বায়বীয়(৪র্থ ও শেষ পর্ব) ###লাকি রশীদ

0
245

###বায়বীয়(৪র্থ ও শেষ পর্ব)
###লাকি রশীদ

সকালে উঠে দেখি সাড়ে ৮টা বাজে। রাতের হাঙ্গামায় ফজরের নামাজ পর্যন্ত কাজা। বৃষ্টি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। শব্দহীন পায়ে উঠে ওয়াশরুমে গোসল করতে ঢুকি। সকালের প্রার্থনা মিস গেলে সারাটা দিন ই যেন অদ্ভুত এক অশান্তিতে কাটে।অনেক বছরের স্থায়ী হয়ে যাওয়া
রুটিন এলোমেলো হয়ে গেলে ভালো লাগে না। চটপট হাতে রেডি হতে শাড়ি পরা শুরু করি। মেয়ের ঘুমের বিঘ্ন ঘটবে বলে লাইট জ্বালাইনি। তীক্ষ্ণ রোদ্রোজ্জল দিনের ঝাপটা জানালা দিয়ে আলোর সঞ্চার করছে। তা দিয়েই কাজ চালানো যাবে। পিঙ্ক কালারের হাফসিল্ক শাড়িতে একই রঙের সুতা দিয়ে কাজ করা শাড়িটা টান দিতেই ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনি আলো জ্বালোনি কেন মা? বললাম সমস্যা নেই, এই আলোতেই পরা যাবে।

উঠে ঝট করে লাইট জ্বালিয়ে বললো এতো সুন্দর শাড়ি !!! এটা কোত্থেকে কিনেছো? বললাম একটা পেইজে দেখে অনলাইনে অর্ডার দিয়েছিলাম। তোমার ভালো লেগেছে? মাথা নেড়ে বললো খুব। আমি বলি তাহলে এটা তুমি নিয়ে নাও। কিন্তু তুমি তো একদিনও পরো নি মা। হেসে বলি তুমি তো পরবে। তাতেই আমার পরা হয়ে যাবে। মেয়ে দেখি মুগ্ধ হয়ে এবার শাড়ি খুলে দেখা শুরু করেছে। অন্য একটি শাড়ি পরতে পরতে শুনি এবার অন্য সমস্যার কথা। আমার তো মা ম্যাচিং ব্লাউজ, আংটি, চুড়ি কিছুই নেই। বললাম সমস্যা কি? বিকেলে দুজন বের হয়ে কিনে নেবো। আর কি কি লিষ্ট করে রাখো। আমি একবার নার্সারি ও রেষ্টুরেন্টে মুখ দেখিয়েই চলে আসবো। ঢিলে দিলেই সমস্যা হয়ে যায়।

উঠে দেখি বাবা মায়ের নাস্তা করা শেষ। মা বলছে ইচ্ছে করেই ডাকিনি তোকে। গিয়ে দেখি মেয়ে তোর বিছানায় ভাবলাম গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেছে মনে হয়। ঝটপট রুটি মুখে নিতেই মা বলছে আজকে না বেরোলে হয় না? মেয়েটা শুধু আজকে আছে। আমি বলি ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে চলে আসবো ইনশাআল্লাহ। এসে লাঞ্চ করে বিকেলে ওকে নিয়ে শপিং এ যাবো। আনুকে চা বানাতে নিষেধ করলাম কারণ আমি আবার গরম চা খেতে পারি না। মামুন এ নিয়ে কত ঠাট্টা করতো। হেসে বলতো আমার বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টি কখনো কেউ শুনে নি চা আবার ঠান্ডা করে খায়। আমি বলতাম আমি তোমার মতো আগুন গরম চা খেতে পারি না। একটু ঠাণ্ডা না হলে কি খাওয়া যায়? রাগাতে চাইতো, বলতো অদ্ভুতুড়ে যত অভ্যাস তোমার। এসি দেয়া গাড়িতে বসেও হঠাৎ দরদর করে ঘামছি,এ আবার কি মুশকিল দেখা দিলো। সব কথায় মামুনের নাম মনে হচ্ছে কেন?
মেয়ে কালকে গল্প করছে বলে? না না এতো ঠিক নয়। মনটা অন্যদিকে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি।

