#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৪৩ অন্তিম]
_________________________
কথা ছিল শাস্তি শেষে অপরাধি মানুষটা একদিন না একদিন ফিরে আসবেই।হয়তো অতীতের ভুল নিয়ে অনুতপ্ত হবে ঠিক ভুলের যথার্থ বিচার করে পুনরায় নিজের জীবন সাজাবে।হায় আফসোস তা আর হলো কই।লিজার মৃত্যুতে সবাইকে
স্তম্ভিত করে দিয়েছে যাদের তার প্রতি ঘৃণা,বিদ্বেষ ছিল তারাও মৃত্যুর দিন সহানুভূতি দেখিয়েছে।আদরের ভাগনির মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি আবিদ প্রথম অবস্থায় তিনি ছিলেন বোবা প্রাণির মতো।মুখ থেকে তার টু’শব্দ বের হয়নি রক্তিম দু’চোখ আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন।ভাগনির শোক কাটিয়ে না উঠতে বোনের আধমরা অবস্থা নিয়ে ফের চিন্তায় পড়লেন।লিজার লা শ টা দেখে সহসা চেতনা হারান লিপি পরবর্তীতে ডাক্তার জানান তিনি স্টোক করেছেন।চিকিৎসা চলতে থাকে,লিপির শরীর উন্নতির পরিবর্তে ধীরে ধীরে অবনতি হতে যায়।একটা পর্যায়ে এসে বাম পাশ সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে যায়।মুখটা বেকে যায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করার জো নেই তার।এই অল্প কয়েক মাসে মানুষটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
১১৯.
সংসারটার ভার পড়েছে ঈশার কাঁধে।এতদিন যাবৎ রাসেল আর ঈশান তাদের ছোট্ট সংসার সামলে রাখলেও বিয়ের পর দুজনেই কেমন অলস হয়ে গেছে অফিস সামলে বাড়িতে এসে দুজনেই অলস হয়ে পড়ে।বাড়ির কাজের জন্য যথেষ্ট লোক রেখেছে ঈশান,কিন্তু দেখাশোনার দায়িত্বটা তো ঈশাকেই সামলাতে হয় অবশ্য অনুও এখন ধীরে ধীরে দায়িত্ব নিতে শিখেছে আগের মতো টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস থাকলেও সংসারটার প্রতি মায়া বেঁধে গেছে। তাদের পরিপাটি ছোট্ট সংসারে নিজেকে দক্ষ গিন্নি গড়ে তোলার চেষ্ঠায় আছে।
শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না ঈশার।এই কথা আবার ঈশানকেও বলা যাবে না যদি জানে কিছু হয়েছে তবে নিয়মিত ক্লাস করা পণ্ড করে ছাড়বে।সামনে পরিক্ষা আছে এতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলেও এখন থেকে পড়াশোনায় মনোযোগি হতে হবে।অবশ্য সে একাই পড়ছে না অনুকে কান ধরে টেনে এনে পড়তে বসিয়েছে।কিন্তু সে আর পড়ছে কই বসে বসে ঈশাকে নিয়ে গবেষণা করতে ব্যস্ত মেয়েটা।
” ঈশা আমার মন বলছে তুই প্রেগন্যান্ট।এই যে তোর মাথা ঘুরছে সব গন্ধ গন্ধ লাগছে এগুলো…. ”
” এমন চ ড় মারবো রাসেল ভাইয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়বি।তোকে কি করতে বলেছি আমি?”
” আমার সাথে বেশি রাগ দেখাবি না বলে দিচ্ছি, একবার যদি ঈশান ভাইয়ার কানে গিয়ে তুলি তুই অসুস্থ তবে দেখিস কি হয়।”
” শুরু হয়ে গেছে তোর ফায়দা তোলা।না পড়লে ভাগ আমাকে পড়তে দে।”
” ঈশু আমি সিরিয়াস একবার টেস্ট করে দেখতে পারিস।”
গতকাল অনুর এই কথাটা মনে ধরেছিলো ঈশার।তাই ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় প্রেগ্ন্যাসির কিট কিনে ফিরেছে সে।সারাটা বিকাল গেলো দ্বিধাদ্বন্দে ভয়ে ভয়ে টেস্ট করায়নি সে।এই মুহূর্তে বাচ্চার প্রেসারে পড়া মানে তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়া।পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া আর তো কয়েক বছর, পড়াশোনার একটা ধাপ চুকিয়ে তারপর না হয় বাচ্চার কথা ভাবা যাবে।তাছাড়া ঈশানটা হয়েছে এক আনাড়ি সে না ঈশাকে একা ছাড়বে আর না বাচ্চা সহ ঈশাকে সামলাতে পারবে।প্রেগ্ন্যাসির দশটা মাস কতটা সচেষ্ট থাকতে হয় তা কি ঈশান বুঝবে?
