রূপবানের_শ্যামবতী #অন্তিম_পর্ব (প্রথমাংশ) #এম_এ_নিশী

0
198

#রূপবানের_শ্যামবতী
#অন্তিম_পর্ব (প্রথমাংশ)
#এম_এ_নিশী

নিয়তির নিষ্ঠুর আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আঁধারে তলিয়ে কতগুলো জীবন। এই আঁধার কাটবে কবে? আদৌ কি কাটবে?

মায়ের মাথার কাছে বসে বসে জীবনের হিসাব কষছে অরুনিকা। সেদিনটা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা পেরিয়ে তার বাবাকে ফিরে পেয়েছিলো সে। কিন্তু সেই খুশি পুরোপুরি ভাবে উপভোগ করার আগেই মুহূর্তেই এক ঝড়ো হাওয়া এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো সব। চোখের সামনে বাবাকে খু ন হতে দেখলো সে। বাবাকে নিয়ে আনন্দ উৎসব করতে করতে বাড়ি ফেরার বদলে বুকে পাথর চেপে বাবার লা শ নিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে এই বাড়ির দুয়ারে।
আরজু বেগম তো কখনো ভাবেননি তার স্বামীকে তিনি আর কখনো দেখতে পাবেন। সেই তিনি হুট করেই নিজের স্বামীর মুখদর্শন করলেন। তাও মৃ ত। ঘটনা বুঝতে বেশ লম্বা সময় লেগেছিলো তার। যখন বুঝতে পারলেন এতোদিনে মনের গহীনে জিইয়ে রাখা সেই আশার প্রদীপ “তার স্বামী বেঁচে আছেন”, দপ করে নিভে গেলো। আর কোনো আশা নেই, নেই আর কোনো অপেক্ষা। আরজু বেগম এই শোক সহজভাবে নিতে পারলেন না। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। সারাক্ষণ মায়ের কাছে বসে মায়ের সেবায় দিন কাটাচ্ছে অরু। খান বাড়িতে আর ফিরে যায়নি সে। সকলের অনুরোধ, প্রচেষ্টা তাকে আর ওই বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে পারলোনা। সবাই ধরেই নিলো, অরু নিজের বাবার মৃ ত্যুর জন্য আহরারকেই দোষী মনে করে। যার ফলস্বরূপ সে হয়তো চিরকালের মতো শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করলো।

এদিকে আহরার, যার ঠিকানা এখন অন্ধকার এক কাল কুঠুরিতে।
সেদিন কানে তালা লাগানো এক গুলির আওয়াজ, ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত বুক নিয়ে হক সাহেবেরু মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া। তারপর.. অরুর ” বাবা, বাবা” বলে আহাজারি, বাবাকে আঁকড়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার, কান্না। আহরারের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গিয়েছিল। থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো কেবল, রি ভ ল বারটা তখনও তাক করে রাখা। ইতোমধ্যে দাইয়ানরা সবাই চলে এসেছিলো। হক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে অরুর কান্না, “বাবা” বলে ডাকা দেখে কারোরই আর বুঝতে বাকি রইলো না হক সাহেবই অরুর বাবা। যিনি এতোদিন নিখোঁজ ছিলেন। কিন্তু আহরার এটা কি করলো? দাইয়ানরা কিছু করবে তার আগেই পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছিলো। আহরারের রি ভ ল বারটা বাজেয়াপ্ত করে যখন তাকে এরেস্ট করা হয় তখনই হুশ ফিরে তার। একবার পুলিশের দিকে তাকায়, একবার তাকায় নিজের হাতে লাগানো হাতকড়ার দিকে। তারপর অস্থির নয়নে অরুনিকার দিকে চাইলো তবে অরুনিকা ফিরেও দেখলোনা। বুক চিঁড়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাই, বন্ধুদের তাকালো। ক্লান্ত স্বরে কেবল একটাই বাক্য উচ্চারণ করলো,

–অরুকে একলা ছাড়িসনা।

আয়াজ এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করে,

–ভাইয়া, সত্যিই কি এই কাজটা তুমি করেছো?

