অবাধ্য_বাঁধনে #পলি_আনান [পর্ব সংখ্যা ৪২]

0
410

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪২]
____________________
১১৫.
কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙলো ঈশার।হন্তদন্ত পায়ে পুরো রুমটা গুছিয়ে ব্যাগপত্র সব ঠিকঠাক করে নেয়।এতবড় একটা ভুল কি করে করলো সে?আজ মা বাবার বিবাহ বার্ষিকী আজকের এইদিনটার কথা সে ভুলে গেছে!ভাগ্যিস আচমকা ঘুম ছুটে যাওয়ায় গ্যালারির পুরোনো ছবিগুলো দেখছিলো হঠাৎ মনে পড়ে যায় আজ তার বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী।আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ঈশা দ্রুত সব গোছগাছ করে গোসলের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে যায়।
বুকটা খালি খালি লাগছিলো ঈশানের,হাতড়ে হাতড়ে ঈশাকে খুঁজে না পেয়ে সহসা চোখ মেলে তাকায়।বিছানায় ঈশা নেই!বালিশের পাশে ফোনে সময়টা দেখে কিছুটা অবাক হয় সবে ছয়টা বাজে ঈশা এখন উঠেছে।পুরো রুমটা গোছগাছ করা বিছানার একপাশে ঈশার ভ্যানিটি ব্যাগটা রাখা।দ্রুত বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কাতে ঈশার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।

” ঈশান আমি আসছি অপেক্ষা করুন।”

” তুমি এত সকাল সকাল গোসল করছো কেন?আজ অফ ডে না?ব্যাগপত্র কেন নামিয়েছো?”

” বেরিয়ে এসে বলছি।আমাদের দ্রুত বের হতে হবে আপনিও তৈরি হয়ে নিন।”

“কোথায় যাবা?”

” বাবার বাসায়।”

” হঠাৎ!এই আমার ফাদার, মাদার ঠিক আছে তো?”

“আছে আছে।”

ঈশান চুপচাপ বসে রইলো বিছানায় ঈশার মাথায় হঠাৎ কী ঢুকেছে কে জানে।ঈশান জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে পরিবেশটা মুখরিত।ঈশান মাথাটা একটু বাঁকিয়ে দেখলো বাগানে সদ্য রোপন করা বাগানবিলাস গাছগুলোকে।এরা বড় হবে কবে?ঈশান কবে এদের ছায়াতলে জমিয়ে প্রেম করবে?

” যাও গোসল করে আসো সময় কম।”

” কি হয়েছে বলবে তো।”

” আজ বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী আমাদের যেতে হবে।প্রতি বছর আমি একা হাতে সবটা করি আগে থেকে নানান পরিকল্পনা সাজানো থাকে আর এবার কোন প্রস্তুতি নেই।আমাকে কেকটাও বানাতে হবে।যাই হোক যাও যাও জলদি যাও।”

ঈশান হকচকালো।ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে জড়িয়ে ধরলো ঈশাকে।

” এত তাড়াহুড়ো করছো কেন?যাওয়ার সময় বাইরে থেকে খাবার যা যা লাগবে কিনে নিয়ে যাব রান্না করার ঝামেলাও নেই।কখন যাবে দুপুরে?”

“এই দিনে প্রতিবছর আমি নিজের হাতে রান্না করি এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না।চলো এক্ষুনি বাজারে যাব বাজার থেকে সোজা সে বাসায়।”

” কি তুমি বাজারে যাবে!”

” হ্যা যাব।এত চমকে যাওয়ার কী আছে?”

ঈশান কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না।ঈশা চটজলদি তাকে পাঠিয়ে দিল ওয়াশরুমে।
.
ঈশান ঈশা অনু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।অনু নজর পড়লো তাদের ফ্লাটে কতদিন হলো আনন্দ নিয়ে প্রবেশ করা হয়নি চিরচেনা স্থানে।রাসেল অফিস থেকে ঈশাদের বাড়ি আসবে হয়তো দুপুরে তাহলে এই এখন একবার নিজ বাসায় যাওয়া যাক।এত আড়াল করে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো রাসেল জানলে তাকে আর আস্ত রাখবে না।

আজকে ছুটির দিন তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশি তাড়াহুড়ো নেই দোলনের।বেলায়েত সকাল সকাল মাসকাবারি বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে।দোলন ধীরে সুস্থে ঘুম থেকে উঠে চুলায় চা বসালেন।হঠাৎ ডোর বেল বাজতে কিছুটা চমকে উঠেন তিনি।দরজা খুলতে অনুকে দেখে দ্রুত হাত টেনে ভেতরে আনেন।

” কিরে মা তুই?কেন এলি তোর বাবা দেখলে আবার অপমান করবে এসব আমার সহ্য হয় না।”

” বাবা কি আছেন?”