বিয়ের পর থেকে একটা রাতেও তাকে কাছ ছাড়া করেনি বাবার বাড়ি গিয়ে একা থাকার সু্যোগ হয়ে উঠেনি।
সবকিছু ভাবতে ভাবতে মনটা বিস্বাদে ভরে গেল ঈশার।আবার ভাবলো বিয়ের নতুন নতুন সবাই এমন থাকে পরে হয়তো পালটে যাবে।নিজেকে হাজার খানেক বুঝ দিয়ে তবুও কুল কিনারা পাচ্ছে না ঈশা।
ঈশার ভাবনা চিন্তার মাঝে আবির্ভাব ঘটে ঈশানের।ঈশাকে ভাবতে দেখে অস্থির উঠেছে সে।
“মন খারাপ কি হয়েছে?”
” ক..কই কিছু না।”
” তোমায় দেখে মনে হচ্ছে কিছু তো হয়েছে।”
” হয়েছে কি,নাকি না হয়েছে তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”
ঈশা চলে গেলো ওয়াশরুমে ঈশান ঈশার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না।অনেকদিন হয়েছে আগের মতো গেমস খেলা হয় না।তাই দ্রুত মোবাইল নিয়ে আরাম করে বিছানায় বসলো সে।কিয়ৎক্ষণ বাদে ঈশা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঈশানের সামনে কিটটা ধরলে সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকায় ঈশান।
” এটা কী?”
” কি মানে জানো না?”
” না সত্যি জানি না আগে দেখেছি বলে মনে হয় না।”
ঈশানের এমন কথায় ঈশা অল্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে।নিজের হাতটা কোলে রেখে অস্থির কণ্ঠে বলে,
” আমি প্রেগন্যান্ট ঈশান।”
” কি! কি বললে?”
” আমি প্রেগন্যান্ট,গর্ভবতী পোয়াতি,এবার বুঝতে পারছো?আর কত ভাবে বলতে হবে?”
” যাহ আমার সাথে মজা করছো কেন?”
” তোমার কি মজা মনে হচ্ছে?প্রমাণ তো এই কিটটায় আছে।”
” আ..আমি কি এমন করলাম যে তুমি ইয়ে হয়ে যাবে।ওমাই গট আমার মাথা ঘুরছে।”
” ছোঁচার মতো সারাদিন বউ বউ করে এখন বলা হচ্ছে আমি কি এমন করলাম।বদ লোক আগেই সাবধান করেছিলাম তুমি শুনলে না তো আমার কথা।”
ঈশান যেন কোন গোলকধাঁধায় পড়েছে কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ রইলো সে।হঠাৎ খবরটা তার ঠিক হজম হয়নি।পরবর্তীতে নিজেকে ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করলো।ঈশা এখনো রাগি মুখ করে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে।ঈশান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ঈশাকে তার ঘাড়ে থুতনি রেখে স্বল্প স্বরে বলে,
” জানো প্রথম প্রথম তোমাকে দেখলেই মনে হয়, আমার বাচ্চা তোমার পেটে আব্বু আব্বু কয়।আর দেখলে এখন ঠিক তাই হলো।এত ঝ গ ড়া ঝামেলার পর তুমি আমার বউ।মন ঠিকি বলেছিল।”
ঈশা আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকালো ঈশানের পানে।এই মানুষটা এখনো মজা করছে তার মাঝে কোন সিরিয়াস ভাব নেই!
