প্রেম_প্রেম_পায় #স্বর্ণালী_সন্ধ্যা পর্ব ছাব্বিশ

0
430

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ছাব্বিশ

২৬.
বাহিরে মেঘ করেছে আজ। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কখন যেন বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় ধরনীকে তার স্নিগ্ধতায়।বৃষ্টি আসার পূর্বের বাতাসটা একেবারে দেহ ও মন শীতল করা বাতাস!বর্ষণের আভাস পেলেই অনেকের মনে প্রেম জাগে৷ কারো জাগে ভালোবাসার মানুষের প্রতি আবার কারো জাগে স্বয়ং বর্ষণের প্রতি।

কিন্তু ফারাজের আপাতত তাতে মন নেই।অফিসে গিয়ে ফারাজ মাথা ধরে বসে আছে তার কেবিনে। এখন আর ফারদিন আহমেদ তেমন একটা আসেন না অফিসে। দরকার পড়লে আসেন। ফারাজের উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

রাতে ঘুম না হওয়ার কারনে এখন মাথার যন্ত্রণায় ভুগছে সে।চোখ লাল হয়ে আছে তার৷ সকাল বেলা মা কে কোনো রকম বুঝ দিয়ে অফিসে এসেছে৷আখি বেগম বলেছিলেন অফিসে যেতে না। কিন্তু ফারাজের যে সেই রুমে থাকতেও ভালো লাগে না। একাকিত্ব ঘিরে ধরে। সকাল থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে বসে ছিল। এখন আর সহ্য হচ্ছে না তাই নীতিকে পাঠিয়েছে একটা ব্লাক কফি আনতে।
কারো শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালো ফারাজ। নীতি কফি এগিয়ে দিল।ফারাজ কফি হাতে নিল। কফি চুমুক দিতে গিয়েও দিল না৷ নীতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
‘চিনি দেন নাই তো?’

নীতি বোকার মতো বলল,
‘চিনি কে দেয় ব্লাক কফিতে?’

ফারাজ নীতির দিকে ইশারা করে তাকালো।পরক্ষনে নীতি বুঝলো কে দেয়! নীতি নিজের প্রশ্নে নিজেই বোকা হয়ে গেল। লজ্জিত হয়ে বলল,
‘ওহ হ্যা আমিই দিতাম!’

নীতির বলার ভঙ্গিতে হেসে দিল ফারাজ৷ সাথেসাথেই আবার চোখ মুখ কুচকে ফেলল মাথার যন্ত্রণায়।
নীতি ফারাজকে ভুগতে দেখে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘বাসায় চলে যান স্যার।’

ফারাজ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘না বাসায় রুমে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না।’

নীতি আবার প্রতিবাদী সুরে বলল,
‘এখানেও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। এসে শুধুই বসে আছেন। মাথা ব্যথায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না আপনার।তার থেকে অফিসে না থাকা ভালো না?’

ফারাজ নীতির কথা শুনে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীতির দিকে বেশ কিছুক্ষন। নীতি ফারাজের এমন দৃষ্টি দেখে ভাবনায় পড়ে গেল। সে কি ভুল কিছু বলেছে?
ভাবা শেষ করে ফারাজ এবার মুখ খুলল। নীতিও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কি বলবে তা শুনার জন্য। ফারাজ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
‘ you know what niti? আপনি একেবারে ঠিক বলছেন।অফিসে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না।আমাদের ঘুরতে যাওয়া উচিত।চলেন!’

বলে সে নীতিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল কেবিন থেকে৷ নীতি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কি বুঝালো আর তিনি কি বুঝলেন!ফারাজ কেবিন থেকে বের হয়ে নীতিকে গলা বাড়িয়ে আবার বলল,
‘আসুন নীতি!’

নীতি ফারাজের ডাক শুনে নিজেকে সামলে ফারাজের সাথে সাথে গেল। এটাও ভালো। অফিসে থাকার থেকে বাহিরে মাইন্ড ফ্রেশ করাটা ভালো আইডিয়া।তাই নীতি আর বাধা দান করে নি ফারাজকে।

বাবার গাড়িটা এখন ফারাজ চালায়। ফায়াদের তো নিজের আছেই৷ ফারাজ ভাবছে একটা বাইক কিনবে। যেটাতে হুটহাট করে বেরিয়ে যাওয়া যাবে নিজের মতো করে ঘুরার জন্য। গাড়িতে বসে এই কথাটাই শেয়ার করলো নীতির সাথে ফারাজ। নীতি এক্সাইটেড হয়ে বলল,
‘হুম কিনতে পারেন স্যার। আমার বাইক অনেক পছন্দ।’

ফারাজ নীতির এক্সাইটমেন্ট দেখে বলল,
‘আরে বাহ তাহলে আপনিও কিনেন একটা।’

নীতি মন খারাপ করে বলল,
‘চালাতে পারি না।বাবা বলেছিল শিখাবে কিন্তু..’

