শতদলের_ভীরে #পর্ব_২ #মুসফিরাত_জান্নাত

0
510

#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_২
#মুসফিরাত_জান্নাত

“অসম্ভব এ বিয়ে আমি কিছুতেই করতে পারব না।”

প্রতিবাদ করে ঐশী।অবাক নয়নে তাকায় তার ভাবী শায়লা খাঁন।

“এসব কি বলছো ননদিনী!এ ছেলে তোমার পছন্দ নয়?”

চট করে জবাব দেয় সে,

“না।”

কিছু স্বর্নের গহনা সমেত সবেই রুমে প্রবেশ করছিলেন রাহেলা বানু ।প্রবেশ পথে কন্যার কথা কানে বাজতেই চেতে ওঠেন।

“গর্দভের বাচ্চা!এতো ভালো ছেলে কারো অপছন্দ হয়?সব ছেলেতেই তোর সমস্যা।পছন্দটা কাকে তোর একটু বলবি আমাকে?”

মায়ের ঝাঁঝালো গলায় বিরক্ত হয় সে।

“ঠিকই বলেছো।আমি গর্দভের বাচ্চা।আর গর্দভটা তোমরা।উনি আমার শিক্ষক হন আম্মু।আর নিজের শিক্ষকের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছো? শোনো, শিক্ষক পিতার সমতূল্য।পিতৃতূল্য শিক্ষককে জামাই মানতে বলছো!এই তোমাদের শিক্ষা?”

সাদাত ঐশীর শিক্ষক শুনে চমকানোর কথা থাকলেও চমকায় না রাহেলা বানু।ব্যাপারটা তাদের অজানা নয়।কিন্তু শিক্ষক ছাত্রীর মাঝের প্রতিবন্ধকতার বিষয়টা একটু ভাবিয়ে তোলে তাকে।মেয়ের যুক্তিতে কিছুটা নত হন তিনি।বিছানায় গহনার বাক্স রেখে কন্যার পাশে বসেন।
মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শাণিত কন্ঠে বোঝান,

“এটা খুব একটা গুরুতর ব্যাপার না মা।শিক্ষক ছাত্রী প্রণয়ে সমস্যা, পরিণয়ে নয়।ইসলামি শরীয়ত মতে গায়রে মাহরাম যেকোনো নর নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।আর ইসলামি শরীয়তের উপর আমাদের কোনো যুক্তি খাটে না।তাছাড়া বৈবাহিক সম্পর্ক মানে তো আর একে অপরের প্রতি সম্মান ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া না।বিয়ের আগেও সে যেমন তোমার সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখতো বিয়ের পরও রাখবে।ওকে সম্মান দিবে,দৃষ্টি নত রাখবে,সব কথা শুনে চলবে।দেখবে সব ঠিক থাকবে।শুরুতে দুজনের মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগলেও সম্পর্ক খারাপ চলবে না।”

“শিক্ষক ছাত্রী পরিণয়ে সমস্যা না হলেও দৃষ্টিকটু আম্মু।আর এ সমাজের দৃষ্টি কটু কিছু আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়।নিজেদের রেপুটেশনে দাগ লাগার ভয়ে বিয়ে দিচ্ছো মেনে নিলাম।কিন্তু নিজেদের স্বার্থ হাসিলে আমার রেপুটেশনে দাগ লাগিও না।একটু দয়া দেখাও আমার প্রতি।”

বিরক্ত হয় রাহেলা বানু।কপাল কুঁচকে বলেন,

“তোমরা তো নিজেরা সিদ্ধান্ত নেও নি।বরং উভয় পক্ষের পারিবারিক সিদ্ধান্ত থেকে বিয়ে হচ্ছে।তাহলে তোমাদের রেপুটেশনে দাগ লাগবে কেনো?”

“কিন্তু আম্মু…”

কিছু একটা বলতে মুখ খোলে ঐশী।কিন্তু তাকে থামিয়ে দেন রাহেলা বানু।কড়া গলায় বলেন,

“আর কোনো বাহানা শুনতে চাচ্ছি না আমি।হাতে অনেক কাজ আমার।সাজা শেষে এই গহনা কয়টা পড়ে নিও।”

অসহায় দৃষ্টি মেলে ঐশী।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“আমি কোনো শিক্ষক বিয়ে করব না আম্মু।”

তার সে কথা রাহেলা বানুর কান অবধি পৌঁছে না।তার আগেই প্রস্থান করেন তিনি।হতাশ হয় ঐশী।সেদিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে শায়লা খাঁন।

“বিয়েটা করলে কিন্তু লস হবে না ননদিনী।পড়াশোনায় ভালো গাইড পাবে।প্রথম বর্ষে যে দুই সাবজেক্টে ফেইল করছো,সেটায় পাশ করতে পারবে।তারচেয়ে বড় কথা ফেল্টুস এর খাতা থেকে নিজের নাম মুক্ত করতে পারবে।”

শায়লা খাঁন কথাগুলো রসিকতা করে বললেও বুঝে আসে না তার।মাথা ভর্তি সকালের ঘটনার বিচরন।সব কিছুই এখন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মিনমিন স্বরে সে বলে,

“বিয়েটা হলে পড়াশোনায় সবুজ বাত্তি জ্বলবে কি না জ্বলবে তা জানি না।তবে হলফ করে বলতে পারি বিয়েটা হলে আমার জীবনের লাল বাত্তি জ্বলবে।”

