অবাধ্য_বাঁধনে #পলি_আনান [পর্ব সংখ্যা ৪১খ]

0
464

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪১খ]
_____________________
আবিদ শাহরিয়ারের অতি আদরের ভাগনি লিজা।মেয়েটার অল্প কিছু হলেই তিনি চিল্লিয়ে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখতেন।লিজার অল্প স্বল্প ব্যথাতেও আবিদ শাহরিয়ার অবস্থা এমন হতো যেন তিনি নিজে ব্যথা পাচ্ছেন।একটি মেয়ের শখ ছিল তার কিন্তু ঘরে এলো পুত্র সন্তান।তাই তো লিজাকে নিয়ে তার এত আহ্লাদ।এত বিশ্বাস,ভালোবাসা,মর্যাদা,গুরুত্বের মাঝে লিজা এতদিন যাবৎ প্রতারণা করে এসেছে!মানতে বড্ড কষ্ট হয় আবিদের তাই তো আজ লিজার চেতনা হারানো নিয়ে তার কোন অতিশয় আগ্রহ দেখা গেল না।লিজার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে জ্ঞান ফিরলো তার লিপি কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে নিয়ে গেলেন তার কক্ষে।বাড়ির বাকি সদস্যরা ভীষণ অবাক হঠাৎ অতিথিদের দেখে কী এমন হলো যে জ্ঞান হারাবে?

মুজাহিদ হাসানের মনে সন্দেহের বীজ রোপিত হলো।তিনি পাঁচ ভীনদেশীর মুখোমুখি বসলেন।সবাই তাদের পরিচয় দিল নিঃসন্দেহে ছেলেগুলো অনেক বড়লোক ঘরের তা আর বুঝতে বাকি নেই।মুজাহিদ হাসান সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

” তোমরা ঈশানকে চিনলে কী করে?”

সিডের পাশে বসা হাস্যজ্বল ছেলেটির নাম এলমার।মুজাহিদ হাসানের প্রশ্নে সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,

” আমার আঙ্কেল আর ঈশান শাহরিয়ার পূর্ব পরিচিত।বিজনেস পার্টনার বলা চলে।আমি দেশে আসতে চাইলে তিনি আমায় ঈশান শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।”

” তোমরা এসেছো এতে আমরা ভীষণ খুশি।তোমাদের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন ঈশানকে বলছি তোমাদের রুম দেখিয়ে দেবে।তারপর নতুন বাসায় শিফট করবে।”

অনু কিচেনে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোকে দেখছিলো।মুজাহিদ হাসানের সাথে ইংলিশে বলা এতগুলো কথার মাঝে একটি কথাও তার মাথায় ঢুকলো না।এরা হ য ব র ল কী বলেছে?মুজাহিদ হাসানো কি দক্ষতার সাথে বললেন।তবে এলমার নামক ছেলেটাকে ভীষণ মনে ধরেছে অনুর এত আদুরে ছেলেটিকে দেখেই মন চায় গাল টিপে দিতে।অনুর চাহনি সুবিধার লাগলো না রাসেলের কাছে। সে দ্রুত এগিয়ে এসে দাঁড়ালো অনুর সম্মুখে।

” তুমি ওদিকে মনোযোগ দিয়ে কী দেখছো?”

হকচকিয়ে উঠলো অনু।কি বলবে না কি করবে ভেবে পেলো না সে।রাসেলের চাহনি প্রখর এই ছেলেটা কী বুঝে ফেলেছে?

” কি হলো কথা বলছো না কেন?”

” না মানে ছেলেগুলোকে দেখো কিসব ইংরেজিতে হাবিজাবি বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

” ওহ, এসব বুঝতে তোমাকে গরুর ডিম খেতে হবে এখন তো তুমি ঘোড়াম ডিম খাও।”

বিদ্রুপের হাসি হেসে চলে গেলো রাসেল।অপরদিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল অনু।গরুর ডিম হয়!গরু তো দুধ দেয়।

