
মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই আচমকা লাফিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে রূপা। সবকটা দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে থাকে ভ্যাবলার মতো। গা দুলিয়ে দুলিয়ে ন্যাকা স্বরে প্রশ্ন করে ওঠে,
–ওমা একি! এতো সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
গতকাল এদের দুই বোনের দৃষ্টি লক্ষ্য করেছিলো আহরার। যা বোঝার তা তো বুঝেই গিয়েছে। একে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বেশ কাঠকাঠ ভাবে জবাব দেয়,
–হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।
আহরার ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনই রূপা চেঁচিয়ে বলে উঠে,
–হাত মুখ না ধুয়ে চলে যাচ্ছেন যে। ওই যে কলপাড়। ওখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিন।
আহরার পিছু ফিরে তাকায়। তা দেখে রূপা লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে মাথা নুইয়ে নেয়। মনে মনে ভাবতে থাকে, “এইবার বান্দা মুখ খুলবে। হাত মুখ ধুতে গিয়ে, আর তখনি ওই চাঁদমুখখানা দেখতে পাবো। আহা! ভেবেই কি খুশি লাগছে।”
আহরার রূপার ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে ব্যাঙ্গাত্মক হেসে আস্তে করে বলে, “রিডিকিউলাস।”
বলেই সে গটগটিয়ে ভেতরে চলে যায়।
এদিকে রূপা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে ফাঁকা, কলপাড়ও ফাঁকা। কেউ নেই। মাথায় হাত দিয়ে বিরবির করে বলতে থাকে সে,
“কি হলো ব্যপারটা? গেলো কোথায়? জ্বীনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেলো কি করে?”
~~~~~
ঘরে প্রবেশ করতেই দাইয়ান ধমকে বলে উঠে,
–ম রে গেছিলি নাকি হাঁটতে গিয়ে? ফোনটাও নিয়ে যাসনি। আন্টি কতোবার ফোন দিয়েছে।
–মা ফোন দিয়েছে? কই দেখি…
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে অনেককটা মিসডকল। কলব্যাক করতে সাথে সাথেই রিসিভ হলো।
–কি রে বাবু। কোথায় গিয়েছিলি? কল করে পাওয়া যায় না কেন? আমার চিন্তা হয় জানিস না?তোকে পাঠানোটা কি আমার ভুল হয়েছে?
–মা মা মা, শান্ত হও। এতো উত্তেজিত হইয়ো না। আমি একটু হাঁটতে বেরিয়াছিলাম শুধু।
–কেন বেরিয়েছিস? একদম এদিক ওদিক বেরোনোর দরকার নেই। আর শোন, মানুষজনদের ভীড়ে বেশি যাবি না। আর মেয়ে মানুষরা যেদিকে থাকবে, ওখানকার সীমানাও পেরোবি না। দূরে দূরে থাকবি। বুঝলি?
–হ্যা মা বুঝেছি। তুমি এতো চিন্তা করো না। সবকিছু ওকে থাকবে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমি এখন রাখছি। পরে ফোন করবো।
কথা বলা শেষ হতেই দাইয়ান ফোঁড়ন কেটে বলে উঠে,
–কি রে সেই একই বানী? মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলবি..
–মায়ের ই বা কি দোষ দিবো বল। সেই ইন্সিডেন্ট গুলো মা ভুলতে পারে না। অনেক বড় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে মায়ের মনে। তাই ভয় থেকেই এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখে সবসময়..
–হুম বুঝতে পেরেছি। থাক বাদ দে এখন এসব। খেয়ে নিবি চল। খাবার দিয়ে গেছে। তুই তো বাইরে সবার সামনে খাবি না। তাই ঘরেই খাবো সবাই একসাথে আয়।
–চল, প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে।
৪ বন্ধু মিলে একসাথে সকালের খাওয়া দাওয়া সারছে। মুখের মধ্যে একগাদা আপেল ঢুকিয়ে ঈশান বলে উঠে,
–তোর বোন দিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে এবার তো তোর পালা দাইয়ান। কোনো মেয়ে টেয়ে পটিয়ে রেখেছিস নাকি?
দাইয়ান হেসে জবাব দেয়,
–ধুরর! আমি আর মেয়ে পটানো? ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। তোর মতো নই আমি।
ঈশানের পিঠে চাপড় মেরে রাদিফ বলে উঠে,
–তাই তো কথা। ঈশান তো মেয়ে পটিয়ে চুটিয়ে প্রেমলীলা সারছিস। তা বিয়েটা কবে খাওয়াচ্ছিস তাই বল?