আহরার কোনো জবাব দিলোনা। মলিন হেসে আরো একবার অরুর দিকে চেয়ে সোজা চলে গেলো পুলিশের সাথে, একজন খু নের আসামী হয়ে।
হক সাহেবের লা শ ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হলো। অরুও ছুটলো পিছু পিছু হাসপাতালে। সঙ্গে রইলো আয়াজ আর দাইয়ান। রাদিফ, ঈশান লা শ অরুদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে।
সমস্ত ফর্মালিটি শেষে বাবার লা শ নিয়ে বাড়ির পথে চললো অরু। এম্বুল্যান্সে অরুর সাথে দাইয়ান আর রাদিফ রইলো। আয়াজ আর ঈশান আদ্রিকা সহ খান বাড়ির সকলকে নিয়ে আসছিলো।
আদ্রিকা শোকে পাগলপ্রায়। বাবার লা শ বাড়ির উঠোনে রাখতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। হাওমাও করে বিলাপ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে একটাসময় জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে। আয়াজ আগলে নেয়।
জসীমউদ্দিন সাহেব নিজের হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে মৃ ত অবস্থায় ফিরে পেলেন, এই বয়সে এতোবড় ধকলটা সামলাতে পারছিলেন না তিনি। অরুর চাচা-চাচীও নির্বাক হয়ে রয়েছেন। আচমকা আসা এতো বড় ঝড় সকলের ওপর ভারি পড়লো যেন।
নিয়মানুযায়ী শোক ভুলে দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হলো। শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন বাড়ি। সকলে যার যার ঠিকানায় ফিরে যায়। আদ্রিকা থেকে যেতে চাইলেও অরুনিকা জোরকরে তাকে আয়াজের সাথে পাঠিয়ে দেয়। অদ্ভুতভাবে অরুনিকা কেমন শক্ত ও কঠোর হয়ে গিয়েছে। তার চোখে মুখে নেই কোনো শোকের ছায়া। চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গিয়েছে তার। এতোটা কঠোরতা ঠিক কি কারণে, কেউই আন্দাজ করতে পারেনা তা। আদ্রিকাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়াটাও ছিলো অন্যরকম। এর পেছনে থাকা তার অভিসন্ধিও থেকে যায় অন্তরালে।

ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে যায়। আহরার এখনো জেলে। তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে আনার সকল চেষ্টা হয়ে গিয়েছে বৃথা। কারণটা আহরার নিজেই। কেসটা যেদিন কোর্টে ওঠে, দুই পক্ষের আইনজীবীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাঝেই সকলকে অবাক করে দিয়ে অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসে আহরার। স্বীকার করে নেয় খু নের দায়। সকলের বিশ্বাস আহরার এই কাজ করেনি। তাহলে সে কেন মিথ্যে স্বীকারোক্তি দিলো? হাজার জিজ্ঞাসাবাদ করেও এই সত্য তার কাছ থেকে উদঘাটন করতে পারেনি কেউ। যদিও রায় হয়নি, সেদিনকার মতো স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সময় পাওয়া সত্ত্বেও আহরারের সপক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করা এখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি।

অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে জেলখানার মেঝেতে ঝিম ধরে বসে আছে আহরার। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো সে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে ওপাশে। তবুও সে ঝিম মেরে থাকলো। মাথা তুলে চাইলোনা। মিনিট দুয়েক নীরবতা চললো। অতঃপর ভরাট এক কন্ঠস্বর,

–আহরার।

অপ্রত্যাশিত চেনা ডাকে ঝট করে চোখ তুলে তাকায় আহরার। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আয়মান। সে-ই আয়মান, যার জন্য আজ সে এখানে। তার পরিবার এমনকি অরুনিকার জীবনেরও আজ এমন করুণ পরিণতি। তীরের বেগে উঠে দাঁড়ায় আহরার। চোখমুখ শক্ত করে কঠোর স্বরে বলে ওঠে সে,

–তুই? কেন এসেছিস এখানে? দেখতে, যা চেয়েছিস তা ঠিকমতো হয়েছে কিনা? তবে দেখ। তোর চাওয়া মতোই হয়েছে সব। তোর প্রতিশোধ পরিপূর্ণ হয়েছে। এবার যা সেলিব্রেট কর।

আয়মান শান্ত। শীতল কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করে,

–খু ন না করেও কেন খু নের দায় নিলি তুই?

