বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২১)

0
435

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২১)

ঝকঝকে তকতকে রুমটা আজ ভীষণ পরিত্যক্ত। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ ছিল বিধায় ধুলোর পাহাড় জমেছে। খুলতেই কিছু ছোট ছোট প্রাণী দেখতে পেল অভিরাজ। তার ললাটের রেখা গুলো বেরিয়ে এল। সুন্দর শুভ্ররঙা মুখটা বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে আনা হলো। ভদ্রলোক বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন।
“আঙ্কেল বাড়ির যত্ন নিতে বলেছিলাম।”

“বাবা দুই বছর ধইরা তো আপ্নে আসলেন ই না। কোনো বিষয়ই বুঝবাল পারতাছিলাম না।”

তবু দুঃখ প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। এই বাড়িটা সম্পূর্ণ নিজ অর্থে করেছিল অভি। তার আর উষশী’র ছোট্ট একটা সংসার হওয়ার কথা ছিল। তাদের ঘনিষ্ঠ, মধুমাখা মুহূর্ত গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল রুমটি। নিজ হাতে সবটা গুছিয়েছিল ওরা। সেই রুমের অবস্থা আজ ভীষণ খারাপ। অভিরাজের অন্তঃকরণ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। দু বছর পর বাড়িটায় পা রেখেছে সে। একটু একটু স্বাভাবিক হওয়ায় চেষ্টা চালাচ্ছে।

বাড়ির ডানপাশে একটি বাগান রয়েছে। সেই বাগানের একপাশে রয়েছে বাহারি ঝর্ণা। এটা উষশী’র ভীষণ পছন্দের। বৃষ্টি ভালোবাসে মেয়েটি। তাই তার জন্য রাখা হয়েছে ভীষণ সুন্দর একটি সুইমিং পুল। বৃষ্টির জলে ভিজে এখান থেকে পরিপূর্ণ গোসল করবে দুজনে। এমন সব রকমারি কল্পনা সাজিয়েছিল। কিন্তু সময়ের স্রোতে সবটা শেষ হয়ে গেল। হারিয়ে গেল উষশী নামক বৃষ্টির জল।

অতীত
ছেলের বাড়ি থেকে লোক এসে গেছে। একটা চাপা আনন্দ কাজ করছে সবার মাঝে। বিশেষ করে গেট ধরার আনন্দটা একটু বেশিই যেন। ইরা,লাবণ্য শরবত বানাচ্ছে। বিভিন্ন স্বাদ মেশানো রঙিন শরবত। তা দেখে উষশী’র মনে প্রশ্ন জাগে।
“রঙিন শরবত কেন?”

“এই চুপ চুপ এটা সিক্রেট। এখানে টক মিষ্টি ঝাল সব রকমের শরবত আছে।”

“ঝাল শরবত ওদের তো ঝাল লাগবে ইরাপু।”

“এর জন্যেই তো বানাচ্ছি।”

উষশী কিছুই বুঝল না। গ্লাস গুলো টেবিলে এনে রেখে লাবণ্য বলল,”এটা একটা রিচুয়াল বলা যেতে পারে। মেয়ে পক্ষ গেট ধরার সময় ছেলে পক্ষের সাথে একটু আনন্দ উল্লাস করে।”

শরবতের সাথে মিষ্টি,রকমারি চকলেট ও নেওয়া হলো। একটা বাটিতে অনেক ধরনের ফুলের পাপড়ি নেওয়া হয়েছে। ইরা তার ভেতরে কাঁচি লুকিয়ে রাখল। এই নিয়েও উষশী’র মনে প্রশ্ন জাগল। কিন্তু সে প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। ছেলে পক্ষ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই পরিচিত হলেও কিছু অপরিচিত মানুষ রয়েছে। তারা ছেলের বন্ধু গোছের কেউ। তারা সকলেই হাসি ঠাট্টায় ফেটে পড়ছে। উষশী বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। ওমন সময় চোখে পড়ল এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ঈশান। তার মুখে রাজ্যের মেঘ। ছেলেটার এই বিষণ্ন মুখশ্রী উষশী’র হৃদয়কে নাড়িয়ে দিল। সে ছুটে এসে বলল,”ফের মন খারাপ করেছ তুমি?”

