#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৯
চিন্তায় রোদের এবার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আদ্রিয়ানকে বলতে চাচ্ছে কিন্তু কার নাম বলবে? জুরাইন কিংবা ফুপাকে ছাড়া কেউ তো নেই তারমধ্য কাল জারবার এনগেজমেন্ট। এখন আদ্রিয়ানকে কিছু জানানো মানেই হলো বাড়ীতে যুদ্ধ লাগানো। রোদ মোটেও চাইছে এই ঘটনা কেন্দ্র করে এখন বাড়ীতে ঝামেলা হোক তাই বলে যে ওর সাথে এমন বাজে আচরণ করছে তাকেও এভাবে ছেড়ে দেয়া যাচ্ছে না৷ পুরো রুম জুড়ে রোদকে এভাবে পায়চারি করতে দেখে আদ্রিয়ান ব্যালকনি থেকেই কল হোল্ড করে ডাকলো,
— রোদ?
চমকে তাকালো রোদ। আদ্রিয়ান ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে”? রোদ একটু হেসে মাথা নাড়ালো৷ আদ্রিয়ান আবারও ফোনে কথা বলছে। রোদ এবার ধীর পায়ে নিজেও আদ্রিয়ানের পেছনে দাঁড়িয়ে হেলান দিলো আদ্রিয়ানের পিঠে। কথা বলতে বলতেই আদ্রিয়ান এক হাত পেছনে নিয়ে রোদের কোমড়টা নিজের সাথে চেপে ধরলো। রোদ দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো নিজের ভরসার স্থানকে। নিজের ভালোবাসাকে। আদ্রিয়ান তখনও কথা বলছে ফোনে অথচ মাথা হেলিয়ে রোদ ঘ্রাণ নিচ্ছে নিজের ভালোবাসার। বয়সের পার্থক্য,নিজেদের অতীত,কিছু মানুষের তিক্ত কথা, কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা সব কিছুর ঊর্ধে রোদের আকর্ষণ, ভালোলাগা সবকিছু কেন যেন এই প্রাপ্ত বয়স্ক আদ্রিয়ানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আদ্রিয়ানের ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পড়ে রোদ। একবার না বারবার। হাজার বার। রোদের তীব্র সকল বাসানা, আকাঙ্খা এখন এই আদ্রিয়ানকে ঘিরে। নিজের সবটুকু দিয়ে ওর চাই আদ্রিয়ানকে। নিজের একান্ত ভাবে। রোদের তো এখন মাঝে মধ্যে একটা কথা ভীষণ ভাবে মনে হয় যে “বুড়োরা বউ আদর করে বেশি”। নিজের চিন্তায় হাসি পায় রোদের। ওর জামাই মোটেও বুড়ো না। সুদর্শন, সুঠাম দেহের, পেটানো শরীরের অধিকারী তার আদ্রিয়ান।
রোদ এতক্ষণ যাবৎ এসব ভাবছিলো আর হাত দিয়ে খোঁচাখুঁচি করছিলো আদ্রিয়ানকে। একবার দাঁড়ি টানা,কানে ফু দেয়া,পেটে গুতা দেয়া ওর নিত্য দিনের কাজ। আদ্রিয়ানের কথা শেষ হতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
— এবার বলো তখন থেকে জ্বালাচ্ছো কেন?
— কই জ্বালালাম?
কথাটা বলেই রোদ আদ্রিয়ানের বুকে মাথা দিয়ে বললো,
— চলুন চলে যাই আমরা। কাল আসবো নে।
আদ্রিয়ান বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কেন?
— এমনিতেই। আপনি না যেতে চাইলেন? তাই বললাম।
আদ্রিয়ান সন্দিহান গলায় বললো,
— সত্যি করে বলো রোদ। ফুপি কিছু বলেছে?
