#রূপবানের_শ্যামবতী
#১৫তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
নিঝুম দুপুর। শান্ত পরিবেশ। খাওয়া-দাওয়া সেরে সকলেই যার যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সুযোগে চোরের মত পা টিপে টিপে নিজের ঘর থেকে বের হল ফারহা। সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ নজর বুলিয়ে নিল সে। চারদিক ফাঁকা পেয়ে ধীরে ধীরে পা এগিয়ে নিয়ে চলল। ঠিক আহরারের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। ডোর নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে উঁকি মারতে থাকে। যদিও সে জানে ভেতরে কেউই নেই। তারপরও যেন একরাশ জড়তা এসে ভর করেছে। ইতস্তত করতে করতেই ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঘুরে ঘুরে চারিদিক দেখছে। কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা একটি ঘর। আহরার যে বেশ শৌখিন তা তার ঘরের সাজসজ্জা দেখলেই বোঝা যায়। বাহারি রকমের শৌখিন জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো তার ঘর। ঘরটা বেশ বড়। বিশাল বেড, তার পাশেই বেড সাইড টেবিলে রাখা ল্যাম্প, একটা ছোটো ভাস আর একটা ফটো ফ্রেম। ফারহা এগিয়ে এসে ফটো ফ্রেমটি তুলে নেয়। ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি আহরারের। তবে পাশেই আরো একটি মানুষ দাঁড়িয়ে। যে আহরারকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে আর আহরার নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মত্ত। দুজনের মুখেই প্রাণখোলা হাসির রেশ লেগে আছে। মানুষটির ছবির ওপরে হাত বোলায় ফারহা। তার বড় ভাই, প্রিয় ভাই আয়মান। সে যে তার ভাইয়ের বড্ড আদরের। আজ তার জীবনের এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ দিনে তার এই ভাইটি থাকবেনা ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠছে। চোখের কোণে জল জমতে শুরু করেছে। বড় করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নেয় ফারহা। ছবিটি জায়গামতো রেখে দেয়। বেডের ওপর বসে পড়ে সে। বালিশগুলোতে হাত বোলাতে থাকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে লাজুক হাসি। এই বেডটি আর কিছুদিন পর তার হবে। শুধু এই বেডটি নয়, পুরো ঘরটি। ওইযে ওই দানবাকৃতির আলমারিটা সেখানে একটা অংশ হবে তার। ফারহা উঠে দাঁড়ায়। বেলকনির দিকে নজর যায় তার। সেখানে একটা বড় দোলনা ঝুলানো। বেশ আকর্ষণীয়। চারপাশে হরেক রকমের টবে সাজানো গাছ। মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে সেখানে দাঁড়ালেই। ফারহা ঘুরে দাঁড়ায়। সামনেই বিশাল এক আয়না। সেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো আহরার ভাই, পার্মানেন্টলি আমাকে এই ঘরটায় স্যাটেলড হওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। ঘরটা আমার ভিষওওওণণ পছন্দ হয়েছে।”
~~~
জ্ঞানহীন অবস্থা আহরারের। ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। হাতে, পায়ে জায়গায় জায়গায় কালশিটে দাগ পড়েছে। তাকে রাখা হয়েছে একটি মাটির ঘরে। এই ঘরটি আগে ধানের আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যা দাইয়ানের দাদার ব্যবসা ছিলো। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত। একটু ফাঁকা জায়গায় এই ঘরটি। আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই। যে কটা আছে খানিকটা দূরে দূরেই। তাই আহরারের থাকার জন্য এই ঘরটারই ব্যবস্থা করেছিলো দাইয়ান। এতোদিন আহরার এখানেই ছিলো। হঠাৎই আহরারের ফোন থেকে দাইয়ানের কাছে একটা কল আসে। আহরার ভেবে ফোনটা রিসিভ করতেই বুঝতে পারে একজন অচেনা লোক। তাকে জানায়, আহরারের অবস্থা ভালো নয় তাকে গ্রামের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এই শুনে দাইয়ান আর কোনো কিছু ভাবার সময় পায়না। সে রাদিফ, ঈশান এমনকি আয়াজকেও খবর দিয়ে নিয়ে আসে। তারা সকলেই গ্রামে এসেই প্রথমে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছোটে। এমন একটা পরিবেশে আহরারকে রাখা হয়েছে যেখানে থাকলে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা দিয়ে আহরারকে নিয়ে চলে আসে এখানে।
দরজার কাছে চিন্তিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দাইয়ান। বিছানায় আহরারের পায়ের দিকটাই বসে আছে রাদিফ, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ঈশান। আর আয়াজ মাথার কাছে বসে বসে আহরারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিরবতা ভেঙে ঈশান বলে ওঠে,
–তোদের কাছে কি মনে হয়? কে করতে পারে এই কাজ?