–প্যারা নাই চিল। খুব শীঘ্রই ঈশান মাহমুদের বিয়ে খাচ্ছিস তোরা কনফার্ম।
রাদিফকে পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে দাইয়ান,
–তারপর তোর খবর বল রাদিফ। তোর মা তো মেয়ে দেখছে তোর জন্য। পছন্দ হলো কাওকে?
–মায়ের যতো বাছাবাছি। এতো সহজে কি আর মনে ধরে কাওকে?
ঈশান বলে উঠে,
–আরে পছন্দ হয়েই যাবে একটাকে। তোরও বিয়ের সানাই বাজলো বলে। আর এদিকে আমাদের রূপবানকে দেখ। যারই সবার আগেই বিয়ে হওয়ার কথা, ইহজন্মে আর তার বিয়ে দেখার শখ মিটবে কিনা জানিনা।
আহরারের কাঁধ চাপড়ে হাসতে হাসতে জবাবটা রাদিফই দেয়,
–রূপবানের তো আবার কাওকেই পছন্দ হয় না।
মাঝখান থেকে দাইয়ান বলে উঠে,
–শুধু কি তাই, মনে আছে? দেশ সেরা সেই সুন্দরীর কথা। নামকরা ডেকোর কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ছিলো, আহরারের কোম্পানি IWAK এর সাথে যুক্ত ছিলো কোম্পানিটি বেশ অনেকদিন। সেই মেয়ে কতোটা ধর্না দিয়ে পড়ে ছিলো ওর পায়ে। তোরা বল, আমরা তিন বন্ধুই সেই মেয়েকে দেখে পাগল ছিলাম। আর আহরারকে দেখেছিলি, মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকালো না। কি করেনি সেই মেয়েটা আহরারের মন পাওয়ার জন্য। শা লা আইসা কয় কি? তার নাকি চোখ আটকায়না ওই মেয়ের দিকে তাকাইলে।
ঈশান লাফিয়ে উঠে দাইয়ানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
–আমি নিশ্চিত, ওই মেয়ের মতো মেয়ের দিকে তাকাইয়াও ওর চোখ আটকাইলো না। পৃথিবীর আর কোনো মাইয়ারে দেইখা এর চোখ আটকাইবো না।
রাদিফও সায় দিয়ে বলে উঠে,
–সুতরাং, আমাদের রূপবানেরও আর বিয়ে হবে না। তার বিয়ের আশাই বসে থেকে আমাদের চুল দাড়ি পেকে, মরে, কবরে গিয়ে ভুতই হয়ে যাবো।
এবার সরাসরি আহরারকেই প্রশ্ন করে দাইয়ান,
–কি রে সুন্দর পোলা, তোর কি চোখ আটকাবে না রে কাওকে দেখে? তোর বিয়ে খাওয়ার যে বড্ড শখ আমাদের।
আহরার হেসে উঠে জবাব দেয়,
–আটকেছে তো।
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে ব্যাঙ্গ করে দাইয়ান আহরারের কথাকে পুনরাবৃত্তি করে বলে,
–হাহ! আটকেছে।
রাদিফ, ঈশানও যেন একটু ব্যঙ্গস্বরে হাসলো। হাসতে হাসতেই কমলার কোয়া মুখে পুড়তে লাগলো তিন বন্ধু। তারপর…
ধুম করে থেমে গেলো খাওয়া। চোখ তুলে সর্বপ্রথম দাইয়ান চাইলো। অতঃপর রাদিফ আর ঈশান। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ঈঙ্গিত করলো, তিনজনেই কি একই কথা শুনেছে কিনা? যখন তিনজনেরই শোনা কথা একই ছিলো বুঝতে পারে ঝট করে তাকালো আহরারের দিকে। তিন বন্ধুই সাঁই করে এসে একেবারে মুখের ওপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় আহরার একটু ভড়কে পিছিয়ে যায়। ভয় পাওয়া স্বরে বলে,
–এমন করে দেখছিস কেন?
দাইয়ান প্রশ্ন করে,
–কি বললি তুই একটু আগে? আটকেছে মানে?
–তোদের প্রশ্নেরই তো উত্তর দিলাম। চোখ আটকেছে কাওকে দেখে তাই বললাম।
রাদিফ অবিশ্বাসের সুরে আহরারের গালে, কপালে হাত দিয়ে দেখতে দেখতে বলে,
–এই তোর শরীর ঠিক আছে?