কথাটা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলেও রোদের বুক কেঁপে উঠল যেন। আদ্রিয়ানের চোখে তীব্র ঘৃণা দেখা যাচ্ছে ফুপির জন্য। রোদ একটু হাসার চেষ্টা করেই বললো,
— কি বলবেন উনি আমায়? কথাই বলেন না আমার সাথে।
— তাহলে যেতে কেন চাইছো? আজ ও তো কত জোর করলাম।
— অনুষ্ঠান তো কাল রাতে। আমরা রাতেই আসবো নে।
আদ্রিয়ানের সন্দেহ এবার বাড়লো। নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিয়ে রোদকে কাছে টেনে নিলো। আঙুল দিয়ে রোদের পরিহিত কানের গোল রিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
— বলবে না কি হয়েছে?
ঢোক গিললো রোদ। আদ্রিয়ান মুখ নামিয়ে রোদের কানে চুমু খেতেই খিঁচে চোখ বুজে নিলো রোদ। আদ্রিয়ান সেই বন্ধ চোখেও ঠোঁটের ভেজা স্পর্শ দিলো। রোদ দুই হাতে আদ্রিয়ানের বুকের দু পাশের টিশার্ট খামচে ধরে আছে। আদ্রিয়ানের ছোঁয়া এবার এলোমেলো হলো। বেহায়া হাতের বিচরণ চলছে রোদের সর্বাঙ্গে। রোদের হাটুতে যেন কম্পন ধরে গেলো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে একদমে বললো,
— কেউ বাজে ভাবে ছুঁয়েছে।
সহসা থেমে গেল আদ্রিয়ানের ঠোঁটের ছোঁয়া সাথে হাতের অবাধ্য বিচরণ। রোদকে একবারে ছেড়ে দিলো। অবাক হয়ে গেল রোদ। এভাবে কেন সরিয়ে দিলো নিজের থেকে? আদ্রিয়ানের মনোভাব কিছুতেই বুঝতে পারলো না। নিজের থেকেই রোদ এগিয়ে এসে আদ্রিয়ানের বুকে হাত দিয়ে বললো,
— আপনি এমন করছেন কেন?
আদ্রিয়ান ঝটকা মে’রে রোদের হাত সরিয়ে দিলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতবাক রোদ। এটা কি হলো? রোদ কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান কঠিন দৃষ্টিপাত করলো ওর দিকে। রোদের চোখ জ্বলে উঠলো যেন। এভাবে কেন তাকালো আদ্রিয়ান? আদ্রিয়ান কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় টাচ করেছে?
ঢোক গিললো রোদ। গলা ভিজিয়ে বললো,
— একবার কোমড়ের দিকে আর…
আদ্রিয়ান এবার যেন আরো ভয়ংকর হয়ে গেল। রোদকে টেনে নিজের কাছে এনে শক্ত করে ওর কোমড় চেপে ধরলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে রোদ অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠল। আদ্রিয়ান তবুও ছাড়লো না। দাঁত চেপে বললো,
— একবার কোমড়ে মানে? এই একবার কোমড়ে মানে কি হ্যাঁ? তারমানে…
রোদ ছাড়াতে চাইলেও ছাড়লো না আদ্রিয়ান বরং আরেকটু চেপে ধরলো। রোদের চোখ দিয়ে যেন আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পরছে। আদ্রিয়ানের সেদিকে হুস নেই। ও দাঁত খামটি মেরে বললো,
— আর কোথায় ছুঁয়েছে?
রোদের শ্বাস প্রশ্বাস বাড়তে লাগলো। ইদানীং এনজাইটির সমস্যা না হলেও আজ কেমন জানি হঠাৎ আগের মতো লাগছে ওর। রোদ দুই হাত আদ্রিয়ানের বুকে দিয়ে শ্বাস টেনে টেনে বললো,
— পায়ে স্লাইড করেছিলো। পানি দিন আমাকে।পানি খাব।
শ্বাস ফুলে উঠছিলো রোদের। আদ্রিয়ান নিজের রাগটুকু গিলার চেষ্টা করলো কিন্তু কতটুকু পারলো তা আদ্রিয়ান ই জানে। রোদের কোমড় ছেড়ে বুকে আগলে নিলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— কিছু হয় নি রিল্যাক্স।
রোদ মাথাটা আদ্রিয়ানের বুকে ঠেকিয়ে শ্বাস টানছে শুধু। আদ্রিয়ান ওর মাথায় হাত দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। আগে আদ্রিয়ান কিছু করতে পারে নি কিন্তু এবার আর ছাড়বে না। ফুপির প্রতি তিব্র ঘৃণার জন্যই আদ্রিয়ান ওনার আসার খবর পেয়েই বাড়ি ছেড়েছে। একপ্রকার বাবার সাথে নীরব যুদ্ধে লেগেছে ও।
রোদ শান্ত হতেই আদ্রিয়ান ওকে নিয়ে রুমে ডুকলো। পানি ঢেলে খায়িয়ে নিজের বুকে নিয়ে লাইট অফ দিলো। আদ্রিয়ানের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় নি রোদ নিজেই পইপই করে সব বলেছে। আদ্রিয়ান ওকে ঘুমাতে বলতেই রোদ জিজ্ঞেস করলো,
— আপনার কাকে সন্দেহ হচ্ছে?