এমনি এমনি কি আর বলা হয় একটি কাজে নির্দিষ্ট সময় ব্যস্ত থাকা মানুষের জন্য অনেক উপকারী। না হয় সময় বুকের উপর দৈত্যের মতন চেপে বসতো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। কর্মক্ষেত্রে এলে সময়গুলো যেন চটপট উড়ে যায়। ঝটিতি হাতে কিছু কাগজপত্র দেখলাম,যার যার সঙ্গে দরকার কথা বললাম এবং দীপু কে সাবধান করে দিলাম নির্ভুল ভাবে তার একা একা সবদিক খুব নজরে রাখতে হবে। ব্যাস আজকের দিনের মতো কাজ হয়েছে। নার্সারিতে আগেই জানিয়ে দিয়েছি আমি আজ
আর যাবো না। বাসার সামনে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম মনে হলো। কথা টা অন্তত রাখতে পেরেছি। কথামতো লাঞ্চ সেরে শপিং এ চলে যাবো। কিন্তু তখনো জানতাম না মানুষ পরিকল্পনা করে এক আর সৃষ্টিকর্তা করেন আরেক। তিনি ই উত্তম পরিকল্পনাকারি।

ঢুকতেই আরেক সুখকর জিনিস চোখদুটো উপভোগ করলো। বৃষ্টি ধীর লয়ে আলেয়াকে দৌড়ুচ্ছে। আলেয়া খিলখিল করে হেসে উঠছে। আমাকে দেখে তার যা নিত্যকর্ম,ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে গেছে। লাঞ্চের পর একটু একটু করে আকাশের রং পাল্টে যাচ্ছিল। ধুসর থেকে কালো রং হচ্ছে। একই তালে বৃষ্টির মুখ চুপসে যায়।করুণ স্বরে বললো, আমরা কি আজ বের হতে পারবো না মা? আশ্বস্ত করি, দূর বোকা মেয়ে !!! মেঘগুলোকে বাতাস কোথা থেকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বৃষ্টি আসবে না। আমাদের এমনিতেই একটা বৃষ্টি আছে।

বিকেল চারটার দিকে সাজ সাজ রব নিয়ে তুফান উপস্থিত। বাতাসের ঝাপটায় জানালাগুলো ঠাস ঠাস করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। কিছুক্ষন আগে দেখে এসেছি মেয়ে আর বাবা মা জোর গল্পে মশগুল। আমি
জানালাগুলো এক এক লাগাচ্ছি। এতো জোরে জোরে বাড়ি খাচ্ছে ভেঙ্গেই যাবে মনে হয়। দুটো লাগিয়ে দিয়ে অন্যটা লাগাবো ঠিক তক্ষুনি বন্য মোষের মতো পাগলা হাওয়া জানালার কাঠের পাল্লাটা দিয়ে আমার ডানহাত
এর কব্জি তে প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো। চিৎকার দিয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি। চোখে তখন আঁধার দেখছি, কয়েক মিনিট এর মধ্যে সবাই দৌড়ে এসে চেয়ারে তুললো আমাকে। আমি দেখি হাতটা ফুলতে শুরু করেছে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠি। তুফান কিছুটা থেমে গেলে হাসপাতালে যাই। এই সময়ে আলেয়া কি বুঝেছে
আল্লাহ মালুম পরী পরী বলে চিৎকার করে কাঁদছে।ভয় পেয়েছে মনে হয়, আমাকে তো কখনো কাঁদতে দেখেনি বৃষ্টিই দৌড় ঝাঁপ করে ডাক্তার দেখিয়ে এক্সরে করালো। তারপর প্লাষ্টার করিয়ে একগাদা ঔষধপত্র নিয়ে ঘরে ফিরলাম।

