#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
– ‘এত দেখিস না প্রেমে পড়ে যাবি।’
জয়ের লাগামছাড়া কথা শুনে রুহির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে পড়ছে। ছেলেটা একটার পর একটা উদ্ভট কথা বলেই চলেছে, ওর পক্ষে এইখানে দাঁড়িয়ে এইসব কথা শোনার সময় নেই। তাই জয়কে ধাক্কা দিয়ে পেছনে কিছুটা সরিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। রুহির কান্ডে জয় মুচকি হেসে কিছুটা জোরেই বলল,
– ‘আপ্যায়ন করার জন্য রেডি হ। আমি আসছি।’
রুহি জয়ের উ’দ্ধার করতে করতে বাড়ি ফিরে গেল। ছেলেটা কবে থেকে এইরকম হয়ে গেল কে জানে! অনেকটাই অবনতি হয়েছে, সবটাই প্রেমে পড়ার ফল।
**
জয়কে আপ্যায়ন করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে। যতসব আদিক্ষ্যেতা! রাগে রুহির মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এত নাটক দেখতে দেখতে বিরক্তের পাহাড় জমছে।
– ‘জয় বাবা তোমার আর কিছু লাগবে।’
– ‘না আন্টি আর কিছু লাগবে না।’
– ‘না মা ওকে আর একটু দাও। আমাদের সবার রান্না ওকে একাকেই খাইয়ে দিলে আবার বলছো কিছু লাগবে কিনা!’
– ‘এই তুই চুপ করবি।’ (ধমক দিয়ে)
– ‘হ্যাঁ আমাকেই ধমক দাও। ধ্যাত ভালো লাগে না।’
রুহি খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেল। রুহির মা পেছন থেকে অনেকবার ডাকার পরেও রুহি সাড়া দিলো না। জয়ের মনটা খারাপ হয়ে যায়, ওর কারনেই রুহি খাবারটা শেষ না করেই চলে গেল। জয় তাড়াতাড়ি করে খাওয়া শেষ করে রুহির মাকে বলল,
– ‘আন্টি আমি রুহির খাবারটা নিয়ে ওর রুমে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না, ওকে আমি ঠিক খাইয়ে দেবো।’
রুহির মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– ‘তুমিই আমার ভরসা। দ্যাখো ঘাড়ত্যা’ড়ামি সারাতে পারো নাকি।’
– ‘পারতে তো হবেই।’ (শয়তানি হেসে)
রুহি ঘরে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে চলেছে। আসার পর থেকে জয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ঘটনাগুলো বারবার মনে পড়ছে। এইভাবে এইখানে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়, দাদু কিছুটা সুস্থ হলেই আবারো ফিরে যাবে।
– ‘রুহু।’
সেই চেনা কন্ঠস্বর, সেই চেনা ডাক। রুহি পেছন ফিরে তাকাল না। বিরক্তি নিয়ে বলল
– ‘দেখুন আমি কোনো সিনক্রিয়েট চাই না। প্লিজ চলে যান এখান থেকে।’
– ‘তুই আগে খেয়ে নে। তারপর আমি চলে যাবো।’
– ‘আমার খিদে নেই।’
– ‘আচ্ছা তোর রাগ আমার উপরে আমাকে রাগ দেখা, কিন্তু খাবারের উপরে কেন দেখাচ্ছিস?’
– ‘আমার ভালো লাগছে না। আপনি প্লিজ যান।’
জয় খাবারের থালাটা রেখে দিয়ে রুহির হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরাল। রুহির হকচকিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাচ্ছে, জয় শান্ত কন্ঠে বলল,
– ‘আমি কি এতটাই বড়ো কোনো অপরাধ করেছি যার জন্য এতগুলো বছর ধরে শা’স্তি দিয়ে চলেছিস? আমার অপরাধের কি কোনো ক্ষমা নেই!’
– ‘না নেই।’
শান্ত দৃষ্টি, সরল কন্ঠ জয় আর কিছুই বলতে পারল না। হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
– ‘পারলে খেয়ে নিস।’
জয় আর দাঁড়াল না বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল। রুহি জয়ের যাবার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– ‘সত্যিই কি আমার অনুপস্থিতি জয়ের জীবনে শা’স্তি স্বরূপ!’