১১২.
এতটা লম্বা জার্নির পর দেহটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে সবার।সিড শাওয়ার শেষে চুপচাপ পিঠ ঠেকিয়ে বিছানায় বসলো।শরীরের থেকেও মনটা বেশি গুটিয়ে গেছে তার।লিজাকে দেখার পর সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।ধনি পরিবারের ছেলে সিড ছোট বেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি যেমন ঝোক ছিল তেমনি সর্বদা ফুটবলের প্রতি অসীম ঝোক ছিল।বাবার ব্যবসায় মাঝে মাঝে হাত লাগাতো সে, ব্যবসার বিভিন্ন পরিকল্পনায় তার অসাধারণ বুদ্ধিতে যে কেউ প্রশংসা করতে বাধ্য ছিল।তাদের ব্যবসার প্রতিটা পার্টনার সিডকে ভীষণ ভালোবাসতো।এত সব প্রশংসা,সম্মানের ভীড়ে যে কেউ হয়তো খুশিতে গর্বে ভরে যেত।কিন্তু সিড এসবে বড্ড নীরব।ছেলেটা সবসময় নীরবতাকে ভালোবাসতো শোরগোল,হৈচৈ স্থান তার কোন কালেই পছন্দের না।তার আনাড়ি জীবনে প্রেম আসা দুঃসহ, মেয়েদের সাথে কথা বলতেই তার কেমন লজ্জা লাগে আর সেখানে তার সমবয়সী কয়েকজন বন্ধুরা নিজেদের দেহ মন সবটা কতজন মেয়ের কাছে বিলিয়ে দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।

এই নিশ্চুপ ছেলেটার জীবনেও এক পাশলা বৃষ্টির ন্যায় আচমকা প্রেম এসেছিলো।উলটে পালটে দিয়েছে তার জীবনের সবকিছু।নিজেকে যতটা ভালোবেসেছিল তার চেয়েও বহু গুনে ভালোবেসে ফেলেছে প্রেয়সীকে।বন্ধুর জন্মদিন পার্টিতে প্রথম দেখেছিলো লিজাকে মেয়েটাও যেন সেদিন সিডকে টার্গেট করে এসেছে।আগ বাড়িয়ে সিডের সাথে কথা বলা,ডান্স করা, ড্রিংকস করা,সবটা লিজা সেচ্ছায় করেছে।সরল সহজ জীবনে আবির্ভাব ঘটে এক জটিল মেয়ের।লিজা যখন যেভাবে পেরেছে সিডকে ব্যবহার করেছে টাকা,দামি দামি গিফট কোন কিছুতেই কার্পণ্য করেনি ছেলেটা।লিজাকে ভেবেছিলো বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ যার দেহের প্রতিটি ভাজে ভাজে একমাত্র সিডের ছোঁয়া থাকবে।লিজাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে নিজের খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে।হায় আফসোস সেদিন যখন জানতে পারলো লিজা প্রতারক এক মুহূর্তের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিল সিড।লিজার বন্ধুরাই লিজার নামে সব কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়।সিড একে একে প্রমাণ জোগাড় করে ধীরে ধীরে জানতে পারে একাধিক ছেলের সাথে লিজার সম্পর্কের কথা।অনেক ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখে মেজাজটা খিঁচে যায়।তবুও লিজাকে সরাসরি কিছুই জানায়নি সে।ছেলেটা ভাঙা মন নিয়ে বেশ কিছুদিন প্রেমের নাটক চালিয়ে গেছে,লিজা সবসময় তার পরিবারকে হাইড করেছে কিন্তু এবার সিড নানান বাহানায় তার বাংলাদেশের অবস্থান জেনে নেয়।সেদিন লিজা বলেছিল তার কাজিন ঈশান শাহরিয়ারের বিয়ে উপলক্ষ্যে দেশে এসেছে।ঈশান শাহরিয়ার সম্পর্কে টুকটাক বলেছিল লিজা তবে সিড ধীরে ধীরে ঈশান শাহরিয়ার সম্পর্কে সব তথ্য বের করে।এলমার সবচেয়ে বেশি তথ্য দিয়ে সাহায্য করে তাকে।

লিজার বর্তমানে থাকা বাকি চারজনকে বাংলাদেশে আসার জন্য রাজি করায় সিড।যদিও প্রথমে কেউ রাজি ছিল না কারণ তাদের জীবনে মেয়ে আসবে যাবে এটা বড় কোন ইস্যু নয়।তবে সিড তাদের সম্পূর্ণ খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয়, এখানে শুধু তারা লিজাকেই ধরবে না একটা দেশ ভ্রমণ করবে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না।একে একে বাকিরাও রাজি হয় এক ঢিলে দুই পাখি মা রা যাকে বলে।

” তোমার মন খারাপ সিড?দেখো এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।আমরা যে কারণে এসেছে সে কাজটা করতেই হবে।”

” আমি ভেঙ্গে পড়ছি না এলমার।আমি শুধু ক্লান্ত যাই হোক প্রতারকটাকে কখন শায়েস্তা করবে?”

