বেনেবউ #পর্ব_২২ এবং শেষ পর্ব #তানজিলা_খাতুন_তানু

0
288

#বেনেবউ
#পর্ব_২২ এবং শেষ পর্ব
#তানজিলা_খাতুন_তানু

‘কে কে? চোখটা ছাড়ুন বলছি।’

ইপ্সিতা আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তখনি ঘাড়ে কারোর তীব্র নিঃশ্বাস অনুভব করল। এই নিঃশ্বাসের প্রতিটি শব্দ ওর চেনা না এটাই তো কোনো ভুল হতে পারে না। আর একটু ভালো করে উপলব্ধি করে মৃদু হেসে বলল,

– ‘নিভ্র আপনি?’

নিভ্র নিঃশব্দে হাসল। মেয়েটা যে ওর প্রতিটা নিঃশ্বাসের শব্দ চিনে গেছে আর কিছুই চেনার বাকি নেই। নিজের সবটা উজার করে দিয়েছে ইপ্সিতার প্রতি আর ইপ্সিতাও সেটা পরম যত্নে আগলে নিয়েছে। নিভ্রের আওয়াজ না পেয়ে ইপ্সিতা বলল,

– ‘কি হলো, আপনি কোথায়? আর চোখ বাঁধলেন কেন?’
– ‘একটু চুপ করে থাকো, আর আমার হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলো।’

ইপ্সিতা নিভ্রের কথাতে দ্বিমত পোষণ করল না। মানুষটাকে বিশ্বাস করে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তাই চোখ বাঁধা অবস্থাতেও ওর কথা শুনে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। ইপ্সিতা জানে চলতে গিয়ে কখনো যদি হোঁচট খাই তখন নিভ্র ঠিকই সামলে নেবে এবং আগলে নেবে পরম আবেশে।

ইপ্সিতা যখনি এক পা আগিয়ে গেল তখন নিভ্র মৃদু হেসে বলল,

– ‘আজীবন তোমার হাত আঁকড়ে ধরে হাঁটব কথা দিলাম।’

ইপ্সিতা মুচকি হেসে আরেক পা বাড়িয়ে দিলো, আবারো নিভ্র হেসে বলল,
– ‘কখনো কোথাও আটকে গেলে হাতটা শক্ত করে ধরে পার করিয়ে দেব। আগিয়ে চলো।’

ইপ্সিতা আরেক পা বাড়াবে তখনি শাড়িতে পা পেঁচিয়ে পড়ে যেতে গেলে নিভ্র আগলে নিয়ে বলল,
– ‘চলার পথে কোথাও বিপদ আসলে তোমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াব। বিপদে আপদে আগলে রাখব।’

এইভাবে একটার পর একটা পা ফেলে এগিয়ে চলেছে ইপ্সিতা আর নিভ্র একের পর এক কথা দিয়ে যাচ্ছে। ইপ্সিতা পা বাড়াল কিন্তু নিভ্র কিছুই বলল না। নিভ্রের কষ্ঠস্বর শুনতে পেল না তাই ইপ্সিতা বলল,

– ‘কি হলো চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলবেন না?’
– ‘ বলবো তার আগে নিজের চোখটা খুলে নাও।’
– ‘আপনি খুলে দিন।’ (আবদার করে)
– ‘না।’
– ‘কিন্তু কেন?’ (মন খারাপ করে)
– ‘তোমার চলার পথের প্রতিটা মূহুর্তে তুমি আমাকে নিজের পাশে পাবে। তবে তোমাকে নিজের চোখ দিয়ে এই জগৎটাকে দেখতে হবে, কারোর দেখাতে দেখলে চলবে না। ঠিক-ভুল বিচারটা তোমাকেই করতে হবে না, ন্যায়ের পথে থাকতে হবে বুঝলে।
– ‘হুমম।’
– ‘এইবার চোখটা খুলে ফেলো।’

ইপ্সিতা নিভ্রের কথা শুনে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখল নিভ্র ইপ্সিতার সামনে একটা হলুদ ফুলের বুকে ধরে বলল,

– ‘শুভ জন্মদিন বেনেবউ। তোমার সমস্ত ইচ্ছাপূরণের দায়িত্ব নিলাম।’

ইপ্সিতা চমকে উঠল। জন্মদিন! হ্যাঁ আজকে তো ওর জন্মদিন কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে ইপ্সিতার খেয়ালই ছিল না আজকে ওর জন্মদিন। কিন্তু নিভ্র জানলো কিভাবে?