আহরার হেসে উঠলো। হো হো করে পাগলের মতো হাসতে থাকে সে। যেন আয়মান খুব মজার কোনো কথা বলেছে। ধৈর্য্য ধরে সবটা দেখতে থাকে আয়মান। পেট চেপে ধরে হাসি থামিয়ে বিদ্রুপাত্মক স্বরে জবাব দেয় আহরার,

–এমনভাবে জিজ্ঞেস করলি যেন তোর খারাপ লাগছে আমি মিথ্যে দায় নিয়েছি বলে? আসলে তো তোর খুশি হওয়ার কথা।

আয়মান নিশ্চুপ। শান্ত চোখে দেখে যাচ্ছে আহরারকে। আহরার এগিয়ে আসে। কন্ঠ নামিয়ে প্রশ্ন করে,

–খু ন টা তুইই করেছিলি তাইনা। দায়টা আমার ওপর দিতে চেয়েছিস। আমার অরুর কাছ থেকে আমাকে আলাদা করতে চেয়েছিস। তুই সফল। আমার অরু আমাকে খু নী মনে করে। ওর বাবার খু নী। ঘে ন্না করে ও আমাকে। ওর চোখে আমি আমার প্রতি একরাশ ঘৃ ণা দেখেছি। তুই বল নিজের ভালোবাসার মানুষটার ঘৃণা নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? আমি পারবোনা। পারবোনা আমি। তাই আমি খু নের দায় স্বীকার করে নিয়েছি। ফাঁ সি হয়ে যাবে আমার। চলে যাব চিরকালের মতো। অরুর ঘৃণা নিয়ে বাঁচার চেয়ে আমার কাছে মৃ ত্যু শ্রেয়।

এতোক্ষণে আয়মানের মুখের অভিব্যাক্তি বদলালো। বিরক্তি ও রাগ প্রকাশ পেলো তাতে। লকাপের শিকগুলো শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো সে। তেজালো স্বরে জবাব দিলো,

–সবসময় আমরা যা ভাবি তা কিন্তু ঠিক নয় আহরার। এটা আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝবেনা। একটু ভেবে বল তো, সত্যিই কি অরুনিকা তোর দিকেই ঘৃণিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলো?

আয়মানের কথা শুনে দমে যায় আহরার। ভাবতে থাকে সেদিনকার ঘটনা, সে যখন রি ভ ল বার তাক করে রেখেছিলো, সাথে সাথে গু লির আওয়াজ। তবে গু লি টা তার রি ভ লবার থেকে বের হয়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যখন অরুকে চিৎকার করতে শুনলো, “বাবা” বলে ডেকে উঠলো ঠিক সেই সময়ে অরু হক সাহেবের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে একবার আহরারের দিকে তাকিয়েছিলো অবাক দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টি মুহূর্তেই ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো। আহরারের মনে হয়েছিলো অরু তার দিকেই ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই যে কেউই ভাববে সে-ই গু লি টা ছুঁড়েছে। তবে আয়মানের এমন কথা বলার কারণ কী?
ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে আহরার কৌতুহলী দৃষ্টিতে আয়মানের দিকে তাকাতেই আয়মান আবারো বলে ওঠে,

–এই সবকিছুর পেছনে অনেক বড় একটা খেলা আছে আহরার। যেটা এতোদিন আমার অজানা ছিলো। তোদেরও অজানা। যদি এই খেলাটার শেষ দেখতে চাস তবে তোকে এখান থেকে বেরোতেই হবে। বুঝতে পারছিস তুই?