বাবা পাশে বসে আফসোস করছে, আহ্ হা রে আমার মেয়েটার ডানহাতের জোর কমে গেল। ব্যথায় বেদনায়
অস্থির আমি……….কিন্তু এর মধ্যেও একটা আফসোস
হৃদয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার মেয়েটার ম্যাচিং ব্লাউজ আংটি চুড়ি কিনে দেয়া হলো না। সেটা বলতেই বৃষ্টি মাথা নাড়লো,মা তুমি কি গো? এসব তুমি ভালো হয়ে যাবার পর কিনে দিবে। আমি কি এক্ষুনি কোথাও চলে যাচ্ছি না কি? নিজে কি করে ভালো থাকবে সেটা চিন্তা করো। এবার আনুর ভেজা গলা ভেসে এল,প্রত্যেকবার তুফান আইলে আমি খিড়কি(জানালা) লাগাই। ইবার চুলায় পায়েস থাকায় সাথে সাথে আইতে পারলাম না।
আলেয়া কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাতে ব্যথার সাথে যোগ হয়েছে উথালপাথাল জ্বর। মাথায় পানি দেয়া,কান্না সবকিছু শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। বাবা বৃদ্ধ দৌড়ঝাঁপ করতে পারবেন না, মা পুরুষ মানুষ কেউ বাসায় নেই এই ভয়ে রেষ্টুরেন্টের দীপুকে আনিয়েছে। সে এসে অসাধ্যসাধন করেছে। পাড়ার ডাক্তারকে ধরে এনেছে। বিপদ পড়ে যেসময় একসাথেই পড়ে। বাসার সামনে নাকি এক
হাঁটুজল জমে গেছে। শেষ রাতের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। চেয়ে দেখি অনেক গুলো প্রিয়মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বললাম আমি খুব ভালো আছি। সবাই ঘুমুতে যাও এখন।

বৃষ্টিকে বলি ড্রাইভার সময়মতো আসবে। তোমাকে তখন বাবা এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে। মেয়ে বলছে তোমাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি আঁতকে উঠি, তুমি না এসে বললে আগামী সপ্তাহে তোমার ইম্পোর্টেন্ট টেষ্ট আছে। ঘাড় গোজ করে বললো আছে তো। আমি বলি এতো দিন এবসেন্ট থাকলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। মা এবার বলছে আহ্ হা মেয়ে থাকতে চাইছে থাক্ না। এবার বেশ কঠোর গলায় বলি অসম্ভব। তুমি গিয়ে তোমার পড়াশোনায় মন দাও। এখানে খেয়াল রাখার জন্য অনেক লোক আছে। যাও ওই রুমের বিছানায় একটু গড়িয়ে নাও। যাবার সময় মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে গেল,আমার দু চোখ ই শুধু খটখটে মরুভূমি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, মা টেষ্টের ঝামেলা শেষ হলে আমি আবার আসবো ইনশাআল্লাহ। কথা দাও ততদিন তুমি তোমার খেয়াল রাখবে মা।

কাজের মানুষ আমি, কাহাতক আর এভাবে শুয়ে বসে কাটানো যায়? সপ্তাহখানেক পর রেষ্টুরেন্টের কাঁচ ঘেরা
রুমে বসে আছি কর্মী একজন এসে বললো আপনার সাথে মামুন নামের এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। শরীর ও হৃদয়ের অলিগলি কাঁপিয়ে বলে উঠি কোন মামুন? পরক্ষণেই মনে হয় ধ্যাত এই নামের মানুষ কি পৃথিবীতে আর নেই নাকি? বললাম জিজ্ঞেস করে এসো
কোত্থেকে এসেছেন? মিনিট কয়েক পর জবাব দিলো চট্রগ্রাম থেকে এসেছেন। তাহলে তো সে ই। হঠাৎ আমার কাছে এসেছে কেন? বললাম ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

