শতদলের_ভীরে #পর্ব_৩ #মুসফিরাত_জান্নাত

0
419

#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_৩
#মুসফিরাত_জান্নাত

ওই ভয়ার্ত দৃষ্টিকে সাদাতের খুব পরিচিত লাগে।মস্তিষ্কের স্মৃতি কোষে চাপ দেয়, চোখ দু’টোর মালিককে শনাক্তকরণে।ফলাফল শূন্য।আশেপাশের কলরবে মস্তিষ্ক যেন তাল হারিয়েছে।এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সে কন্যার পানে।না এই ভারী মেকআপে সজ্জিত চোখ দু’টোকে আগে কখনো দেখেনি সে,এর বেশি কিছু বোধগম্য হয় না তার।একজনের চোখে তীব্র ভয়,আরেকজনের সন্দিহান চাহনি।সদ্য বিবাহিত বর বউয়ের এমন মুহুর্ত পুর্বে কখনো দেখেনি কেও।একদম ইউনিক,আনকমন লুক আসে।সুন্দর এই মুহুর্তটি একাধিক ক্লিকে বন্দী করা হয় ক্যামেরায়।

সময় গড়িয়ে রাত্রী বাড়ছে।কন্যাকে এবার বরের হাতে তুলে দেওয়ার পালা।তার পূর্বে সকলের মাঝে সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য বৃদ্ধা,ঐশীর দাদীর কথায় বরের এঠো কন্যাকে খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়।এতে নাকি স্বামী স্ত্রীর মাঝে মিল মোহাব্বত বাড়ে।কথাটা শুনতেই ঐশীর বমি পায়।ফাইনালি তাকে এঠো জিনিসও খেতে হবে?তাও কিনা আবার একই গ্লাসের দুধ আর বরের খাওয়া মিষ্টি।মিষ্টি একটা লেভেলের হলেও এঠো দুধ খেতে ভীষণ আপত্তি ঐশীর।কিন্তু এতো মানুষের ভীরে মুখ ফুটে কিছু উচ্চারণ করতে পারে না।তার পূর্বেই একটা সিলভার রঙা স্টিলের ট্রেতে করে এক পিরিচ মিষ্টি ও এক গ্লাস দুধ আনা হয়।যা দেখেই গা গুলিয়ে ওঠে ঐশীর।এমনি ঘৃনা নামক বিষয়টা সর্বদা তার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।ঘৃনার অনুভতিতে তখনের লজ্জাজনক পরিস্থিতি মাথা থেকে হাওয়া হয়ে যায়।বর্তমানে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে।সাদাতের আধ খাওয়া মিষ্টির টুকরো নিজের মুখে দিয়ে গলাধঃকরণ করলেও,বিপত্তি বাধে দুধ খাওয়ানোর সময়।এঠো দুধ ঐশীর মুখে ধরার সাথেই উচ্চশব্দে সে ‘ওয়াক’ বলে ওঠে।হতভম্ব সাদাতসহ উপস্থিত সকলে।ঐশীর দাদী ফুলবানু রুষ্ট হন।চেতে গিয়ে বলেন,

“এ কেবা ব্যবহার বউমা?মেয়েরে কিছু শিখাও নাই?”

ঐশীর ঘৃনার ব্যপারে তার মা রাহেলা বানু বেশ ভালোভাবেই অবগত।কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ঐশীর আচরণে তিনিও বিরক্ত হন।তবুও মা বলে মেয়েকে ফেলতে পারেন না।বিষয়টিকে সামলে নিতে বলেন,

“আসলে কিছু মনে করবেন না আপনারা।দুধ ভীষণ অপছন্দ ওর।তাই এমন করে ফেলছে।…অল্প একটু মুখে দে মা।”

কিছু সময় থেমে থেকে শেষোক্ত বুলিটা ঐশীর উদ্দেশ্যে ছোড়েন তিনি।মায়ের সাপোর্ট পেয়ে আহ্লাদী হয় ঐশী।অসহায় মুখ করে বলে,