আহরার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়মানের দিকে। আয়মানের ঠোঁটে অদ্ভুত এক ফিচেল হাসি।

___
খান ভিলার পরিবেশ নিষ্প্রাণ, নির্জীবের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। বাড়ির ছেলে জেলে, বাড়ির বউ বাড়ি ফেরেনা। কারো মনে কোনো সুখ নেই, নেই কোনো শান্তি। শ্বাস আটকে আছে যেন সকলের। কি হবে? কিভাবে সব ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই সকলের দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়।

বাবার মৃ ত্যুর শোক এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি আদ্রিকা। তবুও আজ সে নিজেকে অনেকটা শক্ত করেছে। কারণ, একটা কঠিন কাজে নামবে সে আজ। সকাল থেকে ঘর জুড়ে পায়চারি করছে সে। কাজটা কি পারবে? হেরে যাবেনা তো? হেরে গেলেই তো সব শেষ। নাহ! তাকে দূর্বল হলে চলবে না। তার বুবুর দেয়া দায়িত্ব তাকে যথাযথভাবে পালন করতেই হবে।
চোখ বুজে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। সন্তর্পণে সেই শ্বাস ছেড়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো যুদ্ধের জন্য।
ধীরপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে সে। পা বাড়ালো ছাদের দিকে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার শরীর। কিন্তু সাহস হারালে চলবেনা। এক পা দু পা করতে করতে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
সামনেই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যজ্জ্বোল নাদিম। বোঝায় যাচ্ছে বেশ খুশিতে সে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আনন্দোৎসব করছে যেন। গুনগুনিয়ে গান গাইছে। আদ্রিকাকে দেখতেই হাসি প্রসস্ত হলো তার। সেই হাসি দেখে আদ্রিকার কেমন গা গুলিয়ে এলো। নিজেকে সামলে সে একেবারে নাদিমের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। নাদিম ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে প্রশ্ন করলো,

–কি ব্যাপার, আদ্রিকা? এতো জরুরি তলব।

মূূলত আদ্রিকাই নাদিমকে ছাদে ডেকেছে। কারণ সবকিছুর সমাধান চাইলে একটা রিস্ক তাকে নিতেই হবে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো আদ্রিকা। তারপর নাদিমের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়াস্বরে বলে ওঠে,

–নাদিম ভাই, আপনি অত্যন্ত নীচ, জঘন্য মনমানসিকতার একজন মানুষ তা কি আপনি জানেন?

দপ করে নিভে গেলো নাদিমের হাসি। এমন কথা হয়তো সে আশা করেনি। ক্ষোভের স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করে সে,

–হোয়াট ননসেন্স! কি বলতে চাইছো কি তুমি?

–আমি ঠিকই বলছি। আমি আপনার ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছি। আপনি একটা শ য় তান।

ক্ষনিকের জন্য নাদিমের চোখেমুখে ভয় দেখা দিলো। তবে পরক্ষণেই তা সরিয়ে ক্রুর হেসে জবাব দিলো,

–আচ্ছা! সব জেনে গেছো। তা কি কি জেনে গেছো শুনি?

নাদিমের কর্মকান্ড সম্পর্কে পুরোপুরি না জানলেও অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই বলে ওঠে আদ্রিকা,

–আপনি আমার অরুবুবুকে মারতে চেয়েছেন। আপনিই আমার বাবাকে খু ন করেছেন আর দোষী বানিয়েছেন আহরার ভাইকে। এই পরিবারের সুখে আগুন লাগিয়েছেন আপনি।

আদ্রিকার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নাদিম। হাসতে হাসতেই বললো,

–ব্যস! এটুকুই জানো শুধু?

আদ্রিকা অবাক স্বরে বলে ওঠে,

–মানে?