“মন খারাপ নয় উষশী।”

“ফ্রেন্ড, তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই না?”

“না উষশী। আমি কেন কষ্ট পাব?”

“মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাচ্ছে।”

উষশী’র দিকে সরল চোখে তাকাল ঈশান। তার বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হচ্ছে। ছেলেটার হাতটা শক্ত করে ধরল সে।
“দুঃখ পেও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষশী’র কথাই ঠিক সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন হয়ত ছোঁয়া নামক মানুষটিকে মনেও পড়বে না। তবে মাঝের সময়টুকু বড়ো দুঃখে যাবে। সেই হাহাকার, উন্মাদনা কাকে বোঝাবে ঈশান? কেউ নেই তার গল্প শোনার জন্য। কিংবা আছে অথচ তার বলার ইচ্ছে হয় না।

বাড়ি ভরাট করে আছে মেহমান। তাদের সমাদরে সকলেই ব্যস্ত। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকে গেছে। বিয়ের সব রকমের আনন্দ উল্লাস ও প্রায় শেষ। অভিরাজকে এত সময় পর দেখল উষশী। তার রাগ হচ্ছে খুব। ছেলেটা সারাদিনে কত টুকু সময় দিয়েছে তাকে?
“খারাপ মানুষ।”

“তোমার আবার কি হলো!”

“কথা নেই খারাপ মানুষ।”

“দেখি কি হয়েছে।”

মেয়েটিকে শক্ত করে আলিঙ্গন করল অভি। এতে অবশ্য গলল না মেয়েটি।
“বলো কি হয়েছে?”

“একটা বার সময় হয় নি দেখা করার?”

“তোমায় তো আমি দেখেই যাচ্ছি।”

“কোথায়,আমি তো দেখি নি।”

“তখন তুমি সবার সাথে ব্যস্ত ছিলে।”

“আপনি কেন নিয়ে গেলেন না।”

“সবার সাথে মেলামেশা করা ভালো উষশী। একজনের উপর নির্ভর হলে চলবে?”

উষশী বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিল। তাদের দুজনের শরীর থেকেই মন ভালো করা সুবাস আসছে। একটা সুন্দর সময় যাচ্ছে তাদের।

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজর ঘুরিয়ে নিল। কথায় আছে মানুষ যা দেখতে চায় না তাই বার বার দেখতে হয়। এমনটাই হচ্ছে তার সাথে। বারং বার ওদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত গুলো চোখে পড়ছে। এটা একটা বিশেষ যন্ত্রণার কিংবা আক্ষেপের। হুট করেই মনে হলো এভাবে অভি’র বুকে মাথা রাখার কথা বহুবার ভেবেছে সে। অথচ এত দিনেও সেটা খেয়াল হয় নি। উষশী’র সাথে অভিরাজের অন্তরঙ্গতা দেখলেই নিজের কল্পনা গুলোর স্মরণ ঘটে। মনে হয় এসব তার বহু দিনের ভাবনা। অথচ সে বুঝতে পারে নি। আর বুঝতে পারে নি বিধায় অভিরাজ তার থেকে এত দূরে। একটা যন্ত্রণা ওকে শেষ করে দিচ্ছে। গলার কাছটা তরল শূন্য হয়ে পড়েছে। চট জলদি পানি পান করল সে। তবু তৃষ্ণা মিটছে না। খানিক বাদে ঘরে এসে শুয়ে রইল। লতিফা আয়না নেওয়ার জন্য মেয়ের ঘরে এসেছিলেন। তখন দেখলেন প্রাণহীনের মতো দেখাচ্ছে তার ছোট্ট মেয়েটিকে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলালেন ক্রমাগত। তার ঠান্ডা শীতল কণ্ঠের মাঝেও কেমন ভীরুতা।
“কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে?”