ঈশান জবাব দেয়,
–এই না না, ওর শরীর ঠিক নেই ওর মাথাও ঠিক নেই। চল চল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে চল।
এই বলে সে প্রায় আহরারকে কোলে তুলে নেওয়ার প্রয়াস করে। এদিকে ঈশানের কথায় দাইয়ানের উত্তর,
–আরে গ্রামে তো ভালো ডাক্তার নেই, আছে হাতুড়ে ডাক্তার।
ঈশান আহরারকে টানাটানি করতে করতেই বলে,
–আরে হাতুড়ে দিয়েই হবে। ওই হাতুড়ে ডাক্তারের হাতুড়ি দিয়ে ওর মাথায় এক বারি মারলেই মাথা ঠিক হয়ে যাবে। নে চল চল..
তিন বন্ধু সত্যি সত্যি আহরারকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু করে দিয়েছে। আহরার চেঁচিয়ে বলে,
–আরেহহ, করছিস কি? ছাড়.. ছাড় আমাকে..
রাদিফ আহরারের মুখে দুহাত বুলিয়ে বলে
–না বন্ধু, তোকে আমরা এভাবে অকালে পাগল হতে দিবো না..
কষিয়ে এক ঘুষি মারে আহরার রাদিফের পেট বরাবর। “উফফ” করে ছিটকে সরে যায় সে।
–ব্যাটা। আমাকে পাগল মনে হয় কোনদিক দিয়ে।
ঈশান বলে,
–তুই বললি তোর চোখ আটকেছে কোনো মেয়েকে দেখে। এটা কখনো বিশ্বাসযোগ্য? তুই বল?
–দোস্ত! ট্রাস্ট মি। আমি সত্যি বলছি।
আহরারের দুকাধ জড়িয়ে দাইয়ান বলে,
–সিরিয়াসলি বলছিস তুই সত্যি করে বল। একদম সত্যি। এরমধ্যে কোনো ফাইজলামি নাই।
–সত্যি বলছি। আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারিনি, অবশেষে আহরার খানের চোখে কোনো মেয়ে ধরা পড়লো তবে।
রাদিফ পেটে হাত বুলাতে বুলাতে কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করে,
–এই কোথাকার মেয়ে রে? দেখতে কেমন?
–এই গ্রামেরই মেয়ে..
ঈশান বলে,
–সারা দুনিয়া ছেড়ে তোর চোখে পড়লো গ্রামের মেয়ে। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে ওই মেয়ের সাথে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে যা করা লাগে আমরা করবো। তুই শুধু আমাদের ঈশারা দিবি।
–কি অদ্ভুত! কতো ফাস্ট ফাস্ট চিন্তা ভাবনা তোদের।
দাইয়ান বলে,
–এই চোখ কখন আটকালো তোর? আজ?
–আরে না। গতকাল গ্রামে ঢোকার সময়ই।
–শা লা, আর এখন জানাচ্ছিস আমাদের।
রাদিফ বলে,
–দে কিলান শা লা রে।
এই বলে তিন বন্ধু এক প্রকার হাতাহাতি লাগিয়ে দেয় আহরারের সাথে। বেচারা আহরার! বন্ধুদের চাপে পিষ্ট হতে থাকে।
~~~~~
“এমন কালো কুৎসিত মেয়ের জন্য যে এতো ভালো সম্বন্ধ পাওয়া গিয়েছে সেটাই তো অনেক বড় ব্যাপার, সেখানে বয়স নিয়ে মাথা ঘামানোটাতো একদমই উচিত না।”
খালাতো বোন নীলুফার কথাগুলো বেশ শান্তভাবে হজম করে নিলেন আরজু বেগম। দম নিয়ে ধীরস্বরে জবাব দিলেন,
–আমার মেয়ে কালো নয় বুবু, শ্যামলা। তাছাড়া শুধুমাত্র গায়ের রংটা একটু চাপা বলে ৪০ বছর বয়সী একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে তার বিয়ে দিতে হবে? ২১ বছর বয়সী মেয়ের সাথে ৪০ বছর বয়সী কি করে মানানসই হয়?
