#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
“আমাকে তুমি বোকা পেয়েছো ভাইয়া? এখানে এসে প্রেম করে বেড়াচ্ছো। সারাদিন বাহিরে ঘুরছো। ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠছো। আর আমি সারাদিন বাসার মধ্যে চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে গুমরে মরছি। আমার কি বাহিরে যেতে ইচ্ছে করে না? আমার কি নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে না? তোমাকে কবে থেকে বলছি? আমাকে বাসায় নিয়ে চলো। আমার এভাবে আড়ালে থাকতে ভালো লাগছে না। তুমি আমার কথা শুনছোই না। তোমার ওপরে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছি। তুমি যদি সাত দিনের মধ্যে আমাকে বাসায় নিয়ে না যাও। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আমি একা একা আব্বুর কাছে চলে যাব। আর আব্বুকে সবকিছু বলে দিব। তুমি আমাকে কতটা মানসিক অশান্তির মধ্যে রেখেছো। আমি যেভাবে বেঁচে আছি। এটা কোনো জীবন হতে পারে না ভাইয়া। আমার একটা সুস্থ জীবন চাই। এমন অসুস্থ জীবন কাটাতে কাটাতে হাঁপিয়ে গিয়েছি। এই অল্প বয়সে আমি বড্ড ক্লান্ত ভাইয়া। এবার আমার একটু বিশ্রাম চাই। আগন্তুকের বোনের কথায় আগন্তুকের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো হিংস্রতা। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–আমি তোকে বাঁচানোর জন্য, তোকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছি। তোর দেখি মরার পাকনা গজিয়েছে। কথায় আছে না। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। তোর হয়েছে সেই অবস্থা। আমি আমার কাজে বাংলাদেশে আসছি। তোকে ঘুরতে নিয়ে আসি নাই। তোকে কালকেই আবার কানাডা পাঠিয়ে দিব। ভাইয়ের কথায় জ্বলে উঠলো মেয়েটি। রাগান্বিত হয়ে বলল,
–তুমি আমার সাথে মজা করছো ভাইয়া? আমাকে কি তোমার মানুষ বলে মনে হয় না। তুমি যা বলবে। আমি তাই শুনবো। এটা যদি ভেবে থাকো। তাহলে তোমার ধারনা ভুল। আমি ততক্ষণই তোমার কথা মানবো। যতক্ষণ তুমি আমার মনের মতো কাজ করবে। যখন দেখবো। তোমার মতের সাথে আমার মত মিলছে না। তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে, আমি দু’বার ভাববো না। তুমি তোমার অতীত ভুলে যেও না ভাইয়া। তোমার অতীত জানলে, সবাই তোমাকে ঘৃণা করবে। এই যে সবার থেকে ভালোবাসা আদায় করে নিচ্ছো। এই ভালোবাসা থাকবে না। আমি যদি কারো ভালোবাসা না পাই। তাহলে তোমাকে ও কারো ভালোবাসা পেতে দিব না৷ তোমার মতো ভাই যেন আল্লাহ কাউকে না দেন। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো তুমি। আল্লাহ তোমার কোনোদিন ভালো করবে না। নিজের প্রান প্রিয় বোনকে অস্থির হতে দেখে, কোমল হলো আগন্তুকের হৃদয়। সে অনুতপ্ত হয়ে, বোনকে দু-হাতে আগলে নিল। বোনের মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে, নরম কণ্ঠে বলে উঠলো,
–তুই তোর ভাইকে এখনো চিনতে পারিস নাই। আমি তোকে বাঁচানোর জন্য তোকে আড়ালে রেখেছি। তোর ভাই অতীতে পাপ করেছিল। সেই পাপের মাসুল তোকে গুনতে হবে। তোকে নষ্ট করার জন্য অতীত আমার পেছনে আঠার মতো গেলে আছে। তুই যে আমার বাগানের ফোটা জ্যান্ত গোলাপ ফুল। আমি কিভাবে সেই ফুলকে নষ্ট হতে দেই বল। তোকে নষ্ট হতে দেওয়ার আগে, আমার যেন মৃত্যু হয়। আগন্তুকের কথায় আগন্তুকের বোন তাচ্ছিল্য করে বলল,
–আজকে তোমার বাগানের ফুলের দিকে, তোমার অতীত কুনজর দিয়েছে। তাই তোমার কলিজা টগবগ করে উঠেছে। তাকে তুমি শেষ করে দেওয়ার জন্য প্রয়াস চালাচ্ছো। তার ভয়ে আমাকে আড়াল করে রাখছো। আমার বিপদ গুলো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছো। আচ্ছা একটা কথা কি কখনো ভেবে দেখেছো। অতীতে তুমি কারো বাগানের সদ্য ফোঁটা গোলাপ ফুলকে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে নষ্ট করে ফেলছিলে? শুধু এখানেই থেমে থাকোনি। মেয়েটির ভাই তোমার দু’টি চরন ধরে পাগলের মতো নিজের বোনের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। তোমার পাষাণ মন। সেদিন গলেনি। কারো করুন কণ্ঠস্বর তোমার মন গলাতে পারেনি। তুমি তার ভাইকে আঘাত করে দূর নদীর পারে ফেলে দিয়ে এসেছিলে। আর মেয়েদিকে নৃশংসভাবে হ’ত্যা’ করেছিলে। মনে পড়ে সেই রাতের কথা। সেই রাতের আত্ম চিৎকারের কথা। আজকে মেয়েটির জায়গায় যদি আমি থাকতাম। তাহলে আমার ওপরে ও কি এমন অমানবিক নিষ্ঠুর জুলুম করতে পারতে ভাইয়া?
