তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৪৭ ||

0
304

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৪৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

অতঃপর কয়েকদিন কেটে গেল। সোনালী রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটে চলেছে তাদের গন্তব্যে। শীত উপেক্ষা করে নিজের দায়িত্ব পালনে তৎপর তারা। মীরারা ফেনী চলে এসেছে কয়েকদিন হলো। আহানের প্রমোশন হয়েছে। এখন সে থানার এস আই। বর্তমানে তার দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। দিবার সাথে মীরার এখনো দেখা হয়নি। মীরা অবশ্য শুনেছে দিবা এসেছে। কিন্তু সে এখনো তাদের বাসায় যেতে পারেনি। আজ দিবার পরিক্ষা ছিল না। চারটে পরিক্ষা শেষ হয়েছে। আরও বাকি আছে তিনটে। ওগুলোর মাঝে অনেক গ্যাফ। দিবা বই নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে, রুম থেকে বারান্দায় পায়চারি করতে করতে পড়ছে। সারাক্ষণ বসে বসে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেছে ও। দিবা বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখল কয়েকটি ছেলে বারো থেকে তেরো বছরের হবে, ওরা ক্রিকেট খেলছে বাসার গলির সামনে। দিবা বই বন্ধ করে দিল। ওদের খেলা দেখতে লাগল। ইচ্ছে হলো ওদের সাথে ক্রিকেট খেলার। বইটা টেবিলের উপর রেখে গায়ে ভালোভাবে ওড়না জড়িয়ে দুলতে দুলতে চলে গেল সে।