” এখন নয় ডিনার শেষে।”

” ঠিক আছে।”
.
এই দেশের খাদ্যাভ্যাসের সাথে ভীনদেশি ছেলেগুলো সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না।তেল, মসলা, ঝাল তারা একটু কম পছন্দ করে।যেহেতু মাহমুদার এই সম্পর্ক ধারণা আছে তাই একাই সব রান্না করছেন তিনি।তার হাতে হাতে কাজ করছিলেন ঈশা এবং অনু।ঈশান কিছুক্ষণ পর পর ঈশাকে দেখে যাচ্ছে এর পেছনেও অবশ্য একটা কাহিনী আছে ছেলেগুলো একবার দেখে ঈশা মনের ভুলে ঈশানের সামনে বলে বসেছে, “এই ছেলেগুলো এত ফর্সা কেন?এক টানা তাকিয়ে থাকলে আশেপাশে সবকিছু আঁধার আঁধার লাগে!”

ঈশার মুখে এমন কথায় হকচকালো ঈশান।দ্রুত ঈশাকে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় সে।মেয়েটার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দ্রুত চোখ মুছতে বলে।ঈশানের এমন ব্যবহার ঠিক মাথায় ঢুকলো না ঈশার।ঈশান ফিসফিস করে কিছু বলছে এবং ঈশার চোখে ফু দিচ্ছিলো।বিরক্ত হয়ে ঈশা এক পর্যায়ে ঈশানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,

” কী সমস্যা বলবেন তো।”

” অনেক বড় সমস্যা।তোমায় আমি কি করি?আজ নিচে যেও না।”

” কেন যাব না?”

” তুমি তো এমন মেয়ে নও অন্য ছেলেদের দিকে নজর দাও।এই ঈশা মনে কি চলছে আমায় বলো।”

ঈশানের কণ্ঠে মিশে আছে অস্থিরতা।চরম অবাকের মাঝেও ফিক করে হেসে ফেললো ঈশা।ঈশানের চুলে হাত বুলিয়ে সে বলে,

” নজর দিলাম কই?এটাকে নজর বলে না।আপনি পাগলামো কেন করছেন?”

” তুমি শুধু আমার দিকে তাকাবে ঠিক আছে?কাল থেকে রূপচর্চা করবো বউয়ের মন ঘুরে যাচ্ছে দূর ভাল্লাগে না।”

ঈশান আপন মনে বকবক করতে করতে বেরিয়ে গেলো।ছেলেটার কাণ্ডে খিলখিলিয়ে হাসছিলো ঈশা।আড়ালে সেই হাসি দেখলো ঈশান।ভাব গম্ভীর ছেলেটার এসব হেঁয়ালি আচরণ করার একমাত্র কারণ ঈশার সহজ হওয়াটা।ম্যাচিউর ব্যক্তিদের পছন্দ করে ঈশান, ঈশা যথেষ্ট ম্যাচিউর কিন্তু তার দু’একটা ইম্যাচিউর কাণ্ডে সম্পর্কে হাস্যরস বাড়ে,ঈশান কখনো ভাবেনি জীবনে একটা পর্যায়ে এসে তাকে এমন পাগলামো করতে হবে।
.

” এই তোমরা এখানে কী করছো?”

আবিদের আগমনে সতর্ক হলো ঈশা এবং অনু।দুজনে টুকটাক কাজ করছিলো।শ্বশুরের সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি তারা।শ্বশুর মানুষটা কেমন মুখটা কালো করে ঘুরে বেড়ায়।ঈশা মাথার ঘোমটা টেনে বলে,

” সালাদ কাটছিলাম।আপনার কিছু প্রয়োজন?”

” না।তুমি কি করছো?”

অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।অনু কপট হেসে বলে,

” এইতো সব পরিষ্কার করছি।”

আবিদ শাহরিয়ার কিছুক্ষণ চুপ রইলেন।তাকিয়ে পরখ করলেন দুই পুত্র বধূর কার্যক্রম।আচমকা তিনি দুজনকে প্রশ্ন করলেন,

” তোমাদের স্বামীর পছন্দের খাবারের নাম কী?”