ফারাজ নীতির মন খারাপ দূর করার জন্য বলল,
‘আমি শিখাবো। টেনশন কিসের?’

‘হুম’

নীতির মন অন্যদিকে নেওয়ার জন্য ফারাজ এবার নীতিকে ডেকে বলল,
‘আপনি কি জানেন নীতি? আপনাকে কুর্তি তে অনেক সুন্দর লাগে। ‘

হঠাৎ প্রশংসা শুনে নীতি একটু লজ্জা পেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো হালকা। তা দেখে ফারাজ দুষ্টুমি করে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
‘ওমাহ! আপনি লজ্জা পাচ্ছেন?’

একথায় যেন নীতির লজ্জা আরো বেড়ে গেল। সে বাহিরে তাকিয়ে বলল,
‘ একদম না’

ফারাজ শব্দ করে হেসে দিল। নীতি আর ফারাজের দিকে ঘুরলো না। বাহিরেই তাকিয়ে রইলো।ফারাজ হাসি থামিয়ে এবার স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘ একদম সত্যি করে বলছি আপনাকে সুন্দর লাগছে। আপনাকে শাড়িতেও বোধহয় খুব সুইট লাগবে। ট্রাই করতে পারেন।’

ফারাজের মনোযোগ রাস্তায়। নীতি তাকালো ফারাজের দিকে। বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর সামনে মনোযোগ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

ফারাজ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জবাব দিল,
‘এমন একটা জায়গায় যেটা আপনি অনুভব করেন নি কখনো। গেলে বুঝতে পারবেন।’

বাকিটা রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলল না।
গাড়ি থামলো বেশ দূরে নদীর পাড়ে। নীতি গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। চারদিকে দারুন বাতাস। বাতাসের দরুন নদীতে ছোট বড় ঢেউ খেলা করছে। অনেকেই এসেছে ঘুরতে। নীতি চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,
‘নদীর পাড় এ ঘুরতে এসেছি?’

ফারাজ গাড়ি লক করে নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘নদীর পাড়ে নয়। আমরা আসলে নদীতে ঘুরতে এসেছি।’

বলে হাত দিয়ে নৌকার দিকে ইশারা করলো ফারাজ। নৌকা দেখে নীতি ঢোক গিলল।ভীত স্বরে বলল,
‘আমি যাবো না। আকাশের অবস্থা দেখেছেন? তারউপর এই ছোট ছোট নৌকা? না না। আমি যাবো না।’

ফারাজ বলল,
‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনিও সাতার জানেন আর আমিও।আর যদি বৃষ্টি আসে তাহলে তো দারুন ব্যাপার হবে।নদীর মাঝে বৃষ্টি বিলাস! এ যেন আলাদা এক অনুভূতির সৃষ্টি করবে।’

নীতি তবুও উঠতে চাচ্ছিল না। নদীর ঢেউ এ এরকম ছোট নৌকাতে উঠতে তার ভয় করছে। ফারাজ অনেকটা জোড় করে নীতিকে উঠালো।
নৌকা দুলছে ঢেউ এর তালে তালে।নীতির পরাণটাও যেন দুলছে সাথে।সে সাতার জানে তবে সেটা শুধুই পুল পর্যন্ত কিন্তুএতো বড় নদীতে!ফারাজ খুব উৎসাহ নিয়ে আশে পাশে তাকাচ্ছে।অনেক বছর পর নৌকা তে উঠলো আবার। আগে বন্ধুদের সাথে কতো উঠেছে!

নৌকা মাঝ নদীতে পৌঁছাতে নীতি খিচে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।বাতাসের আর ঢেউএর কারনে তার মনে হচ্ছে এটা যেকোনো সময় উলটে যাবে।

নীতির দিকে চোখ যেতেই ফারাজ কপাল চাপড়ালো। নীতির কাছে গিয়ে বলল,
‘চোখ খুলুন নীতি’

নীতি সেভাবেই বলল,
‘না না আমি পড়ে যাবো।’

ফারাজ এবার হালকা ধমক দিয়ে বলল,
‘যা বলেছি করুন।’

নীতি ধীরে ধীরে চোখ খুলল।মূলত ফারাজের ধমকে তার একটু খারাপ লেগেছে।ফারাজ এবার নীতি কে বলল,
‘আশে পাশে তাকান। ‘

নীতি মনে মনে ফারাজকে ভেঙচি কেটে আশে পাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর! আকাশ নদী যেন একসাথে মিলে গিয়েছে। বাতাসের কারনে নীতির চুল উড়ছে এলোমেলো ভাবে।নীতি সেগুলো হাত খোপা করে ফেলল। ফারাজ প্রথমে একবার ভাবলো বলবে খোলা থাকুক কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো কি দরকার!
নীতি বসে থেকেই আশে পাশে তাকাচ্ছে হাসি নিয়ে। মন প্রাণ শীতল করা পরিবেশ৷ এখন আর নৌকার দোলনে ভয় পাচ্ছে না সে।সে এখন আনন্দে দুলছে।

‘স্যার এতো সুন্দর কেন!’