” আপনি মজা করছেন ঈশান?আমি সিরিয়াস প্লিজ আপনি এই মুহূর্তে আমাকে উলটো রাগিয়ে দেবেন না।”
” আমিও সিরিয়াস তুমি এতটা ভয় পাচ্ছ কেন?আমার রুমাপুকে দেখেছো সে আর রুদবা এখন একসঙ্গে পড়াশোনা করছে।রুমা পড়ছে তার চাকরির পড়া আর মেয়েকে তার স্কুলের পড়া পড়ায়।সচারাচর তো তুমি যাও না সন্ধ্যার পর গেলে দেখতে পাবে।ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে কি তুমি আল্লার রহমতের উপর বেজার থাকবে?অযথা যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিজের মন মা রা র কোন মানে নেই।”
ঈশা চুপচাপ তাকিয়ে রয় মেঝেতে মেয়েটা কি ভাবছে?কু’বুদ্ধি আসার আগে তার মন ঘুরিয়ে দিতে হবে।
” এত কি ভাবছো?আসো আদর করি।”
ঈশান চট করে ঈশার গালে চুমু খেলো।ঈশা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বলে,
” হুম ঠিক বলেছো।আচ্ছা চাইলে আরেকটা চুমু দিতে পারো আমি মাইন্ড করবো না।”
.
বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে শুনে অনু খুশিতে কেঁদে ফেলেছে।ঈশাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে আত্মহারা মেয়েটা।রাসেলকে জোর জবরদস্তি করে টেনে নিয়ে গেছে মিষ্টি কেনার উদ্দেশ্যে।ঈশান কিয়ৎক্ষণ আগে মাহমুদাকে ফোন করে জানিয়েছে বাড়িতে নতুন অতিথি আগমের কথা।মাহমুদার দু’চোখ ভিজে উঠেছে খুশিতে, তবে মনটা কেমন যেন মুদে গেছে আফসোস জাগছে এখন যদি দেশে থাকতো মেয়েটার পাশাপাশি থাকতে পারতো।এই দূরত্ব যে আর ভালোলাগে না যত দ্রুত সম্ভব আবার দেশে আসবেন তিনি।
ঈশান সুযোগ খুঁজছিলো কখন মুজাহিদ হাসানকে ফোন করবে।ঈশাকে ঘরে রেখে ছাদের দিকে রওনা হলো সে এইবার ফাদারকে একটু জ্বালানো যাবে।
” কেমন আছেন ফাদার?শরীর,মন,মেজাজ সব ঠিকঠাক?”
” সব ঠিকি আছে তবে এখন সন্দেহ হচ্ছে ঠিক থাকবে কি না।”
” ঠিক থাকার জন্যই তো ফোন করেছি।আপনি কোথায়?”
” সেলুনে আছি।”
“ফাদার ইন ল চুলে কালি লাগিয়ে স্টাইল মেরে ঘুরার দিন এবার বিদায় দিন।এবার একটু বুড়ো নানা নানা ভাব ধরুন আর কতকাল জাতির ক্রাশ হয়ে থাকবেন?”
” আমি জাতির ক্রাশ!কি বলছো এসব?”
” একটা শুভ সংবাদ আছে।”
” কি তুমি দেশ ছাড়ছো নাকি?”
” না।আপনাকে একা জ্বালিয়ে ঠিক শান্তি পাচ্ছি না তাই তো আমার বাহিনী গঠন করছি।বাহিনীর প্রধান দশ মাস পর পৃথিবীতে ল্যান্ড করবে।”
” নাই কাজ তো খই ভাজ।তোমার কাজ না থাকলে গিয়ে খই ভাজো।”
” খই আমি জায়গা মতো ভেজে এসেছি।এখন শুনুন গুড নিউজটা হলো আমি বাবা হতে চলেছি।”
” কিহ!তুমি নিজে মানুষ হয়েছো এখনো?তুমি কি করে একটা বাচ্চার বাবা হও!আগে তো নিজে মানুষ হও।”
” আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?আমার কথা বিশ্বাস না করলে আপনাকে সেলুন থেকে তুলে আনবো বলে দিলাম।আশা রাখছি আপনার মেয়েকে এসেছে দেখে যাবেন।”
” আমি সত্যি নানা হচ্ছি?”