এমন সোজা প্রশ্ন পেয়ে গটগটিয়ে দ্রুত উত্তর দিলো অনু।

” পাস্তা বাবা।আমার আর আপনার ছেলের একই খাবার পছন্দের।”

” তাই নাকি?তা বলতো পাস্তার উৎপত্তি কোথায়?”

থমকে গেল অনু।পাস্তার উৎপত্তি কোথায় এসব জেনে তার কাজ কী?তাকে যদি বলা হতো এই শহরে সবচেয়ে ভালো পাস্তা কোন রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় তবে সে গড়গড়ে বলে দিত।অনুরকে হাঁশফাঁশ করতে দেখে আবিদ ভ্রু নাচালেন।

” কি হলো বলো শুধু কি গিললেই হবে?পছন্দের খাবার নিয়ে একটু আধটু জানাও তো দরকার।”

অনু আড় চোখে তাকালো ঈশার পানে।ঈশা ইশারায় তাকে উত্তরটা বলে দিচ্ছে কিন্তু অনু বুঝতে পারছে না ঈশা ঠিক কি বলছে।তাই ঈশা তার গলার স্বর আরেকটু বাড়ালো,চাপা গলায় ইশারায় বলে,’ইতালিতে’। ঈশা বললো এক অনু বুঝলো আরেক।অনু হাসি মুখে বলে,

” ইন্দোনেশিয়ায় পাস্তা উৎপত্তি হয়েছে।”

অনুর উত্তরে মাথায় হাত ঈশার! আবিদ শাহরিয়ার শ্লেষ হাসলেন এই মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।তিনি বিদ্রুপে অনুকে বলেন,

” তুমি বোধহয় সেই স্টুডেন্ট যারা সামনের টপারদের থেকে দেখে লিখেও ফেল করে।আমি আর তুমি একই অবস্থানে মুখোমুখি ঈশা অদূরে দাঁড়িয়ে তোমায় ইতালি ইতালি করছিলো উলটো দিক ফিরেও আমি শুনতে পেলাম আর তুমি সোজাসুজি থেকেও বুঝতে পারলে না।”

১১৩.
পাঁচ জনে বেশ তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার‍ খেলো।পাঁচ জনের প্রশংসায় ভাসছেন মাহমুদা এই ছেলেগুলো সহজে মন কেড়ে নিতে ওস্তাদ।খাবার শেষে তারা রাসেল এবং আবিদ শাহরিয়ারের সাথে পর্যটন স্থান গুলোর বর্ননা শুনছে আগামীকাল সকালে ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে তারা।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে লিজার আচরণের পরিবর্তন সহজে চোখে পড়লো লিপির।মেয়েটা কেমন পাগল পাগল করছে কানে দু’হাত চেপে কিছু একটা বিরবির করছে।অপরদিকে লিজার এখনো মানতে কষ্ট হচ্ছে এরা পাঁচজন এক হলো কী করে?এরা নিশ্চয়ই লিজাকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে?আবিদ শাহরিয়ারের কাছে লিজা তার ব্যক্তিগত জীবনের যত নোংরামো আছে সবটা গোপন করে গেছে সে শুধু জানিয়েছে একটি ছেলের সাথে তার সম্পর্ক আছে অথচ এখন যদি তিনি জানতে পারেন এত এত ছেলের সাথে সে মিথ্যা সম্পর্ক স্থাপন করেছে,তাদের সাথে ইন্টিমেট হয়েছে এসব জানলে তার কপালে অসীম দুঃখ আছে।আচ্ছা এই ছেলেদের খোঁজ নিয়েছে কে?তাদের দেশে এনেছে কে?ঈশান!
মুহূর্তে রাগে দপদপ করে উঠলো লিজার মাথা।সে যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।দ্রুত কক্ষের দরজা খুলে বাইরে তাকাতে কাউকে নজরে এলো না এভাবে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মিনিট।ঈশান যখনি তার কক্ষের সামন দিয়ে গেল ঈশানের পথ আটকে দাঁড়ায় সে।

” ওই ছেলেগুলোকে তুমি এনেছো তাই না?”

“আমি!”

