রূপবানের_শ্যামবতী #৩৫তম_পর্ব #এম_এ_নিশী

0
158

#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩৫তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

অফিসে যাওয়ার পথেই আহরারের কাছে ফোন আসে। হক সাহেবের ফোন। আহরার রিসিভ করতেই উনি বেশ তাড়া দিয়ে বললেন, যেন এক্ষুনি উনার বাড়িতে যায় আহরার। ভিষণ জরুরি।
আহরার তাই অফিসের রাস্তায় না গিয়ে হক সাহেবের বাড়ির রাস্তা ধরে। উনার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতেই দেখতে পেলো পুলিশ এসেছে। আহরার অবাক হয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বললেন,

–আপনিই আহরার খান? ওনার অব IWAK?

আহরার মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,

–জি আমি। কোনো সমস্যা?

আহরার হক সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

–কি হয়েছে হক সাহেব হঠাৎ এমন জরুরি তলব?

উত্তরে পুলিশটি বলে ওঠেন,

–আপনি আমার সাথে কথা বলুন মি.খান।

আহরার পুলিশটির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,

–জি বলুন।

–আপনার কোম্পানিই তো এই বাড়ির ইন্টেরিয়র এর কাজ করেছে তাইনা?

–হ্যা।

–তা মি.খান, আপনি তো বেশ ধূর্ত।

–মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?

–আপনি ড্রাগস সাপ্লাই করেন। এই বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় যেখানে সচরাচর মানুষের নজর পড়বেনা সেখানে লুকিয়ে রেখেছেন। আপনার পরিকল্পনা ছিলো ডিলারের সিগনাল পেলে এখান থেকে সেই জিনিসপত্র গুলো সহ ড্রাগস সাপ্লাই করে দিবেন। যেহেতু আপনার ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং কোম্পানি তার ওপর বেশ নামকরা, তাই খুব একটা সন্দেহ বা চেকিং এর সিচুয়েশনে পড়তে হবে না আপনাকে। এরই সুযোগ নিয়ে বিন্দাস এই ড্রাগস পাচার এর কাজ করে যাচ্ছেন।

আহরার বাকহারার ন্যায় চেয়ে আছে। এই পুলিশ অফিসারের কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। তার কাজের মধ্যে ড্রাগস সাপ্লাই এর ব্যাপার আসলো কিভাবে?

–দেখুন অফিসার, এসব ড্রাগস এর ব্যাপারে আমি বিন্দু পরিমাণও অবগত নই।

–আমরা এই বাড়িটা সার্চ করে সমস্ত ড্রাগস খুঁজে পেয়েছি এবং হক সাহেব নিজেই সাক্ষী দিয়েছেন এই কাজ আপনার।

আহরার বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে হক সাহেবের দিকে। তাতে হক সাহেবের কোনো হেলদোল নেই। তিনি নির্লিপ্ত। এমন একটা মিথ্যা দায় লোকটা কেন তার ওপর চাপালো? কোন শত্রুতার জেরে?

আহরার কৈফিয়ত নিতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। অফিসারটি বলে উঠলো,

–আপনি বেশ সম্মানীয় ব্যক্তি তাই আমরা আপনাকে এরেস্ট করছিনা। আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। চলুন।

আহরার কিছু না বলে পুলিশের সাথে চলে গেলো। কারণ সে বুঝতে পারছে এর মধ্যে এক বিশাল চক্রান্ত আছে।

পুলিশ আয়াজকে খবর জানালে আয়াজ দ্রুত থানায় চলে আসে। আসার পথে অরুনিকাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। থানায় আসতেই পুলিশের সাথে কথা হয় তার। আহরারকে এখনো লকাপে ঢোকানো হয়নি। সম্ভবত তার জামিনের ব্যবস্থা করা যাবে। ইতিমধ্যে দাইয়ান, রাদিফ, ঈশানও চলে এসেছে। দাইয়ান উকিলের সাথে কথা বলে আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করছে। আয়াজের হাতে ছিলো আহরারের ফোন। টুং করে ফোনে ম্যাসেজ আসার শব্দ শুনে সে না চাইতেও ম্যাসেজটা দেখে ফেলে। সাথে সাথে চক্ষু কপালে ওঠে তার। আহরারের দিকে তাক করে রাখে ফোনটা। ইশারায় ম্যাসেজটি পড়তে বলে। আহরার পড়তে থাকে,