মামুন অনেক বদলে গেছে। গায়ে বেশ মাংস লেগেছে। চুলগুলো পাতলা হয়েছে। কি রকম অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে মনে হয়। যতটুকু
সম্ভব আমি সহজ স্বাভাবিক স্বরে সালাম দিয়ে বলি কি ব্যাপার ? কোনো সমস্যা? মানুষের গলার স্বর যে জীবনের কত খাতা পূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে পারে আমি
তো আর জানতাম না। এই এক কথাতেই তার আড়ষ্ট ভাবটুকু চলে গেছে বেমালুম। হেসে বললো না কোনো সমস্যা নিয়ে আসিনি। আমি অফিসের কাজে ঢাকায় এসেছিলাম। কয়েকদিন আগে তোমার হাত ভাঙ্গার কথা শুনেছিলাম। তাই ভাবলাম একবার দেখে যাই। আমি মৃদু হেসে বলি ভালো করেছো। কি খাবে? বললো
শুধু কফি। আর কিছু না। দুই কাপ কফির কথা বলতেই
বললো তুমি খাবে না কি এখন? আমি মাথা নেড়ে হ্যা বলি। নীচু স্বরে বললো না বলছিলাম যে ঘুমের সমস্যা হলে কফি না খাওয়াই ভালো।

আমি এবার অবাকস্বরে বলি, ঘুম হবে না কেন? আমার ভালো ঘুম হয়। সে এবার বলছে তাহলে তো ভালো। আমি তো শুনলাম তুমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাও। মাথা মুহূর্তেই সজাগ,কার কাছে শুনলে? বৃষ্টির সাথে এই ব্যাপারে আমার তো কোনো আলাপ হয়নি। বললো খুব সিম্পল ব্যাপার, তোমার ড্রয়ারে না কি ঘুমের ঔষধ এর সাথে প্রেশক্রিপশন মোড়ানো ছিল। তাতেই লেখা ছিল ঘুম হচ্ছে না তোমার। আমি বিস্মিত স্বরে বলি মেয়ে তোমাকে এসব বলতে যায় কেন? মাকে ভীষণ বেচারা দেখাবার জন্য? না কি অন্য কিছু? আমাকে এবার কি সুন্দর বলে গেল বাবা তোমাকে এখনও অনেক মিস্ করে মা। আমার কিন্তু এসব ভালো লাগছে না মোটেই।

মামুন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ওর কথা বাদ দাও। আমার একটা কথা শোনো পরী এভাবে একা একা থাকার মানে কি বলোতো? একটা কথা আছে জানো তো প্রকৃতি শুন্য স্থান রাখে না। গত ১৫ বছর এভাবে থেকে তুমি ঠিক কাকে শাস্তি দিলে? এর কোনো মানে হয়? এখনও অনেক সময় তোমার সামনে পড়ে আছে। এভাবে একা একা থাকার ভুত মাথা থেকে সরাও প্লিজ কফি এসে গেছে বললাম একবারেই শখ মিটে গেছে। ন্যাড়া কি বারবার বেলতলায় যেতে চায়? ইচ্ছে করে বলো? থাক্ এসব কথা। সে হালছাড়া ভঙ্গিতে বললো তবে থাক্।

তবে তুমি তো আর জানো না, বৃষ্টি তোমার জন্য হন্যে হয়ে রীতিমতো পাত্র দেখছে। কাউকে ভালো মনে হলে উনাকে তোমার ছবি দেখিয়ে আসছে? আমি বলি মানে কি এসবের? আমার ছবি দেখাচ্ছে মানে? আমি কি ওকে বলেছি পাত্র খুঁজতে? তোমার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় আমায় বলেছিলে, মেয়ে এতো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে খুব ভালো একজন মানুষের সাথে থাকবে। এতো ভালো বাবার কাছে থেকে এসব আজব জিনিস শিখছে না কি? হেসে বললো তুমি এখনো এসব মনে জমা রেখে দিয়েছো? তুমিও তো আমার চৌদ্দগুষ্টি খারাপ, আমরা শয়তানের চ্যালা এসব বলেছো। এসব কাটাকাটি হয়ে গেছে কবে।