– ‘আজকে আমার জন্মদিন আপনি জানলেন কিভাবে?’
– ‘তোমার জন্মদিন আর আমি জানব না সেটা কিভাবে হয়!’
– ‘সব জানেন বুঝি।’
– ‘হয়তো তোমার থেকে একটু বেশিই।’
– ‘যা।’
– ‘ অনেক গল্প করব কিন্তু তার আগে কেক কাটবে চলো।’

নিভ্র ইপ্সিতাকে নিয়ে রির্সোটের একটা ধারে নিয়ে আসে আর সেইখানটা সুন্দর করে সাজানো গোছানো।

– ‘কি সুন্দর করে সাজানো! এইসব কখন করলেন?’
– ‘করেছি যখন হোক। পছন্দ হয়েছে তো?’
– ‘হুমম।’

তারপর দুজনে মিলে একসাথে কেক কাটে।

– ‘বাড়ি কখন ফিরবেন।’
– ‘কেন তোমার ভালো লাগছে না।’
– ‘আরে না আসলে অনেক রাত হয়েছে তো।’
– ‘কিছু হবে না। চলো ওই দোলনায় বসে রাত্রি বিলাস করি।’

নিভ্র ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘তোমার সমস্ত দায়িত্ব পূরনের দায়িত্ব নিলাম তোমার জন্মদিনে। বলো কী গিফট চাও।
– ‘আপনার থেকে আমার কিছুই চাওয়ার নেই। আপনিই আমার জীবনের সেরা গিফট।’
– ‘তাই।’
– ‘হুমম। তবে আমার একটা কথা জানার ছিল।’
– ‘কি বলো।’
– ‘আসনি আমাকে বেনেবউ বলে ডাকেন কেন? মানে এই নামে ডাকার কারন কি?
– ‘বলবো।’
– ‘হুমম।’

নিভ্র ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
– ‘জানো তোমাকে প্রথম যেদিন দেখছিলাম সেইদিন তোমার পরনে ছিল হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ আর মাথা ভর্তি কালো কেশ। তোমাকে দেখা মাত্রই আমার সর্বপ্রথম বেনেবউ নামটা মনে আসে তখন থেকে তোমাকে বেনেবউ বলে ডাকি। বুঝলে।’
– ‘সেইদিন ছাদে?’
– ‘হুমম।’
– ‘এইটা বলতে এত রহস্য করলেও কেন?’
– ‘বলে দিলে তো তুমি ওইটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে। আমি চেয়েছিলাম তোমার জীবনে আমি এবং আমার ডাকটা প্রিয় হবার পরেই তবে বেনেবউ বলার কারনটা বলবো, যদিও এইটা খুবই সামান্য।’
– ‘কে বলেছে সামান্য। আপনি আর আপনার ডাক দুটোই আমার ভিষন প্রিয় বুঝলেন মিষ্টার।’

নিভ্র ইপ্সিতাকে আগলে নিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল,
– ‘আমার বেনেবেউ।’

কিছুক্ষণ নিরবতা ইপ্সিতা নিভ্রের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে। নিভ্র ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– ‘একটা কথা বলবো।’
– ‘কি বলুন।’
– ‘রাগ করবে না তো।’
– ‘না বলুন।’

নিভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– ‘নয়ন বলে কাউকে চেনো?’

ইপ্সিতা অনেকদিন পর নয়ন নামটা শুনে চমকে উঠল।‌ নয়ন বলে তো ওহ একজনকেই চেনে কিন্তু নিভ্র নয়নের কথা জানলো কিভাবে?