“মাই ডিয়ার ব্রাদার, কেমন ফিল করছিস? এটা ছোট্ট একটা ট্রেইলার ছিলো ভাই। সিনেমা এখনো বাকি। প্রতিশোধের খেলা তো কেবল শুরু। তুই আমার কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছিলি আমিও তোর কাছ থেকে তাই কেড়ে নিব। তোর অরুনিকা.. তোকে জেলে না পাঠালে তো ওর কিচ্ছু করতে পারতাম না। একটু অপেক্ষা কর। খুব শীঘ্রই মুক্তি পেয়ে যাবি।”

ম্যাসেজটি পড়ে আহরারের বুঝতে বাকি থাকেনা এই কাজ কার। আয়মান। এতোটা ক্ষোভ পুষে রেখেছে সে মনে, তাও মিথ্যে একটা বিষয়ের জেরে।
আহরার আয়াজকে বলে, আর এক মুহুর্ত দেরি না করতে। অরুনিকার কাছে যেতে। যে করেই হোক অরুনিকাকে বাঁচাতে হবে। হয়তো অরুনিকা এতোক্ষণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তায় যে বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে তার জন্য।
আয়াজও ভাইয়ের কথা শুনে দেরি করেনা আর। ঈশানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে দাইয়ান, রাদিফ দ্রুত জামিনের ব্যবস্থা চালাচ্ছে।

আয়াজ অরুনিকাকে ফোনে পাচ্ছে না। ফোন বন্ধ। বাড়িতে ফোন করে জানতে পারে অরুনিকা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
আায়াজ, ঈশান খান ভিলা থেকে থানায় যাওয়ার রাস্তা পুরোটাই দু-তিন বার চক্কর চালিয়েছে। কিন্তু অরুনিকার নিশানাও পায়নি খুঁজে। যেই নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছিলো সেখানেও বার কয়েক ডায়াল করেছে কিন্তু এটাও বন্ধ। আয়াজ ভেঙে পড়ে ভিষণ। সে তার ভাইয়াকে কি জবাব দিবে? ভাইয়ার দেওয়া দায়িত্ব সে পালন করতে পারলোনা। ঈশান শান্তনা দিয়ে বলে,

–চিন্তা করিসনা আয়াজ, অরুনিকা ভাবির কিচ্ছু হবেনা। আমরা ঠিক খুঁজে পাব। মনের জোর রাখ।

দাইয়ান যখন কিছুতেই আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করে উঠতে পারছেনা তখনই সে আফজাল সাহেবের শরণাপন্ন হলো। তবে আফতাব সাহেবকে কিছু জানালো না। সে অফিসিয়াল কাজে বাইরে থাকায় তাকে ঐ মুহুর্তে এমন দুঃসংবাদ দেওয়াটা অনুচিত বলে মনে করলো তারা। আফজাল সাহেব থানায় আসতেই একপ্রকার হুলুস্থুল লেগে গেলো। কারণ তিনি বিশিষ্ট গন্যমান্য ব্যক্তি। একপ্রকার নিজের পাওয়ার খাটিয়েই আহরারের জামিনের ব্যবস্থা করলেন তিনি দ্রুত।