ঈশান চমকে গেল লিজা কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।ঈশান বুঝতে পারলো এখানে কোন জট আছে ছেলেগুলোকে দেখে লিজাও কেন অজ্ঞান হয়েছিল!ঈশানের ভাবনা চিন্তার মাঝে তার কলার টেনে ধরে লিজা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তুই আমাকে সবার সামনে বেইজ্জত করতে চাইছিস তাই না?তোর সংসার আমি বাঁচিয়েছি।ভুল করে ফেলেছি তোর ঈশাকে আমি…”

দুজনের ঝগড়ার মাঝে উপস্থিত হয় ঈশা।ঈশানের কলারে লিজার হাত দেখে কিছুটা রেগে যায় সে।দ্রুত দুজনকে ছাড়াতে নিলে লিজা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ঈশাকে টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটা কাঁচের বড় ফুলদানিটার সঙ্গে ধাক্কা খায়।তৎক্ষনাৎ ফুলদানিটা মেঝেতে আঁছড়ে পড়ে ভেঙেচুরে বিকট শব্দ তোলে।বাড়ির সবাই সেই আওয়াজ শুনতে পায় তারা ছুটে আসে লিজার কক্ষের দিকে।

লিজার আচরণে ঈশান এতক্ষণ হতবিহবল থাকলেও ঈশাকে মেঝেতে দেখে লিজাকে পালটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঈশার কাছে যায়।ভাঙা কাঁচের টুকরো হাতের কোণায় লেগে একটুখানি কেটে যায় তবে কাটা অংশ বেশি দেবে যাওয়ায় কেমন দেদারাসে রক্ত ঝরছে।লিজা মেঝেতে পড়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।বাড়ির সকলে এখানে ভীড় জমিয়েছে তার প্রেমিক পুরুষেরা তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।সিড সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে এলো লিজার কাছে হাটু মুড়ে হাত বাড়িয়ে বলে,

” হাতে হাত রাখো।”

এর পেছনে এগিয়ে আসে এলমার সেও হাত বাড়িয়ে দেয় লিজার উদ্দেশ্যে। তার দেখা দেখি বাকি তিনজনেও এগিয়ে এসে হাত বাড়িতে দেয় লিজার দিকে।বাড়ির সকলে অবাক হয়ে পাঁচটি ছেলেটা কাণ্ড দেখছে।লিজা মনে মনে সিডের প্রতি দূর্বল তাই যে ভাবে হোক সিডকে বন্দি করতে হবে তার মায়াজালে।সবার নজর উপেক্ষা করে লিজা সিডের হাত ধরলো উঠে দাঁড়ানোর আগ মুহূর্তে তার হাত ছেড়ে দিল সিড যার দরুনে ছিটকে পড়লো লিজা। লিজার এমন পতন দেখে পাঁচজন ছেলে মুহূর্তে পৈশাচিক হাসি দিলো।সিড কোমড়ে হাত ঠেকিয়ে লিজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” ঠিক একই ভাবে আমাকে ভেঙে দিয়েছো তুমি।তুমি একজন প্রতারক!আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছো তুমি।”

আবিদ শাহরিয়ার অবাক হলেন।ঈশান নিজেও কিছুই বুঝতে পারছে না।রাসেল সিডের কাছে এগিয়ে যায় ব্যপরটা খোলাসা করা জরুরি এরা ঠিক কি বলতে চায়?”

” সিড তুমি এসব কি বলছো?লিজার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক আছে?”

” আমার এখানে আসার মূল কারণ এই মেয়েটা।যাকে আমি ভালোবেসেছি, অন্ধকের মতো বিশ্বাস করেছি,অগনিত অর্থ ব্যয় করেছি তার পেছনে।সে আমাকে ঠকিয়েছে শুধু আমাকে নয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যকটা ছেলের সাথে তার এখনো সম্পর্ক চলমান।এর আগেও সে অনেক ছেলেদের টার্গেট করেছে তাদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়েছে, দৈহিক সম্পর্ক স্থাপণ করেছে।”

মাথায় যেন আকাশটা ভেঙে পড়লো আবিদ সহ অনন্যদের।অনু পিটপিট চোখে চেয়ে রইলো সিডের পানে সে আধো আধো বুঝতে পারছে কি বলছে এই ছেলেটা।ঈশার হাতে রুমাল বেধে দিয়েছে ঈশান।ঈশা হাতের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, “এই একটা মেয়ে এত প্রেমিক কী করে সামলায়?আমি তো ঈশানকে সামলাতে হিমশিম খাই।নাহ মেয়েটা আসলেই ট্যালেন্টেড।”

