#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৬]
__________________
জন্মদিনের আনন্দ এক নিমিষে যেন হাওয়া হয়ে গেছে।ছোট্ট রুদবা ঈশামনিকে খুঁজতে খুঁজতে কেঁদেই ফেললো।মেয়েটার কান্নায় মন খারাপটা বেড়ে গেল তিয়াশের।মন খারাপের সঙ্গ নিয়ে রুদবাকে কোলে নিয়ে ছুটলো ছাদের দিকে।
” মামা আমার ঈশামনি কই?”
” তোমার ঈশামনিকে আমরা পেয়ে যাব তুমি শুধু শুধু কাঁদছো।”
তিয়াশের আশ্বস্ত পেয়ে কান্না থামালো মেয়েটা।রুদবাকে নামিয়ে পুরোটা ছাদ ঘুরে দেখলো তিয়াশ।পুরোটা ছাদ নিস্তব্দ উপায়ন্তর না পেয়ে ঈশা ঈশা বলে বেশ কয়েকবার ডাকলো সে।রুদবা তখন দাঁড়িয়ে ছিল চিলেকোঠার সম্মুখে।বদ্ধ দরজার ভেতর থেকে করাঘাতের শব্দ আসায় চমকে তাকায় সে।
” মামা এখানে কেউ আছে।”
তিয়াশ এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রুদবার পাশে।
” এখানে কে থাকবে?ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।”
” আমি শুনেছি কেউ দরজায় ধাক্কালো।”
রুদবার কথা অনুসারে তিয়াশ দেরি করলো না।ঝটপট অস্থির হাতে খুলে দিলো চিলেকোঠার ঘর।বন্ধী দশায় মুক্তি পেয়ে অতিদ্রুত ছুটে পালালো বিড়ালটি।ঈশা তখন পিটপিট চোখে দেখছিলো সবটা।ঈশার করুন পরিস্থিতি দেখে হাটু মুড়ে বসে পড়ে তিয়াশ।
” ঈশা তুমি এখানে কী করছো?”
তিয়াশের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর জানালো না ঈশা বরং তার দুর্দশার কথা মুখ ফুটে বলার আগে মুহুর্তে কেঁদে ফেললো।তিয়াশ একের পর এক প্রশ্নের থালি নিয়ে বসে কিন্তু লাভ কী হলো? ঈশার মুখ থেকে টু-শব্দটিও বের হলো না।মেয়েটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।নাকে বুমির গন্ধ আসায় আশেপাশে সচেতন দৃষ্টিতে চোখ বুলালো তিয়াশ। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে চিন্তা বাড়লো বহু গুণ।
” উঠে দাঁড়াও নিচে চলো।”
ঈশার বাহু টেনে দাঁড় করালো তিয়াশ তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না।ক্লান্ত দেহটা ছেড়ে দিল চোখের পলকে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিয়াশ না চাইতেও ঈশাকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়।ছোট ছোট চোখ করে ঈশা তখনো কাঁদছিলো।তিয়াশের বুকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো তাকে।এর মানে সে তিয়াশের কোলে উঠতে চায় না।তার সম্মতি বুঝতে পেরে তিয়াশ বলে,
” এই শরীরে তুমি নিচে নামতে পারবে?জেদ করে লাভ নেই ঈশা।”
ব্যস্ত পায়ে ঈশাকে নিয়ে ছুটে চললো তিয়াশ।তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল রুদবা।
.
বসার ঘরটা নিরিবিলি নিস্তব্ধ। অতিথিরা সবাই চলে গেলো ঘণ্টা খানেক আগে।ঘরের বাকি সদস্যরা ঈশাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো, একা একা বসে রইলো ঈশান।হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা জেনে নিলো।অনেক রাত হয়েছে এবার ঈশাকে ছাড়া উচিত মেয়েটাকে নিশ্চয়ই এবারের মতো চরম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।ভাবনা অনুযায়ী উঠে দাঁড়ালো সে।এক কদম এগিয়ে যেতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তিয়াশ তার কোলে ঈশা। মেয়েটার খোলা চুল এলোমেলো ময়লা জড়িয়ে আছে।ঈশান পিলে চমকে উঠলো রুদবা ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে ঈশানের পেট ঘেষে দাড়ালো।
” মামা মামা ঈশামনির কি হয়েছে সে কাঁদছে কেন?”
রুদবাকে কোলে তুলে নিলো সে।তিয়াশ ততক্ষণে ঈশাকে নিয়ে ছুটে চলে যায় রুমার কক্ষে।সদর দরজা দিয়ে কোলাহলের শব্দে ঘুরে তাকায় ঈশান। রুমা,রাসেল সহ বাদবাকিরা ছোটাছুটি করে ঘরে ফিরছে।
.