” না নেই।হঠাৎ কেন এলি?”

“এটা আমার বাড়ি ছিল আম্মু আমি এই বাড়ির মায়া এত সহজেই ছাড়তে পারবো বলে তোমার মনে হয়?”

” তুই ভালো আছিস মা?”

” আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?আমি ভালো আছি তবে তোমরা ভালো থাকতে দিচ্ছ না তোমাদের এই আচরণ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।”

” এসব বলে এখন কী হবে?তোর বাবার জেদের কথা তুই জানতি।”

” জেদের কারণে আব্বু আমাকে পর করে দিচ্ছে আমি তার একমাত্র মেয়ে।”

“আমার কোন মেয়ে নেই।তুমি এখানে কেন এসেছো আবার নাটক করতে?”

শেষোক্ত বাক্যটি বলে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করলেন বেলায়েত।স্ত্রীর দিকে তাকালেন চোখ রাঙিয়ে।

” এই মেয়েকে এখানে ঢুকতে দিয়েছো কেন?এক্ষুনি বের করো তাকে।”

” আব্বু আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো।”

“আমার কোন মেয়ে নেই কেউ আমাকে আব্বু ডাকবে না।”

” সামান্য জেদ নিয়ে মেয়েকে পর করে দিচ্ছ।যদি আমি আমার সিদ্ধান্তে ভুল করতাম তবে মা রো, কা টো যা ইচ্ছা তা করো আমি কিচ্ছু বলতাম না।কিন্তু এখন তো তুমি নিজেও জানো আমি ভুল করিনি।”

” এত কথা আমি শুনতে চাই না বের হও।”

বেলায়েত ভীষণ রেগে গেলেন।অনুর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

“নিজের জেদের কাছে অমূল্য সুখগুলো বিক্রি করে দিচ্ছ আব্বু।আজ মেয়ে জামাই নিয়ে চাইলেই তুমি খুশিতে থাকতে পারতে।রাসেলের মা নেই তার বাবা তাকে ছেড়ে দিয়েছে তোমরা চাইলে তার মা বাবা হতে পারতে।ঈশান ভাইয়াকে দেখেছো ঈশার মা বাবা তাকে কতটা ভালোবাসে আগলে রাখে।এসব দেখে আমার বড্ড আফসোস হয় রাসেল চাইলে কি এমন একটা পরিবার পেত না?অথচ তুমি তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছো। যতবার এসেছি আমাকে অপমান করে বের করেছো।অযথা জেদ খাটিয়ে কি লাভ হচ্ছে বলো?তবে একটা সময় তুমি বুঝবে যা করছো মোটেও ভালো করছো না।তোমাদের কাছে আমি আর কখনো আসবো না, তুমি তোমার জেদের কাছে আমায় বিক্রি করে দিয়েছো।”
.

অনুর ভাবনা ভুল প্রমাণ হলো যখনি ঈশাদের ঘরে প্রবেশ করতে মুখোমুখি হলো রাসেলের।সে ভেবেছিল রাসেল অফিসের কাজ সেরে আসবে হয়তো দুপুর হয়ে যাবে।কিন্তু রাসেল যে এ মুহূর্তে এসে পড়বে তা কস্মিনকালেও ভাবেনি অনু।রাসেলকে দেখেই তার কলিজাটা মোচড় দিয়েছে যদি জানে সে বাবার বাসায় গিয়েছিল তবে লণ্ডভণ্ড করে ছাড়বে সব।অনু দ্রুত নিজেকে আড়াল করলো রান্না ঘরে ঈশা সবটা সামলাচ্ছে তার পাশাপাশি কাজ করছে ঈশান।আজকে সুলতানার ছুটি যা আয়োজন করার মেয়ে জামাইরা মিলেমিশে করবে।হঠাৎ পেছনে রাসেলের উপস্থিতি টের পেয়ে কেঁপে উঠলো অনু দ্রুত পায়ে সরে আসতে তার হাত টেনে ধরলো রাসেল।অনুকে গম্ভীর মুখে আদেশ করলো,

” আসো আমার সাথে।”

রাসেল তাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরের রুমে দ্রুত হাতে দরজা বন্ধ করে দাঁড়ায় অনুর মুখোমুখি।

” ওই বাড়ি গিয়েছিলে?”