“দুধ না খেলে হয় না আম্মু?এমনি দুধ খাই না।তারউপর আবার আজকে খুব গ্যাস বাড়ছে আমার।”

কোনো কিছু খেতে অরুচি হলে এমন সাতপাঁচ বলে বুঝ দেয়া ঐশীর স্বভাব।অভ্যাসবসত এই ভরা বিয়ের আসরেও এমনটাই করে বসে সে।আবারও অস্থানে বেফাঁস কথা বলেছে বুঝতে পারে ঘরময় হাসির রোল পড়ায়।মাথা নুইয়ে ফেলে সে।হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহেলা বানু।এ কেমন মেয়ে পেটে ধরেছেন তিনি?এখন কি বলে বিষয়টা সামলাবেন?লজ্জায় মা’থা কা’টা যাচ্ছে তার।মুখ তুলে তাকান সাদাতের পানে।হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কন্যার দিকে চেয়ে আছে ছেলেটি।চলমান ঘটনাপ্রবাহে বেশ উশখুশ শুরু করে দেয় ঐশী।মেয়েটার বয়স হলেও নিতান্তই বাচ্চা স্বভাবের রয়ে গিয়েছে।ঐশীর লজ্জিত চেহারা দেখে সাদাতেরও হাসি পায়।নতুন বর জনসম্মুখে হাসলে বেমানান দেখায়।বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সে।নরম গলায় বলে,

“অসুবিধে হলে জোর করে খাওয়ার কিছু দেখছি না।মোহাব্বত মনের ব্যাপার,এঠো খাওয়াতে নয়।”

সম্মতি জানায় সকলে।হাঁফ ছাড়ে ঐশী।মুখ বেজার করে প্রস্থান করেন ফুলবানু।
_____
শেষবেলায় সাদাতের হাতের মুঠোয় পুরে দেওয়া হয় ঐশীর কোমল হাত।পুরুষালী স্পর্শ পেতেই কেঁপে ওঠে ঐশী।ঠোঁটের কোন প্রসস্ত হয় সাদাতের।মেয়েকে সাদাতের হাতে তুলে দিয়ে ধরা গলায় আনোয়ার খাঁ বলেন,

“মেয়েটা আমার অনেক শখের রত্ন বাবা।অতি যত্নে গড়া মোমের পুতুল।চাইলেই ভালোবাসার উত্তাপে গলিয়ে পছন্দসই আকৃতি দিতে পারবে।কিন্তু আঘাত করো না কখনো।অল্প আঘাতেই যে সে চুরমার হয়ে যাবে।”

পাশ থেকে রাহেলা বানু বলেন,

“সুখী হও দুজনে।এক সাথে সারাজীবন কাটাও।অনেক দোয়া রইল।”

চোখে তার টলমলে পানি।আনোয়ার খাঁর হাতের উপর আরেক হাত রাখে সাদাত।শাণিত কন্ঠে জবাব দেয়,

“আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আপনাদের মেয়েকে সুখে রাখার।আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।আমার দ্বারা কখনো কষ্ট পাবে না সে।”

হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছেন আনোয়ার খাঁ ।ঐশীর দিকে তাকান এক পলক।মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“বাবা-মা সবকিছু সন্তানের ভালোর জন্যই করে আম্মা।হটাৎ করে বিয়ে দিয়েছি বলে বাবাকে ভুল বুঝো না।ও বাড়ি সবার সাথে মানিয়ে থেকো।ভালো থেকো আম্মা।”

এই প্রথম বারের মতো ঐশীকে আম্মা বলে ডাকে আনেয়ার খাঁ।ওনার চোখেও প্রথম অশ্রু বর্ষনের দেখা পায় সে।তার প্রতি বাবার ভালোবাসা কতোটা গভীর উপলব্ধি করে সে।বুকের মাঝে হু হু করে ওঠে।চোখ ফে’টে অশ্রু আসে।নিজেকে সংযত করতে পারে না।আচমকা জড়িয়ে ধরে জন্মদাতা পিতাকে।একটু পূর্বেও কি না যার প্রতি আকাশসম অভিমান ছিলো,বর্তমানে সেই মানুষটার মাঝেই মিশে যেতে ইচ্ছে করে তার।হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন আনোয়ার খাঁ।উপস্থিত সকলের চোখে অশ্রু ভীর করে।ফুপিয়ে কেঁদে সে জবাব দেয়,