আরজুর কথা শুনে অট্টহাসি শুরু হয়ে যায় নীলুফার। হাসতে হাসতে বলেন,
–মানানসই এর কথা কও তুমি। ছেলের এতো বড় ব্যবসা। কত টাকা পয়সা। এমন ঘরে গেলে তোমার মেয়ে তো রাজরানি হয়ে থাকবে। যেই মেয়ের জন্য এখনো একটা ভালো সম্বন্ধ জুটাইতে পারলা না। কত কত ঘর লাগলো আর ভাঙলো। সেই মেয়ের জন্য এমন প্রস্তাব তোমার লুফে নেওয়া উচিত আরজু।
–মাফ করবেন বুবু। মেয়ে আমার এতোটাও ফেলনা হয়ে যায়নি যে যার তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিব।
–এমন পোলা দশ গ্রামে পাইবা তুমি?
–শুনেছি এর আগে ছেলের তিন তিনবার বিয়ে হয়েছিলো। ২-৩ মাসের মাথায় বউগুলোই ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাহলে কেমন ভালো ছেলে তা তো বোঝায় যাচ্ছে।
আরজুর কথা শুনে নীলুফার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। থমথমে চোহারা বজায় রেখেই বিদায় নিয়ে চলে যায় সে। যাওয়ার আগে আরো একবার ভেবে দেখার কথা বলতে ভুলে না সে।
আরজু আর নীলুফার শেষের কিছু কথোপকথন কর্ণগোচর হয়ে যায় আহরারের। সে এসেছে এই বাড়িতে দাইয়ানের সাথে। বিয়ের দাওয়াত দিতে। আহরার বুঝতে পারলো কথাগুলো কাকে নিয়ে হলো তবে নিশ্চিত হতে পারছিলো না। নীলুফা চলে যেতেই আরজু বেগম দাইয়ান আর আহরারকে দেখতে পেলেন। কৌতুহলী স্বরে জানতে চান,
–কাকে চাচ্ছো বাবারা? তোমাদের তো ঠিক চিনলাম না।
দাইয়ান জবাব দেয়,
–আমি মকবুল মিঞার বড় নাতি। মিঞা বাড়ির বড় ছেলে মাজেদুল আমার বাবা। শহর থেকে এসেছি। জসীম দাদু আছেন?
–ওহহ! তুমি মকবুল চাচার নাতি। যার নাতনির বিয়ের আয়োজন চলছে?
–জি জি।
–এসো বাবা ভেতরে বসো। আমি আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি।
আরজু বেগম চলে গেলেন শ্বশুরকে ডাকতে। যাওয়ার আগে সেলিনাকে চা নাস্তা রেডি করার কথা বলতেও ভুললেন না।
আহরারের দৃষ্টি কেবল এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। শ্যামবতীকে একনজর দেখার আশায়। এভাবে অরুনিকাদের বাড়িতে আসার সুযোগ পাবে ভাবেনি আহরার। দাইয়ান যখন বলছিলো কোনো এক বাড়িতে দাওয়াত দিতে যাবে ঈশান, রাদিফের মতো আহরারও যেতে মানা করে দেয়। তবে দাইয়ানের জোরাজোরিতে আহরার আসতে বাধ্য হয়। অন্য দুজন তো ঘুমাবেন। ঘুম ছেড়ে বেরোবে না। এখন মনে মনে বলছে আহরার, “ভাগ্যিস এসেছিলাম!”