” না মানে.. ”

” মিথ্যা বলবে আমায়?এত সাহস!”

” রাসেল আমি মানে…”

” বারণ করেছিলাম আমি।গতবার যে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ভুলে গেছো?”

” অপমান করলেও কিছু করার নেই আমি মায়া ছাড়তে পারছি না।আমি যেতে চাইনি কেন জানি চলে গেলাম।”

রাসেল খামছে ধরলো অনুর দু’বাহু সহসা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো মেয়েটা। নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও রাসেলের শক্ত হাতের বন্ধনীতে কিছুতেই কিছু করতে পারলো না।যদি রাসেল টের পায় সে গিয়েছিল ওবাড়ি এমন কিছু যে হবে তা পূর্বেই আঁচ করেছিল সে।
অনুর ছটফট করা দেহখানিতে একবার ঝাঁকুনি দিল রাসেল,চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তুমি আমার স্ত্রী আমার আদেশ নির্দেশ মানা কি তোমার কতর্ব্য নয়?আমি বারণ করেছিলাম কোন সাহসে গেলে?পদে পদে যারা অপমান করছে তাদের কাছে ফিরে যাওয়া কী খুব বেশি জরুরি?”

” আমি যাব না।বিশ্বাস করো আর যাব না।তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?তুমি জানো রাগলে তোমায় কতটা সুন্দর লাগে?ইসস কি কিউট।সবাইকে বলতে মনচায় রাসেল ভাইয়াকে বিয়ে আমি জিতছি।”

কথা ঘুরিয়ে দিলো অনু।হঠাৎ রাগটা পড়ে গেল রাসেলের হতবাক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো অনুর পানে।

” আমি ভাইয়া হই তোমার?”

” পরিচয়ের প্রথম ধাপে তো ভাইয়া ডেকেছি কে জানতো ছাইয়া হয়ে যাবে।এইজন্য মেয়েদের বলি হ্যান্ডসাম ছেলেদের ভাইয়া ডাকা থেকে বিরত থাকতে না হলে এরা ছাইয়া হয়ে যায়।”
.
ঈশানের শ্বশুর শ্বাশুড়ির বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা কোন দিক দিয়ে অপূর্ণ রাখা যাবে না।রান্না-বান্নার আয়োজন শেষ হতে প্রায় বিকাল তিনটা বেজে গেল।অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে সন্ধ্যার পর।অবশ্য অতিথি হিসেবে কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি শুধুমাত্র অনুর বাবা মাকে আসতে বলা হয়েছে কিন্তু তারা তো গোসসা করেছেন কি করে আর আসবেন।বেলুন,ফুল,ছোট ফেইরি লাইটের সাহায্যে রুম সাজিয়েছে ঈশান।কেক কাটা শেষে সবাই মিলে আড্ডায় বসেছেন।মেয়ে জামাইদের এত আহ্লাদ দেখে লজ্জায় পড়েন সুলতানা বুড়ো বয়সে এসব করা কি খুব জরুরি?এসব নিয়ে অবশ্য ঈশাকে ভীষণ বকেছেন সুলতানা মাহমুদা কিছুক্ষণ আগে ভিডিও কলে তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

” ফাদার ইন ল আপনি কোথায়?এখন আপনাদের ডান্স করতে হবে।”

নাচের কথা শুনে চমকে গেলেন সুলতানা।মুজাহিদ হাসান আড় চোখে তাকালেন ঈশানের পানে,

” আমার লজ্জা আছে ভুলে যেও না।বুড়ো বয়সে ছেলেমেয়ের সামনে নাচবো?এতটা অকাল আসেনি আমার।”

” যেদিন আমি আপনার জামাই হয়ে এসেছি মনে করেন সেদিন আপনার অকালের সূচনা হয়েছে।”

” সেটা আমিও জানি।”

