তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_২৩

0
666

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৩

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুধা। বাতায়ন হতে পর্দা সরিয়ে দিলো তূর্ণ। মুহুর্তের মধ্যেই উজ্জ্বল কিরণে আলোকিত হলো কক্ষ। ঘুমন্ত ললনার চোখেমুখে আলো পড়তেই বিরক্ত বোধ করলো। বাম কাত হয়ে শুয়ে পড়লো সে। তূর্ণ বাতায়ন হতে মুখ ফিরিয়ে পিছু ঘুরে তাকালো। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো ঘুমন্ত অর্ধাঙ্গীর অবয়ব। মুচকি হেসে তূর্ণ এগিয়ে গেল বিছানার ধারে।

” দুয়া অ্যাই দুয়া! উঠে পড়। সকাল হয়ে গেছে। ”

ঘুমন্ত মানবীর কর্ণ কুহরে ডাক পৌঁছালো কি? বোধহয় না।

” দুয়া ওঠ। অ্যাই মেয়ে আর কত ঘুমাবি? ওঠ। তোর না ক’দিন পর পরীক্ষা? ”

ওপাশ হতে কোনো সাড়া নেই। বিরক্তিতে ‘ চ ‘ সূচক ধ্বনি নির্গত হলো কণ্ঠনালী হতে। তূর্ণ গিয়ে বসলো মেয়েটির শিয়রে। দীঘল কালো কেশে হাত বুলাতে বুলাতে মোলায়েম স্বরে ডাকতে লাগলো,

” দুয়া! ওঠ। পড়তে বসতে হবে না? ”

” উম্! ”

ঘুমন্ত রমণী মাথায় আদুরে স্পর্শ পেয়ে ডান কাত হয়ে শুলো। মুচকি হাসলো তূর্ণ। এ তো পুরো ঘুম পা’গলী! ঘুমালে দিনদুনিয়ার হুঁশ থাকে না।

” দুয়া! পড়তে বসতে হবে। উঠে পড় না পুতুল। ”

মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে চলেছে তূর্ণ। হঠাৎ ঘটলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কাণ্ড! পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী ঘুমন্ত মেয়েটি সন্নিকটে থাকা মানুষটির কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। দু হাতে আলিঙ্গন করলো কটিদেশ। মুখ গুঁজে দিলো উদরে। শিউরে উঠলো তূর্ণ! হৃদয়ে লুকানো ললনার এতখানি ঘনিষ্ঠতা হৃৎপিণ্ডে তুফান সৃষ্টি করলো। জাগ্রত হলো প্রেমপূর্ণ পৌরুষ চিত্ত। একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার, স্বল্প আদরে সিক্ত করার বাসনা তনুমনে ঝঙ্কার সৃষ্টি করছে। মেয়েটি কি পা’গল? স্বেচ্ছায় তার লুকানো অনুরক্তি জাগ্রত করে তুলছে! সে যদি একবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় তবে মেয়েটি পারবে কি তাকে সামলাতে! বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো তূর্ণ। মেয়েটির কেশের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে ললাটে অধর স্পর্শ করলো। কর্ণ কুহরে অধর ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

” বিবিজান উঠবেন না? এভাবে আমার কোলে মুখ লুকিয়ে আর কত দিশেহারা করবেন আমায়? এবার তো উঠুন। ”

কর্ণ কুহরে পৌঁছে গেল পুরুষালি কণ্ঠস্বর। মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো। আস্তে ধীরে নেত্রপল্লব মেলে তাকালো মেয়েটি। চোখ মেলেই সর্বপ্রথম দর্শন মিললো হৃদয়ে চুপিসারে ঠাঁই নেয়া মানুষটির। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। হলো কত অব্যক্ত আলাপণ! অতি মিষ্টি হাসি উপহার দিলো মেয়েটি।

” উঠবেন না? ”

ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসলো মানুষটি। তাতে আরো মোহিত হলো দুয়া। বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। অবলোকন করতে লাগলো অধর কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু। ধুকপুক ধুকপুক করে চলেছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। সে ধুকপুকানি মানুষটির কর্ণগোচর না হয়ে যায়! ভাবতেই দৃষ্টি নত করে নিলো দুয়া। তূর্ণ মুচকি হেসে বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দিতে লাগলো চিবুকে। সে ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে মেয়েটি তড়িৎ সরে গেল। মাথা ঠেকলো বালিশে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরল তার! সে এতক্ষন কই ছিল তাহলে? একবার তূর্ণ আরেকবার বালিশে তাকালো দুয়া। সবটা বোধগম্য হতেই লালিমায় আচ্ছাদিত হলো মুখশ্রী। লজ্জা কি লজ্জা! ইশ্! তৎক্ষণাৎ বালিশে লজ্জা মাখা মুখখানি লুকিয়ে ফেললো দুয়া। কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো মানুষটির অট্টহাসি।