” হুম।”
মুজাহিদ হাসান থমকে গেলেন।তার ছোট্ট ঈশা মা হচ্ছে!সময় কত দ্রুত পালটে গেল।সময় এত তাড়াহুড়ো করছে কেন?সুখের সময়গুলো থাকুক না আরেকটু।ঝাপসা চোখে
সেলুনের বড় আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করলেন মুজাহিদ হাসান।জীবনের আরেকটা ধাপে এসে পৌঁছে গেছেন তিনি।প্রথমে ছিলেন নিষ্পাপ শিশু বাবা মায়ের আদরের সন্তান,উপযুক্ত বয়সে স্বামী হলেন তারপর বাবা হলেন দায়িত্ব বাড়লো আর এখন নানা হতে যাচ্ছেন।শরীরের ঝুঁকে আসা ভারটাই বলে দেয় বয়স হয়েছে এখন শুধু বিশ্রামের প্রয়োজন শুধুই বিশ্রাম।
১২০.
অসহায় দৃষ্টিতে ঈশার পানে তাকিয়ে আছে ঈশান।আজ ঈশার সি সেকশনের ডেট সকাল থেকে মেয়েটা কেমন ছটফট ছটফট করছিলো ঈশান আর দেরি করলো না দ্রুত তাকে নিয়ে এলো হসপিটাল।সেদিনের পর কেটে গেল নয়টা মাস।এই নয়টা মাস খুব যে ভালো ভাবে কেটেছে তা কিন্তু না।একেরপর এক বাঁধা বিপত্তি তাদের জীবনে এসেছে।ঈশার প্রেগ্ন্যাসির যখন ছয় মাস তখন মারা যান লিপি।প্যারালাইজড অবস্থায় মিত্যুর আগ মুহূর্তে মানুষটা কেমন ছটফট করেছে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তার এমন আচরণে ভীষণ ভয় পেয়ে যান মাহমুদা।লিপির মৃতদেহ নানান ঝটঝামেলা পেরিয়ে দেশে আনা হয় অপরদিকে মাহমুদা হয়ে পড়েছেন অসুস্থ।আবিদ শাহরিয়ার নিজেকে দৃঢ় রেখেছিলেন বলে অন্তত শেষটা ঠিকঠাক ভাবে সম্পূর্ণ হয়।লিপির মৃত্যুতে বাড়ির সবার মাঝে কেমন আতঙ্ক দেখা দেয় বিশেষ করে ঈশার মাঝে।না পারতে ঈশাকে তার বাবা মায়ের কাছে রেখে এসেছিল ঈশান।হাসি আড্ডায় মিলেমিশে থাকা পরিবারটা কেমন যেন মুদে গেলো।সেই আনন্দ আবার ফিরিয়ে আনলো আরেক সুসংবাদে।একমাস আগে প্রকাশ পায় ঈশানদের বাড়িতে এক মেহমান আসতে না আসতে আরেক মেহমানের ডাক পড়েছে।মাহমুদার
হা হতাস্মি ভাবটা এক ঝলকে কেটে গেলো দুই ছেলের ঘর আলো করে
উত্তরাধিকার আসতে চলেছে এর চেয়ে আর কোন খুশির সংবাদ হয়!
.
ঈশানকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ রাঙায় মাহমুদা ছেলেটা যেন এক্ষুনি ভেঙ্গে পড়বে।
“তুমি বাইরে কেন?ঈশার সাথে দেখা করে আসো ওঁকে ওটিতে নেওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।”
” আমি যাব না।”
” যাবে না মানে?ঈশা তোমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে বুঝতে পারছো না?ওর এখন তোমাকে প্রয়োজন।”
” আম্মু আমার ভালোলাগছে না প্লিজ জোরাজোরি করো না।আমার দম বন্ধ লাগছে,ভয় লাগছে।”
” বাচ্চাটা তোমার হচ্ছে নাকি ওর?অপারেশন তোমার হবে নাকি ওর?আজ তোমার ঈশাকে সাহস দেওয়ার কথা ছিল অথচ তুমি এক চিপায় পড়ে ভয়ে কাঁপছো!”