– ‘হ্যাঁ কিন্তু আপনি কিভাবে?’
– ‘কারন নয়ন আমিই।’

ইপ্সিতা একটার পর একটা চমকে পাচ্ছে। নিভ্রের কথাটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।

– ‘মানে!’
– ‘হ্যাঁ তুমি ফেসবুকে নয়ন বলে যার সাথে কথা বলতে ওইটা আমারই আইডি। আসলে মামার বাড়িতে সবাই নয়ন বলে ডাকত সেই কারনে আইডিটা নয়ন দিয়েই খুলে ছিলাম।’

ইপ্সিতা নয়নকে বলা কথাগুলো মনে করতে লাগল, নয়ন তো ইপ্সিতার জীবনের প্রতিটি কথাই জানত তারমানে কি দয়া দেখিয়ে! ইপ্সিতা গম্ভীর স্বরে বলল,
– ‘তারমানে আপনি সবটা জেনে আমাকে বিয়ে করেছেন?’
– ‘এই না। তুমি আবার ভুল বোঝো না।’
– ‘না কি ভুল বুঝব, আপনি আমার সবটা যেনে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন তাই তো।’

নিভ্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল, এই ভয়টাই করছিল সত্যিটা জানার পর ইপ্সিতা না আবার ভুল বোঝে আর সেটাই হলো। আর ভুল বোঝোটাও স্বাভাবিক। ইপ্সিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, নিভ্র ওকে বুকের মাঝে আবারো আগলে নিয়ে বলল,

– ‘আরে গাধী আমি কিভাবে জানব আমি যার সাথে কথা বলি আর যাকে ভালোবাসি তারা দুজন একই আর তোমার আইডির নামও তো আলাদা ছিল।’

ইপ্সিতা কিছুটা শান্ত হয়। সত্যি তো ওর নিজের আইডির নামটাও তো আলাদা ছিল। তাহলে নিভ্র জানলো কিভাবে?

– ‘তাহলে আপনি জানলেন কিভাবে?’
– ‘একদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মনে করে দ্যাখো। সেইদিন তোমার কথা শুনে আমার মনে হয় তুমি আমার চেনা কেউ তাই তোমার নাম জিজ্ঞেস করি আর তুমি বলে দাও তখন থেকেই বুঝতে পারি।’
– ‘ওহ। সত্যি বলছেন তো দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেননি।’
– ‘আরে পাগলি এইসব কিছুই নয়। আর বলো তো তোমার কখনো মনে হয়েছে আমি তোমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছি!’
– ‘নাহ।’
– ‘ভালোবাসি বউ।’

ইপ্সিতা মৃদু হেসে নিভ্রকে জড়িয়ে ধরল। সম্পর্কটা পবিত্র, দুজন দুজনের প্রতি বিশ্বাস-ভরসা, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এইরকমটাই যেন থাকে আজীবন।

**

বিশাল‌ অনুষ্ঠান চারিদিকে আলো, লাইট হাজারো মানুষের ভীড় তারমাঝে নিভ্র ও ইপ্সিতার পরিবারের মানুষজন উৎসুক হয়ে বসে আছে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৫টা বছর, ইপ্সিতা ঘরে-বাইরে দুজায়গাতেই লড়াই করে চলেছে। ইপ্সিতা আর নিভ্রের কোল জুড়ে এসেছে ছোট একটা রাজকন্যা নিশিতা রায়হান। নিশিতা পরিবারের সকলের চোখের মনি, নিভ্র মায়ের, ইপ্সিতার বাবা মায়ের সময় কাটে নিশিতা কে নিয়ে আর নিশিতা একসাথে দুই পরিবারের আদর পেতে পেতে বাঁদর হয়ে উঠছে। নিভ্র এখন কোম্পানির সিইও, অনেক দায়িত্ব সারাদিন ব্যস্ততার পর বাকি সময় পার হয় নিশিতার সাথে। আর ইপ্সিতা!