আহরারের জামিন পেতে খুব একটা সময় ব্যায় হয়নি। জামিন পেয়ে বেরোতেই সে সর্বপ্রথম অরুনিকার খোঁজ করলো। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াজের কাছ থেকে জানতে চাইলে তার নীচুস্বরের জবাব, “অরুভাবিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাইয়া।” কথাটুকু শুনতেই মুহুর্তের জন্য দুনিয়া থমকে যায় আহরারের। অরুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? মস্তিষ্কে ভালোভাবে বারি খেতেই রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেলো সে। ছুটে বেরিয়ে পড়লো একাই। পাগলের মতো অরুকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু কোনো চিহ্নও খুঁজে পাচ্ছে না। এভাবে ক্লুলেস হয়ে কোথায় কোথায় খুঁজবে সে? মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। দিশেহারা হয়ে যখন এদিক সেদিক ছুটছে সে তখনই তার ফোনে আরো একটা ম্যাসেজ আসে। এবারের ম্যাসেজে ঠিকানা দেওয়া, যেখানে অরুকে আটকে রাখা হয়েছে। আহরার যেন জানে পানি পেলো। দেরি করলো না আর। গাড়ি নিয়ে ছুটলো। তবে দাইয়ানের ফোনে ঠিকানাটা ম্যাসেজ করে পাঠিয়ে তাকে আসতে বলে দিলো। আহরারের ম্যাসেজ পেতেই দাইয়ান, ঈশান, রাদিফ আর আয়াজ চারজনই একসাথে বেরিয়ে পড়লো।

এদিকে আহরারের মাথায় খু ন চেপে আছে। সে ভাবছে অরুর গায়ে যদি আজ একটা আঁচও লাগে সে সত্যি খু ন করে ফেলবে আয়মানকে। কিছুতেই ছাড়বেনা। ভাই, বন্ধু বলে আর কিছুই মানবেনা।
গাড়ি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই সে তার গাড়ির গোপন জায়গা থেকে একটা রি ভ লবার বের করলো। এই রি ভ লবারটা সে সবসময় নিজের কাছে রাখে। সেফটির জন্য। যেটা তার বাড়ির লোকেরা কেউই জানেনা। সেই রি ভ লবারটা এতোদিন কোনো কাজে না লাগলেও আজ লাগবে মনে হচ্ছে। আহরার আর কিছু না ভেবে রি ভ লবার নিয়ে এগিয়ে গেলো।

আহরারের এরেস্ট হওয়ার খবর শুনে অরু যখন অস্থির হয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। বাড়ির গাড়িটা অবধি নেয়নি। অন্য কোনো গাড়ি বা কোনো রিকশা নেওয়ার কথাও যেন মাথায় আসেনি তার। সে কেবল ছুটতে থাকে। একটু আগেই দাদীজানের কাছ থেকে যেই ধাক্কাটা খেয়েছে সেটার রেশ কাটানোর আগেই আরো বড় ধাক্কা। অরুনিকার চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়ে যায়। কি করছে, কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। ছুটতে ছুটতে কিছুদূর যেতেই আচমকা তার সামনে হুট করে কালো রংএর এক গাড়ি এসে থামে। অরুনিকা ভয় পেয়ে যায়। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েই গাড়ি থেকে দুজন মুখোশধারী লোক বেরিয়ে আসে। অরুর মনে হলো, তার পালানো উচিত। কিন্তু সে নড়তে পারছেনা। তার পা দুটো যেন দেবে গেছে মাটিতে। শরীরে জোর লাগিয়ে শক্তি সঞ্চার করে পিছিয়ে যেতে চায় কিন্তু পারেনা। লোকদুটো ততক্ষণে এগিয়ে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অরুর মুখে রুমাল চেপে ধরে। খুব একটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেনা সে। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে।

যখন জ্ঞান ফিরলো চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না সে। বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। একটু নড়াচড়া করতেই বুঝলো তার হাত বাঁধা আর চোখও বেঁধে রাখা হয়েছে বলেই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
অরুনিকা বাঁধন খোলার জন্য ছটফট করতে থাকে। তখনই মনে হলো কেউ তার হাত খুলে দিচ্ছে।
হাত দুটো ছাড়া পেতেই সে ঝট করে চোখের বাঁধনও খুলে ফেলে। বেশ অনেকক্ষণ বাঁধা থাকায় চোখ ঝাপসা হয়ে আছে তার। সবকিছু অস্পষ্ট দেখছে সে। বার কয়েক চোখ ডলে ধীরে ধীরে সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পেলো।