মাহমুদা ছেলেকে পুনরায় ধমক দিতে উদ্যত হয়।কিন্তু তার আগে রাসেল তাকে চোখ ইশারায় থামিয়ে দেয়।রাসেল ঈশানকে আড়ালে টেনে নিয়ে অভয় দেয়।রুম থেকে একে একে সবাই চলে যায় তখনি প্রবেশ করে ঈশান।দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে হাটু মুড়িয়ে বসে ঈশার পাশে।মেয়েটার হাতে ক্যানলা লাগানো সেদিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটায় মোচড় দেয় ঈশানের।
” তুমি নিষ্ঠুর আচরণ করছো কেন ঈশান?আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তুমি পাত্তাই দিলে না।আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?”
ঈশার প্রশ্নে স্মিথ হাসলো ঈশান।ঈশা বুঝতে পারে ঈশানের অস্থিরতা ছেলেটার এলোমেলো চুলিয়ে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয় ঈশা।
” আমার যদি আজ কিছু হয়ে যায় তুমি কী বিয়ে করবে ঈশান?”
” এসব কথা না বললে কি হয় না?ভালো কিছু চিন্তা করো।”
” এই তো শেষ সময়।ভাগ্যে থাকলে দেখা হবে।আমার কথা রাখবে?তুমি বিয়ে করো না ঈশান আমি মানতে পারবো না।”
” একটা চড় লাগাবো কিসব চিন্তা তোমার।আমার প্রতি এই বিশ্বাস তোমার?তুমি ছাড়া আমি ভালো থাকবো?”
” ইদানীং আদরো করো না আদর করার বাহানাও করো না, তুমি পালটে গেছ ঈশান।”
” আমি আগের মতো আনন্দে আছি বলো?আমার চোখে মুখে আনন্দের আভাস পাও তুমি?তোমার সি সেকশনের ডেট যত এগিয়ে আসছিলো আমার দম তত বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো,হারানোর যন্ত্রণা বাড়ছিলো এই যন্ত্রণা তুমি অনুভব করতে পারবে না ঈশা।”
” সময় হয়ে গেছে শেষ বারের মতো আমায় আদর করবে না?”
ঈশার আবদার ঈশান ঝাপসা চোখে হেসে ঈশার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় ঈশাকে।দরজায় করাঘাতে ধ্যান ভাঙে দুজনের।ঈশান আসতে অনুমতি দিলে দুজন নার্স এগিয়ে আসে তারা ঈশাকে নিয়ে ওটিতে যাবে।মুজাহিদ হাসান আতঙ্কগ্রস্ত চেহারায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে সুলতানা মুখে কাপড় গুজে কাঁদছেন।ঈশা তার বাবার দিকে তাকিয়ে হাস্যজ্বল মুখে বলে,
” ঈশান তোমায় জ্বালালেও একটুও বকবে না বাবা।ও যে তোমায় ভীষণ ভালোবাসে।”
মুজাহিদ হাসান ঈশানের দিকে তাকালো ছেলেটার রক্তিম চোখের কার্নিশ বেয়ে এক্ষুনি জল গড়িয়ে পড়বে।অনুর হাত টেনে কাছে আনে ঈশা এবং রাসেলকে উদ্দেশ্য করে আদেশ সুরে বলে,
” পড়াশোনা নিয়ে অনুকে একদম বকাবকি করবেন না রাসেল ভাই।অনু আমার আদরের বোন, যদি না ফিরে আসি তবে ও যে একা হয়ে যাবে।ওর এক অংশ ভেঙে যাবে।অনু ঈশা এক জোড় যেখানে যাবে সেখানেই সবাই তাদের একসাথে পাবে।”
” তুই এমন করছিস কেন ঈশা?তুই কি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার বাহানা করছিস?একদম যেতে দিব না।”
অনুর কথায় ঈশা প্রত্যুত্তর করলো।সে ইশারায় ডাকলো রুদবাকে।মেয়েটা কেমন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
” তোমার ফেইরি টেলসের পরিরা বেশি সুন্দর নাকি ঈশামনি বেশি সুন্দর?”