মুজাহিদ হাসান কেশে উঠলেন।ঈশান তার হাবভাবে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।এই দুইজনের খুনশুটিগুলো দেখে ভীষণ ভালোলাগে রাসেলের।নিজ হাতে সুলতানা সবাইকে কেক খাইয়ে দিলেন ঈশান শ্বাশুড়িকে টেনে বসালো তার পাশে।পূর্বে ঈশান আর সুলতানার সম্পর্ক বুনো ওল বাঘা তেতুলের মতো হলেও বর্তমানে সুলতানা চোখে হারান ঈশানকে সেই আগের মতো বিয়ে ঠিক হওয়ার শুরুতে যতটা ভালোবাসতেন ঈশানকে হয়তো এখন তার থেকেও বেশি বাসেন।

” মাদার ইন ল আপনি বলুন ফাদারের কোন কাজে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত খুশি হয়েছেন।”

” তোমার শ্বশুর বিরস মানুষ।তবে সেদিন ফোন করে তিনি একটা কথা বলেছেন যে কথা শুনে কয়েক ঘন্টার জন্য আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম।তবে তিনি কি বলেছেন সেটা বলবো না বলা যাবে না।”

মুজাহিদ হাসান আড় চোখে তাকালেন ঈশানের পানে।সেদিন ফোনে সুলু আই লাভ ইউ এই কথা বলতে ঈশান বাঁধ্য করেছিল আর তারপর থেকেই তিনি লক্ষ্য করেছেন সুলতানা আগের মতো সারাক্ষণ ঝগড়া ঝামেলার মুড নিয়ে চলে না বরং তার মাঝে দেখা যায় আনন্দের আভাস তবে এত আনন্দিত হওয়ার কারণ কি এটাই!

“মাদার এবার বলুন ফাদারের কোন কাজে আপনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু ফাদার সেই কারণে এখনো আপনাকে সরি বলেনি।”

সুলতানা তীর্যক চোখে তাকালেন মুজাহিদ হাসানের পানে।নাক ফুলিয়ে অভিযোগ নিয়ে বলেন,

” বিয়ের নয় মাসের মাথায় স্টেশনে একটা মেয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল তার পাশে যে বউ আছে সেদিকে কোন হেলদোল ছিল না তার, নিলর্জ্জ লোক একটা।”

মেয়ে জামাইদের সামনে এই কথা বলা কি খুব জরুরি ছিল?লজ্জায় পড়লেন মুজাহিদ হাসান।বাচ্চা হওয়ার আগের একটা বিষয় সুলতানা এখনো মনে রেখেছে!সেই কোন কালের কথা।এই নারী পারেও বটে।স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কানে ধরে ক্ষমা চাইলেন তিনি।
১১৬.
খাবার টেবিলে ঝাপসা চোখে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছেন বেলায়েত।প্রতিবার মেয়েকে বের করে দিয়ে আড়ালে কাঁদেন তিনি।তবে আজ আর আড়ালে কান্নার ইচ্ছে নেই স্ত্রীর সম্মুখে কেঁদে ফেলেছেন তিনি।মেয়েটা ভুল কিছু বলেনি জেদের দরুনে একা নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে তাদের।মুজাহিদ হাসান কিছুক্ষণ আগে একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন তাকে সেখানে দেখা যাচ্ছে,বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সেই ছোট্ট আয়োজনে পরিবারের সবার আনন্দ,হাসি খুশি,আড্ডা,খুনশুটি।সেই দলে অনুও ছিল মেয়েটা হাস্যজ্বল চেহারায় আড়াল হয়ে গেছে তার সকল দুঃখ বিস্বাদ।বেলায়েতের চোখের জল দেখে দোলন বলেন,

” এভাবে চোখের পানি ফেলে কী হবে?মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনো আমাদের আর কে আছে বলো?”

” যে চলে গেছে তাকে আমি ফিরিয়ে আনতে চাই না।”

” সে গেছে?নাকি তুমি তাকে পর করেছো।শুনো না সময় আছে মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনো আমাদের ঘরের আনন্দ ফিরে আসবে।তুমি একবার দাঁড়ালে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ তাদের নেই।”