মাইকের আওয়াজ হতেই সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল স্টেজে দাঁড়ানো মহিলাটি। পরনে শাড়ি হাত বাইক নিয়ে মিষ্টি কন্ঠে সবাইকে ওয়েলকাম জানাচ্ছে।

– ‘আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য। আপনারা সকলেই জানেন আজকে আমাদের বীরভূম বাসীর জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের জেলার গর্ব মিসেস ইপ্সিতা রায়হান।

চারিদিক থেকে করতালি বেজে উঠল। মহিলাটি আবারো বলতে শুরু করল,
– ‘সমাজের বুকে আমরা মেয়েরা বারবার লা’ঞ্ছিত- ব’ঞ্চিত হয়ে থাকি। কিন্তু প্রতিবাদ করে উঠতে পারি না, নিজেদের কষ্টগুলো,য’ন্ত্রনা গুলো নিজেদের মাঝে রেখেই মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে থাকি। যখন মানিয়ে নিতে পারিনা তখন নিজেদের শে’ষ করে দিতেও ভাবি না। আমাদের সমাজে বহু নারী আছে যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ না করেই হার মেনে নিয়েছেন। ধ’র্ষিতা হওয়ার পর সমাজের মানুষের কাছে অপমানিত হয়ে সু’ইসাইড করেছে কিন্তু এইগুলো কি আদৌও আমাদের পাওয়ার কথা! আঘাত পেতে পেতে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আর কত এইবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা লড়াই করার পালা এইবার আমরা নারীরা একসাথে লড়াই করবে আর তার সহযোগী হিসাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মিসেস ইপ্সিতা রায়হান। ওনার নারী সংগঠনের এখনো পর্যন্ত বহু নারীর পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায় পাইয়ে দিয়েছে। আর কিছুদিন আগেই এক ধ’র্ষককে শাস্তি দিয়েছেন উনি সত্যিই আমাদের গর্ব আর সেই কারনেই ওনাকে সম্মান জানানোর আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। ইপ্সিতা রায়হানকে আমাদের মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’

আবারো চারিদিক থেকে হাততালির শব্দ ভেসে উঠল। ইপ্সিতা পাশে বসে থাকা নিভ্রের দিকে তাকাল। আজকেও ইপ্সিতার পরনের হলূদ শাড়ি, নিভ্রের বেনেবউ সেজেই উপস্থিত হয়েছে এই অনুষ্ঠানে।

নিভ্র ইপ্সিতাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
– ‘কি হলো যাও।’
– ‘হুমম।’

ইপ্সিতা ওঠার আগে নিভ্রের হাত স্পর্শ করল। নিভ্র মৃদু হেসে চোখের ইশারায় সাহস জোগালো। ইপ্সিতা সকলের দিকে একবার তাকিয়ে স্টেজে উঠতে গেল তারপর….

– ‘ইপ্সিতা রায়হানকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে আমাদের আরেক নারী সংগঠনের নেত্রী মিসেস অহনা আহমেদ।’

নামটা শুনে ইপ্সিতা চমকে উঠল। রিতেশের মা! পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে মুখের কোনে হাসি ফুটে উঠল।

অহনা আহমেদ ইপ্সিতার হাতে ফুলের তোড়া, আরো কিছু উপহার তুলে দিলেন। ইপ্সিতা মৃদু হেসে চাপা গলায় বলল,

– ‘মনে আছে ম্যাম একদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ সবাই পাই না আমি পেয়েছিলাম আমি নাকি খুব লাকি। অথচ আজকে দেখুন আপনার সহায়তা ছাড়াই আমি এই জায়গায় আর আপনিই আমাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছেন বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং না।’

অহনা আহমেদের মুখটা লাল বর্ন ধারন করল, লজ্জায় কিনা রাগে সেটা বোঝা গেল না। হ্যাঁ কথাটা সত্যি ইপ্সিতা একাই এই নারী সংগঠনটাকে দাঁড় করিয়েছে, আর ওনার থেকে অনেক বেশি নারীকে ন্যায় পাইয়ে দিয়েছে তাই তো উনি সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও ইপ্সিতাকে সংবর্ধনা জানাতে হয়েছে। বিষয়টি হয়তো চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারতেন কিন্তু তাতে ওনার রেপুটেশনে দা’গ পড়ত, সাংবাদিকরা নানান কথা বলে বেড়াত সবকিছু ভেবেই এই কাজটা করতে হয়েছে।

ইপ্সিতা নেমে আসতে যাবে তখনি সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে নানান প্রশ্ন করতে লাগল। ভিড়ের মাঝ থেকে একজন প্রশ্ন করে উঠল,

– ‘ম্যাম আপনি ধ’র্ষিতা বিষয়টি কি সত্যি?’