— কাউকে না। ঘুমাও।
— আমার সাথে রেগে আছেন কেন?
— ঘুমাও রোদ। ভালো লাগছে না।
— আপনি কি আমার উপর বিরক্ত?
এবার চটে গেল আদ্রিয়ান। বুক থেকে সরিয়ে রোদকে বেডে ফেলে নিজে ওর উপর উঠে চেপে ধরে বললো,
— আমার রাগ কি স্বাভাবিক না? তোমার কি উচিত ছিলো না সবার আগে আমাকে বলা? তোমার কেন এত সময় লাগলো আমাকে বলতে?
রোদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— কাল বাসায় অনুষ্ঠান। এখন যদি আমি আপনাকে সব বলতাম আপনি নিশ্চিত ঝামেলা করতেন তখন কি হতো? হয়তো আপনি আমাদের নিয়ে চলে যেতেন নাহলে ফুপিরা চলে যেতো। দিন শেষে জারবার দোষটা কোথায়? ওর এত সুন্দর একটা দিন নষ্ট হয়ে যেতো। আমি চাইছিলাম তাই আজ চলে যেতে যাতে এটা নিয়ে ঝামেলা না হয় আর অবশ্যই আপনাকে জানাতাম। আপনাকে না বললে আর কাকে বলবো বলুন?
আদ্রিয়ান একেবারে শান্ত হয়ে গেল। রোদের প্রতি সম্মানটা বেড়ে গেলো। এখন কিছু করা মানেই জারবার মন ভাঙা। মেয়েটা এমনিতেই সাধারণ এনগেজমেন্ট নিয়ে ভীতু হয়ে আছে। আদ্রিয়ান ঝামেলা করে চলে গেল জারবা আরো ভেঙে পরবে। তার রোদটা কতকিছুই না ভেবেছে। আদ্রিয়ান গভীর চুমু খেল রোদকে। উঠে ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রোদের টিশার্টটা একটু তুলে কোমড়ে নজর দিলো। ফর্সা জায়গাটা লাল হয়ে আছে। আদ্রিয়ানের নিজের উপর ই রাগ লাগলো। কি দরকার ছিলো মেয়েটাকে চেপে ধরার? মুখ বাড়িয়ে ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো লাল দাগে। রোদ শক্ত হয়ে আছে একদম। আদ্রিয়ান একটু শব্দ করে হেসে বললো,
— এমন শক্ত হয়ে আছো কেন?
— কই?