বোনের কথায় আগন্তুকের শিরা-উপশিরায় কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। তার ভেতর টা কেউ তীর দিয়ে ছিদ্র করে ফেলছে। এমন এক অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে তার বুকের মধ্যে। সে দু’হাতে নিজের চুলগুলো মুঠোয় পুরে নিল। চোখের সামনে নিজের ভাইকে অস্থির হতে দেখে, মেয়েটির মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি। সে যেন ভাইয়ের এমন ভয়ংকর অস্থিরতায় দেখতে চেয়েছিল। সে তার কাজে সফল হয়েছে। এবার নিশ্চয়ই তার ভালোবাসার মানুষটিকে সে পাবে। আচ্ছা কার কথায় নিজের ভাইকে এতটা অসহ্য যন্ত্রনা দিচ্ছে মেয়েটি? তার বোন তো এমন ছিল না। তার সহজ সরল বোন। এত কথা কোথায় থেকে শিখলো? এভাবে তাকে মানসিক পিড়া দিচ্ছে কেনো? তবে কি এর পেছনে কারো হাত আছে? কথাটা মাথায় আসতেই আগন্তুকের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। মুখশ্রীতে হিংস্রতার ছাপ ফুটিয়ে তুলে, কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। আগন্তুকের বোন আগন্তুকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আনন্দিত হয়ে কাউকে ফোন করে সবকিছু জানালো। সবকিছু শোনার পরে ওপর পাশ থেকে, অদ্ভুত ভাবে হাসির শব্দ পাওয়া গেল।
আজকে শুক্রবার। আরাভদের পরিবার প্রতি শুক্রবারে নিজেদের পরিবারকে সময় দেয়। সবাই মিলে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। বাহিরে এসে প্রকৃতি উপভোগ করে। আজকে সবাই মিলে পার্কে গিয়ে আড্ডা দিবে। সেই উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছে। সবাই মিলে রিক্সা করে যাবে। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনটি ফাঁকা রিক্সা আসার প্রহর গুনছে। এমন সময় স্মৃতি আইসক্রিম কেনার জন্য বাসার নিচে আসে। প্রতিদিন বিকেলে তার আইসক্রিম না হলে চলে না। স্মৃতি রাস্তার ওপাশে যাবে। এমন সময় স্মৃতির কাছে ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়া রায়ান আসে। রায়ানকে দেখে স্মৃতি মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয়। রায়ান তার হাতের সাইকেলটা স্মৃতির হাতে দিয়ে হাসোজ্জল মুখ করে বলল,
–তুমি আমার সাইকেল নিয়ে চার পাক ঘুরে আসো। আমি তোমার মোবাইলে একটু গেইম খেলবো। কথা দিচ্ছি। আজকেই শেষ। আর কখনো তোমার থেকে ফোন চাইবো না। তুমি বলেছো। আমি বড় হলে, আমাকে ফোন কিনে দিবে। আমি বড় না হওয়া পর্যন্ত তোমার থেকে ফোন চাইবো না। ছেলেটির কথায় স্মৃতির মুখশ্রী কুঁচকে গেল। গম্ভীর মুখ করে বলে উঠলো,
–আজকে দিয়ে কতদিন বললি। যে আজকেই শেষ। আর কখনো আমার ফোন নিবি না। তুই কথা দিয়ে কথা রাখিস না। তোকে ফোন দিব না যা আমাকে একদম বিরক্ত করবি না৷ আমার ফোন কি সরকারি নাকি? যে তুই এসে চাইবি। আর আমি দিয়ে দিব। স্মৃতির রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে দমে যায় রায়ান। সে মলিন মুখশ্রী করে বাসায় দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এমন সময় স্মৃতির ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছায়। রায়ান দ্রুত স্মৃতির দিকে মুখশ্রী ঘোরায়। স্মৃতি রায়ানের হাতে ফোন দিয়ে, রায়ানের থেকে সাইকেল নিয়ে বলল,
–আমি একটু ঘুরে আসছি। আজকেই শেষ। আর কোনোদিন মোবাইল দিব না। হ্যাঁ বলে দিলাম। কথা গুলো বলেই স্মৃতি সাইকেল চালাতে চালাতে পাড়ার মোড়ের দিকে চলে গেল। সাইকেল চালাতে স্মৃতি বেশ পছন্দ করে। তবে মেয়েদের সাইকেল চালানো উচিৎ নয়। ব্যক্তিগত কারনে স্মৃতির সাইকেল চালানো স্মৃতির আম্মু পছন্দ করে না। তাই মায়ের ভয়ে আর সাইকেল কেনা হয় নাই স্মৃতির। সে একটু সুযোগ পেলেই রায়ানের থেকে সাইকেল নিয়ে চালাতে শুরু করে। স্মৃতির ঘোরা শেষ হলে, বাসার দিকে এগিয়ে আসছিল। তখনই দমকা হাওয়া এসে স্মৃতির অবাধ্য কেশ গুলোকে এলোমেলো করে দিতে শুরু করল। কেশ গুলো যেন হাওয়ারই অপেক্ষা করছিল। একটু হওয়ার ছোঁয়া পেতেই কেমন প্রানবন্ত হয়ে গিয়েছে। আনন্দে মেতে উঠেছে। স্মৃতি বিরক্ত হয়ে চুলগুলো কানে গুঁজে দিচ্ছে। রায়ান খেলতে খেলতে স্রুতিদের সামনে চলে আসছে। রায়ানকে দেখে স্রুতি বলে উঠলো,