সকলে চুপ করে যায় প্রশ্নটা শুনে। সকলে আলোচনা করতে থাকে বিষয়টি কি সত্যি! ইপ্সিতা কিছুটা সময় চুপ করে গিয়ে বলল,

– ‘হ্যাঁ আমি ধ’র্ষিতা। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে এক পুরুষের কাছে আমি নিজের সবটা হারিয়েছিলাম, ছেলেটাকে কোনোরকমে শা’স্তি দিতে পারিনি কিন্তু উপরওয়ালা তাকে ছেড়ে দেয়নি সে ঠিকই তার কাজের শা’স্তি পেয়েছে। সেই ঘটনার পর আমার জীবন থমকে যায় নি, পরিবার ও প্রিয়জনের সার্পোটে আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি লড়াই করেছি আর এখনো করছি। প্রতিটা মেয়েকে বলব ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাবে না, লড়াই করো দেখবে ন্যায় পাবেই। আর সু’ইসাইড কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না, সু’ইসাইড মানে একটা স্বপ্নের মৃ’ত্যু, একটা পরিবারের মৃ’ত্যু তাই এই কাজটা থেকে দূরে থাকুন। সমাজ আপনাকে অনেক কথাই বলবে তবে তাদের কেউই আপনার জীবনটাকে গুছিয়ে দেবে না। নিজের জীবন যতই এলোমেলো হয়ে যাক না কেন আপনি চাইলে ঠিকই গোছাতে পারবেন তাই ভয় না পেয়ে এগিয়ে চলুন।’

অডিয়েন্স হাততালি দিয়ে উঠল‌। ইপ্সিতার কথা শুনে ওর প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে গেল, একটা মেয়ে নিজে ধর্ষিতা হবার পরেও এইভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সত্যি এটা অকল্পনীয় বিষয়।

আরেক সাংবাদিক বলে উঠল,
– ‘ম্যাম একটা পার্সোনাল কথা জানতে চাইছি, আপনি কি এখনো আপনার স্বামীর সাথে থাকেন? না মানে আপনাদের মাঝে কি এখনো সব সম্পর্ক ঠিক আছে?’

ইপ্সিতা হেসে নিভ্রকে কিছু ইশারা করতেই ওহ উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াল।

– ‘উনি আমার হাসবেন্ড নিভ্র রায়হান। আমাদের বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর চলছে, আমার সন্তান আছে সুখে সংসার করছি। আমার বিয়ের আরো তিনবছর আগে আমি রে’পড হয়েছিলাম। আমার স্বামী আমার অতীত সম্পর্কে সবকিছু জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিলেন। আমার শক্তি হয়েছেন আজকে ওনার সার্পোটেই আমি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। তাই বলব সব পুরুষ এক হয় না, কিছু কিছু পুরুষ ভাঙতে নয় বরং জুড়তে আমাদের জীবনে আসে। আর মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটা কথা, জীবনের খারাপ পরিস্থিতিতে যদি কোনো ছেলে আপনাদের পাশে থাকতে চাই নিজের ইচ্ছায় তাহলে সমাজের কথা ভেবে তাকে কখনোই ফিরিয়ে দেবেন না। ভালোবেসে আগলে নেবেন দেখবেন মানুষটি আপনাকে সবটুকু উজার করে দেবে। সবাই ভালো থাকুন নিজেদের পছন্দের মানুষের সাথে। আমার আর কিছু বলার নেই।’

ইপ্সিতা নিভ্রের হাত ধরে বেড়িয়ে আসে। বাইরে এসে বাড়ির কাউকে দেখতে না পেয়ে ইপ্সিতা বলল,

– ‘সবাই কোথায়?’
– ‘বাড়ি চলে গেছে।’
– ‘কেন?’
– ‘একসাথে রাত্রিবিলাস করব।’