— এই যে।
বলেই রোদের বুকে মাথা দিয়ে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।
_______________
রোদের বাসায় সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে কিন্তু জাইফা প্রেগন্যান্ট। প্রথম অবস্থায় রাদ কোন ধরনের রিক্স নিতে রাজি না কিন্তু জাইফাও বায়না ধরে আছে। সে যাবে। শাশুড়ীকে বলেছে এটা। রাদকে বলার সাহস ওর নেই। যেই রাগ এই ছেলের যদিও জাইফাকে তেমন রাগ দেখায় না। জাইফা তো অবাক হয় সেদিনের কথা ভাবলে যেদিন ও প্রেগন্যান্সির খবর রাদ পেয়েছিলো। রাদ যেন পুরো বোকা বনে গিয়েছিলো। খুশিতে এই ছেলে দুই রাত ঘুমায় নি। জাইফাকে একটু আগেও বলে গিয়েছে,
— জায়ু বেবি কিক মারলে কিন্তু আমাকে বলবা।
জাইফা চেয়েও হাসি আটকাতে পারেনি। দুই দিন হলো না প্রেগন্যান্সির খবর জেনেছে ওরা। এই তো চাঁদ রাতে জেনেছে। বাচ্চার হার্ট বিট ও আসে নি এদিকে রাদ বলে কি না বেবি কিক মারবে। জাইফা এ কথা বলতেই বোকা হাসি হেসেছে রাদ। রাদের মা তো বলে, ছেলে নাকি বাবা হওয়ার খুশিতে দিশাহারা হয়ে গিয়েছে। রাদ এতে অবশ্য রেগে যায় নি। ওর বাচ্চা হবে এতেই ও খুশিতে পারে না জাইফাকে কোলে তুলে ঘুরে। খুশির খবর শুনে দিশাও এসেছিলো জাইফাকে দেখতে। নিজের হাতে আচার বানাচ্ছে দিশা। ওর ভাবনা বাচ্চা নাকি জলপাই এর আচার পছন্দ করে কারণ হলো রাদ খিচুড়ির সাথে একমাত্র এই আচার ই খায়। জাইফার দিশাকে দেখলেই কেন জানি বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বের হয়। মেয়েটা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে রাদকে ভুলে সামনে বাড়ার অথচ এখনও লুকিয়ে চুপিয়ে ও রাদকে দেখে। জাইফার প্রেগন্যান্সির খবর শুনার পর থেকেই দিশা একটু পর পরই এটা ওটা এনে এনে খাওয়াবে জাইফাকে। আজ এসে নিজে জাইফার মাথায় তেল লাগিয়ে গেলো। জাইফা কিছু বলতেও পারে না। মেয়েটা অনেক সরল, সোজা টাইপের। হয়তো কথা একটু বেশি বলে দিশা কিন্তু মনটা একদম নরম।
.
রাদকে রোদ ফোন করে রাজি করিয়েছে জারবার এনগেজমেন্টে যাতে জাইফাকে নিয়ে আসে। বোন পাগল রাদ কি আর না শুনে পারে? মোটেও না। সে জানিয়েছে জাইফাকে নিয়ে আসবে। শুনে যেমন খুশি রোদ হয়েছে তেমন জাইফাও। রাদ ভ্রু কুচকে জাইফাকে জিজ্ঞেস করলো,
— জায়ু রোদকে নিশ্চিত তুমিই বলেছো?
জাইফার খুশি খুশি মুখটা চুপসে গেল। রাদ হেসে এগিয়ে এসে জাইফার পেটে হাত রেখে বললো,
— ও নড়ে না কেন?
জাইফা আবারও হেসে উঠলো। জাইফা পেট চেপে হাসতেই রাদ তারাতাড়ি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— জায়ু বেবির চাপ লাগবে তো। এত জোরে হেসো না।
জাইফার তবুও হাসি থামলো না। উপায়ান্তর না পেয়ে রাদ নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো জাইফার ঠোঁটে। জাইফা একদম চুপ। হাসি থেমে গেল ওর। রাদ চুপ করানোর জন্য এমন করলেও প্রিয় জনের এতটা কাছে এসে নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ হলো। গভীর ভাবে চুম্বন করলো জাইফাকে। ছাড়া পেতেই জাইফা লাল হয়ে গেল। রাদ বোকা বোকা হাসি হেসে বললো,
— শব্দ করে হাসবা না। ঠিক আছে?
— আচ্ছা।
__________________
সকাল সকাল আজ বাড়ীতে আয়োজন শুরু হয়ে গেল। জারবা এখনও কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। কেউ ডাকলেই বলছে,
— উনি আসবে না। কল ধরে নি। মনে হয় পালিয়ে গিয়েছে।
জারবার এহেন অহেতুক কথায় ওর মা বেশ ঝারলেন ওকে। জারবা তবুও উঠলো না। সাবা ফেস প্যাক বানিয়ে এনে জোর করে জারবাকে লাগিয়ে দিলো। জারা আর জুরাইন এসে জারবার রুমে ডুকে গল্প করলো। জুরাইন জারবাকে খোঁচা দিয়ে বললো,
— কিরে তুই আমরা আসার পর থেকে রুম থেকে বের হস না কেন?