নাদিম কিছুটা ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

–আমি তো আরো অনেক কিছু করেছি। জানোনা?

আদ্রিকা সত্যিই এর বাইরে তেমন কিছুই জানেনা। তবে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবটা আগাচ্ছে। সত্যি সত্যি নাদিম এখন তার করা সকল অপরাধের কথা স্বীকার করবে। আদ্রিকা কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে,

–আর কি কি করেছেন আপনি?

নাদিম তার চারপাশে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতেই বলে,

–তুমি আমার সম্পর্কে এটুকু যখন জেনেছো তখন বাকি সবকিছু জানারও অধিকার রাখো। এতো যখন শুনতে চাইছো তবে শোনো, এই বাড়ির বড় বউ তোমার বড় জা তানিশাকেও কিন্তু আমিই মেরেছি।

বলেই আবারো হাসতে থাকে নাদিম। আদ্রিকা বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে। তোতলানো স্বরে বলে,

–ক..কি বল..ছেন কি আপনি? তানিশা ভাবিকে মেরেছেন.. আপনি.. কিন্তু কেন?

–কারণটা ওই আহরার আর আয়মান। ভার্সিটি লাইফে ওদের জন্যই আমাকে কত কত বুলিং এর স্বীকার হতে হয়েছে। আয়মান! আমার গায়ে হাত তুলেছে ও তাও ওই আহরারের জন্য। এই দুই ভাইয়ের জন্যই আমাকে আমার পছন্দের ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তখন থেকেই আমার ভেতরে একটা জেদ বাসা বেঁধেছে যে চরম প্রতিশোধ নিব আমি এই দুই ভাইয়ের কাছ থেকে। এই জেদ আমি খুব যত্নে লালন পালন করতে থাকি। ফারনাজকে গুটি হিসবে ব্যবহার করে এই বাড়ির জামাই হয়ে প্রবেশ করেছি এখানে। আর অপেক্ষায় থাকতাম কখন একটা সুযোগ পাব। আহ! ফাইনালি সেই সুযোগ মিললো যখন আয়মানের পিএ মেয়েটার জন্য তানিশা আর ওর মধ্যে ঝামেলা বাঁধে। এই ইস্যু কাজে লাগিয়ে আমি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করি যেন তানিশা আর আহরারের অবৈধ সম্পর্ক চলছে। আয়মানের পিএ কে দিয়ে আমিই তার কানে বিষ ভরাতাম, আহরার তানিশাকে নিয়ে। আয়মান বোকা ধীরে ধীরে সবটা সত্যি ভাবতে লাগলো। এই সুযোগে আমি সবচেয়ে মোক্ষম চালটা চাললাম। তানিশাকে মেরে দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিলাম। ব্যস! শান্তি। কিন্তু আয়মান গৃহত্যাগী হলেও আহরার.. ও তো বহাল তবিয়তে ঘুরছে ফিরছে। আমার শান্তি তো আবার নষ্ট হলো। তবে আমাকে আর মাথা খাটিয়ে কিছু করতে হয়নি। এরপর সব আয়মানই করতো। আহরারের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছে ওকে দিয়ে ভুলভাল কাজ করাতো আর সেসবকে আমি নতুনরূপ দিয়ে নতুনভাবে কাজে লাগাতাম। আয়মানেরই এক বিশস্ত লোক আমাকে সব খবরাখবর দিত। আয়মান যেহেতু অরুনিকাকে আহরারের জীবন থেকে সরাতে চায় তাই আমি ভেবে দেখলাম যেভাবে তানিশাকে মেরে আহরারের প্রতি আয়মানের ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করেছি সেভাবে অরুনিকাকে মেরে আয়মানের প্রতি আহরারের ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করবো। তাহলেই তো কেল্লাফতে। কিন্তু কিভাবে করবো,কিভাবে করবো ভাবতে ভাবতেই একদিন দাদীজান আমাকে সেই পথ দেখিয়ে দিলেন। উনি চেয়েছিলেন আমি অরুনিকাকে এই বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা করি আর আমি চেয়েছি অন্যকিছু। তোমার বোনের কপাল ভালো বুঝলে আদ্রিকা যে সে বেঁচে গিয়েছিলো সেদিন। কিন্তু ওই গুলবাহার তো আমার জন্য রিস্কি ছিলো। বুড়ি যেকোনো মুহুর্তে মুখ খুলতে পারতো তাই ওইটাকে প্যারালাইসড করার মতো ইনজেকশন মেরে, দিয়েছি সিঁড়ি থেকে ফেলে। পথের কাঁটা সরিয়ে দিলাম। এরপর আবার ভাবতে বসলাম কিভাবে অরুনিকাকে মারা যায়। আর তখনই আয়মানের বিশ্বস্ত লোক আমাকে খবর দিলো অরুর কিডন্যাপিং এর ব্যাপারে। আমি ভাবলাম এটাই তো মোক্ষম সুযোগ। মেরে দিব অরুনিকাকে আর দোষ হবে আয়মানের। কিন্তু ওখানে গিয়ে তো দেখি খেলার মোড় ঘুরে গিয়েছে। আহরার রি ভ লবার তাক করে রেখেছে তোমাদের বাবার দিকে। ওই লোক যে অরুনিকার বাবা সেটা আমাকে আমার সেই ইনফর্মার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে আহরারকে এমন কাজ করতে দেখে ভাবলাম ছেলেটাকে কষ্ট না দেই, কাজটা আমিই সেরে ফেলি। যেই ভাবা সেই কাজ। তোমার বাবাকে টপকে দিলাম। আহরার এখন জেলে। অরুনিকাও এই বাড়িতে নেই। আমার কাজ শেষ। প্রতিশোধ সম্পন্ন। রিল্যাক্সে এখন সুখী জীবন কাটাবো। কি মজা না?