_______
তখন থেকে হাসফাস করে যাচ্ছে ঐশী।বিয়েটা আটকানোর কোনো ফন্দিই আটতে পারছে না যেন।কারো কাছে সাহায্য চাইবে সে উপায়ও নেই।কেও তার কথায় পাত্তাই দিচ্ছে না।যার যার কাজে ব্যস্ত সবাই।অগত্যা ভারী মুখে বসে রয়েছে সে।পার্লার থেকে লোক নিয়ে আসা হয়েছে।ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হলেও আয়োজনে কমতি রাখতে চায় না আনোয়ার খাঁ।আজকের দিনটা তার মেয়ের জন্য স্পেশাল।এই দিনটা সারাজীবন ক্যামেরা বন্দী থাকবে।তাই সাজের ক্ষেত্রেও আপোষ চলবে না।টাকা বাড়িয়ে পার্লার থেকে লোক আনা হয়।ছেলে মন মতো হওয়ায় বাড়াবাড়িও চলছে বেশ।এসব দেখে ভীষণ গা জ্বলছে ঐশীর।কি দরকার এসবের।সে কি খুব বেশি যন্ত্রণা দিয়ে ফেলেছিলো তার বাবা মাকে?একদিন না হয় একটু রুটিন এলোমেলো করেছে, তাতে কি এমন হয়েছে,ভেবে পায় না ঐশী।মনে মনে শ খানেক বকা দেয় সবাইকে।আর বাকি অর্ধেক বকা দেয় সাদাতকে।কেন সে বিয়েতে মত দিলো?সে অমত করলেই তো বিয়েটা হতো না।রাগে,দুঃখে সাদাতের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলে ঐশী।কিন্তু সাদাত বেচারারই বা দোষ কিসে।সে কি জানে যাকে বিয়ে করতে চলেছে সে তার স্টুডেন্ট। ভার্সিটিতে ঐশী মাস্কসহ হিজাব পড়া ছিলো বিধায় মুখ শনাক্ত করতে পারে নি সে।উপরন্তু ঐশী প্রথম দেখায় চোখে আটকানোর মতো সুন্দর হওয়ায় তাকে রিজেক্ট করার প্রশ্নও আসে নি।এছাড়া সব তো পরিবারের সিদ্ধান্তেই হচ্ছে।তবে তার অমত কিসে!

_____
তপ্ত পরিবেশ।সারাদিনের খাঁ খাঁ রোদ্দুরের তাপ শোষণ শেষে সমস্ত উত্তপ্ততা রাতে ছড়িয়ে দেওয়া অসভ্য ইট সিমেন্টের স্থাপনার গন্ডিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে ঐশী।এর মাঝে ভারী শাড়ি, গহনা পড়ে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার।মুখে ভারী মেকআপের আচর আঁকছে পার্লারের মেয়েগুলো।মাথার উপর ইলেকট্রনিক পাখা অনবরত ঘূর্ণায়মান।তবুও স্বস্তি পাচ্ছে না কেউ।কৃত্রিম হাওয়াও কোনো অংশে কম গরম ভাব ছড়াচ্ছে না।মাথার চিন্তা ও পরিবেশের গরমে নাজেহাল ঐশী।মেয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে আবারও ঘরে ঢোকেন রাহেলা বানু।রান্না ঘরের ব্যস্ততায় ঘর্মাক্ত শরীরে ফ্যানের হাওয়া গায়ে লাগতেই স্বস্তি ভাব ফিরে পান।শাড়ির আঁচলে গলার ঘাম মুছে মাত্রই বিরক্ত হয়ে বলেন,

“উফ কি গরম!”

ওমনি খপ করে কথা কেঁড়ে নেয় ঐশী।কথার চেইন টেনে বলে,

“ওইত্তো মানুষ মা’রা গরম।এমনি গরমে কুলাতে পারছি না।তার মাঝে আবার বিয়ে জোড়াইছো।কি লাভ হবে আমার এখন বিয়ে করে!এত্তো গরমে কেও বিয়ে করে?”

মেয়ের এহেন কথায় হতভম্ভ হয়ে যায় রাহেলা বানু।গোল গোল চোখে তাকায় মেয়ের পানে।গুম গুম করে হেসে ওঠে পুরো ঘর।সম্বিৎ ফিরে পায় ঐশী।রাগের বসে বোকার মতো কেমন বেফাঁস কথা বলে বসেছে সে।লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে এখন।চুপটি মেরে যায় সে।আর একটি কথাও বলে না।লজ্জায়,আড়ষ্টতায় বিয়ে প্রতিরোধ করতেও ভুলে যায় যেন।

ঘন্টা খানেকের ব্যবধানে কাজী সাহেব আসেন।বিয়ে পড়ানো হয়।তবুও কোনো কথা বলে না ঐশী।এমনকি প্রতিবাদও করে না।তখনের লজ্জাটা এখনও বয়ে চলেছে সে।পালাক্রমে সব আয়োজন শেষ হয়।বরকে কন্যার পাশে বসানো হয়।রীতি অনুযায়ী একটি সু কারুকার্য বিশিষ্ট আয়না তাদের সামনে ধরা হয়।অধিকার প্রাপ্তির পর প্রথম বারের মতো একে অপরের দর্শন পাবে তারা।সাদাত হয়তো অনেক পূর্বেই আয়নায় দৃষ্টি রেখেছে।মায়াময়ীর সুশ্রী বদনে আটকেও গেছে হয়তো।কিন্তু চোখ মেলানোর সাহস পায় না ঐশী।কিছু সময় পর বয়োজ্যেষ্ঠদের অনুরোধে অবশেষে তাকায় সে।আয়নার ভিতর দিয়ে গম্ভীর এক জোড়া দৃষ্টি পতিত হয় তার দিকে।ভীতি জেঁকে বসে কন্যার চোখেমুখে।সাদাতের হটাৎ ভীতিগ্রস্থ চোখ দু’টোকে খুব চেনা লাগে।এটা কি সেই অসহায় দৃষ্টি? যা আজ সকালে সে দেখেছে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here