বৃষ্টির উপর প্লিজ রাগ করো না। তোমার হয়তো বা কষ্ট হচ্ছে ভেবেই ও এসব করছে। ঢাকা থেকে গিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কি কান্না !!! বাবা সত্যিই তো তোমার
কাছে ফ্যামিলি আছে আমি আছি। কিন্তু মায়ের কাছে কেউ নেই বাবা। রাতে যদি শরীর খারাপ করে মা একা একা কি করবে বাবা? আমি শান্ত করতে বলি তোমার নানা নানু আছেন। ওরাই তোমার মাকে দেখে রাখবেন। কিছু বলেনি কিন্তু উত্তরে সন্তুষ্ট নয় বেশ বুঝতে পারছি।
আগামী সপ্তাহে ঢাকায় আসছে মনে হয়। তোমার কাছে একটা অনুরোধ ছিল। চোখ তুলে বলি কি অনুরোধ? আমি যে আজ এখানে এসেছি বৃষ্টিকে তা বলবে না। হেসে বলি কেন? এবার বলছে মেয়ে ভীষণ জেদি। যদি
কখনো ওর মতের সঙ্গে আমার মত না মিলে তবে সে মাকসুরা কে নিশ্চিত একথা বলে দেবে।

মাকসুরা ওর দ্বিতীয় স্ত্রী। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি, ঠিক আছে বলবো না। তবে একটা কথা জানতে চাই।এই তোমার মেয়ে মানুষ করার নমুনা? তবলা তে মানুষ যেমন আঙ্গুল দিয়ে আওয়াজ তুলে ঠিক তেমনি টেবিলে
আঙ্গুল গুলো টোকা দিয়ে বললো বাইরে থেকে সবকিছু যত সহজ মনে হয় তত সহজ জীবনটা না। মাকে পাচ্ছে না,সবার মা আছে ওর নাই কেন……….এই বিষয়গুলো
যে কতো বেশি মারাত্মক তা আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। আরেকটা ভুল করেছি, মাকসুদা মানুষ ভালো কিন্তু সৎমা খারাপ হতে পারে এই ভেবে প্রথম থেকে এতো শাসিয়েছি ও আদর করার রাস্তায় যেতেই পারে নি। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে আমাদের সমঝে চলেছে। তুমি আজব হয়ে যাবে শুনলে এতো বছর পরও ও বৃষ্টিকে নিয়ে কখনো একা বাসায় থাকে না। পরিবারের আরো কাউকে সঙ্গে রাখবেই। জিজ্ঞেস করলে বলে এমনিই।
একদিন খুব জোর করায় বললো আমার ভয় লাগে। আল্লাহ না করুন হঠাৎ করে ওর কিছু হলে তোমরা বলবে আমি শত্রুতা করেছি।

এখন মনে হয় সারাজীবন কি অদ্ভুত ভাবে কেটে গেল। তোমার আর আমার। মধ্যে থেকে মাকসুরা বলি হয়ে গেছে। আমার বলতে ইচ্ছে করে আমার জন্য ই ৪টা জীবনের সর্বনাশ। কথা একটু কম বললে সবকিছু ঠিক থাকতো। কিন্তু কে যেন গলার টুঁটি চেপে ধরেছে। মামুন উঠে দাঁড়িয়ে বললো আল্লাহ তাআলা তোমাকে অনেক অনেক ভালো রাখুন পরী এই দোয়া করি । গতজনমের আমার কঠিন কঠিন কথাগুলো মনে রেখো না। সময় দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আসি। আমার গলায় স্বর ফোটেনি। শুধু চোখগুলোতে কে যেন খুব যত্ন করে আগুন লাগিয়ে পরে সমুদ্র পুরে দিয়েছে। যা থেকে
অনবরত টুপটুপ পানি পড়ছে।

সপ্তাহখানেক এর আগেই এক বিকেলে বৃষ্টি এলো।কারো জন্য কিছু আনেনি শুধু আলেয়ার জন্য সুন্দর একটি ফ্রক নিয়ে এসেছে। আমাকে বললো তুমি কিন্তু আমাকে এবার চকলেট কেক বানানো শেখাবে। পাশে বসে বলে গেলাম কি কতটুকু দিতে হবে আর কি করতে হবে। মেয়ে ভীষণ চিন্তিত কেক ভালো হবে কি না ভেবে। মার্কেটে গিয়ে অনেক গুলো চুড়ি,আংটি,কুর্তি,স্যান্ডেল কিনে দিলাম। আমার সাথে ঘুমায়,জিজ্ঞেস করলাম এবারের প্রোগ্ৰাম কয়দিনের তোমার? বললো কালকের দিনটা আছি। হঠাৎ একটা ছবি নিয়ে বললো,দেখো তো মা ইনাকে কেমন লাগে? সাদা কালো চুলের অধিকারী সুদর্শন এক ভদ্রলোকের গলফ্ খেলার ছবি। বুঝি ইনি মামুনের বলা সেইজন। খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখে বলি,হ্যা ঠিক আছে কিন্তু তোমার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য একটু বেশি হয়ে যাবে না? এবার চিৎকার মা আমি আমার জন্য উনাকে বলছি না কি? তোমার জন্য বলছি। আমি বলি আপাতত ইচ্ছে নেই। যদি কখনো বিয়ে করতে ইচ্ছে করে তোমাকে বলবো।