দাইয়ান ফিরে তাকায়। আহরারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে। ফট করে রাদিফ বলে ওঠে,
–সন্দেহের কোনো অবকাশই নেয়। আমি নিশ্চিত এটা ওই শাহাদাতের কাজ।
দাইয়ান অবিশ্বাসের সুরে বলে,
–কিন্তু আহরার তো ছদ্মবেশে ছিলো। ওকে তো চিনতে পারার কথা নয়।
ঈশান জবাব দেয়,
–হয়তো সে অরুনিকাদের ওপর নজর রাখতো। আর আহরারের ঘুরঘুর করা দেখে বুঝে গিয়েছিলো। কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছে।
দাইয়ান ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠে,
–ভাবতে পারছিস কি মারাত্মক এক বিপদে ফেঁসে গেছিলো ও। যদি ওর কিছু হয়ে যেতো আন্টিকে কি জবাব দিতাম আমরা। আর দাদীজান? উনি কি আমাদের ছেড়ে দিতেন?
আয়াজ চিন্তিত স্বরে বলে,
–ভাইয়ার তো জ্ঞানও ফিরছে না এখনো।
আয়াজের কথা শেষ হতে না হতেই আহরারের জ্ঞান ফিরে আসে। সে ওমন অবচেতন অবস্থায় চোখ বুজে রেখেই বিরবির করতে থাকে,
–অরু, অরু যেওনা অরু। আমাকে ছেড়ে যেওনা.. আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ.. আমি পারবোনা তোমায় ছেড়ে থাকতে, ফিরে এসো.. ফিরে এসো..
কাছাকাছি বসে থাকায় আয়াজ স্পষ্ট সবকথা শুনতে পায়। দাইয়ান, ঈশান, রাদিফ সকলেই আহরারের কাছাকাছি এসে তাকে ডাকাডাকি করতে থাকে। এমন সময় কিছু একটা ভেবে আয়াজ বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে।
~~~
পড়ন্ত বিকেলে সময়টা কেমন বিষাদময়। ভারি মন নিয়ে বিস্তৃত আকাশপানে চেয়ে আছে অরুনিকা। যে মানুষটাকে এড়িয়ে চলার নিমিত্তে মনকে কঠোর করে রেখেছিলো এতোদিন সেই মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়ায় আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? জানা নেই তার। সেই যে মুখ ফিরিয়ে চলে এলো এরপর থেকে মানুষটাকে আর একবারো দেখলো না। তবে কি সে ফিরে গেলো নিজ ঠিকানায়? অবশ্য ফিরবে না-ই বা কেন? আর কিসের আশায়ই বা থাকবে? তবে অরুর ভেতরটা এতো ফাঁকাফাঁকা লাগছে কেন? মনটা অশান্ত হয়ে আছে। অস্থিরতায় বারবার এদিক সেদিক পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। এতটুকু স্থিরতা আনতে পারছে না সে। কি হলো তার? কেন হলো? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা।
আর ভাবতে পারছে না সে। চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়াতেই আচমকা আদ্রিকার উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
–বুবু! বু..বু!
