শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬।

0
1388

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।

‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। ম্যাডামকে পৌঁছে দিয়েছেন?’

‘স্যার, ম্যাডামকে তো এখনো দেখেনি। অনেকক্ষণ হয়েছে, অনেক ছাত্র ছাত্রীকে দেখলাম বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ম্যাডামকে তো পাইনি, স্যার।’

রাবীর কিছুটা চিন্তিত হলো। বলল,

‘আচ্ছা, আপনি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমি মেহুলকে কল দিয়ে দেখছি।’

‘আচ্ছা স্যার।’

কলটা কেটে দিয়ে রাবীর ঘড়ির দিকে চাইল। দেখল তিনটা বেজে দশ মিনিট। মেহুলের তো দুইটায় ক্লাস শেষ হওয়ার কথা। আর গাড়িও তো দুইটা বাজার আগেই পৌঁছে গিয়েছে। তাহলে মেহুল এখনও বের হচ্ছে না কেন? রাবীর মেহুলের নাম্বারে কল দেয়।

‘দেখ, কল দিচ্ছে।’

‘রিসিভ কর। ভাইয়া হয়তো দুশ্চিন্তা করছেন।’

‘কেন, এখানে দুশ্চিন্তা করার কী আছে? আমি কি ছোট বাচ্চা যে আমাকে একদম চোখে চোখে রাখতে হবে? আশ্চর্য তো! পুরো ভার্সিটি লাইফ আমি স্বাধীন ভাবে কাটিয়েছি। জীবনেও মা বাবা এরকম প্যারা দেয়নি। আর উনি প্রথম দিনই আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন। উফফ!’

রিতা বলল,

‘রাগ না দেখিয়ে কলটা রিসিভ কর।’

‘তা তো করতেই হবে। নয়তো পরে আবার মা’কে কল দিয়ে বসবেন।’

আর কোনো উপায় না পেয়ে মেহুল কলটা রিসিভ করে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই রাবীর বলে,

‘কোথায় আপনি?’

‘ভার্সিটিতে।’

‘ক্লাস শেষ হয়নি এখনও?’

‘না।’

‘কখন শেষ হবে?’

‘চারটায়।’

‘তাহলে তখন দুইটার কথা বলেছিলেন কেন?’

‘কারণ তখন জানতাম দুইটার দিকেই ছুটি হবে। কিন্তু, এখন স্যার বলেছেন এক্সট্রা আরো দুটো ক্লাস নিবেন। তাই আমাদের এখন চারটা পর্যন্ত থাকতেই হবে। বুঝতে পেরেছেন?’

‘ঠিক আছে। বাইরে গাড়ি আছে, ক্লাস শেষে সাবধানে বাড়ি ফিরে যাবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

রাবীর কল কেটে দিয়ে তার ড্রাইভার কে জানিয়ে দেয়। অন্যদিকে মেহুল একটা ফুচকা মুখে পুরে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। রিতা ইতস্তত গলায় বলল,

‘ভাইয়াকে মিথ্যা বলাটা ঠিক হয়নি। ক্লাস তো আমাদের সেই কখন শেষ। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করছিস।’

মেহুল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ফুচকাটা গিলে চরম অবাক হয়ে বলে,

‘এই তোদের সবার কী হয়েছে বলতো? ঐ লোকটা কি তোদের তাবিজ টাবিজ করেছে নাকি? বিয়ের হওয়ার পর থেকেই তোরা সবাই রাত দিন খালি উনার কথাই ভেবে যাচ্ছিস। আমাকে নিয়েও একটু ভাব। ঐ লোকটার মা আমার কাছ থেকে আমার গানটাকে কেড়ে নিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, নিজের কোনো ক্যারিয়ারের দরকার নেই। পড়াশোনা শেষ করে সংসার করো। ব্যস, এটাই জীবন। আমি তো এটা আশা করিনি। আমার তো বড়ো গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন। এটলিস্ট, আর কিছু করতে পারি আর না পারি পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি করতে চাই। নিজের উপার্জনে চলতে চাই। অথচ, ঐ লোকগুলো আমাকে বিয়ে নামক শিকলে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে যে আমি এখন কোনমতেই এসব থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারবো না। আর আমার মা বাবাও খুশি খুশি মনে এসব কিছু মেনে নিয়েছেন। তুইও মেনে নিয়েছিস। আমার কষ্টে কারো কিচ্ছু যায় আসেনা। এত পাষাণ কী করে হয়ে গেলি তোরা?’

মেহুলের কথার সুরে ঠুকরে পড়া যন্ত্রণাগুলো রিতা টের পাচ্ছে। সে মেহুলের হাতের উপর হাত রাখে। নরম গলায় বলে,

‘এভাবে বলিস না, প্লিজ। আমরা সবাই তোর ভালো চাই। বিশেষ করে আন্টি আংকেল, ঐ মানুষ দুজন তোকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। প্লিজ উনাদের ভুল বুঝিস না। মা বাবা নিজের সুখের কথা ভেবে কিছু করেন না। যা করেন ছেলে মেয়ের কথা ভেবে করেন। আর যাই হোক, এটা তো সত্যি যে রাবীর ভাইয়ের মতো ছেলে মেয়েদের স্বপ্ন থাকে। তোর তো না চাইতেই সেই স্বপ্ন পূরণ হয়ে গিয়েছে। এই যে ভাইয়ার এত এত ব্যস্ততার মাঝেও বার বার ফোন করে তোর খবর নেওয়া, এটা ঠিক কতটা কেয়ার করলে একটা মানুষ করে জানিস? উনি তোকে সম্মান করে। তাই তুই এত রাগ দেখানোর পরও উনি তোকে কিছু বলেন না। আমার কি মনে হয় জানিস, তোর স্বপ্নের কথা উনাকে বলা উচিত। আমার বিশ্বাস, উনি তোর পাশে থাকবেন।’

মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অন্যদিকে ফিরে বলে,

‘আমার তো তা একদমই তা মনে হয় না। আমার কেন যেন মনে হয়, উনি খুব পজেসিভ। আর হয়তো উনিও উনার মায়ের মতো এসব গান বাজনা পছন্দ করেন না। যদি আমি বলার পর উনি না করে দেন, তখন? তখন কী হবে? তখন তো আমার আরো কষ্ট লাগবে। তার চেয়ে না বলাই ভালো।’

‘আমার মনে হচ্ছে না এমন কিছু হবে। তুই বলেই দেখ না। আমি সিউর, ভাইয়া তোকে বুঝবেন। একবার বলে দেখ।’

মেহুল খানিক ভেবে বলল,

‘আচ্ছা, আমি বলব উনাকে। আর উনি যদি আমার গান গাওয়াটাকে সাপোর্ট করেন তাহলে আমিও এই বিয়েটাকে খুব খুশি মনে মেনে নিব। আর যদি সাপোর্ট না করেন, তবে আমিও এই বিয়ে মানব না, না উনাকে কখনো স্বামী হিসেবে মানব।’

রিতা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘মানবেন। তুই কোনো চিন্তা করিস না। ভাইয়া ঠিক মানবেন।’

_____

খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহুল তার রুমে যায়। মনটা খুব উসখুস করছে। রাবীরকে কি বলা উচিত সবকিছু? যদি উনিও উনার মায়ের মতো কড়া কথা শুনিয়ে দেন, তখন? কিন্তু, এভাবে নিজের জীবনকে বোঝা বানিয়ে তো চলা যায় না। সবাই’ই জীবনে কিছু করতে চায়। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। মেহুলও তাই চায়। কিন্তু, রাবীর যদি তার পাশে না থাকে তবে তো তার সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যাবে। কীভাবে গায়িকা হবে সে? কীভাবে নিজের একটা ক্যারিয়ার বানাবে?

এসব চিন্তাই চিন্তাই মেহুলের ঘুম উবে যাচ্ছে যেন। সে হতাশ হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশটাও আজ একা। বাইরে থমথমে পরিবেশ। বাতাস বইছে খুব। মেহুলের সেই বাতাসে আরাম লাগলেও মনে শান্তি পাচ্ছে না সে। রাবীরকে একবার কল দিবে? আবার ভাবে, না থাক। যদি উনি না মানেন?

মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ফিরে আসে। এসে দেখে তার ফোন বাজছে। সে বুঝে যায়, এটা রাবীর ছাড়া আর কেউ না। সে খুশি হয়ে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে। তারপর নিজেকে শান্ত করে বলে,

‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। খাওয়া দাওয়া হয়েছে?’

‘জি, আপনার?’

‘জি, হয়েছে।’

মেহুল নিজেকে প্রস্তুত করছে কথাগুলো বলার জন্য। রাবীর মাঝ দিয়ে বলে,

‘আচ্ছা তাহলে, শুয়ে পড়ুন। কাল তো আবার ক্লাস আছে। সকালে উঠতে হবে।’

‘না, শুনুন। আমার আপনার সাথে একটু কথা আছে।’

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আচ্ছা, একটু দেখা করা যায় না? আমি আসলে এই কথাগুলো সরাসরি দেখা করে বলতে চাইছি। আপনি কি কালকে ফ্রি আছেন?’

রাবীর কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

‘ক্লাস শেষে আমি নিতে আসব। তখন না হয় কথা হবে।’

‘আচ্ছা। আর একটা কথা, দয়া করে ভার্সিটির ভেতরে আসবেন না। গেইটের সামনে দাঁড়ালেই হবে।’

রাবীর মৃদু হেসে বলল,

‘কেন, নেতা সাহেবের বউ বলে লজ্জা পান?’

‘জি, আপনার জন্য সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় আমি কোনো ভীনগ্রহের প্রাণী।’

‘সেটাই তো ভালো। সবাই আপনাকে আলাদা চোখে দেখবে। নেতার বউ হিসেবে চিনবে। তাতে আমিও একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। অনন্ত, আমার ওয়াইফের দিকে নজর দেওয়ার আগে সবাই একবার হলেও ভাববে, কার ওয়াইফের দিকে নজর দিচ্ছে।’

মেহুল বড়ো করে নিশ্বাস ফেলে। বলে,

‘আমার নিজেরও একটা পরিচয় আছে। আর আমি আমার নিজের পরিচয়েই পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’

‘নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাকা দারুণ ব্যাপার। তাই বলে স্বামীর পরিচয়কে অগ্রাহ্য করা কোনো শিক্ষিত ব্যক্তির কাজ নয়।’

মেহুল সময় নিয়ে বলল,

‘এখন তো আর চাইলেও আমি আপনার পরিচয়কে অগ্রাহ্য করতে পারব না। আপনি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন, যেটা মুছে ফেলা সম্ভব না।’

রাবীরের মনে ক্ষুদ্র প্রশান্তি জাগে। সে মিহি সুরে বলে,

‘আর আমি বেঁচে থাকতে এই অস্তিত্ব কেউ মুছতেও পারবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, রাবীর খান তার ওয়াইফকে আগলে রাখতে জানে। এখন আর যায় হয়ে যাক না কেন, সে তার ওয়াইফকে এক মুহুর্তের জন্যও নিজের থেকে আলাদা করবে না। ইনফেক্ট, তার ওয়াইফ চাইলেও না।’

মেহুল ঢোক গিলে। কথার বিপরীতে আর কিছু বলে না। রাবীর বলে,

‘কালকে তাহলে দেখা হচ্ছে। রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here