ফারাজ হাসলো নীতির কথা শুনে। ফারাজ মুচকি হেসে বলল,
‘আমার বাংলাদেশ অনেক সুন্দর যদি সেটা মন দিয়ে অনুভব করা যায়।’

নীতিও অনুভব করলো। হুম সুন্দর।বাংলাদেশ সুন্দর।এর মানুষগুলোও।
নীতি এবার চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনার মাথা ব্যথা কমেছে?’

ফারাজ নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়লো মাথার নিচে হাত দিয়ে।আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
‘এই ঠান্ডা পরিবেশ পেয়ে মাথা ব্যথার কি সাধ্য আছে আমাকে কাবু করার?’

নীতি আর কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ফারাজ জিজ্ঞেস করলো,
‘কাউকে ভালোবাসেন নীতি?’

প্রশ্নে চমকে উঠলো সে। ছোট্ট একটা প্রশ্ন অথচ এটা শুনে নীতির হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। মাথা নিচু করে ধীর স্বরে শুধালো,
‘বাসি স্যার!’

ফারাজ তা শুনে উৎসুক হয়ে হাসি মুখে বলল,
‘ কে সে?আমাকে তো বললেন না কখনো!সে কে?আপনাকে ভালোবাসে? ‘

নীতি অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
‘সে আমাকে ভালোবাসে না স্যার। সে জানে ও না আমি তাকে ভালোবাসি’

ফারাজ নীতির কথা শুনে আবার আকাশে পানে তাকিয়ে রইলো। বলল,
‘তাহলে জানানো উচিৎ। হারিয়ে যাওয়ার আগে জানানো৷ উচিৎ। ‘

নীতি মুখে কিছু বলল না। তবে মনে মনে বলল,
‘জানালে হারিয়ে যাবে। থাকুক কিছু মানুষ অজানাতে।’

ফারাজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সে প্রকৃতিতে ডুবে আছে। অনুভব করছে পরিবেশ টাকে। হয়তো বা কারো স্মৃতিতেও ডুব দিচ্ছে।আশে পাশে খেয়াল করলে সে বুঝতো কেউ তাকে দেখায় ডুবে আছে।ভীষন মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

———————

‘হ্যালো’

‘বাহিরে বৃষ্টি হবে বোধহয়’

‘তো?’

‘আসুন পেম আলাপ করি।’

ফায়াদ প্রেসক্রিপশন লিখছিল।সামনে একবার রোগীকে দেখে বলল,
‘ হোল্ড এ থাকো।’

অপরাজিতা ১০ মিনিট অপেক্ষা করলো।

‘এতো প্রেম আলাপ আসে কোথা থেকে? আজ কোচিং এ গিয়েছো?’

অপরাজিতা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
‘কি আজব! আমি বলছি ভালোবাসার কথা আপনি বলছেন পড়ার কথা’

ফায়াদ হাসলো।অপরাজিতা বলল,
‘গিয়েছি গিয়েছি!’

‘বাসায় তুমি?’

‘হুম।আপনাকে দেখবো।’

ফায়াদ ফোন কানে ঠেকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বলল,
‘কাল তো অনেকটা সময় দেখলে। মন ভরে নি?’

অপরাজিতা মিষ্টি হেসে বলল,
‘আপনাকে দেখে আমার কখনো মন ভরে না।’

ফায়াদ চোখ বন্ধ করে বলল,
‘তোমার মন কখনো না ভরুক।’

তারপর দুজনে বেশ খানিকটা সময় চুপ রইলো৷ তারপর ফায়াদ বলল,
‘বিকালের পর রেডি থেকো। আমি এসে নিয়ে যাবো। মা হয়তো তোমার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিবে।এখন রাখছি। আর দুজনকে দেখে বাসায় যাবো।’

ফোন রাখতে গিয়েও ফোনটা আবার কানে ঠেকালো সে। ডাক দিল,
‘অপরাজিতা?’

অপরাজিতা তখনও ফোন কানে ঠেকিয়ে ছিল।বলল,
‘হুম’

ফায়াদ কবিতার মতো করে বলল,
‘তুমি আমার এমনি একজন যাকে একজনমে ভালোবেসে ভরবে না মন।ভালোবাসি ভালোবাসার ফুল।’

ফোনটা কেটে গেল। কিন্তু তা অপরাজিতাকে ঘোরে রেখে গেল। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক করে দিল সে। পেশায় সে ডাক্তার অথচ অপরাজিতাকে সে প্রেমের অসুখে ভোগায়।

(চলবে)

(আরেকটা পার্ট পাবেন আজ 🌸🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here