” আমার ঈশা পরিটা বেশি সুন্দর।একদম লালটুকটুকে বউ বউ।”
” লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবে কেমন।”
” তুমি কোথাও যাচ্ছো?”
” হ্যাঁ,তোমার মতো একটা ছোট্ট পরি আনতে যাচ্ছি।”
১২১.
আজকের অপেক্ষাটা এত দীর্ঘ কেন?ঈশানের অপেক্ষা যে শেষ হচ্ছে না।বাইরে পাইচারি করতে করতে ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি দেখছিলো ঈশান।এতটা দেরি দেখে সবার চিন্তা ক্রমশ বাড়লো ঈশান তো না পারতে কেঁদেই ফেলেছে।আবিদ শাহরিয়ার অদূরে দাঁড়িয়ে ছেলেকে দেখলেন মনটা ধীরে ধীরে মুদে যাচ্ছে তার তাই তো আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামলেন।মুজাহিদ হাসান এসে ঈশানের পাশে দাঁড়ালো রাসেল যে ছেলেটাকে সামলাতে ব্যর্থ।তাই মুজাহিদ হাসান গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
” কাঁদছো কেন?আমার মেয়ে যদি জানে তুমি কেঁদেছো তাহলে আমায় বকবে কারণ আমি তার বরকে কেন সামলে রাখিনি।”
” আপনি কাঁদছেন কেন ফাদার?আমার বউ যদি জানে আপনি কেঁদেছেন তাহলে আমায় বকবে কারণ আমি তার বাবাকে কেন সামলে রাখিনি।”
“আমার একমাত্র মেয়ে আমি একটু কাঁদতেই পারি।”
” আমারো একমাত্র আদরের বউ আমিও একটু কাঁদতে পারি।”
দুজনের তর্কাতর্কিতে শোকের মাঝেও হেসে ফেললো সকলে।মুজাহিদ হাসান কপট রাগ দেখালো ঈশানকে।
” ঈশা কি বলেছে ভুলে গেছেন?আপনি আমায় চোখ রাঙাচ্ছেন,আমি কিন্তু ঈশার কাছে নালিশ করবো।”
দমে গেলেন মুজাহিদ হাসান।অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো একজন নার্স তোয়ালে প্যাঁচিয়ে ছোট্ট দেহের সদ্য জন্মানো শিশুটিকে নিয়ে এলো।কে আগে কোলে নেবে বলে আলোচনার মাঝেই আবিদ শাহরিয়ার নির্দেশ দিলেন ঈশানের কোলে দেওয়ার জন্য।এই প্রথম সদ্য জন্মানো শিশু কোলে তুলেছে ঈশান।বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় কেঁদে ফেললো সে।কি সুন্দর নিষ্পাপ চেহারার অধিকারিনী শিশুটি।ঈশান ভয়ে ভয়ে আরেকটু আঁকড়ে ধরে বাচ্চাটাকে।
” এত ছোট কেন?বাচ্চারা এতটাও ছোট হয়!”
ঈশানের প্রশ্নে পালটা জবাব দিলেন মাহমুদা।
” তুমি তো আরো ছোট ছিলে আমার আব্বা বলছেন তুমি নাকি লেংটি ইঁদুরের মতো ছিলে।”
মাহমুদার কথায় সবাই একসাথে সশব্দে হেসে উঠে।ঈশান সেদিকে পাত্তা দিলো না সে তার ছোট্ট বাচ্চাটাকে পরখ করতে ব্যস্ত।
.
ঈশাকে দেখার জন্য অনুমতি দিতে হুড়মুড়িয়ে সেখানে প্রবেশ করে ঈশান।ঈশা ফ্যালফ্যাল চোখে দেখছিলো তাকে মেয়েটার মুখে রা নেই।কথা বলতে চেয়েও কথা বলার শক্তি নেই।ঈশান তাদের বাচ্চাটাকে এগিয়ে এনে দেখালো ঈশাকে।
” এই দেখো আমাদের মেয়ে ঈশানী।বলতো কার মতো হয়েছে?”