পরদিন বাটিতে তেল নিয়ে মাইক্রোওয়েভে গরম করে আঙ্গুল বুলিয়ে ঘষে ঘষে তেলটা লাগিয়ে দিল। মৌরির বিয়েতে রাতে যেতেই হবে, সবুজ শাড়ী পরে ওকে নিয়ে গেলাম। কতকিছু যে বকবক করতে লাগলো আমাদের চিটাগাং হলে এরকম হতো ওরকম হতো। ঘুমানোর সময় টিউবলাইট নিভিয়ে দেয়ার সময় বললো একটা কথা বলি মা? সত্যি করে বলো তো সুজা আঙ্কেল কে তোমার ভালো লাগে নি? তুমি বললে উনি ঢাকায় এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। আমি বলি সুজা আঙ্কেল মানে ছবির সেই ভদ্রলোক? না আমি এসবে আর জড়াতে চাই না। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম,
মুখ চেপে ধরে বলছে প্লিজ মা উনার বাসায় যেতে হলে আমাদের বাসা থেকে মাত্র ১০ মিনিট লাগে। তুমি আমি
দুজন কতো কাছাকাছি থাকতে পারবো ভেবে দেখো। আমি বলি ঘুমাও এখন। সকালে উঠতে পারবে না। হাত
ধরে বললো তাহলে তুমি আগামী মাসে চিটাগাং আসো। আমি ভেতর পর্যন্ত দুলতে থাকি, কি বলছে মেয়ে? বেশ পশ্রয়ের সুরে বলি, কেন রে?

বেশ বুদ্ধিমতীর মতো বললো আমি তো আসতে পারবো
না তাই। বাসায় যেতে অস্বস্তি হলে হোটেলে উঠবে। এক
দিন গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এলে। বললাম তোমার আন্টি মাইন্ড করবে না? মেয়ে মাছি উড়ানোর মতো বললো আরে দূর !!! আন্টিকে আবার কেউ ভয় পায় না কি? বললাম ভয় না পেলে অবিচার করা যায় তাই না? চোখ ঘুরিয়ে বলছে অবিচার কিসের? বাবাকে বন্ধু ভেবে তো
তুমি উনার বাসায় যেতে পারো মা। আমি হেসে বলি,
ধরো ঠিক এই জায়গায় আমি বা তুমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি এতো স্বাভাবিক ভাবে এসব বলতে পারতে? আমি নিশ্চিত পারতে না। মেয়ে এবার রেগে গেছে, তাহলে কি করবো? তুমি বিয়ে করবে না, চিটাগাং যাবে না তবে আগামী মাসে দেখা হবে কি করে? আমি তো প্রতিমাসে এখানে আসতে পারবো না। বললাম ওকে, চিটাগাং নয়
কক্সবাজার যাবো। ইনশাআল্লাহ মা মেয়ে দুজনে দেখো অনেক আনন্দ করে আসবো। সাথে সাথে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো আলেয়ার চেয়েও অনেক বেশি আমাকে আদর করে দাও। এতো দিনের সব আদর চাই আমি।

মেয়ে চলে গেছে, রেখে গেছে মায়া। ঠিক যেমন পাখি চলে যায় রেখে যায় পালক। আমার ভেতরটা সৃষ্টিকর্তা গতরাতে এতো বড় সম্পদে ভরিয়ে দিয়েছেন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়েছে। সুখগুলো, আনন্দগুলো ঠিক যেন
বায়বীয় নয় বরং কঠিন রুপে দেখা দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে যা ধরাছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here