সত্যিই তাই বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অনুর নেই।এক স্নিগ্ধ সকালে বেলায়েত এবং দোলনের আগমন ঘটে অনুর শ্বশুড়বাড়িতে তাদের দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সকলে তিনিও অবশ্য বিব্রতবোধ করেছিলেন।বাবা মা’কে কাছে পেয়ে সবটা থমকে গেল অনুর তার কান্নায় থরথর করে কাঁপছিল রাসেলের বুক।অভিমানের পালা শেষে বেলায়েত মেনে নিলেন মেয়ে জামাইকে।ধীরে ধীরে সম্পর্কটা স্বাভাবিক এবং দৃঢ় হয়ে উঠলো।আকাশের পানে তাকিয়ে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘগুলোকে চুপিসারে অনু বলে,তার জীবনে আর আফসোস নেই,ভালোবেসে তো ভুল করেনি সে।
১১৭.
মধ্যে রাতে ব্যস্ত নগরী ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু ঘুম নেই সেই নগরীর একজোড়া চড়ুইয়ের মাঝে তারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে এই রাতে। আকাশের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ভয়ে অন্তর আত্মা কাঁপছে ঈশার।এই রাতে ঈশানের বায়না, চলো তোমায় নিয়ে রাতের শহরটা ঘুরি।ঈশা ভেবে পায় না কি দরকার এসবের?বৃষ্টি আসছে কাঁথা জড়িয়ে একটা ঘুম দেবে তা না করে গাড়ি নিয়ে এখন ছুটবে উদ্দেশ্যহীন।ঈশার ভীতু মুখটা দেখে এক সাইডে গাড়ি থামায় ঈশান।কি সুন্দর শীতল হাওয়া বইছে!অথচ মেয়েটা কেমন জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে গেছে।ঈশানের স্মৃতির কোণে ভেসে উঠে সেদিনের কথা,টিউশন শেষে ঈশা যখন বাড়ি ফিরছিল কাকভেজা ঈশাকে গাড়িতে তুলেছিল রাসেল।মেয়েটার সিক্ত ঠোঁট,চোখ,গাল দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিলো ঈশান।অবাধ্য সব ভাবনা সেদিন তাকে গায়েল করেছিল,চোখের বালি সেই মেয়েটার প্রতিও সেদিন চোখের আকর্ষণ কাজ করেছিল।ঈশানের চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ঈশা ভ্রু কুচকে বলে,

” কি দেখো এমন করে?”

” আমার নিলর্জ্জ হওয়ার কারণ টা’কে।”

” কি!”

আচমকা ঈশার ঠোঁটের কোণে ঠোঁট ছোঁয়ালো ঈশান।তার এমন কান্ডে রাগী চোখে তাকায় মেয়েটা।

” ঘরে যা বাইরেও তা একটুতো ভদ্র হও।”

” তোমার কাছে ভদ্র হয়ে কি হবে?লাভ কি?অভদ্র হলেও ক্ষতি কি?”

” তোমার সাথে আমি কোনদিন কথায় পারবো না।”

” আসো ভিজি।”

” না না আপনার জ্বর হবে।এসব বায়না এখন ছাড়ুন ঈশান।”

” জ্বর হলে হবে আমি আর তুমি এক সাথে শুয়ে শুয়ে আহাজারি করবো।অনু আর রাসেল আমাদের সেবা করবে ওদের একটু জ্বালানো যাবে কি বলো?”

” এসব চোরা বুদ্ধি নিয়ে ঘুরে লাভ নেই।”

” তোমার কথা আমি শুনছি না আসো ভিজি।”

ঈশান ঈশা দুজনে রাস্তায় নামলো পিচ ঢালা সরু রাস্তাটায় কোন গাড়ির চিহ্ন নেই।সাইডে থাকা ল্যাম্পপোস্ট গুলোর আলোতে আলোকিত হয়েছে এই রাস্তা।ঈশান ঈশার হাত টেনে ধরলো বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,

” চলো আমরা একটু নাচি।”

” আমি নাচ পারি না।”

” আমি কি পারি নাকি?হাত আর পা দুলালেই নাচ হয়ে যাবে আসো আসো।”

” আগে গিয়ে গাড়ি থেকে একটা গান চালিয়ে আসুন গানের তালে তালে নাচবো।”

” কি গান?”

” আপনার ইচ্ছা।”

ঈশান ফিরে গেল গাড়িতে সে এখন কি গান চালাবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে আছে।বেশ কিছুক্ষণ গান খুঁজে ফিরে এলো সে, ঈশানের এসব কান্ডে না হেসে পারে না ঈশা।শুরু হয়ে যায় দুজনের এলোমেলো নাচ বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা দুজনের বৃষ্টির গতি বাড়লো।আচমকা অন্ধকার আকাশটায় বিজলি চমকে উঠলো ঈশা বুঝতে পারলো এখনি বাজ পড়বো তাই দ্রুত হাত ঈশানকে ছেড়ে রাস্তার পাশে একটি দোকানের ছাউনিতে চলে গেল।অপরদিকে ঈশান ঈশার এমন দৌড়ের কারণ বোঝার আগেই বিকট শব্দে বজ্রপাত হয় ঈশান নিজেও ভয়ে আঁতকে উঠে।ঈশার পালিয়ে যাওয়ার কারণ এবার বুঝলো ঈশান তাতে মনে মনে হাসলো সে।কপট রাগ দেখিয়ে চিৎকার করে বলে,