থমকে দাঁড়ায় অরু। পিছু ফিরে বোনকে দেখে কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
–কিরে? কি হয়েছে? আর এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?
–আহরার..আহরার ভাই..
আহরারের নাম শুনে হঠাৎই মনটা যেন খুশি হয়ে গেলো অরুর। তবে কি উনি এখনো যাননি? কিন্তু পরক্ষণেই এই খুশি মিলিয়ে গেলো আদ্রিকার পরবর্তী কথা শুনে,
–বুবু, আহরার ভাইকে কারা যেন খুব মেরেছে।
ধ্বক করে ওঠে অরুনিকার বুক। এ কি শুনছে সে? ছুটে এসে আদ্রিকার দুবাহু ধরে অস্থির কন্ঠে বলে,
–কারা মেরেছে উনাকে আদ্রি? কোথায় আছেন উনি এখন? আমায় নিয়ে চল.. জলদি নিয়ে চল..
আদ্রিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে অরুকে নিয়ে চললো অাহরারের কাছে।
বিকেল বেলা বান্ধবীদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে গিয়ে হুট করে আয়াজের সাথে দেখা আদ্রিকার। প্রচন্ড অবাক হয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছিলো সে কি সত্যি দেখছে কিনা। আয়াজের কন্ঠস্বরে ঘোর কাটে তার,
–আদ্রিকা প্লিজ আমার একটা উপকার করো। তোমার বোনকে একটু ভাইয়ার সাথে দেখা করাবে প্লিজ।
আদ্রিকা হা করে চেয়ে আছে। কন্ঠে বিস্ময় রেখে সে জবাব দেয়,
–আপনি এখানে? কিভাবে? কখন? কেন? কিছু বুঝতে পারছিনা..
–আমি এখানে এসেছি আমার ভাইয়ার জন্য। আহরার ভাইয়ার জন্য।
–কেন? কি হয়েছে ভাইয়ার?
–ভাইয়ার অবস্থা ভালো না। কে বা কারা যেন ভাইয়ার ওপর হামলা করেছে। জানি না। ভাইয়া শুধু তোমার বোনেরই নাম নিচ্ছে। যদি উনাকে একটু দেখা করানো যেতো ভাইয়ার সাথে অনেক বেটার হতো। তুমি কি এই হেল্পটা করবে প্লিজ?
আয়াজের করুণ স্বরে করা অনুরোধ শুনে বড্ড মায়া লাগলো আদ্রিকার। সে বললো,
–আমি এখুনি বুবুকে নিয়ে আসছি।
তারপরই সে ছুটে যায় তার বুবুর কাছে।
~~~
দাইয়ান গিয়েছে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। রাদিফ আর ঈশান আহরারের কাছে আছে। অপেক্ষা করছে আয়াজের। ছেলেটা হুট করে কোথায় যে গেলো? আয়াজ এলে তাকে আহরারের কাছে বসিয়ে ওদের ওষুধ কিনতে যেতে হবে। অপেক্ষার মধ্যেই হুট করে দরজায় কারো আগমন টের পেয়ে রাদিফ ঈশান ঘুরে তাকায়। অরুনিকাকে দেখে দুজনেই অবাক হয় বেশ। অরুনিকা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আহরারের দিকে। ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। বিছানার কাছে আসতেই রাদিফ আর ঈশান উঠে দাঁড়ায়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তারা। অরুনিকা আহরারের কাছে এসে বসে। মানুষটার আঘাতে জর্জরিত মুখটা দেখে অরুর ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এতো সুন্দর মুখটার কি করুণ হাল। চোখের কোণে জমা অশ্রু টলমল করতে করতে গড়িয়ে পড়লো। ঝট করে তা মুছে নিলো সে। মানুষটার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখে। হাতে পায়ের কালশিটে দাগ গুলো চোখে পড়তেই বুক খামছে ধরে তার। ইশশ! কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করছে মানুষটা। ভেতর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে অরুর। সহ্য করতে পারছে না। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ঘুরে চলে যাবে ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে পরিচিত কন্ঠস্বর,
–এভাবে চুপচাপ দেখে চলে যাবে? কিছু বলবে না?