“আমি তোমাদের কখনো ভুল বুঝি না আব্বু।তোমরা আমার জীবনের সেই গাছ যা নিজেরা রোদে পুড়ে আমাকে ছায়া দিয়েছে।তুমুল বর্ষনে যারা ঠিকই ভিজেছে অথচ আমার গায়ে এক ফোটা পানি পারতে দেয় নি।তোমরা আমার জীবনের সেই অমূল্য রত্ন যা আমাকে কখনো প্রয়োজন,কোন অভাব অনুভব করতে দেও নি।না চাইতেও আমার কতশত প্রয়োজন পূরণ করেছো তোমরা।আমার সকল শখ পুরণের কারিগর তোমরা।যখন আমি পূর্ণ রুপে অসহায় ছিলাম,সেই জন্ম থেকে আমাকে লালন করেছো।নিজে কষ্ট করলেও আমাকে কষ্ট পেতে দেও নি।তোমাদের সিদ্ধান্তকে কি করে ভুল বুঝি বলো?”

আনোয়ার খাঁর চোখের কান্নার সাথে মন কেঁদে ওঠে।পাশে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল গুজে কাঁদছিলেন রাহেলা বানু।মেয়ের কথাগুলে শুনে প্রশান্তি অনুভব করেন।শত কষ্টেও বুক ভরে যায়।মেয়েকে তিনি সঠিক বুঝ দিয়েই মানুষ করেছেন।হটাৎ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মা’কে জাপ্টে ধরে ঐশী।

“কারণে অকারণে তোমাকে কতো জ্বালাতন করেছি আম্মু।রাগের মাথায় কতো কি বলেছি।তোমরা তো আমার জ্ঞানের উর্ধ্বে।তোমাদের জ্ঞানেরই ক্ষুদ্র একটা অংশ পেয়েছি মাত্র।এই জ্ঞানে ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।ভুল হলে ক্ষমা করো।”

“সন্তানদের ভুল পিতা মাতার মনে আটকে থাকে না মা।সন্তান বলেই তোর কোনো ভুল নেই।”

মেয়েকে বাহুডোরে তিনিও আগলে নেন।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।মাত্র তিনটা কবুল,এটাই যেন পর করে দিলো তার মেয়েকে।কেমন করে সে ক্ষমা চাচ্ছে।কন্যার কথা শুনে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে রাহেলার।প্রায়শ্চিত্ত স্বরুপ কিছুই করার নেই।মেয়ের কাধে মাথা গুজে সারা জীবন কাটাতে মন চাচ্ছে তার। অথচ নিরুপায় তিনি।মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তো আর এমন করলে চলবে না।নিজেকে কঠোর রেখে চোখের পানিতে তালা দেন।তিনি যদি এভাবে কাঁদেন তার মেয়ে ও বাড়ি গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারবে না।

শক্ত পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজ হাতে গাড়ি তুলে দেন কন্যাকে।ঘ্যাড়ঘ্যাড় আওয়াজ তুলে আপন গতিতে ছুটে চলে যান্ত্রিক বাহন।সেদিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।গাড়ির দুরত্ব বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায় তার কান্নার বেগ।গাড়িটি সম্পূর্ণরুপে চোখের আড়াল হলে গগন ফা’টিয়ে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।বুক পু’ড়ে ছাই হয়ে যায়।অসহনীয় যন্ত্রনায় কা’টা মুরগির ন্যায় ছটফট করেন।বুক চাপড়ে উচ্চশব্দে আল্লাহকে ডাকেন বারংবার।সেই শব্দে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস।থেমে যায় পাথুরে জীবন।নীড় হারা হয় বুনো পাখির দল।