রাতটা বেশি হওয়ায় বিপাকে পড়তে হয়েছিল রুমাকে।কি করবে না করবে ভেবে ভেবে অস্থির সে।তিয়াশ তাকে অভয় দিল এবং এই রাতে বাড়ির পাশে একটি ক্লিনিক আছে সেখান থেকে ডাক্তার নিয়ে ফিরলো ।প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে ডাক্তার ফিরে গেল।বসার ঘর তখনো ছিল থমথমে। ঈশার বাবা একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছেন কিন্তু তাকে মানাতে ব্যর্থ রুমা।
” আঙ্কেল আমার কথাটা শুনুন ঈশা আজকে রাতটা রুদবার সাথে থাক।”
” কোন প্রয়োজন নেই ঈশাকে ফোনটা দাও সে ফোন তুলছে না কেন?”
” আঙ্কেল ঈশা ঘুমিয়ে পড়েছে আপনি…. ”
” আমার সাথে মিথ্যা বলছো তুমি আমার মেয়ের কি হয়েছে সত্যিটা বলো।তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম রুমা।”
ঈশার বাবা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।ফোন লাউডে থাকায় সবটা শুনছিল ঈশা পিটপিট চোখে চেয়ে থেকে রুমার থেকে ফোনটা চেয়ে নিল সে।
” বাবা আমি ঠিক আছি।”
” তোমার কি মনে হয়, তুমি কী আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো ঈশা?।”
” আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙছিনা বাবা।হাসিন ভাইকে পাঠাও আমি বাড়ি ফিরবো।”
মাথা তুলে বসে পড়লো ঈশা।তিয়াশ পাশ থেকে কাতর চাহনীতে নিবদ্ধ।রুমা আর কথা বাড়ালো না, ঈশাকে তৈরি করে দিল দ্রুত।পুরো হাতার জামা হওয়ায় মেয়েটার হাতের ছোট ছোট ব্যান্ডেজ গুলো ভালো ভাবে দেখা গেল না।তা ভেবে নিশ্চিন্ত হলো ঈশা। এই ব্যপারে পরিবারের কাউকে কিছু বলা যাবে না।
” ঈশা তুমি যা বলছো আমি বিশ্বাস করছি কিন্তু চিলেকোঠার ঘরে তোমায় কে আটকে রাখবে?”
” জানি না।তবে আমি অনুভব করেছি কেউ আমাকে পেছন থেকে ধ্বাক্কা দিয়ে ভেতরে রেখে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল।কার মনে কী আছে আমি কীভাবে বলবো।”
.
” ঈশান কাজটা ভালো করলি না তুই।”
” কোন কাজ?”
মিহিয়ে এলো ঈশানের কণ্ঠ।ঈশার সাথে এতটা বাজে পরিস্থিতি হবে ভাবতে পারেনি ঈশান।সে ভেবেছিল মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পাবে ব্যস এইটুকুই কিন্তু এতটাও চোট পাবে, ভাবতে অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
” নাটক করছিস?ঈশাকে তুই চিলেকোঠার ঘরে বন্দী করেছিস তাই না?এত কিসের রাগ তোর বলবি আমায়?”
” বাজে কথা বন্ধ কর আর আমার সামনে থেকে যা।”
” সবসময় গলা উচিয়ে বাঁচা যায় না।তুই তোর বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকলি।”
রাসেলের কথায় প্রত্যুত্তর করলো না ঈশান।অবশ্য রাসেল ঈশানের কাজে এর উত্তর আশাও করেনি।গেটের বাইরে রাস্তার পাশে সিএনজি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঈশান ছেলেটির অবয় বুঝলেও চেহারাটা ঠিক ঠাহর করতে পারলো না।রুমার সাথে তখন গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঈশা সিএনজিতে উঠে হাত উঠিয়ে বিদায় জানালো রুমাকে।গাড়িটা চলতে শুরু করলো ঈশা যতটা দূরে যেতে থাকলো ততটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঈশানের বুক চিড়ে।
১২.
কংকর ঢালা রাস্তায় ছোট ছোট পা ফেলে আসছে ঈশা অনু।গতকাল রাতের বৃত্তান্ত দিয়ে ড্যাবড্যাব চোখে অনুর দিকে তাকালো ঈশা।অনুর প্রতিক্রিয়া দেখতে বেশ আগ্রহ নিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়ালো সে।
” কিরে অনু চুপ হয়ে গেলি কেন?”