জারবা মুখ ফুলিয়ে বললো,
— ছোট ভাইয়া না করেছে।
— তাতে কি? চল। আমি ব্রো’কে বলবো নে।
— না না ছোট ভাইয়া রেগে যাবে।
জারবাকে বের করতে না পে’রে জারা আর জুরাইন চলে গেল। জারবা আবার ও ইয়াজের নাম্বারে ডায়াল করলো কিন্তু ইয়াজ ধরে নি।এতেই যেন হু হু করে উঠলো বোকা সোকা জারবার নরম মনটা।
.
আদ্রিয়ান সকাল থেকে বেশ ঠান্ডা মেজাজে আছে। সকালেই বাবা’র রুমে আদ্রিয়ান, বাবা,আরিয়ান আর শশুড় মিলে কিসের মিটিং করলো এরপর থেকেই পরিবেশ ঠান্ডা। ঠান্ডা মানে ফুপি সেই থেকে রুম থেকে আর বের হয় নি। রোদ আদ্রিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেও আদ্রিয়ান এরিয়ে গেল কথাটা।
.
সন্ধ্যা থেকেই কিছু নিকট আত্মীয় আসতে শুরু করলো। রোদ আর শাশুড়ী তাদের নাশতা দিতে ব্যাস্ত। সাবা জোর করে জারবাকে রেডি করাচ্ছে। রোদ আবার মিশানকে ডাকতেই মিশান জুরাইনের কাছ থেকে এসে বললো,
— ডেকেছো?
— হ্যাঁ। বাবা রেডি হও। যাও রুমে। মা আসছি একটু পরই। তোমার সব আমার বেডে রাখা।
— একটু পর যাই?
— এখনই যাও। গেট ধরব আমরা। ইয়াজ পিয়াজের পকেট খালি করব।
মিশান হেসে রুমে চলে গেল। একটু পরই আদ্রিয়ান ঘেমে নেয়ে এসে কিচেনে ডুকে বললো,
— রোদ রুমে আসো। রেডি হবো।
রোদ ট্রের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললো,
— আপনি গোসল করুন যান। আমি মামনিকে হেল্প করছি।
কথাটা বলেই রোদ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা শরবত এনে আদ্রিয়ানের হাতে দিয়ে ট্রে নিয়ে বাইরে গেলো। আদ্রিয়ান তৃপ্তির হাসি হেসে এক ঢোকে খেয়ে নিলো। এটার এখন ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। রোদ’কে আদ্রিয়ানের বলতে হয় না এই মেয়ে কিভাবে যেন আগে থেকেই আদ্রিয়ানের জন্য সব ঠিক করে রাখে।
রোদ আবারও কিচেনে ডুকে বললো,
— এখনও যান নি?
— তুমি চলো আমার সাথে। কোথায় কি রাখা পাই না আমি।
রোদ কিছু বলার আগেই ওর শাশুড়ী কিচেনে ডুকে বললো,
— রোদ যা এবার রেডি হ। গেস্টরা আসছে সব।
— তুমি একা কিভাবে করবে মামনি?
— আরে বুয়া এসেছে। যা তুই।
রোদ সম্মতি জানিয়ে আদ্রিয়ানের পেছনে গেলো। আদ্রিয়ানের মা হাসলেন। বুয়া আসেনি। সে ছেলের কথা শুনেছে। ছেলের এখন বউ দরকার। এত বছরে তার আদ্রিয়ান সংসার ঠিকই করেছিলো কিন্তু এক তরফা। সংসার ও এক তরফা হয়। কোন দিন এক গ্লাস ঠান্ডা পানি ও তার আদ্রিয়ানের কপালে জুটে নি মাইশা থেকে। সারাদিন কত খাটতো তার সোনার ছেলে। মা হয়ে তো আর বেডরুমে ডুকে ছেলেকে ঠান্ডা পানি দিতে পারতো না। এখন ছোট রোদ কত সুন্দর আদ্রিয়ানয়ের খেয়াল রাখে। আদ্রিয়ানেরও সামান্য তৈরি হতে রোদকে লাগে। এত সুন্দর মুহূর্ত আদ্রিয়ানের মা নিশ্চিত ভেস্তে যেতে দিতে পারেন না। তাই মিথ্যা বলা নাহলে রোদ কিছুতেই যেত না।
.