সবাই সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে ওনাকে।বাড়ি ভর্তি লোকজন।অথচ সারা বাড়ি খাঁ খাঁ শূন্যতা দেখেন তিনি।চোখ বুলিয়ে দেখেন,বাড়ির প্রত্যেকটা সিমেন্ট কনায় লেপ্টে আছে তার মেয়ের স্মৃতি।মেয়েশূন্য এই স্মৃতির রাজ্যে এখন কি করে প্রবেশ করবেন তিনি?কলিজা যে চি’রে যাচ্ছে।মেয়েকে মানিয়ে নেয়ার উপদেশ দিলেও আদৌ কি তিনি পারবেন মেয়ের শূন্যতা মেনে নিতে?
_______
উত্তপ্ত নগরী।শহুরে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত চারিদিক।এর মাঝের রাস্তা বেয়ে শনশন করে গাড়ি চলছে।তার সমতালে বয়ে চলছে ঐশীর চোখে কান্নার দল।বাবা মা, নিজের চির পরিচিত আশ্রয়স্থলকে পর করে ফেলে আসার অসহনীয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে সে।বুকের মাঝে জ্বলা গনগনে আগুনের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে দু’চোখ বেয়ে।এতোটা অশ্রু হয়তো আগে কখনো ঝরায় নি সে।মেয়েদের এমন এক জীবন,যার অর্ধেকটা সময় কাটে বাবার সুখের সম্রাজ্যে।আর বাকি অর্ধেক সময় কাটে অন্যের রাজত্বে নিজের জায়গা তৈরী করতে।এক সময় সেই পরের ঘরটাই বেশি আপন হয়ে যায়।তবুও বাবা বাড়ির আক্ষেপ মিটে না।ঐশীর অন্তরে আজকে যে নতুন আক্ষেপের জন্ম হয়েছে তা আমৃ’ত্যু চলবে।বৃদ্ধা খুন খুনে বয়সেও বাবার বাড়ি যাওয়ার আশা জন্মাবে।কান্নারত মেয়েটাকে দেখে বড় মায়া হয় সাদাতের।স্বামী হিসেবে মেয়েটির মনের কষ্ট লাঘব করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।অধিকারপ্রাপ্ত স্ত্রীর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।মোহনীয় কন্ঠে বলে,

“আপনার কষ্টটা কেবল মাত্র দু’চোখ মেলে অনুধাবন করতে পারছি মিসেস সাদাত সরকার। কিন্তু অনুভব করতে পারছি না।এই কষ্টটা যুগ থেকে যুগান্তরে প্রত্যেকটা মেয়ে সহ্য করে আসছে।তাই সান্ত্বনা দিব না।আপনার চির অভ্যস্ত প্রশান্তি স্থলের জায়গা ত্যাগ করে আসছেন আপনি।তবুও আমার হৃদয় কি যথেষ্ট হবে না আপনাকে শীতল করতে?আপনার দিকে মেলে ধরা আমার হৃদয়ের পানে একবার তাকিয়ে দেখুন।আশা করছি ওই মায়া ভরা চোখ দু’টোতে কান্নারা ভীর জমানোর আর সাহস পাবে না।”

শত কষ্টের মাঝেও প্রশান্তি বয়ে যায় ঐশীর হৃদয়ে।নাহ তার বাবা মা তাকে অপাত্রে দান করেনি।কিন্তু সাদাত তো তাকে না চিনে এতো ভালো ব্যবহার করছে।যখন চিনবে তখন তার কি হবে?চিন্তা ভর করে ঐশীর মনে।মুখ তুলে তাকায় সুদর্শন পুরুষটির পানে।আচমকা মাথা ঘুরে ওঠে।দানা পানি না পড়া শূন্যপেটে এসির গন্ধে গা গুলিয়ে বমি আসে।হুট করে তা উগলে দেয় সাদাতের গায়ে।পুরো শরীর নোংরা হয়ে যায়।হতভম্ব সাদাত।এই তার বাড়িয়ে দেওয়া হৃদয়ের প্রতিদান?

চলবে

আগের পর্বের লিঙ্কঃ
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/826044622450645/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here