কথ শেষ করে আদ্রিকার দিকে তাকাতেই আদ্রিকা কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো নাদিমের গালে। রাগে থরথর কাঁপছে সে। কু পিয়ে কু পিয়ে মারতে মন চাইছে তার এই জানো য়ারটাকে। নাদিম ক্রোধে ফেঁটে পড়লেও নিজেকে সামলে নিল। হালকা হেসে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

–ব্যাপার না। এমনিতেও তোমার দৌড় এখনই শেষ হয়ে যাবে।

আদ্রিকা কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রঁ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। নাদিম সহাস্যে আবারো বলে ওঠে,

–তুমি কি ভেবেছো তোমাকে এমনি এমনি সব বলেছি। একে তো তুমি অনেক কিছুই জেনেছো আমার ব্যাপারে। এমনিতেও তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতাম না। মে রেই যখন ফেলবো তাই সবটা জানিয়ে দিলাম।

ধ্বক করে ওঠে আদ্রিকার বুক। কি বলছে এই সাইকোটা? নাদিম তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

–জানোই তো আমি পথের কাঁটা রাখিনা।

নাদিমের এগিয়ে আসা দেখে আদ্রিকা পেছাতে থাকে। কি করবে সে? পালাবে? সামনে লোকটা যেভাবে এগিয়ে আসছে কোনদিক দিয়ে পালাবে? পালাতে গেলেই তো ধরে ফেলবে। আদ্রিকার গলা শুকিয়ে আসছে ভয়ে। তার জীবনঘড়ি কি তবে থেমে যাবে এখানেই? রেলিং এ এসে আটকে যেতেই বুক হাপড়ের মতে ওঠানামা করতে থাকে তার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে সে। নাদিম একেবারেই কাছে চলে এসেছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি। কি ভয়ংকর লাগছে তাকে দেখতে। আদ্রিকা বড় বড় চোখ করে তাকায়। পলক ফেলার আগেই নাদিম ধাক্কা মেরে দেয় তাকে।

চলবে…

(অন্তিম পর্বের শেষাংশ ইনশাআল্লাহ আগামীকাল পেয়ে যাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here