**
জয় বিষ’ন্ন হয়ে বেলকনিতে বসে আছে। মনটা ভীষন রকমের খারাপ কি করেছে এমন যার জন্য রুহি ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো! এতবছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিলো! জয় নিজের অতীতে ডুব মারল। কতই না রঙিন ছিল দিনগুলো। হাসি,মজা, আনন্দ সবকিছু নিয়ে ওদের ফ্রেন্ডশিপ সবার থেকে বেস্ট ছিল।
অতীত,
– ‘আমাকে ধরতে পারে না,ধরতে পারে না।’
– ‘রুহুর বাচ্চা দাঁড়া একবার। তোকে ধরতে পারলে না, একেবারে শেষ করে দেবো।’
– ‘আগে তো ধরে দেখা।’ (ভেংচি কেটে)
– ধরতে পারলে খবর খারাপ করে ছাড়বো দেখিস।
– হু।’ (আবারো ভেংচি দিয়ে)
গোটা স্কুলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে জয় আর রুহি। এই দূটো বড়ো হয়ে গেলেও ওদের দুষ্টুমি বাচ্চাদেরকেও হার মানাবে। স্কুলের ছোট বড়ো সকলেই ওদের বন্ধুত্বটাকে এনজয় করে, ওদের বন্ধুত্বটা সকলের নজর কাড়তে বাধ্য করে।
রুহি দৌড়াতে দৌড়াতে হোঁচট গিয়ে পড়ে গিয়ে গাল ফোলায়। জয় দৌড়ে এসে ওকে আগলে নিয়ে বলল
– ‘দৌড়াতে বারন করেছিলাম দেখলি তো কি হলো।’
– ‘সব তোর জন্য।’
– ‘যা বাবা আমি কি করলাম?’ (কিছু না বুঝে)
রুহি জয়ের মাথাতে চাঁটি মেরে দৌড় লাগায় জয় হেসে ফেলল রুহির বাচ্চামো দেখে। ঘরে বাইরে দুই জায়গাতেই রুহি আর জয় বেস্ট ওদের বন্ধুত্ব বেস্ট। জয় পড়াশোনায় খুব ভালো আর রুহি আঁকায়। ছোট থেকে যখনি রুহি আঁকতে গিয়ে কোনো জায়গায় আটকে যেতে জয় ঠিক করে দিত।
– ‘এতদিন ধরে আঁকছিস তবুও এখনো ভুলটা আমি শুধরে না দিয়ে হয় না।’
– ‘জানিসই তো তুই ছাড়া আমার আঁকা গুলো কিরকম একটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।’
– ‘বেশি ঢং। (মাথাতে চাঁটি দিয়ে)
– ‘এই মা’রলি কেন?’
– ‘মা’রলাম যাতে পরের বার নিজের ভুলটা নিজেই ধরতে পারিস।’
– ‘কেন তুই আছিস তো।’
– ‘সবসময়ে কি আমি থাকব নাকি।’
– ‘এইভাবে বলছিস কেন।’
– ‘ঠিকই তো বলছি। মানুষ কি সারাজীবন থাকে নাকি।’ (মুচকি হেসে)
– ‘এইভাবে কখনো বলবি না আমার কষ্ট হয়।আর তুই যতদিন আছিস ততদিন আমার ক্যানভাস আছে বুঝলি।’ (জয়ের হাত আঁকড়ে ধরে)
– ‘পাগলি মেয়ে সবাই সবার পাশে আজীবন থাকে না, নিজেরটা নিজেকেই দেখে নিতে হয়।’
রুহি গাল ফোলাল আজকে জয় বড্ড বড়ো বড়োকথা বলে চলেছে। বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘আজকে বড্ড বড়োদের মতো কথা বলছিস। এইরকম করলে আমি আড়ি নিয়ে নেব।’
– ‘আচ্ছা সরি আর বলবো না। তুই আঁকায় মন দে।’
– ‘হুমম। দেখবি জয় একদিন আমি অনেক বড়ো হবো, সবাই আমাকে বলবে তোমার সাফল্যের পেছনে কে আছে তখন আমি কার নাম বলবো জানিস।’
– ‘কার নাম আবার, বাবা মা ড্রয়িং টিচারের নাম।’
– ‘না সবার প্রথম তোর নাম বলব।’
– ‘কেন?’
– ‘কারন তোকে ঘিরেই তো আমার সবকিছু, বুঝলি গাধা।’
– ‘না আমার এত বুঝে কাজ নেই। তাড়াতাড়ি আঁকা শেষ কর পড়তে বসতে হবে ।’
– ‘দূর ভালো লাগে না পড়াশোনা।’
– ‘সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা না পড়লে ডাব্বা মা’রবি। তাড়াতাড়ি ওইটা শেষ কর।’
চলার পথে যতবার রুহি আটকে গেছে, থমকে গেছে ততবারই জয় ওকে সামলে নিয়েছে। যত্ন করে আগলে ভুলগুলোকে ঠিক করে দিয়েছে তাই তো দিনে দিনে জয়ের প্রতি রুহির দূর্বলতা বাড়তেই থাকে। তবে সেইসব কে কখনোই পাত্তা দেয়নি, দুজনে দুজনের বেস্টফ্রেন্ড হিসাবেই থাকতে চেয়েছিল।
স্কুল লাইফ পেড়িয়ে কলেজে লাইফে আসে। সেইখানে অনেক নতুন বন্ধুবান্ধব তবে রুহি আর জয়ের সম্পর্কটা ছিল নজর কাড়া, সকলেই মুগ্ধ হতো ওদের বন্ডিং দেখে।
সবকিছু ভালোই চলছিল কিন্তু তার মাঝে হঠাৎ করেই তৃতীয় ব্যক্তির আগমন তারপরেই সব শেষ!
#চলবে….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসসালামু আলাইকুম।