বাহিরে এসে দিবা বাচ্চাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাচ্চারা ড্যাবড্যাব করে তাকাল দিবার দিকে। দিবা তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমিও খেলব তোমাদের সাথে।”
ব্যাট হাতে বাচ্চাটি বলল, “আমরা তোমায় খেলায় নিব কেন? তুমি অনেক বড়ো।”
“তাতে কি হয়েছে? বড়োরা বুঝি ছোটদের সাথে খেলতে পারেনা?”
“বকা দিবে না তো?”
“একদমই না। বরং তোমরা আমার সাথে খেললে সবাইকে চকলেট দিব।”
চকলেট এর কথা শুনে সবাই খুশি হয়ে গেল। ছেলেটা ব্যাট হাতে নিল। দিবা অন্য বাচ্চাদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বল করছে। বল ছুড়ে মারতেই ছেলেটি ব্যাট ঘুরাল। এবং চার হয়ে গেল। কেউ ধরতে পারেনি। দিবা ছেলেটিকে বলল, “এই আমায় দাও। আমি ওকে আউট করি।”
দিবার হাতে বল দেওয়া হলো। সে বল করলো। কিন্তু কাজ হলো না। দিবার বলে ছক্কা মেয়ে দিল। দিবার বেশ রাগ উঠল। এইটুকু একটা ছেলের সাথে সে পারছে না? দিবা সবাইকে সুন্দরভাবে দাঁড়াতে বলল। তারপর খুব মনযোগ দিয়ে বল করলো। ব্যাটের ধাক্কায় বল উড়ে যাচ্ছে। দিবা এই বলকে সীমানার বাহিরে যেতে দিবে না। সে দিল এক ছুঁট। ছুটতে ছুটতে বলটা হাত দিয়ে ধরে ফেলল। সবাই একসাথে লাফিয়ে উঠল। দিবা তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্যাটটা হাতে নিল। এবার সে ব্যাট করবে। পরপর তিনটে বল সে ব্যাটে লাগাতে পেরেছে। চার নাম্বার বলটা যখন মারলো, তখন বলটা অনেক দূরেই চলে গেছে। ছক্কা হয়েছে কিন্তু উড়ে গিয়ে লেগেছে একজনের হাতের বাহুতে। সবাই সে-ই দিকেই তাকিয়ে আছে। বাচ্চারা ভয়ে ছুটে পালাল। এদিকে দিবা জ্বিভে কামড় দিল। বল পড়ার আর মানুষ পেল না। এর গায়েই পড়তে হলো। এখন কি করবে সে? বাচ্চারাও চলে গিয়েছে। ব্যাটটা হাতে নিয়ে চুপচাপ নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আয়ান বলটা নিয়ে এগিয়ে এলো। দিবার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে মিস! ক্রিকেট খেলার আর জায়গা পাননি? শেষ পর্যন্ত আমার গায়েই?”
“স্যরি। আমি দেখিনি।”
“বাচ্চাদের সাথে খেলতে লজ্জা করে না? তুমি বাচ্চা হয়েছ? সবাই কি বলছে হ্যাঁ?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাতে কে কি বলল ওসব আমি মাথায় নেই না।”
“তা নিবে কেন। তুমি উড়নচণ্ডী মেয়ে কিনা!”
দিবা মাথা তুলে বলল, “আপনি তখন থেকে আমাকে যা তা বলে যাচ্ছেন। আমি কিছু বলছিনা দেখে মাথায় চড়ে বসেছেন?”
“একেই তো আমার গায়ে বল ফেলেছ, উপর থেকে আমার মুখের উপরই কথা?”
“আমি কি ইচ্ছে করে আপনার গায়ে ফেলেছি নাকি?”
“আমার তো মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই করেছ।”
দিবা দাঁতে দাঁত চেপে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান তার চুল দাড়ি কেটে ছোট করে ফেলেছে। ওকে দেখতে এখন আর মাস্তানের মতো লাগছে না। বেশ ভদ্র ও সুদর্শন লাগছে। দিবাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়ান বলল, “খেয়ে ফেলবে নাকি! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
“আপনি একটা বদমাশ।”
রেগে গেল আয়ান। দিবার হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। দিবা পিছন থেকে হায় ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। জোরে জোরে বলছে, “কি করছেন। হাত ছাড়ুন আমার।।কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে।”
আয়ান কিছু বলল না। সোজা দিবার হাত ধরে তার বাসার সামনে গেল। দিবা আয়ানের বাসা দেখে বলল, “একি! আপনি এখানে নিয়ে এলেন কেন?”
আয়ান দিবার হাত ধরে ভিতরে ঢুকল। জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে মীরাকে ডাকতে লাগল।
“মীরা, মীরা।”
মীরা রান্নাঘরে ছিল। আজ তার শাশুড়ী বাসায় নেই। তার শ্বশুরের সাথে মার্কেটে গিয়েছেন। হঠাৎ আয়ানের চিৎকারে মীরা চুলো বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে এলো। মীরা দেখল আয়ান দিবার হাত ধরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মীরা জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে? এতো জোরে ডাকছ কেন? আর তুমি ওর হাত ধরে আছোই বা কেন?”
“তোমার কাজিন! ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমার গায়ে বল ছুড়ে মেরেছে। খুব ব্যথা পেয়েছি। তুমি এর বিচার করবে।”
আয়ান মীরাকে তার হাতে থাকা বলটা দেখাল।
দিবা স্ব জোড়ে এক কামড় বসাল আয়ানের হাতে। আয়ান ব্যথা পেয়ে ‘আহ্’ শব্দ করে উঠল। দিবার হাত ছেড়ে দিল। মীরা বলল, ” এসব কি হচ্ছে আয়ান?”
“মীরা তুমি কিছু দেখছ না? ও কেন আমাকে কামড় দিল?”
“বেশ করেছি কামড় দিয়েছি। আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? সমস্যা কি আপনার!”
“তুমি আমার গায়ে বল ছুড়ে মারলে কেন।”
“বললাম তো আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
মীরা রেগে গর্জে উঠে বলল,
“উফফ!! থামবি তোরা? এই তোদের দূরে থাকার নমুনা? তোরা নাকি দুজন দুজনের থেকে দূরে থাকবি। এখন তো দেখছি দেখা হলেই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচ্ছিস তোরা।”
দুজনেই চুপ। কিছু বলছে না কেউই। মীরা দুজনকেই বলল, “তোরা দুজনেই এখন আমার চোখের সামনে থেকে যাবি। এক্ষুণি।”
আয়ান দিবার দিকে তাকাল। মেয়েটা নিরবে চোখের জল ফেলছে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল ডান হাতটা লাল হয়ে গেছে। খুব জোরে চেপে ধরেছিল কি? ইশ! মেয়েটা বোধহয় কষ্ট পেয়েই ওকে কামড় দিয়েছে। দিবা ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। আয়ান তখন মীরাকে বলল, “আমি কি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললাম।”
মীরা আয়ানের কান টেনে ধরে বলল, “একটু নয় অনেক। ওর সাথে ঝগড়া করতে গেলে কেন? আমি যেন আর ওর আশেপাশে তোমায় না দেখি।”
“ছাড়ো, লাগছে।”
মীরা আয়ানকে ছেড়ে দিল। বলল, “তোমার ওকে জ্বালানো ঠিক হয়নি আয়ান। মেয়েটা কয়েকদিনের জন্য এসেছে মাত্র।”
“হুম। এরপর ওকে আর দেখব না। যতদিন চোখের সামনে দেখব, ততোদিন আমার মন শান্তিতে থাকবে মীরা।”
“তুমি ওর পিছু ছেড়ে দাও আয়ান। তুমি ওকে এভাবে জ্বালাতন করতে থাকলে ও কষ্ট পাবে খুব।”
“বিশ্বাস করো, আমি চাইনা ও কষ্ট পাক৷ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। আমার কেন যেন রাগ উঠে যায় হুট করেই।”
“আমরা আজ বিকেলে আমাদের বাসায় যাব। তুমিও আমাদের সাথে যাবে, আর দিবাকে স্যরি বলবে।”
“যদি কথা না বলে?”
“কেন বলবে না। তুমি সুন্দর করে কথা বললে দিবাও বলবে।”
“তাহলে বিকেলে দেখা হবে।”
“এখন কোথায় গিয়েছিলে?”
আয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“যেতে আর পারলাম কই! ভেবেছিলাম হাসপাতাল মোড়ে যাব। আমার কয়েকটা ফ্রেন্ড এসেছে ওখানে। যাওয়ার পথেই এই ঘটনা ঘটে।”
“তো এখন যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
“আচ্ছা, বাবা মা কোথায় গেছে জানো?”
“মার্কেটে গিয়েছে। কেন গেছেন এ বিষয়ে আমি জানি না।”
“অহ আচ্ছা। যাচ্ছি ভাবি।”
“বায়।”
আয়ান চলে গেল বাসার বাহিরে। মীরা রান্নাঘরে এসে নিজের অর্ধেক কাজ সম্পূর্ণ করতে লাগল।