নিভ্রের আবদারে ইপ্সিতা হাসল, ছেলেটা ওর কাছ থেকে ঠিকই ভালোবাসা আদায় করে নেই। মনখারাপের সময়ে মন ভালো করার দায়িত্বটা নিয়ে নেয়।

– ‘কি অসুবিধা আছে ম্যাডাম?’
– ‘না, অসুবিধা থাকবে কেন।’
– ‘না বলা যায় না আপনি এখন সেলিব্রিটি, এই সাধারন মানুষটির সাথে যেতে অসুবিধা থাকতেই পারে।’
– ‘আপনি আমার কাছে সাধারণ নয় অসাধারণ কেউ বুঝলেন।’
– ‘চলো হাঁটতে শুরু করি।’

নির্জন রাস্তা দিয়ে দুই মানব-মানবী হেঁটে চলেছে। ইপ্সিতা নিভ্রের হাতটা আঁকড়ে ধরে পা পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে। এতগুলো বছর হয়ে যাবার পরেও ইপ্সিতা কখনোই ভালোবাসি কথাটি বলেনি কিন্তু প্রতিটা ক্ষনেই বুঝিয়ে দিয়েছে ওর জীবনে নিভ্র ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

– ‘মনখারাপ লাগছিল।’
– ‘কেন?’
– ‘ঝি যে লোকটা তোমার অতীত নিয়ে তুলল।’

ইপ্সিতা মুচকি হেসে বলল,
– ‘না আপনি আমার পাশে থাকতে কোনো খারাপ লাগাই আমাকে ছুঁতে পারে না। আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।’
– ‘বলো।’
– ‘ভালোবাসি।’

নিভ্র থমকে দাঁড়ায়। ৫টা বছর ইপ্সিতার মুখ থেকে কথাটা শোনার জন্য আকুল হয়ে ছিল ফাইনালি এতগুলো দিন পর বলল। নিভ্র খুশিতে কি করবে বুঝতে পারছে না, ইপ্সিতা নিভ্রের কান্ড দেখে হাসছে। এতগুলো দিন নিভ্রকে কথাটা না বলেও নিজেও কষ্টে ছিল কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিল যেদিন সফল হবে সেইদিন নিভ্রকে কথাটা বলবে। আজকে সফলতা অর্জন করেছে তাই বলেই দিলো।

– ‘কি বললে আর একবার বলো।’
– ‘ভালোবাসি।’

নিভ্র ইপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরল, চোখ দিয়ে একফোঁটা আনন্দ অশ্রু ইপ্সিতার ঘাড় স্পর্শ করল। ইপ্সিতা মৃদু হাসল, মানুষটির ভালোবাসা ওকে প্রতিটা মুহুর্তে মুগ্ধ করে। মানুষটি ওকে কোনো কারন ছাড়াই ভালোবাসে, জীবনে এইরকম জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ইপ্সিতা সত্যি খুব লাকি।

নিভ্র মাথা তুলে ইপ্সিতার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে, কপাল কপাল ঠেকিয়ে বলল,
– ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।’
– ‘কতটা ভালোবাসেন!’
– ‘যতটা ভালোবাসলে নিজেকে নিঃস্ব করে দেওয়া যায়। যতটা ভালোবাসলে নিজেকে তার মাঝে হারিয়ে ফেলা যায় ঠিক ততটাই ভালোবাসি বেনেবউ।’

ইপ্সিতা নিভ্রকে জড়িয়ে ধরল। এই খোলা আকাশ, চাঁদনী রাত, নিস্তব্ধ প্রকৃতি সবকিছু সাক্ষি থাকুক নিভ্র আর ইপ্সিতার প্রকৃত ভালোবাসার। যুগে যুগে জন্ম নিক নিভ্রের মতো নিঃস্বার্থ প্রেমিক। ভালো থাকুক ভালোবাসারা।

#সমাপ্ত

শেষ করে দিলাম গল্পটা। গোটা গল্পটা আপনাদের কাছে কেমন লাগলো সকলে বলবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here