নিজের গোপন আস্তানায় অরুনিকাকে বেঁধে রেখেছে আয়মান। হক সাহেবকে পাঠিয়েছে তার বাঁধন খুলে দেওয়ার জন্য। নিজের ছোট্টো ঘরটিতে রাখা চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে পা তুলে বসে আছে সে। চোখ সামনে রাখা স্ক্রিন গুলোতে যেখানে সিসিটিভি ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছে সে। অরুনিকাকে যে ঘরে বেঁধে রেখেছে সেখানেও ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন সেট করা। তারা কি করছে সেসব দেখার সাথে সাথে তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে তাও শোনা যাবে। তাই তো ভিষণ মনোযোগী হয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে স্ক্রিনের দিকে।

চারপাশের অস্পষ্ট সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পেতেই নিজের সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে নজর পড়ে অরুনিকার। বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে সে হক সাহেবের দিকে। যাকে সে তার বাবা বলে মনে করেছিলো, এই মানুষটা তাকে কিডন্যাপ করে এনেছে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করার আগেই হক সাহেবের কথা থামিয়ে দিলো অরুনিকাকে। চিন্তিত নয়নে চেয়ে কেমন উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠেন হক সাহেব,

–অরুমা, তুই? তুই এখানে কেন?

অরুনিকা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। এই তো তার বাবার মতো চাহনি, বাবার মতো কথা বলার ভঙ্গি, বাবার মতোই ডাক, “অরুমা”। তার মানে অরু ভুল নয়। অরু ঠিকই চিনেছিলো নিজের বাবাকে। হক সাহেবই অরুনিকার বাবা জামিল হক। অরুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অশ্রুদের ভিড়ে। অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে সে,

–ব..বাবা।

অরুনিকার কন্ঠে বাবা ডাক শুনে যেন ঘোর কাটে হক সাহেবের। নিজের অজান্তেই তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বসেছেন। এখন কথা ঘোরানোরও কোনো জায়গা রইলোনা। কিন্তু তিনি কথা ঘোরাতেও চাননা। আরো কিছুটা এগিয়ে এসে মেয়ের কাছে বসে তিনি দু’হাতে মেয়ের মুখ আগলে ধরেন। পরমযত্নে মেয়ের চোখে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

–মা, মারে। আমার অরুমা। আমার সোনামা।

হক সাহেবের গলা ভেঙে আসছে। বাবার স্নেহের স্পর্শে অরুনিকা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যায়। বাবাকে জাপটে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে থাকে। হক সাহেবও মেয়েকে আগলে নিয়ে সমানতালে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছেন।

ওদিকে সবকিছু দেখে ও শুনে আয়মান বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে থাবা মেরে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

–আরেহহহ! এই অরুনিকাকেই হক সাহেবের মেয়ে হতে হলো। পুরো খেলাটাই ঘুরে গেলো এখন।

আসিফ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,

–তাহলে এখন কি করবেন বস?

আয়মান স্ক্রিনে হক সাহেব ও অরুনিকার কর্মকান্ডের দিকে নজর রাখে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে জবাব দেয়,

–চেয়েছিলাম অরুনিকাকে অনেক অনেক দূরে পাঠিয়ে দিব। বন্দিনী হয়ে থাকবে সে সারাজীবন। আর আহরার! খুঁজে খুঁজে মরিয়া হয়ে যাবে কিন্তু খুঁজে পাবেনা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। সারাটাজীবন ধরে নিজের স্ত্রীকে হারানোর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে। তিল তিল করে মরবে ভালোবাসা হারিয়ে। আর এই কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হক সাহেবের ওপর ছিলো। যদি সত্যিই অরুনিকা হক সাহেবেরই মেয়ে হয়ে থাকেন তবে তিনি কখনোই এমনটা করবেন না। বিকল্প ভাবতে হবে আমায়। বিকল্প, বিকল্প..

কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলে নেয় অরু। বাবাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। চোখ মুছে অভিমানী স্বরে প্রশ্ন করে,

–সেদিন তুমি কেন আমাকে না চেনার ভান করেছিলে বাবা? তুমি জানো কতোটা কষ্ট পেয়েছি আমি। আর, আর এতো বছর তুমি বাড়ি কেন ফেরোনি বাবা? তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষায় আমাদের কি অবস্থা হয়েছিলো তুমি জানো? সবকিছু বলতে হবে আজ তোমায়। বলো বাবা।

মেয়ের কথা শুনে মলিন হাসলেন হক সাহেব। আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দেন,

–কি করে ফিরবো রে মা। আমি যে নিরুপায় ছিলাম।

অরুনিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হক সাহেব আবারো বলতে থাকেন,

–ব্যবসার কাজে এসেছিলাম এই পাশের শহরে। তবে যার কাছে এসেছিলাম সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমার সম্পূর্ণ টাকাপয়সা সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু পালানোর আগে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে যায় এক ড্রাগস পাচারকারী চক্রের সাথে। মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত হই আমি। এদিকে পুলিশ আমাকে তাই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু আমি ধরা দেইনা। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। বাড়িতে ফেরার উপায় নেই কারণ পুলিশ আমার বাড়ির ঠিকানা জেনে গিয়েছিলো, এমনকি ওখানে গিয়েও আমার খোঁজ চালিয়েছে। আমার জন্য উপযুক্ত ছিলো ওই শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে যাওয়া। যেখানে আমাকে কেউ চিনবেনা। কিন্তু পালানোর কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। ভিষণ অসহায় হয়ে লুকিয়ে থাকতাম যেখানে সেখানে। আহ! কি করুণ দিন ছিলো সেসব। তারপর একদিন ফেরেশতার মতো আগমন ঘটলো আয়মানের। সে আমাকে এই শহরে নিয়ে এলো। নিজের কাছে আশ্রয় দিলো। আমরা দুজনেই একসাথে গড়ে তুলি নিজস্ব বিজনেস। জীবনে সবকিছু ফিরে গেলাম সুন্দরভাবে। শুধু পরিবারটাকেই ফিরে পেলাম না আর।

কথা শেষ করে চোখ মোছেন হক সাহেব। বাবার কথা শুনতে শুনতে অরুনিকারও দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝড়তে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করতেই হক সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন,

–আহা অরুমা। কাঁদছিস কেন? কাঁদেনা মা আমার।

এই বলে পরম মমতায় অরুর চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

স্ক্রিনে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে অজান্তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আয়মানের। একটা চাপা শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবতে থাকে, “বাবা-মেয়ের ভালোবাসা বোধহয় পৃথিবীর সুন্দর বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।”

হক সাহেব এবার কৌতুহলী স্বরে অরুনিকাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন,

–কিন্তু অরুমা, তুই এখানে এলি কিভাবে? এখানে তো আহরার খানের স্ত্রীর থাকার কথা ছিলো। ওরা কি ভুল করে তোকে তুলে নিয়ে এলো?

অরুনিকা অবাক হয়ে বলে,

–বাবা, তুমি জানোনা? আমিই আহরার খানের স্ত্রী।

হক সাহেব যেন মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না এমনকিছু শুনতে। হতবাক হয়ে বলেন,

–কিইই? তুই? তোর বিয়ে হলো কখন?

–সে অনেক লম্বা কাহিনী। কিন্তু আমার বিয়ে হয়েছে, আহরার খানের সাথেই। উনি আমার স্বামী। আর আমাকে মানে উনার স্ত্রীকে তুলে আনার কি প্রয়োজন পড়েছে তোমাদের বাবা? এসব কি তুমি আয়মান ভাইয়ার কথাতে করছো?

এবার হক সাহেব খানিকটা শক্ত কন্ঠেই জবাব দেন,

–হ্যা। আয়মানের কথাতেই করেছি। এই ছেলের জন্যই আজ আয়মানের জীবনের এতো করুণ পরিণতি। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব সে। এমন একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে কি করে হলো অরুমা?