ফিরে তাকায় অরু। আহরার চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। তার দৃষ্টিতে কেমন বেদনার ছাপ স্পষ্ট। উঠে বসার চেষ্টা করে সে। অরু ছুটে এসে আহরারকে দুহাতে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলতে থাকে,
–উঠছেন কেন আপনি? শরীরটা অনেক দূর্বল আপনার।
আহরার জবাব দেয় না। ঠিকভাবে বসে নেয়। অরুও সাহায্য করে তাকে বসতে। সুগভীর চাহনি অরুর মুখবিবরে লুটিয়ে দিতেই সেই চাহনি লক্ষ করে বিব্রত হয়ে পড়ে অরু। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। একই চাহনি বজায় রেখেই আহরার জবাব দেয়,
–আমার মেডিসিন এসে গেছে। আর কোনো অসুস্থতা নেই আমার।
চোখ তুলে তাকায় অরুনিকা। আহরারের মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছে। আর তার বলা কথাগুলো, আজ এতো মধুর লাগছে কেন? দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অরু। আহরারের কালশিটে দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
–আমার কাছে কিছু গাছঔষোধি আছে। লাগালে খুব জলদিই সেরে যাবে। আজকের রাতটুকু একটু কষ্ট করে পার করে নিন। কাল সকালেই নিয়ে আসবো আমি।
এই বলে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না অরু। আহরারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো সে। অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আহরারের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে হাসি। এ যেন বিশ্ব জয়ের হাসি। পেছনে গা এলিয়ে চোখ বুজে আপনমনে বলতে থাকে,
“মার খেয়ে যদি তোমার এতো কেয়ার পাওয়া যায় তবে এমন মার আমি হাজারবার খেতে রাজি।”
~~
সকাল বেলা আহরারের ঘরে বসে দাইয়ান, ঈশান, রাদিফ, আয়াজ সকলেই আলোচনা করছিলো আহরারের এমন অবস্থা কিভাবে হলো?
আহরার সবটাই খুলে বলে,
–কাজটা শাহাদাত করেছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। তবে হয়তো তার আক্রমণ আরো হিংস্রতা পেতো যদি না কেউ এসে বাঁধা দিতো।
দাইয়ান প্রশ্ন করে,
–বাঁধা দিতো মানে? কেউ কি এসেছিলো তোকে বাঁচাতে?
–জ্ঞান হারানোর আগে আমি হালকা হালকা বুঝতে পারছিলাম। শাহাদাত যখন আবার আমাকে মারতে উদ্যত হয় ঠিক তখনই দুজন লোক এলো। সম্ভবত তাদের হাতে রি ভ ল বার ছিলো। ওরা এসে হুমকি দিতেই শাহাদাত আর তার লোকেরা পালিয়ে গেলো। আর তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
আহরারের কথা শুনে সকলেই অবাক হয়ে ভাবতে থাকে কারা এসে বাঁচালো? তাও আবার ব ন্দু ক ধারী। সাধারণ কোনো গ্রামের মানুষ তো মনে হচ্ছে না। ভাবনার ছেদ ঘটে সকলের এক মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে।
–আসবো?
অরুনিকাকে দেখে সকলেই হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়। আহরারের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় কেমন বেকুবের মতো হা করে তাকিয়ে আছে সে অরুনিকার দিকে। দাইয়ান গলা খাঁকারি দিতেই আহরারের ঘোর কাটে। থতমত খেয়ে যায় সে। তা দেখে সকলেই মুখ টিপে হাসছে। দাইয়ান বলে উঠে,
–চল তো সবাই আমরা বাইরে যাই।
রাদিফ,ঈশান,আয়াজ সকলেই একযোগে জবাব দেয়,
–হ্যা হ্যা চল।
অরুনিকা বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো ওদের কথা শুনে। তারা বেরিয়ে যেতেই সে আহরারের কাছে এসে দাঁড়ায়। ঔষুধির বাটিটা এগিয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–নিন, ওষুধটা লাগিয়ে নিন।
আহরার চোখে মুখে মন খারাপ ফুটিয়ে তোলার অভিনয় করে বলে ওঠে,
–একজন অসুস্থ মানুষকে নিজে নিজেই তার সেবা করতে বলছো। আহারে! কোনো মায়াদয়া নেই কারো?