“জানি না মা। আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবটা কেমন অশান্তি’র মনে হচ্ছে।”

“ছোঁয়া চলে যাচ্ছে দেখে এমন লাগছে। কত আদরে বড়ো করেছিস।”

“হয়ত মা।”

“কিছু খাবি?”

“না। একটু বসবে মা? আমি তোমার কোলে মাথা রাখব।”

লাবণ্য মায়ের কোলে মাথা এলিয়ে দিল। মেয়ের এই ভাঙনের কারণ লতিফা ঠিক ঠাক বুঝতে পারছেন না। তবে এতটুকু উপলব্ধি করলেন কারণটা মোটেও ফেলনা নয়।

বউ সাজে ছোঁয়াকে কি অপূর্বই না দেখাচ্ছে। তাকে আড়চোখে দেখে চলে যাচ্ছিল ঈশান। তখুনি ডেকে উঠল ছোঁয়া। লেহেঙ্গার দু পাশ ধরে কাছে এল।
“আজও বকা দিবে আমায়?”

“বকব কেন?”

“তুমি তো সবসময়ই বকা দাও।”

“এখন থেকে আর দিব না।”

“সবাই দেখা করেছে। তুমি একটিবার ও কেন এলে না? আমি বুঝি এতই পর?”

মৃদু হাসল ঈশান। মেয়েটার মাথায় স্পর্শ করতে গিয়েও করল না।
“সাবধানে থাকবি। আমি যাই রে। বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে।”

এইটুকুই কথা হলো ওদের। ছোঁয়া’র মন খারাপ হয়ে গেল। ঈশান সর্বদা তাকে রাগালেও তাদের সম্পর্কের কোথাও একটা সৌন্দর্য ছিল। সেটা মনে হতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর।

ঈশানের সঙ্গে কেউ একজন চলছে। ছায়াটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে। সেটা বুঝতে পেরেও তাকাল না সে। আগের গতিতেই পথ চলতে লাগল। কোনো রকম সাড়া না পেয়ে উষশী নিজ থেকেই বলল,”কোথায় যাচ্ছ?”

“বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।”

“এখন আড্ডা দেওয়ার সময়? আরেকটু বাদেই তো ছোঁয়াপু’র বিয়ে পড়ানো হবে।”

আনমনেই কথাটা বলে ফেলল উষশী। তারপর খেয়াল হতেই বলল,”যা চলে যায় তাকে কি ধরে রাখা যায় ঈশান?”

“রাখা যায় না।”

“তাহলে এমন ভেঙে যাচ্ছ কেন?”

“ভাঙি নি তো।”

“ফের মিথ্যে বলার প্রয়াস। লাইফটা এতটা ঠুনকো নয়। যা হবার নয় তা কেবল ধু ধু মরীচিকা।”

“তবু সেই মরীচিকাই কেন টানে বলতে পারো?”

“মানুষ আমরা। বস্তু নই। চোখের সামনে যা দেখি তাই রঙিন মনে হয়। ভ্রম জিনিসটা চট করেই ধরতে পারি না। অথচ একটা সময় ঠিকই বুঝে যাই যার পেছনে ছুটে যাই তা কল্প ব্যতীত কিছুই নয়।”

“ঠিক এই কারণেই নিজের উপর রাগ হচ্ছে। অর্নথক কষ্ট এসে চেপে ধরেছে। যার কোনো মানে হয় না।”

এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল ঈশান। উষশী গেটের কাছে এসে থেমে গেল। তার দুটি চোখ জলে পরিপূর্ণ। এতটা কষ্ট আগে অনুভব হয় নি। বিচ্ছেদ বুঝি এতই যন্ত্রণার?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here