–বাবা, তুমি ভুল বুঝছো। আয়মান ভাইয়ার জীবনের এই পরিণতি উনার জন্য হয়নি। এরমধ্যে অনেক বড় একটা চক্রান্ত আছে বাবা। তুমি উনাকে ভুল বুঝিও না। উনার মতো মানুষ হয়না। তুমি ভাবতেও পারবেনা তোমার মেয়ে কতটা সৌভাগ্যবতী হয়েছে ওই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে।

অরুনিকার চোখের ভাষা হক সাহেবকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে সত্যিই আহরার ছেলেটা খারাপ নয়। হক সাহেব হালকা হেসে পুনরায় অরুর মাথায় হাত রেখে বলেন,

–তুই যদি সুখী হোস মা, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার দুটি মাত্র রাজকন্যা..

সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল স্বরে অরুনিকা আবারো বলে,

–বাবা, আদ্রিরও বিয়ে হয়েছে জানো। আমার দেবরের সাথে। যোগ্য জীবনসঙ্গী আদ্রিকাও পেয়েছে বাবা। আমার বনুটাও খুব সুখী হয়েছে।

হক সাহেবের চোখে এবার আনন্দাশ্রু দেখা দেয়। তিনি আজ ভিষণ খুশি। মেয়েকে দেখতে পেয়েছেন, মন ভরে আদর করেছেন। দুই মেয়েই তাদের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছে বেশ ভালোভাবে। হক সাহেবের যেন আর কোনো চিন্তা থাকলোনা। এবার মৃ ত্যু এলেও তার আর কোনো আফসোস থাকবেনা। মেয়েকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করে হাত বাড়িয়ে দেন হক সাহেব। অরুনিকাও ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বাবার বুকে। তবে তার আগেই বিকট শব্দে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলো আহরার। অরুনিকাকে দেখতেই শান্তির ঢেউ খেলে গেলো তার বুকে। পরক্ষণেই হক সাহেবকে সামনে দেখতেই আহরারের দমে যাওয়া রাগটা নতুন উদ্যমে ফিরে এলো। এই হক সাহেব তাকে ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়েছেন, তিনিই অরুকে কিডন্যাপ করেছেন। আয়মানের সাথে হাত মিলিয়ে হক সাহেব তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার পিঠে ছুরি মারলেন। প্রচন্ড রাগ আর আক্রোশে আহরারে মুখমণ্ডল শক্ত কঠোর আকার ধারণ করলো। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে। তাই কোনো কিছু বিবেচনা না করেই সরাসরি হক সাহেবের দিকে রি ভ লবারটা তাক করে। আহরারকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠলেও রি ভ লবার তাক করতে দেখে মুহুর্তেই সেই হাসি মিলে গেলো অরুনিকার। হক সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় অরুনিকাও। অঘটন ঘটার আগেই বাঁধা প্রদান করার উদ্দেশ্যে অরু খানিকটা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

–দাঁড়ান, এই কাজ করবেন না প্লিজ। উনাকে কিছু করবেন না। উনি আমার বা..

কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলোনা অরুনিকা। তার আগেই ঘর কাঁপিয়ে গু লির আওয়াজ ভেসে আসলো। দেয়ালে দেয়ালে বারি খাওয়া সেই শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো। অরুনিকা চিৎকার করে দুহাতে কান চেপে চোখ বুজে মাটিতে বসে পড়ে। কম্পনরত বুকটা যেন ফেঁটে যেতে চাইছে। অরুনিকা শ্বাস নিতে পারছেনা। কষ্ট হচ্ছে তার। গু লির আওয়াজ থেমে গেলেও চোখ খুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না কিছুতেই। না চাইতেও একটাসময় তাকাতে হয় তাকে। কারণ হুট করেই চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এতোটা নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারছেনা সে। মনে মনে চাইছে খারাপ কিছু যেন তাকে না দেখতে হয়। কিন্তু হায় আফসোস! ভাগ্য সহায় হলোনা। দৃষ্টি মেলতেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন, বেদনাদায়ক দৃশ্য ভেসে উঠলো অরুনিকার চোখের সামনে। দুহাত দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার বাবা জামিল হকের র ক্তা ক্ত লা শ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here