অরুনিকা আহরারের মুখের দিকে তাকায়। তার অভিনয়টুকু অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়না একটুও। মৃদু হেসে সে বসে পড়লো। বাটি থেকে কিছুটা ওষুধ তুলে নিয়ে ইশারায় আহরারের হাতটা এগিয়ে দিতে বললো। আহরার হাত এগিয়ে দিতেই অরু পরম যত্নে আঘাতের জায়গাগুলোতে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। নিরবে সম্পূর্ণ কাজটুকু শেষ করে বিদায় নিতে চায়। আহরার দ্রুত বলে উঠে,
–এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে? আর একটু থাকো না..
অরুনিকা হালকা হেসে জবাব দেয়,
–আবার আসবো।
এই বলে চলে যায় অরু।
এদিকে অরুনিকার প্রস্থান নিশ্চিত করে লুকিয়ে তাদের ওপর নজর রাখা ব্যক্তিটি ফোন লাগায় তার বসকে। রিসিভ হতেই সরাসরি ভেসে আসে,
–তারপর খবর কি?
–মেয়েটা যাতায়াত শুরু করেছে সম্ভবত।
–সেবা করছে নাকি নিজের প্রেমিক পুরুষের?
এ কথা শুনে মানুষটি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে। ধমকে ওঠে আগন্তুক।
–এমন বিচ্ছিরিভাবে হাসবেনা আসিফ। কানে লাগে।
বসের ধমক খেয়ে চুপসে যায় আসিফ নামক লোকটা। কিছু বলার পূর্বেই অপরদিক থেকে আদেশ আসে,
–প্রতি মুহুর্তের আপডেট যেন একুরেটলি পাই। ওকে?
–ওকে বস।
লাইন কেটে যায়।
ফোনে কথা বলা সমাপ্ত করে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় আগন্তুকটি। বাইরে দৃষ্টিপাত করে গভীর ভাবে কোনো কিছু চিন্তা করতে থাকে সে। পর মুহুর্তেই শব্দ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। আপনমনেই বলতে লাগলো,
–তুই আমার শত্রু তাই তোকে আঘাত করার অধিকারও কেবল আমার। তোকে বাঁচিয়েছি তার মানে এই নয় যে তোকে ভালোবাসি। আমি তোকে সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করি আহরার। সবচেয়ে বেশিইইই।
~~~
অরুনিকা যেন আদর্শ প্রেমিকার মতোই আহরারের খেয়াল রাখতে শুরু করেছে। প্রতিদিন এসে আহরারের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগানো, তার সুস্থ হওয়ার জন্য ভালোমন্দ রান্না করে নিয়ে এসে খাওয়ানো, সঠিক সময়ের ওষুধ দেওয়া এমনকি ড্রেসিংটা পর্যন্ত সে নিজের হাতে করেছে। কেন করছে তা সে জানেনা। শুধু জানে এসব করে সে একধরনের মানসিক তৃপ্তি লাভ করছে।
অরুর সেবা পেয়ে আহরার এখন মোটামুটি সুস্থ। আহরারের ক্ষতস্থানগুলো মন দিয়ে দেখে অরু। অভিজ্ঞের ন্যায় বলে ওঠে,
–হুম সেরে গেছে প্রায়। আশা করি আর কোনো সমস্যা হবেনা। আমি তাহলে আজ আসি।
অরু উঠে চলে যায়। দরজার কাছে যেতেই আহরারের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
–অরু..
ঘুরে দাঁড়িয়ে আহরারের দিকে তাকায় অরু। ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,
–কী?
