#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_৬
কখনো তাসরিফের ভালোবাসার বেড়ি ভেঙে, শাসন ডিঙিয়ে এভাবে একা বেরোনো হয়নি ফাইজার। রিকশা চকল নামিয়ে দিয়েছে রেল স্টেশনে। বুকে দুরুদুরু ভাব। চোখে কান্নার তাজা ছাপ। এহেন দশায় ফাইজা টিকিট কাউন্টার হতে টিকিট কাটলো। বাস হলে বড্ড ভালো হতো কিনা একথা বোঝেও না ফাইজা আর অনুমানও করতে পারছে না। চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে কখনো বাসে বা ট্রেনে করে যাওয়া হয়নি। শুধুই তাসরিফের পাশে বসে ভাবনা চিন্তা ছুড়ে ফেলে প্রাইভেট কারে যাওয়ার হয়েছে। ফাইজার মন বড্ড কাঁদছে। বড্ড তড়পাচ্ছে। এ কেমন অধ্যায় এলো জীবনে। প্রতি পদক্ষেপে যার ছায়া ছিল পাশে আজ সে বহু দূরে। কখনো কি আর তার সাথে পূর্বের সেই সময় গুলো পার করা হবে? হবে না। হওয়া সম্ভব না। এক আকাশ ঘৃণা, একটা ভালোবাসার ভাঙা মহল, বিশ্বাসের উপড়ে পরা খুটি নিয়ে আবারও তার পানে ছুটে যাওয়া কোনো জেদি, তেজি, আত্ম সম্মানী মেয়ের পক্ষে সম্ভব না। ফাইজা ভাবনার মাঝে হাতের ফোনটা অন করলো। জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো বেলার প্রহর। চারটা বাজতে চলল। ট্রেন আসবে বিকেল পাঁচটায়। অগত্যা বসে থাকা হীনা কোনো কাজ নেই। ফাইজা আকাশ পানে চাইলো। বৃষ্টির আগাম বার্তা হিসেবে ঘন কালো মেঘ অস্থির চিত্তে ছোটাছুটি করছে। পশ্চিমে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে তারা। ফাইজার মা আগে বলতো, পশ্চিমে মেঘ যাওয়া মানে ঘন বর্ষণ হওয়া। বাবা মজা নিতে মায়ের সাথে কথার প্যাচ লাগাতো। ছোট ফাইজা টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শ্রবণ করতো, ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বাবা-মায়ের মাঝে বসে তাদের মিষ্টি ঝগড়া উপভোগ করতো। তখন সাদ মাত্র দুধভাতের বাচ্চা। ফাইজার মা-বাবা ছিলেন সমবয়সী জুটি। একসাথে এক ভার্সিটিতে পড়ালেখা। অতঃপর অজ পাড়া গায়ের ফাইজার বাবাকে পুরোদস্তর শহুরের ভাবওয়ালী মেয়ের বিয়ে করা। পালিয়ে বিয়ে। গোপনে সংসার। ঢাকার বিলাশবহুল বাসা ছেড়ে টিনের দোচালা ঘরে শান্তি কুড়ানো তার। মায়ের কি বড্ড কষ্ট হয়েছিল? ফাইজার হঠাৎ প্রশ্ন জাগে মনে। এরপরই উঁকি দেয় মা হারানোর কষ্ট। অতঃপর হুমড়ি খেয়ে পরে সমঝোতা নিয়ে সকল দুঃখ। ফাইজার চোখ বেয়ে আবারও জলের ধারা। বুক ভাঙা আর্তনাদ একের পর এক ঢাকা পরতে লাগলো বুকেরই মধ্যে। আজ ফাইজা শুধু দুঃখ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। মা নেই। সব ভুল যেন মায়েরই। কেন সে এতো দ্রুত চলে গেছে। আজ যে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে মায়ের বুকে মাথা রাখতে। ফাইজার যে একটা আসন দরকার। মা নামক আসন। যে আসনের বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে বসে হাউমাউ করে কাঁদা দরকার। অভিযোগ করা দরকার। প্রশ্ন তোলা দরকার। বলা দরকার
” ও মা, পৃথিবীর সব পুরুষই কি এমন? এরা কেন এমন মা? তাসরিফ কেন এমন করলো আমার সাথে? নারী কি সত্যিই এতো অসহায়? কেন নারীকে এতো অসহায় ভাবা হয়? একটা বাচ্চার জন্ম না দিতে পারলে কেন একটা মেয়েকে এতো কথা শুনতে হয়? তাহলে কি তাসরিফ সত্যি করে কখনো আমাকে ভালোবাসে নি?”
নোনাপানি চোখে ছুটে এলো ফাইজার। নিজেকে সামলানো বড় দায় হলো। তবুও সামলে নিলো। একটু আড়াল হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে চোখের পানি মুছে ফেলল শাড়ির আঁচলে। আজ বাড়ি ফেরা হচ্ছে। বাবা, সাদ সবাই আছে। কিন্তু আসল মানুষটাই নেই। যাকে দ্বিধা ছাড়া বলা যেতো সকল কথা।
.
প্লান্ট ফর্মে দাড়িয়েই ফাইজার কেটে গেলো একটা ঘন্টা। ট্রেনের আগমন হলে উঠে পরলো ফাইজা। তার আসন খুঁজে বসে পরে প্রথমেই ফোন করলো ভাইটার কাছে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে গাঢ় রাতের বিস্তার থাকবে। গ্রামের শুনশান পথ ধরে বেশ খানিকটা হাটলে তবেই পাওয়া যাবে বাড়ি।
— এই যে শুনতে পাচ্ছেন?