ঈশা নাক ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো।তার চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিলো ঈশান।গালে চুমু খেয়ে ঈশাকে কাঁদতে বারণ করলো কিন্তু ঈশা এখনো কাঁদছে।ঈশান পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকা ঈশানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
” এই দেখো তোমার আম্মুর আদরে ভাগ পড়েছে বলে কেমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে।মামুনি তাকে বলে দাও তার আদর তার জন্য সংরক্ষিত আছে।পাপা আমাকে আমার ভাগের আদর দেবে। আচ্ছা ঈশানী তুমি কথা বলবে কবে?”
১২২.
প্রচন্ড বাতাসে গাছের সব ফুল ঝরে পড়ছে মাটিতে।সবুজ ঘাস মিশ্রিত উঠোনটায় দখল করেছে ঝরে পড়া সাদা,গোলাপি বাগান বিলাসের ফুলেরা।আকাশটা আজ একটু বেশি নীল তার মাঝে উড়ে যাচ্ছে সাদা মেঘেরা।আকাশের পানে তাকিয়ে মিহি হাসলো ঈশান।টগবগে যৌবনের সময় এই গাছগুলো লাগিয়েছিল সে অপেক্ষা করছিলো কখন এই গাছগুলো পরিপূর্ণ বড় হবে আর হয়েও গেল।গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে ঈশানের জীবনের দৈর্ঘটা যে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
বাগানের কাঁচা আম পাড়ছে ঈশানের নাতি নাতনিরা।একমাত্র মেয়ে ঈশানীর কোল জুড়ে এসেছে এক ছেলে এবং এক মেয়ে।বড় ছেলে নাসিম এবার এইচএসসি পরিক্ষা দেবে আর মেয়েটার নাম রোজা ক্লাস নাইনে পড়ছে।ঈশান চশমা ঠেলে তাকালো পাশে রাসেলের নাতনিটা একটু বেশি ছিঁচকাদুনে নাসিমের সাথে ঝগড়া করে আম গাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
রাসেলের একমাত্র মেয়ে রুহি।রুহির ঘরেও আবার একটি মেয়ে হয়েছে।রুহি হয়েছে অনুর মতো দুরন্ত স্বভাবের।আবার রুহির মেয়েটাও ঠিক তার মতোই হয়েছে।সংসার এখন বড় হয়েছে পালটে গেছে।মায়ায় আগলে রাখা মানুষগুলোও একে একে ইহকাল ত্যাগ করেছে।ঈশানের মা মাহমুদা বেঁচে নেই তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে।ঈশার বাবা মা দুজনেই অসুস্থ থুকথুকে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তাদের জীবনের বাতিটাও হয়তো একদিন আচমকা নিভে যাবে।
বৃদ্ধ রাসেলের চেহারা এখন বেশ পালটেছে।ফতুয়া পরাহিত রাসেল এগিয়ে এসে বসলো ঈশানের পাশে বৃদ্ধ দুই বন্ধু কথার তালে তালে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।তাদের হাসির মাঝে উপস্থিত হয় অনু।আধাপাকা চুলে ঘোমটা টেনে রাসেলকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
” তুমি এখানে এসে পালালে।এক্ষুনি উঠো আমার পানের বাটা কেন আড়াল করেছো?তুমি জান না পান না খেলে আমার শান্তি লাগে না?”
” বদ অভ্যাস পান খাওয়া বন্ধ করো আমার ভালো লাগে না।”
” আমার ছড়তা দিয়ে মে রে তোমার মুখ ভেঙে বন্ধ করে দেব। আমার পানের বাটা এক্ষুনি দাও বলছি।নাতি নাতনিগুলোর সামনে লজ্জা পেতে না চাইলে যা বলছি করো।”
রাসেল জানে এই অনু বুড়ি যা বলবে তাই করে ছাড়বে তাই তো আর বসে থাকতে পারলো না।দ্রুত উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনে তার পিছন পিছন এগিয়ে এলো অনু।
” বুড়ি হয়েছো এবার অন্তত আমার শান্তি দাও অনুরূপী একটু কথাও শুননা আমার।”
রাসেল হাত বাড়িয়ে অনুর চামড়া কুচকে যাওয়া গাল টানলো।তার এমন কাণ্ডে চোখ রাঙালো অনু।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
” বুড়ো হয়েছে তবে লাজ লজ্জা একটুও হয়নি নাতি নাতনির সামনে সোহাগ করে কি লজ্জায় ফেলতে চাও?”