জসীমউদ্দিন আসতেই দাইয়ান আহরার দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। জসীম সাহেব সালাম গ্রহন করে তাদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। দাইয়ানের সাথে আলাপ শুরু করলেন। এদিকে আহরার ভেতরে ভেতরে ছটফটিয়ে ম রছে। আশপাশ নজর বুলাতে বুলাতে আনমনেই বলে ফেলে সে, “বাড়িটা বেশ সুন্দর।”
তার কথা শুনে জসীম সাহেব বলে উঠেন,
–তোমার ভালো লেগেছে? তাহলে বাড়িটা ঘুরে দেখো।
তখনই সেদিক দিয়ে আদ্রিকাকে যেতে দেখে জসীম সাহেব ডেকে বলেন,
–আদ্রি দাদুভাই, এই নতুন মেহমানকে একটু বাড়িটা দেখাও তো। ও কিন্তু শহুরে মেহমান।
আহরারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–ও আমার ছোটো নাতনী। যাও ওর সাথে দেখো বাড়িটা।
বান্ধবীর ডাক পেয়ে আম কুড়াতে বেরোচ্ছিলো আদ্রিকা। দাদুর ডাক পেয়ে বেশ বিরক্তই হলো। তবুও কিছু করার নেই। আহরারকে নিয়ে বাড়ি দেখাতে লাগলো। অরুনিকাদের বাড়িটিও বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করা। কারুকাজগুলোও ভিষণ সুন্দর। একটা জমিদারি জমিদারি ভাব আছে। কিছুটা দেখাতেই হঠাৎ বান্ধবীর ডাক শুনে আদ্রিকা বলে,
–আপনি ঘুরে দেখুন ভাইয়া। আমি একটু আসছি।
এই বলে ছুট্টে বেরিয়ে যায় সে। এদিকে আহরারের চোখ তো অন্য কাওকে খুঁজছে। বাড়ি দেখাতে তার বিশেষ মনোযোগ নেই।
ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়ছে অরুনিকা। জানালাটি উঠোনের সাথে লাগানো। বাড়ির ভেতরের উঠোনটি খোলা উঠোন। এক ফালি রোদ এসে ভেতরে আছড়ে পড়ে। সেই রোদের ছোঁয়া এসে জানালায় লাগে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগে অরুনিকার। তাই সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দের বইটি পড়ছে সে। পড়ার মধ্যে গভীর মনোযোগ তার।
–বাহ! সাতকাহন? আমারও পছন্দের বই।
আচমকা পুরুষালি কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে অরু। মুখের কাছ থেকে বই সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে জানালার ওপারে সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে। কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো সে? আহরার মুচকি হেসে পুনরায় বলে উঠে,
–স্বপ্ন মনে হচ্ছে নাকি? আরে না। আমি সত্যি দাঁড়িয়ে আছি। এই দেখুন।
বলে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে লাগলো আহরার। আর তা দেখে অরুনিকা আচমকা মুখের ওপর জানালাটি লাগিয়ে দিলো। সে ভিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে আহরারের এমন আচানক উপস্থিতিতে। কিছু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ধীরে ধীরে আবার জানালাটি খুলে দেয় সে। কিন্তু কেউ নেই। ভালো করে উঁকিঝুঁকি মেরেও কাওকে দেখতে পেলো না। তাই বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো। আর তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো সেই স্বর,
–আমাকে খুঁজছেন নাকি, সুনয়না?
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অরুনিকা। পিছু ফিরবে কি ফিরবে না করতে করতে ফিরেই তাকায়। পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দুহাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে আহরার। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। অরুনিকাকে তাকাতে দেখে ভ্রুঁ নাচিয়ে উত্তর জানতে চায় আহরার। অরুনিকা চোখ নামিয়ে নেয়। ইতস্তত করতে থাকে। ছুটে পালাবে কিনা ভাবছে। আর হুট করেই একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে আহরার। নিচু স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে,
–চোখে একটু কাজল পড়বেন সুনয়না? বেশ মানাবে ওই সুন্দর মুখখানায়।
ঝট করে তাকায় অরুনিকা। এভাবে তো কেউ কখনো বলেনি। অথচ এই মানুষটা… অরুনিকা দাঁড়ায় না আর। এবার সত্যিই ছুটে পালায় সে। আহরার হেসে ওঠে। প্রাণখোলা হাসি। তার মুখটুকু খুলে রাখা এখন। হাসিতে তার সৌন্দর্যের আভা কয়েকগুণ বেশি ফুটে উঠেছে। আর এমন সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে বিস্ময় নিয়ে থমকে আছে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অাদ্রিকা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার কুড়িয়ে আনা আমগুলো। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বিরবির করে বলতে থাকে সে,
“এত্তোওওও সুন্দর পুরুষ, কে এই রাজপুত্র?”
চলবে…..
(আজ কিন্তু বড় পর্ব দিয়েছি। এবার সবাই খুশি তো?
আর যাদের নায়কের সৌন্দর্যের বর্ণনা নিয়ে সমস্যা এবং তিন পর্বের সামান্য বর্ণনা দেখেই মনে হচ্ছে একটু বেশি বেশি তাদের বলবো, নায়কের রূপটায় গল্পের অনেক বড় একটা অংশ আর পুরো গল্প জুড়ে নায়কের রূপের বর্ণনা থাকবে। এখনো তো অনেক অনেক বর্ণনা দেওয়া বাকি। তাই আপনাদের প্রতি আমার একটি সুপরামর্শ, খারাপ লাগলে নিঃসংকোচে এড়িয়ে যেতে পারেন গল্পটি। তারপরও যদি পড়েন এবং পড়ে বাড়াবাড়ি মনে হলে তার দায় কিন্তু লেখিকার থাকবে না।)