সিডের বক্তব্যতে বাকিরাও সহমত জানায়।নিজের মেয়ের কুকীর্তির কথা লিপি জানেন তবুও মেয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সিডকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

” আমার মেয়ে যে খারাপ তার প্রামাণ কী?বরং তোমরা তাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছো নিজেদের লালসা মিটিয়েছো।”

সিড কিছু বলার আগে মুখ খুললো এলমার,

” আপনার মেয়ে আমাদের দেখে জ্ঞান হারালো কেন?আপনার চোখের ভাষা বলে দেয় সত্যটা আপনি জানেন।এমন তুচ্ছ মেয়ের জন্য আমাদের জীবন পড়ে নেই তবুও এই মেয়েটাকে শায়েস্তা করা জরুরি ভেবে এতটা দূর ছুটে এসেছি।মিস্টার ঈশান শাহরিয়ার আপনি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার কাজিনের সম্পর্কে।আমরা অনেক অনেক প্রমাণ নিয়ে এসেছে।
আমাদের আর কিছুই বলার নেই।”

এলমার কথায় বাকিরাও সহমত পোষণ করে তবে এসব সম্পর্কে কিছু বলার নেই ঈশানের।নর্দমায় হাত দেওয়ার শখ তার নেই এই নর্দমাকে আরো আগেই প্রত্যাখ্যান করে ছুটে এসেছে এই দেশে।আবিদ শাহরিয়ারের বিশ্বাসে আঘাত লাগলো,সম্মানে কালি লাগলো।লিজাকে কোন দিন অবিশ্বাস করেননি যখন যেভাবে পেরেছে মেয়েটাকে আগলে রেখেছেন তার কারণে সন্তানকেও পর করে দিচ্ছিলেন আর সেই লিজা…

বুকটা ভার হয়ে এলো তার।বুকে হাত ঠেকিয় ছোট ছোট পা ফেলে চলে গেলেন বসার ঘরে।সোফায় বসে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন মেঝেতে।মাহমুদা স্বামীর কষ্ট বুঝতে পারলেন দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে দিলেন তার সম্মুখে যা এক নিশ্বাসে শেষ করেন আবিদ।

ঈশানের এসবে ইন্টারেস্ট নেই সে চুপচাপ এসে বসলো এক কোণে।সিড এলমার সব প্রমাণ রাসেলের নিকট পেশ করছে ছেলেগুলো যে মিথ্যা বলছে না, তা আর বুঝতে বাকি নেই কারো।

ভাইয়ের বিশ্বাস ভেঙে গেলে পথে বসতে হবে লিপিকে তাই দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের পা ধরে বসলো সে।ন্যাকা কান্নায় যতটা পারা যায় ভাইয়ের মন গলাতে ব্যস্ত সে।

” ভাইয়া লিজা ছোট মানুষ ওঁকে মাফ করে দেন।একবার সুযোগ দেন মেয়েটাকে আমি বুঝাবো।একাই কি আমার মেয়ের দোষ?ওই ছেলেদেরো দোষ আছে ও ভাইয়া আপনি এভাবে চুপ করে থাকবেন না।”

” সেদিন লিজার অন্যায়ে তুমি যদি আমার ছেলেটাকে না ফাঁসিয়ে নিজের মেয়েকে শাসন করতে তবে আজ আর মেয়েটার অধঃপতন হতো না।সেদিন যদি আমি তোমাদের বিশ্বাস না করতাম তবে আমার ছেলের সাথে আমার এতটা দূরত্বের সৃষ্টি হতো না।সব নষ্টের মূলে তুমি আছো লিপি।”

” ভাইয়া আমি…”

” কোন কথা আমি শুনতে চাই না।আমাদের সাথে ফিরে যাবে তুমি।নিজের মেয়ের ব্যবস্থা নিজে করবে।”

” নিজের মেয়ে?আমার মেয়ে তোমার কেউ হয় না ভাইয়া?তোমার ভাগনি সে।”

তৎক্ষনাৎ লিপির দিকে থুথু ছুড়লেন আবিদ শরীরটা কেমন ঘিণ ঘিণ করছে তার।

” তোমাদের মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে সামনে থেকে সরে যাও।”