আহরার এগিয়ে আসে। অরুনিকা আর তার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে সে। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে অরুকে। অরু বিব্রতবোধ করে। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইতে থাকে তখনই আহরারের ঘোরলাগা কন্ঠস্বর শুনে থমকে যায় সে,
–আমার সাথে যাবে অরু? সারাজীবনের জন্য?
থমকে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখে অরু। সরাসরি আহরারের দিকে তাকায় না সে। দৃষ্টি অন্যদিকে রেখেই নম্রস্বরে জবাব দেয়,
–আপনি এখনো ওই ভাবনাতেই আটকে আছেন?
–তবে তুমি কি ভেবেছো? দুদিনের মোহ যে তুমি ফিরিয়ে দিলে আর আমি সব ভুলে চলে গেলাম?
এবার চোখ তুলে তাকায় অরু। খাানিকটা শক্ত কন্ঠেই বলে উঠে,
–দেখুন, মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন।
আহরার উদগ্রীব হয়ে অরুর কথা শোনার উদ্দেশ্যে চেয়ে থাকে। কিছুটা থেমে শ্বাস নেয় অরু। অতঃপর শান্তকন্ঠে বলে ওঠে,
— সকলের ভাষ্যমতে আমি একজন কুৎসিত মেয়ে আর অন্যদিকে আপনি অত্যন্ত আকর্ষণীয় রূপের অধিকারী। তাছাড়া আপনার পারিবারিক অবস্থান আর আমাদের পারিবারিক অবস্থানের মধ্যেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। আপনার পরিবারের সদস্যরা আমাকে সহজে গ্রহণ করতে পারবেনা। এতে করে আপনাকে প্রচুর সমস্যার মধ্য দিয়ে পার হতে হবে। আর তারপর এভাবে চলতে চলতে একটা সময় আপনার মনে হবে আপনি ভুল করেছেন। আবেগ কেটে যাবে। তখন সবকিছুই তিক্ত মনে হবে। সুন্দর সাজানো গোছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে। কোনো কিছুই আর ঠিক করতে পারবেন না। তাই আমার পরামর্শ। ভুলে যান এসব। বাড়ি ফিরে যান। পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে সুখী হন।
দম নেয় অরুনিকা। উত্তরের আশায় আহরারের মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু আহরার চুপ। একটু পর হাসতে শুরু করে সে। ধীরে ধীরে হাসতে হাসতে একটাসময় তা প্রকট আকার ধারণ করে। হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ে আহরার। অরুনিকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ভাবতে থাকে, “লোকটা শোকে পাগল হয়ে গেলো না তো।”
কোনোরকমে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করে নেয় আহরার। তারপর পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে অরুনিকার মুখোমুখি হয়। মুহূর্তেই মুখমন্ডল কঠিন করে ফেলে সে। অরুনিকার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে কন্ঠে গাম্ভীর্যতা টেনে বলে,
–এই যে বাড়ি ঘর, কাজকর্ম সবকিছু ফেলে এখানে এসে পড়ে থাকলাম দিনের পর দিন। সারাটাক্ষন পিছু পিছু ঘুরলাম। তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য, তোমার ভাবনাজুড়ে নিজের অস্তিত্ব তৈরি করতে কতকিছু করে বেড়ালাম, মারও খেলাম। এসবকিছুকে কতো সহজেই তুমি সংজ্ঞায়িত করে দিলে “আবেগ” নাম দিয়ে।
বিদ্রুপাত্মক হাসে আহরার। কিছুটা পিছিয়ে যায়। এবার করুণ স্বরে বলে ওঠে,
–আর কি কি করলে আমি তোমার মন পাবো অরু? বলতে পারো?