” ঈশা তুমি আমায় সারাজীবন পাশে থাকার কথা দিয়েছিলে অথচ এখন বিজলি দেখেই ছেড়ে গেলে।”

” আপনার শরীরে তো কারেন্ট বেশি বলেছিলাম আজ বের না হতে এবার থাকুন রাস্তায়।ইচ্ছে করে দৌড় দিয়েছিলাম।কথায় আছে না চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।”
১১৮.
লিজার জেল জীবনের ছত্রিশ তম দিন আজ।
আর আজকে তার সাথে সিড দেখা করতে এসেছে।সিডের ভাব পরিপাটির ধরণ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা ভীষণ আনন্দে আছে।লিজা যেন হারানো বৈঠা ফিরে পেয়েছে তার উদ্দেশ্যহীন নৌকার বৈঠা তো সিড।অথচ ছেলেটা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।একজন মানুষের দুটো রূপ ভীষণ কাছ থেকে দেখেছে লিজা এক ভালোবাসার আর দুই ঘৃণার।সিডের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা খুঁজে পায় না সে।রহস্যময় যে চোখে ছিল ভালোবাসার জোয়ার সেই চোখে এখন ঘৃণার গহীন খাদ।

” কেমন আছো লিজা?”

” তুমি ভালো আছো?তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো।”

” খারাপ থাকার কোন কারণ নেই আমার জীবনে।”

” আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না সিড?বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ধোঁকা দিতে চাইনি আমিও ভালোবেসেছি ত…”

” দয়া করে চুপ করো।ভালোবাসা তোমার কাছে যতটা সহজ আমার কাছে ততটা নয়।আমি একবার ভুল করেছি আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়বার একই ভুল আমি আর করবো না।আমি আবার প্রেমে পড়বো, ভালোবাসবো।আমি এক পবিত্র আত্মাকে ভালোবাসবো যার মন আমি ছাড়া অন্য কেউ দখল করতে সক্ষম হয়নি।আমি এমন কাউকে ভালোবাসবো যার দেহের প্রতিটি ভাজে ভাজে আমার স্পর্শ থাকবে।সে দশ পুরুষের কাছে মন,শরীর না বিলিয়ে এক পুরুষের কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে।”

” তোমার প্রতি আমার অনুভূতি মিথ্যে নয় সিড।”

” এসব রাখো আমার এখন এসব শুনলে হাসি পায়।তবে যত যাই বলো আর করো তোমার নিস্তার নেই।আমি এমন ব্যবস্থা করবো অন্তত এই বন্ধী জীবনে যৌবন ফুরিয়ে যাবে তোমার।এই সিডকে ধোঁকা দিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ পার পায়নি।”

সিডের নিষ্ঠুর দু’চোখ দেখছিলো লিজা।এই চোখে সে ভালোবাসা দেখেছে,মায়া দেখেছে আর আজ শুধুই ঘৃণা নিষ্ঠুরতা!

সিড জেল ছেড়ে চলে গেল।তার চোখ ভাসছে নোনাজলে।
সিড ভেবে রেখেছিল লিজার সাথে এটাই শেষ দেখা আর কখনোই এই বেইমান মেয়েটার সঙ্গে সে দেখা করবে না।কিন্তু তার এই কথা যে সত্যিতে পরিণত হবে কে জানতো?তারপর দিন সকাল সকাল খবর এলো লিজা নাকি গত রাতে আ ত্ম হ ত্যা করেছে।ধারালো কিছুর সাহায্যে হাতে,পায়ের রগ কেটেছে প্রচন্ড রক্তক্ষরণে দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেছে মেয়েটার।খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল সিড পরাজিত সৈনিকের ন্যায় হাটু মুড়িয়ে বসে আচমকা দেহের সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো নাকের ডগায় গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।সেই বিশ্বাসভঙ্গকারী অকৃতজ্ঞ মেয়েটাকে সে এখনো ভালোবাসে।
#চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here