.
ঈশান একাই বসেছিল নাতি নাতনিরা কাঁচা আম নিয়ে চলে গেছে ঘরের দিকে।নিশ্চয়ই এখন অনুকে নুন মরিচ মিশিয়ে আম মাখা করে দেওয়ার আবদার করবে।চশমার ফাঁকে ঈশানের নজরে এলো ঈশার দিকে।পাকা চুলগুলোতে মেহেদী দিয়ে কেমন লাল করে ফেলেছে।যৌবনে যেমন সৌন্দর্য ছিল ঠিক বৃদ্ধ বয়সেও তার সৌন্দর্য এখনো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে।বৃদ্ধ ঈশানকে এখনো ঘায়েল করছে এই এক নারী।
ঈশা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে ঈশান মনে মনে হাসলো।ঈশা এসে বসলো তার পাশে গাছের নিচে এই বেঞ্চিতে সব ঝড়ে পড়া ফুলেরা।
” আসো, পাশে বসো আমার এই ফুলেরা তোমায় খুঁজছিলো।”
” তাই তো এলাম।আমার বুড়টা একা কেমন করে অসহায়ের মতো বসেছিল।”
” শরীরের চামড়া কুচকে গেছে,বয়সটা বেড়ে গেছে তাই বুড়ো হয়ে গেলাম।মনটা কিন্তু এখনো বুড়ো হয়নি সে আগের মতোই আছে।”
ঈশান আরেকটু কাছে ঘেষে বসলো।ঈশার কাঁধে মাথা রাখতে ঈশা দ্রুত সরে বসে ভ্রু কুচকে বলে।
” খালি বাহানা।দেখি ছাড়ো আমি যাই।”
” ছাড়ছি না দেখলে তো কীভবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেললাম আমার বাঁধনে।চাইলেও এই বাঁধন ছেড়ে মুক্তি পেয়েছো?ঠিকি তো দুর্বিন দিয়ে হলেও খুঁজে এনেছি।কাল যে আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ভুলে গেছো?”
ঈশা চমকে উঠলো।ঈশানের দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে বলে,
” হ্যাঁ তাই তো।অবশ্য এখন বুড়ো হয়ে গেছি নাতি নাতনির সামনে রঙ ঢঙ করা বেমানান।”
” আসো একটু আদর করি।”
“এই না না ভুলেও না।স্বভাবটা আগের মতোই আছে আপনার।”
ঈশা উঠে যেতে নিলে ঈশান তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে অতি দ্রুত ঈশার গালে চুমু খেয়ে কপালে ঠোঁট স্পর্শ করার আগে গাছের আড়ালে তার চোখ পড়ে।ঈশানীর ছেলে নাসিম আড়ালে তাদের ছবি তুলছে।ঈশান অবাক চোখে নাসিমের দিকে তাকাতে ছেলেটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।ঈশা পড়েছে ভীষণ লজ্জায় দ্রুত ঘোমটা টেনে সরে যেতে চাইলে ঈশান তার হাত ধরে নেয়।অপরদিকে নাসিমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ওখানে কি করছিস নানাভাই?”
” তোমাদের প্রেম প্রেম ছবি তুলে ফেলেছি নানা ভাই।তুমি এত রোমান্টিক!এত্ত!”
” সব ডিলেট করে দাও নানা ভাই।”
” কখনো না।”
নাসিম মোবাইলটা পকেটে রেখে ছুটে পালিয়ে যায়।ঈশানের মেজাজটা খিঁচে গেছে রোমান্টিক মুডে কেউ বিরক্ত করলে তার সেই দিনটাই খারাপ যায়।ঈশা ঈশানকে রাগ দেখানোর আগেই পুনরায় ঈশার গালে চুমু খায় ঈশান।ঈশাকে রেখে দ্রুত উলটো দিকে হাটা শুরু করে সে।ঈশান যেতে যেতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” যারা প্রেম প্রেম মুহূর্তে এসে জ্বালাতন করে তাদের আমি ঘেন্না করি।”
_________ সমাপ্ত__________