” আমার বড্ড রাগ লাগছে ঈশা।এই লোকটার এত সাহস হলো কী করে এমন বাজে একটা কাজ করার।সবচাইতে বেশি তোর উপর রাগ হচ্ছে তুই কেন সবাইকে বললি না ঈশান শাহরিয়ার এই কাজটা করেছে।”
“বিশ্বাস কর চুপচাপ গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।যেন কিচ্ছু বুঝেনা কিচ্ছু জানেনা এত ভালো মানুষ এই সমাজে আর একটিও নেই আমি তখন এই কথা বললে কেউ বিশ্বাস করতো না।বরং আমাকে সবাই ভুল বুঝতো তাই তো চুপ ছিলাম।”
” এত চুপচাপ থেকে কাজ হবে না ঈশু বরং ঈশান শাহরিয়ারকে চুপচাপ জবাব দেওয়া উচিত।”
দুই বান্ধবীর কথা চললো দীর্ঘক্ষণ।নিরিবিলি রাস্তার পাশে একটি গাড়ি দেখে দু’চরণ থেমে যায় ঈশার।
” এই অনু এই গাড়িটি ঈশান শাহরিয়ারের।”
” হ্যা তাই তো উনি কি এখানে আছেন নাকি।”
ঈশা অনু দুজনে সর্তক দৃষ্টিতে চারিদিকে চোখ বুলালো দুপুরের শুনশান পরিস্থিতে তেমন কোন মানুষনেই।সরু রাস্তাটায় দুই চারটা গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে।রাস্তার পাশে বিশাল মাঠ সেই মাঠে একটি গরু খুটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।গরুর পাশে সাদৃশ্য হলো কয়েক থাবা গোবর।
” ঈশা প্রতিশোধ নেওয়ার সময় এসেছে।”
ঈশা ভ্রু কুচকে চাইলো অনুর পানে মেয়েটা কেমন করে হাসছে।
” এই গাড়িতে গোবর দিয়ে গোসল করাবো।”
অনুর বুদ্ধিতে সম্মতি জানালো না ঈশা।নাক কুচকে বলে,
” ছিহ!ফা/ল/তু বুদ্ধি।”
” আরে বেশি ঝামেলা নেই লাঠি নিয়ে একটু একটু করে গাড়ির কাঁচে লাগিয়ে দিব।”
” আমি পারবো না এসব।”
” তোর জন্য আমি রিক্স নিলাম আর তুই বলছিস পারবি না এই তোর বন্ধুত্ব।”
অভিমানের স্বরে কথাটি বলে হাটা শুরু করলো অনু।তার পিছু ছুটে যায় ঈশা।
” আচ্ছা চল।আবার ধরা পড়বো না তো?”
” একদমি না।”
.
পুরোনো বিজনেস পাটনার নিয়ে জমি দেখতে এসেছিলো ঈশান এবং রাসেল।ঈশানের তদারকিতে বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন বিজনেস পাটনার আলী।জমি দেখা শেষ হতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে এগিয়ে যান তারা।গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে থমকে যায় রাসেল
হঠাৎ তার নাকে আসে বিদঘুটে গন্ধ।মিস্টার আলী নাকে রুমাল চেপে ভ্রু কুচকে তাকান ঈশানের দিকে।
” মিস্টার ঈশান আপনার গাড়ি থেকে এমন বাজে স্মেল আসছে কেন?”
ঈশান ঘাবড়ে যায় দ্রুত পায়ে পুরো গাড়িটা চেক করে পেছন সাইডে গোবর লেপটানো দেখে রাগান্বিত চোখে তাকায় রাসেলের দিকে।গোবর দেখে রাসেল নিজেও রেগে গেল,
” মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছাকৃত এমনটা করেছে ঈশান।”
” এমন দুঃসাহস কার হলো আমি দেখতে চাই রাসেল।”
মিস্টার আলী খানিকটা বিরক্ত বোধ করলেন তার তাড়া আছে ভেবে ঈশানকে বলে,
” আমি বরং আমার ড্রাইভার কে আসতে বলি আমার তাড়া আছে আমি চললাম ঈশান।পরবর্তীতে আমাদের দেখা হবে কোন একসময়।”
নিজের প্রিয় গাড়িটির দিকে তাকিয়ে বড্ড কষ্ট পেল ঈশান।গাড়িটির কি বিশ্রি অবস্থা হয়েছে।কোমড়ে হাত ঠেকিয়ে থুলনিতে হাত বোলাতে বোলাতে আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজন খুঁজছিল সে।তখনি চোখে পড়ে একটি ডিপাটমেন্টাল স্টোরে থাকা সিসি ক্যামেরার দিকে।
” রাসেল ওই যে সিসি ক্যামেরা আজকের ফুটেজটা আমার চাই।”
“পেয়ে যাবি এখন বরং বাড়ি ফিরি।ড্রাইভারকে বলবো গাড়িটা নিয়ে যেতে।”
.
অফিসের কাজ সেরে পুণরায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে এসে দাঁড়ালো ঈশান।দোকানি সিসি টিভি ফুটেজ দেখাতে বারণ করেননি বরং হাসিমুখে গ্রহণ করেছে ঈশান এবং রাসেলকে।দুজনে মিলে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করে ফুটেজটা কিন্তু একটা পর্যায়ে দুটো মেয়েকে দেখা যায় ঈশানের গাড়িতে গোবর লাগাচ্ছে তাদের চেহারা চিনতে পেরে চমকে যায় রাসেল।ভয়ার্ত চোখে ঈশানের দিকে তাকাতে দেখতে পায় ঈশানের হতবাক চাহনি।
#চলবে___
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