বিকেলের দিকে মীরা রেড়ি হয়ে বসে থাকল। কিন্তু আহানের কোনো খবরই নেই। মীরা অনেকগুলো কল দিল আহানকে। ফোন বেজে গেল, কিন্তু কেউ ধরলো না। মীরার খুব টেনশন হতে লাগল। এদিকে আয়ান রেড়ি হয়ে মীরাকে তাড়া দিল। মীরা তার ভাইয়ের কথা বলল। আয়ান বলল হয়তো কাজের চাপ বেশি তাই আসতে দেরি হবে। কিন্তু মীরার মন কেমন খচখচ করছে। আয়ান বলে, “মীরা! তুমি এতো টেনশন করছ কেন? ভাই চলে আসবে। চলো তোমাকে এগিয়ে দেই।”
আহানের কথায় মীরা আর কিছু বলল না। ব্যাগ নিয়ে আয়ানের সাথে গেল। যাওয়ার সময় শ্বশুর শাশুড়ীকে সালাম করে গেল মীরা।
আয়ান একটা দোকান থেকে ফল মিষ্টি নিল। তারপর একটা সিএনজি নিয়ে মীরাদের বাসায় চলে গেল।
বাসায় এসে দেখে সবাই মীরাদের জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিল। মীরাকে দেখে সবার মুখে হাসি ফুটল। ড্রয়িংরুমে সবাইকে দেখলেও দিবাকে দেখল না মীরা। দিবার কতজা জিগ্যেস করলে মীরার ভাবি বলে সে তার রুমেই আছে। তবে চলে যাবে বলছে বারবার। মীরা আয়ানকে বসতে বলে নিজের রুমে চলে যায়। ওখানে গিয়ে দেখে দিবা মন খারাপ করে বসে আছে। মীরা আস্তে করে দিবার পাশে গিয়ে বসল। একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, “কিরে! মন খারাপ নাকি?”
“কিছুনা মীরা।”
“বলবি না?”
“আমি আর থাকব না এখানে।”
“কেন?”
“আমাকে তোরা দেবর ভাবি মিলে অপমান করিস। আমি আর কত সহ্য করব! এখানে আসাই আমার ভুল ছিল।”
“এভাবে বলিস না দিবা। তোকে কোথায় অপমান করলাম। আমিতো আয়ানকে শাসালাম। তোকে কিছু বলিনি তো। আর আয়ানও এসেছে তোকে স্যরি বলতে।”
দিবা দাঁড়িয়ে গেল। চোখ মুখ খিঁচে বলল, “ওনার স্যরির আমার কোনো প্রয়োজন নেই। উনি কি ভেবেছেন? যখন যা খুশি তা-ই করবেন, পরে স্যরি বলে একি কাজ পূণরায় করবেন; আর আমি সব মেনে নিব? কখনোই না।”
“লক্ষীটি। প্লিজ রাগ করিস না। আমি ওকে বকে দিয়েছি। আর তোকে জ্বালাবে না।”
“আমি বাইরে যাচ্ছি। ভাইয়া আসবেন না?”
“রাতে হয়তো আসবে। জানি না আমি। ফোন করলাম ধরল না।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে আমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
“থাকনা, আজ তুই আর আমি একসাথে ঘুমাব।”
“আমি ভাইয়াকে কষ্ট দিতে পারব না। তার বউয়ের সাথে থাকলে সে না কি কি করে বসে!”
“দিবা!!”
“এতো লজ্জা পেতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।”
দিবা তার ব্যাগ নিয়ে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে গেল। ড্রয়িংরুমে এসে আয়ানকে দেখল সে। আয়ান দিবার সাথে কথা বলার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। দিবা সেটা বুঝল। কিন্তু সে আয়ানের সাথে এখন কোনো কথাই বলবে না। পাগলকে পাত্তা দিলে আরও মাথায় চেপে বসবে। চুপচাপ মেহজাবিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে সে। অন্যদিকে মীরা বারবার আহানকে ফোন দিচ্ছে, কিন্তু সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। মীরার টেনশন ও ভয় দুটোই বাড়ল। কি এমন কাজ করছে যে ফোন রিসিভই করতে পারছে না। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল মীরার। সে ভয় পাচ্ছে, আরও একবার এমন হয়েছিল। মীরার ভয় আহানকে হসপিটাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। সেইম ভয় সে এখনো পাচ্ছে। আহানকে ও কিছুতেই হারাতে চায়না। বড্ড ভালোবাসে মানুষটাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here