স্টাডি টেবিলে পাশাপাশি বসে পড়াশোনায় মগ্ন দুয়া এবং তৃষা। দু’জনেই পড়তে পড়তে একপ্রকার শহীদ হয়ে যাচ্ছে। তখনই ট্রে হাতে কক্ষে প্রবেশ করলেন তাসলিমা। ওদের পড়তে দেখে সন্তুষ্ট হলেন। টেবিলের ওপর ট্রে রাখতেই তাকে লক্ষ্য করলো ওরা দু’জনে। দুয়া মুচকি হাসলো।

” মামণি! কি খবর তোমার? ”

” আমি তো আলহামদুলিল্লাহ্ বেশ আছি। তোদের কি খবর বল? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। প্রিপারেশন কেমন? ”

দুয়া কিছু বলার আগেই তৃষা উত্তর দিলো,

” একদম ফাটাফাটি আম্মু। ”

” বেশি ফাটাফাটি হলে তো সমস্যা। রুমের দেয়াল খসে পড়বে‌। ”

মায়ের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না তৃষা। তবে দুয়া সশব্দে হেসে উঠলো। তাসলিমা এবার ওদের দু’জনের দিকে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,

” নে দুধটা খেয়ে নে। তারপর মন দিয়ে পড়। ”

দুয়া চোখমুখ কুঁচকে বললো,

” মামণি! আমরা কি ছোট বাচ্চা? পরীক্ষার আগে রোজ রোজ দুখ খাওয়াচ্ছো‌। ইশ্ ভাল্লাগে না। ”

” তা লাগবে কেন? এখন যদি কেএফসি থেকে ফাস্টফুড এনে দিতাম ঠিক খেতি। ”

তৃষা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

” কেন খাবো না? নিশ্চয়ই খাবো। এত টাকা খরচ করে আনবে, অপচয় করবো কেন? ও আম্মু কেএফসি থেকে অর্ডার দাও না। ”

তৃষার অনুরোধ উপেক্ষা করে তাসলিমা ওদের হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিলেন।

” ওসব বাজে জিনিস বাদ দিয়ে দুখ খা। শরীরে পুষ্টি হবে। ওসব খেলে টাকার টাকা তো যাবেই। সাথে পরীক্ষার হলে গিয়ে ডিসেন্ট্রি হবে। ”

” ইয়াক। ” চোখমুখ কুঁচকে ফেললো তৃষা।

দুয়া দুধের গ্লাসে করুণ চোখে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে তিন ঢোকে পান করে নিলো। তাসলিমা মেয়ের পিঠে চাপড় মে রে বললেন,

” তুই খাচ্ছিস না কেন? খা। ”

” ধুৎ! ভাল্লাগে না। ”

একাকী ফটরফটর করে তৃষাও দুখ পান করলো। তাসলিমা ট্রেতে গ্লাস রেখে ওদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর প্রস্থান করলেন কক্ষ হতে। দু’জনে পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো।

ফজরের সালাত আদায় করে দুয়া সে-ই যে বই নিয়ে মগ্ন! দিনদুনিয়ার হুঁশ নেই। ঘন্টাখানেক বাদেই পরীক্ষা। চিন্তায় হাত-পা অবশ প্রায়। সকালের ব্রেকফাস্ট অবধি করেনি। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে রিভিশন দিয়ে চলেছে। সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো স্বামী মহাশয়। হাতে খাবারের ট্রে। গিয়ে বসলো দুয়া’র বিপরীতে। দুয়া তাকে খেয়াল অবধি করেনি। তূর্ণ বিছানায় ট্রে রাখতে রাখতে বললো,

” এই যে ম্যাডাম! ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা হবে। তাই বলে নাওয়াখাওয়া ভুলে যাবেন? ”

চোখ তুলে তাকালো দুয়া। পুনরায় বইয়ে মুখ গুঁজে মৃদু স্বরে বললো,

” খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবারগুলো নিয়ে যাও। ”

” বললেই হলো খিদে নেই? এরপর এক্সাম হল এ অনাহারে অজ্ঞান হয়ে যাবি। সেটা বুঝি ভালো হবে? ”

দুয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

” সত্যি বলছি খেতে ইচ্ছে করছে না। ”

তূর্ণ কড়া কণ্ঠে বললো,

” একদম ঢঙ করবি না বলে রাখলাম। হা কর। নইলে পরীক্ষা ক্যান্সেল। ”

তূর্ণ’র হাতে রুটির টুকরো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হা করলো দুয়া। ওর মুখে সবজি ভর্তি রুটির টুকরো পুরে দিলো তূর্ণ। আরেক টুকরো রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো,

” ইম্পর্ট্যান্ট টপিকস পড়েছিস তো? কিছু বাদ দিস না। ”