আহরারের কথা শুনে অরুর ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন। সে তো সেদিনকার সেই লোকটার বলা কথাগুলো ভেবেই ভয় পাচ্ছে। তার জন্য এই মানুষটা কোনো সমস্যায় পড়ুক সে সেটা চায়না। কিভাবে বোঝাবে সে। আহরার ঝট করে এগিয়ে এসে অরুর দু বাহু ধরে কাছে টেনে আনে। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব সম্পূর্ণভাবে ঘুচিয়ে দেয়। চোখে চোখ রেখে কোমলস্বরে বলে,
–কি হলো অরু, জবাব দিচ্ছো না কেন?
আহরারের চোখে মুখে ফুটে ওঠা আকুতি অরুকে দূর্বল করে দিচ্ছে। ম্রিয়মাণ স্বরে জবাব দেয় সে,
–ভয়! বড্ড ভয় হচ্ছে।
–কিসের ভয়? আমি আছি তো। যত শক্তিশালী বাণই আসুক না কেন এই আহরার তার অরুনিকার সামনে বক্ষ মেলে ঢাল হয়ে থাকবে সর্বদা।
–যদি ঢাল সরে যায়?
–উঁহু! কক্ষনো না। শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা থাকবে যতদিন এই ঢাল ততদিন আগলে রাখবে তোমায়। ভয় পেও না অরু। বিশ্বাস রাখো।
নিষ্পলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চেয়ে আছে দুজন। আহরারের কথা শুনে তাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে অরুর। সত্যিই বোধহয় সে রাজপুত্র পেয়ে গিয়েছে। যেমনটা আদ্রিকা বলতো। এই মানুষটাকে কি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত?
দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘোর কাটে দুজনের। ছিটকে সরে যায় দুজন। অস্বস্তি এসে ভর করে অরুনিকার মধ্যে। বাইরে থেকে ভেসে আসে আদ্রিকার কন্ঠস্বর,
–বুবু, সন্ধ্যে নেমে এলো প্রায়। বাড়ি ফিরতে হবে এবার।
লজ্জামিশ্রিত চাহনি মেলে একবার আহরারকে দেখে নেয় অরু। পরক্ষণেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আর কিছু না বলেই ছুটে চলে যায়। আর সেই যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আহরার।
~~~—~~~
আজ অনেকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে আহরার। তার সাথে আছে রাদিফ। সেও যেন আজ ঘুমকাতুরে হয়ে গিয়েছে। ধুম ধুম করে দরজায় আওয়াজ হতেই লাফিয়ে ওঠে রাদিফ। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুতে শুতে আহরার বলে ওঠে,
–কে রে এমন গর্দভের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছে? দেখ তো রাদিফ।
এদিকে ক্রমশ দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈশানের কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
–দরজা খোল, দরজা খোল, আহরার, রাদিফ দরজা খোল….
ঈশানের ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বর শুনে আহরার, রাদিফ দুজনেই হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ব্যাপারটা কি? ঈশান এভাবে ডাকছে কেন? কোনো বিপদ নয় তো?
আহরারই আগে ছুটে এসে দরজা খুলে। দেখতে পায় ঈশান হাঁপাচ্ছে। আহরার কোনো প্রশ্ন করার আগেই ঈশান উত্তেজিত স্বরে বলতে থাকে,
–আরে শীগগির চল। মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে।
রাদিফ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
–কি হয়েছে রে? তুই এতো ভয় পেয়ে আছিস কেন?
ততক্ষণে আহরার ভেতরে এসে নিজের শার্টটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো। বোতাম লাগাতে লাগাতেই শুনতে পেলো ঈশান বলছে,
–অরুনিকা.. অরুনিকাদের বাড়িতে বিচার বসেছে। অনেক বড় ঝামেলা লেগেছে। জলদি চওওললল…
অরুনিকার নাম শুনেই থেমে গিয়েছে আহরারের হাত। বোতাম লাগানো অসম্পূর্ণ রেখেই সে ছুটে বেরিয়ে গেলো। এমনকি ঈশানের বলা কথাগুলোও সবটা শোনা হলোনা তার।
চলবে….
গল্পটা সুন্দর। বাকি পর্ব কবে আসবে।