১১৪.
এক সাপ্তাহের মাঝে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন আবিদ শাহরিয়ার।আজ তারা দেশ ছাড়বেন তাদের সাথে আছে লিজা এবং লিপি।তিনি চাইলেই এদের গ্রামের বাড়িতে রেখে যেতে পারতো কিন্তু এখানে রাখা মানে ঈশানের জীবনে ফের কাঁটার আগমন।দুই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মাহমুদা আবার কবে দেখা হবে তাদের সাথে?কবে এভাবে বুকে আগলে নেবেন।ঈশা,অনু ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে মাহমুদার পানে এগিয়ে এসে তাদের ছুঁয়ে দিতে কেমন বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো।মাহমুদা ঈশা আর অনুকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

” ঈশান তোমাকে বকলে অযথা রাগ ঝারলে আমাকে ফোন করবে।আর অনু রাসেল যদি তোমাকে পড়াশোনা নিয়ে বেশি বকে আমি তো আছি চিন্তা করবে না আমি বকে দিব তাকে।”

ঈশা,অনু ঝাপসা চোখে মাথা দুলায়।আবিদ এগিয়ে গেলেন ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

” তুমি ভীষণ ধৈর্য্যবান একটা মেয়ে কেননা সেচ্ছায় একটা পাগলকে গলায় ঝুলিয়েছো।”

আবিদ শাহরিয়ারের কথায় সবাই চাপা হাসলো।ঈশান পড়লো লজ্জায় এরা তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে।ঈশার পাশে দাঁড়ানো অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে আবিদ বলেন,

” পাস্তার উৎপত্তি কোথায়?”

” ইতালিতে।”

” না কেউ যেন বলেছিল ইন্দোনেশিয়ায়।”

” সে ভুল ছিল বাবা এবার সে সঠিকটা জানে।”

আবিদ শাহরিয়ার স্মিত হাসলেন।সবার চোখে পানি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল রুদবার।আবার সবাই কী আলাদা হয়ে যাবে?আচ্ছা ঈশামনি কাঁদছে কেন?ঈশামনির কী খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?ছোট্ট রুদবা ঈশার হাত টেনে বলে,

” ঈশামনি কেঁদো না।”

ঈশা কোলে নিলো রুদবাকে।গাল বাড়িয়ে বলে,

” তুমি একটা আদর দাও তবে আমি কাঁদবো না।”

” মামা একটু আগে দিয়েছিল এখন কী আমায় দিতে হবে?ঠিক আছে আমিও একটুপরে মামার মতো তোমায় চুপিচুপি চুমু দেব।”

রুদবার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো ঈশা।আশেপাশে সকলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।ঈশান দ্রুত ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল, ঈশা রুদবাকে নামিয়ে উলটো পথে হাটা শুরু করলো।

১১৪.
কেটে গেল একমাস।সিড যতটা চুপচাপ যত্নবান প্রেমিক ছিল লিজার প্রতারণায় ঠিক ততটাই বিষাক্ত হয়ে উঠে।দেশ ছাড়ার পর সিড লিজার নামে সর্বপ্রথম মামলা করে।এরপর বাকিরাও লিজার অনন্য প্রেমিকরা তার নামে মানহানির মামলা করে ।সিডের এমন কাজে উৎসাহ পেয়ে বাকিরাও লিজার বিরুদ্ধে একে একে সকলে উসকে যায়।নিজেকে বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা রইলো না মেয়েটার কাছে।আবিদ শাহরিয়ার এসবে গা দিলেন না তিনি তার মতো চললেন লিজাকে জেল থেকে মুক্তি করার তার কোন তাড়া নেই।লিপি ভাইয়ের পা ধরেও কোন কিছুই করতে পারেনি।বরং আবিদ শাহরিয়ার তাকে আলাদা করে দিয়েছে এখন লিপি একাই একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
আজ তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন।মা হিসেবে যদি একটু সৎ সতর্ক হতেন তবে মেয়েটার সুন্দর ভবিষ্যত থাকতো।শারিরীক অত্যাচারের থেকেও হয়তো মানসিক অত্যাচারটা সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক যা মোটেও সহ্য করতে পারছেন না লিপি মেয়ের চিন্তায় ধীরে ধীরে তার জীবনের যেন পতন ঘটছে।একা একা দুঃসহ হয়ে পড়ছে প্রতিটি রাতদিন।অপরদিকে লিজার কারাবন্দী জীবনটা বিস্বাদের কড়া নাড়ছে জীবনে।শারীরিক সব সৌন্দর্য, মনের সব সুখ দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে।
#চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here