–তুই আবার ফোন নিয়েছিস? তোকে না নিষেধ করেছি। তুই ছোট মানুষ। তুই একদম ফোনে হাত দিবি না। তবুও কেনো কথা শুনিস না। স্মৃতি তোর হাতে বার বার ফোন দেয় কেনো? এটা আমি বুঝি না। স্রুতির কথা শুনে, রায়ান সামনের কয়েকটা দাঁত বের করে হেসে বলল,
–লোভে গো বউ। স্মৃতি আপু আমাকে ফোন দেয়। আমার সাইকেল পাওয়ার আশায়। আর আমি স্মৃতি আপুকে সাইকেল দেই, স্মৃতি আপুর ফোন পাবার আশায়। তুমি বুঝবে না বউ। তোমাকে বিয়ে করতে চেয়ে ছিলাম। তুমি আমাকে ঠকিয়ে একটা বুড়ো ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছো। আমার মতো ছেলে তুমি জীবনে পাবে না। রায়ানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসলো না শুধু অভ্র। সে গম্ভীর মুখ করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার হাসি দেখে জ্বলে উঠলো অভ্র। সে রায়ানের কান টেনে ধরে বলল,
–তোর খুব পাকা পাকা কথা হয়েছে তাই না। তুই এতটুকু ছেলে হয়ে বিয়ের চিন্তা করিস। আমাকে দেখে তোর কোন দিক দিয়ে বুড়ো মনে হয়। আমার বউকে বউ ডাকতে তোর লজ্জা করে না। তুই ছোট ছোটর মতো থাকবি। আমার সামনে বড়দের মতো কথা বললে, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। অভ্রের গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথা গুলো শুনে, রায়ান ভীত দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকায়। রায়ানের ভয়ার্ত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, অভ্রের কথায় রায়ানের মনে ভয় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কথার মাঝে স্মৃতি এসে সবার সামনে দাঁড়ালো। আরাভ আড়চোখে স্মৃতিকে একবার পরখ করে নিল। স্মৃতিকে দেখে স্রুতি মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
–স্মৃতি তুই বড় হয়েছিস। বাচ্চামো স্বভাব গুলো ছাড়। মা তোকে সাইকেল চালাতে নিষেধ করেছে। তবুও কেন মায়ের কথা শুনিস না। বাচ্চা ছেলেটার হাতে কোন বিবেকে ফোন দিয়েছিস। তোর জ্ঞান বুদ্ধি কবে হবে? এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে বলায় স্মৃতির বেশ খারাপ লাগলো। সে স্মৃতিকে কথা গুলো আড়ালে ডেকে নিয়ে বলতে পারতো। সবার সামনে এভাবে অপমান করার কি দরকার ছিল। যদি-ও স্রুতি ভালোর জন্য বলেছে। সবার সামনে বলার জন্য হয়তো একটু খারাপ লাগছে। স্মৃতি রায়ানের থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। রায়ানের সাইকেল রায়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, স্রুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–রায়ান বলেছে আর কখনো নিবে না। ও যদি আবার মোবাইল চায়। আর কখনো দিব না। তোমরা বোধহয় কোথাও যাচ্ছিলে, আমার জন্য শুধু শুধু তোমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে। তোমরা নিজদের কাজে যাও। আমি আসছি। আমার অনেক পড়া আছে। কথা গুলো বলেই স্মৃতি দ্রুত চলে যেতে চাচ্ছিল। এমন সময় স্রুতি স্মৃতির হাত ধরে ফেলে, বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
–পাগলী মেয়ে। তোর ভালোর জন্যই বলেছি। কথা না বুঝে শুধু শুধু অভিমান করিস। তোর পড়া কেউ খেয়ে ফেলছে না। রাতে এসে পড়তে পারবি। আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। তুইও আমাদের সাথে চল। আমি মাকে ফোন করে জানিয়ে দিব। তুই মাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমার সাথে আছিস জানলে, মা তোকে কিছু বলবে না। প্রথমে স্মৃতি অমত করলে-ও পরে যেতে রাজি হয়। চারটা রিক্সা নেওয়া হলো। প্রতিটি রিক্সায় দু’জন করে বসলে ও স্মৃতি একা এক রিক্সায় বসেছে।
চলবে…..