” পড়েছি। একটু ভালো করে দোয়া করো ঠিক আছে? খুব চিন্তা হচ্ছে। ”

তূর্ণ নরম স্বরে বললো,

” চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ্ পরীক্ষা ভালো হবে। ”

দুয়া মুচকি হাসলো। তূর্ণ দ্রুত গতিতে ওকে খাইয়ে দিলো। দুয়া গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করলো। খাওয়া শেষে তূর্ণ রুমাল দিয়ে মেয়েটির সিক্ত মুখ মুছে দিলো। অতঃপর ট্রে হাতে উঠে দাঁড়ালো।

” তাড়াতাড়ি রিভিশন দিয়ে রেডি হতে শুরু কর। আমি দেখে আসি বি*চ্ছুটা কি করছে। ”

তূর্ণ কক্ষ হতে প্রস্থান করলো। উদ্দেশ্য বোনের অবস্থা দেখে আসা।

ভার্সিটি প্রাঙ্গনে এসে থামলো শুভ্র রঙা গাড়িটি। পেছনের ডোর খুলে বেরিয়ে এলো তৃষা।

” ভাইয়া। আমার প্রিয় ভাইয়া। খাস দিলে দোয়া করো। ঠিক আছে? পরীক্ষা শেষে বেঁচে ফিরলে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্। ”

কথা শেষ হতেই এক বান্ধবীকে দেখে তার দিকে ছুটলো তৃষা। গাড়িতে পাশাপাশি বসে থাকা তূর্ণ এবং দুয়া তা দেখে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে দুয়া তাকালো ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা অর্ধাঙ্গের পানে।

” আসছি তাহলে? আর হ্যাঁ। আমাদের জন্য খাস দিলে দোয়া করবেন মাস্টার মশাই। ”

তূর্ণ মুচকি হেসে ওর পানে ঝুঁকে এলো। আকস্মিক কাণ্ডে মেয়েটির মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। সিটের সঙ্গে একদম মিশে গেল কোমল কায়া। অতি সন্নিকটে এসে থামলো তূর্ণ। মিলিত হলো দু জোড়া নয়ন। নয়নে নয়ন মিলিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর সিট বেল্ট খুলতে লাগলো মানুষটি। বেশ সময় নিয়ে খুললো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো দুয়া। তার দুষ্টু মন কিসব ভাবছিল! ছিঃ! কিন্তু আহা আহা! তার ভাবনা ঠিক সঠিক হলো। দু ভ্রুয়ের সন্ধিস্থলে অধরের পবিত্র ছোঁয়া অঙ্কন করে দিলো তূর্ণ। আঁখিপল্লব বন্ধ করে সে পবিত্র ছোঁয়াটুকু অনুধাবন করলো দুয়া। চোখ মেলে তাকাতেই নয়ন সন্ধি হলো। মানুষটি ওর বাঁ কপোলে আলতো করে হাত রাখলো। মোলায়েম স্বরে বললো,

” ভালোমতো পরীক্ষা দিয়ো। একদম দুশ্চিন্তা করবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে কোয়েশ্চেনস্ সলভ্ করবে। যেটা ভালো পারবে সেটা আগে দিবে। যেটায় সমস্যা ওটা নিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে না। ঠিক আছে? ”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মেয়েটি। তূর্ণ এমন করে ওকে পরামর্শ দিচ্ছে যেন তার অর্ধাঙ্গী কোন শিশু। বুঝদার নয়। তাই তো এত পরামর্শ! দুয়া এসব ভেবেই মুচকি হেসে দিলো। তখন তূর্ণও মুচকি হেসে দুয়া’র ফোলা ফোলা গাল টিপে দিলো।

” যাও। আল্লাহ্ হা’ফিজ ”

” আল্লাহ্ হা’ফিজ। ”

মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো দুয়া। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো। গাড়িতে থাকা মানুষটিও বিপরীতে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। দুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্রষ্টার নাম স্মরণ করতে করতে ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো। কিছুদূর এগিয়ে আরেকবার পিছু ঘুরে তাকালো। চোখের ইশারায় যেতে বললো মানুষটি। দুয়া মুচকি হেসে প্রস্থান করলো। তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো পার্কিং লটের দিকে।

প্রথম পরীক্ষা শেষ। ওপর ওয়ালার শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফুরফুরে মেজাজে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে হাজির হলো তৃষা। আশেপাশে তাকিয়ে বন্ধুদের খোঁজ করে চলেছে। গেল কোথায় সব? পরীক্ষা শেষে গেল কোথায়? তৃষা যখন খোঁজাখুঁজিতে মগ্ন ঠিক তখনই তার সম্মুখে হাজির হলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক ব্যক্তি! তৃষার কণ্ঠনালী হতে বেরিয়ে এলো,

” আপনি! ”

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here