অতিশয় ব্যাস্ত ফাইজা ধেয়ে আসা গোধূলির এই অবেলায় মুখ তুলে চাইলো অচেনা কন্ঠস্বর পেয়ে। বড্ড নিরীহ তার চাহনি। আগন্তুক স্যাম বর্ণের। ঝাপসা তার মুখখানা ঘন কালো মেঘ ও গোধূলির মলিন আলোর দরূণ। ফাইজা জানতে চাইলো সরল সুরে
— আমাকে বলছেন?
আগন্তুক একটু ঝুঁকে তার মুখের দর্শন দিলো। তাও স্বইচ্ছায় নয়। পকেট হতে একটা কাগজের টুকরো বের করে ফাইজার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ফাইজা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। তবে তার ধারণা হলো কিছু একটা। হঠাৎই চটজলদি বসা থেকে উঠে দুঃখ আর আফসোসের মিলন মেলা গড়ে তুলে বলল
— সরি। আমি হয়তোবা সিট খুঁজতে ভুল করেছি। আমি বুঝিনি এটা আপনার সিট। এটা আমার না নিশ্চয়ই। সরি সরি।
এক হতে ফোন, অপর হাতে ব্যাগ বাকি ফাইজার ভূমি ছুঁই ছুঁই করে পরা শাড়ি। হন্তদন্ত হয়ে উঠে হুড়মুড় করে চলতে যাওয়ার পথে ফাইজা আচমকাই পরতে বসলো। তবে তৎক্ষনাৎ সামলাতে গেলো নিজেকে। সামলে নিলো বটে। তবে ছুটে গেলো তার হাত থেকে ফোন। এলোমেলো, মনে আঘাতপ্রাপ্ত ফাইজা যেন সত্যিই হয়ে গেছে ছন্নছাড়া। কাব্য তড়িৎ গতিতে বাচিয়ে নিলো ফোন। তার বড্ড শখের জিনিস এই ফোন। হোক নিজের বা অন্যের। এর ক্ষয়, ব্যাথা কাব্যর হার্টের অসুখ বাধিয়ে ছাড়তে পারে।
— আপনি ঠিক আছেন?
বিরক্তিকর ছিটেফোঁটা সহিত শুধানো বাক্য। ফাইজা নত দৃষ্টিতে নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে বলল
— হ্যা।
কাব্য পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার পরখ করলো ফাইজাকে। ধারণা হলো, ফাইজা দেখতেও বোকা বোকা, চলনেও বোকা, কথাতেও বোকা, মোট কথা সুন্দরী মেয়েরা যে বোকা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ফাইজা।
— আপনি বসা থেকে উঠে পরলেন কেন?
ফাইজার এবার যেন একটু টনক নড়লো। এ কেমন প্রশ্ন করলো মানুষটা।
— ওটা আপনার সিট তাই আমি….
— কে বলল ওটা আমার সিট?
ফাইজা অবাক হলো। চোখের দৃষ্টিতে নেমে এলো অবুঝ ভাব। আবার খানিকটা রাগ, বিরক্তিও জরো হলো মনে।
— আপনার সিট না হলে বিরক্ত করলেন কেন আমাকে?
বেশ জোরালো কন্ঠ ফাইজার। ছেলেটা কি মজা নিচ্ছে তার সাথে। অপরিচিত এক মেয়েকে একা পেয়ে ঠাট্টা করতে এসেছে? ফাইজা ক্ষুব্ধ হলো। অসহায় ভাবে নকি মেয়েদের? কাব্য ভরকে গেলো। ঠিক বোকা নয় মেয়েটা। আবার এমন চাপা উগ্রবাদী কণ্যাকে কি চালাক বলা যায়? মাথায় ধরলো না কাব্যর। সে আলগোছে হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো ফাইজার দিকে। তার বন্ধু আদ্র বলেছিল নারীর সাথে ঝামেলায় জড়াতে নেই। নারী মানে দু লাইন বেশি বোঝার ব্যাপার স্যাপার। বাঁকা স্বভাবের কারবার। কাব্য পিছু হটলো। থাক, এ নারী একাই থাক। তার পূরণ হয়ে গেছে জানালার পাশে বসার সাধ। এমন কি ইচ্ছে হারিয়ে গেছে এই নারীর পাশের সিটে বসে ঘন্টা চারেকের রাস্তা পাড়ি দেওয়ার। একবার ক্ষেপেছে মানে আগামীতে অহেতুক ক্ষেপে যাবে। পাছে না এমন হয় মান সম্মানে ধুলোবালি জমে। ভরা ট্রেনে চিৎকার, চেচামেচি করে।
কাব্য দূরে সরলো। ঝামেলা তার বড়ই অপছন্দ। ওই জিনিসটা কাঁদা। গায়ে মাখতে চায় না সে। তাইতো চলতি ট্রেনে কষ্ট সইয়ে ঝুলে ঝুলে যাত্রা শুরু করলো গন্তব্যে। বগিতে ভরপুর মানুষ। সকলেই নিজ নিজ আসনে ছিলো। কেবল সেই আপন আসন ছেড়ে ঝুলে আছে এখানে।
চলবে….