রুমে ডুকতেই দেখলো এলাহি কান্ড। মিশান আর মিশি মিলে সারা ঘর এলোমেলো করে রেখেছে। রোদ ধমকে উঠতেই দুই জন চুপ। টাওয়াল বের করে রোদ আদ্রিয়ানকে দিয়ে ওয়াসরুমে পাঠিয়ে মিশানের কাছে এসে পাঞ্জাবি ঠিক করে দিলো। এই ছেলে এতক্ষণ অর্ধেক পাঞ্জাবি পড়ে মিশির সাথে লাফাচ্ছিলো। মিশান চুল ঠিক করছে আয়নার সামনে। রোদ মিশিকে তুলে ছোট্ট একটা প্রিন্সেস গাউন পড়িয়ে মাথার চুলগুলো একত্রে করে ঝুঁটি করে দুটো ক্লিপ লাগিয়ে দিয়ে জুতা পড়িয়ে মিশানকে বললো,
— মিশান বোনকে হাতে হাতে রেখো। বাইরে কিন্তু অনেক লোক।
— আচ্ছা। তুমি কখন আসবে?
— তোমার বাবার হলেই আমি রেডি হয়ে আসছি।
মিশান মিশির হাত ধরে রুম থেকে বের হতেই রোদ দরজা লক করলো। রুম গুছিয়ে আদ্রিয়ান আর নিজের সব বের করলো। আদ্রিয়ান দরজা একটু খুলে গলা উঁচিয়ে ডাক দিলো,
— রোদ?
রোদ এগিয়ে এসে বললো,
— বলুন।
— টাওয়াল দাও।
— দিলাম না তখন।
— লাগবে আবার দাও।
রোদ দিতেই আদ্রিয়ান ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে দরজা লক করে দিলো।
.
আদ্রিয়ান পাঞ্জাবি পড়েছে আর রোদ পড়েছে লং গাউন সাথে হিজাব আর হালকা সাজ। এতেই মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগে। আয়নায় রোদের পেছনে আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
— তুমি এত সুন্দর কেন রোদ?
রোদ আয়নায় আদ্রিয়ানের চাহনি দেখে নজর নামিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান রোদের হিজাবটা কাঁধ থেকে সরাতে চাইলো কিন্তু পিন করায় তা হচ্ছে না। আদ্রিয়ান এবার অধৈর্য হয়ে বললো,
— উফ রোদ খুলো তো পিনটা।
রোদ সরে যেতে যেতে বললো,
— লেট হচ্ছে চলুন। এমনিতে ওনার কিছু হয় না অথচ আজিরা সময়তে রোম্যান্স করতে আসে।
আদ্রিয়ান মাথা চুলকে হাসলো একটু। দুজন বের হতেই শুনা গেল ইয়াজ এসেছে। রোদ ছোট সবাইকে নিয়ে গেট ধরতেই ইয়াজ বিরক্ত কন্ঠে বললো,
— এই আমি কি বিয়ে করতে এসেছি যে গেট ধরিস?
রোদ ভেংচি কেটে বললো,
— সম্পর্কে তোর বড় হই। সম্মান দিয়ে কথা বল। টাকা দে নাহলে চলে যা।
ইয়াজ পকেট হাতরে হাজার টাকার চারটা নোট দিতেই সবাই হোই হুল্লোড় করে উঠলো। ভীরের মধ্যেই কেউ যেন রোদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। রোদ ফিরতেই দেখলে এখানে ছোট বড় সবাই ই আছে। টাকাগুলো জারার কাছে দিয়ে রোদ আলগোছে সরে গেল। মনটা এবার ভীষণ ভাবে খারাপ হয়ে গেল। নিজ বাড়িতে এমন হচ্ছে অথচ রোদ কিছুই করতে পারছে না। রাদরা আসতেই রোদের মনটা ভালো হয়ে গেল। সবার সাথে মেতে উঠলো রোদ। বেশ সুন্দর ভাবে আংটি বদল হলো। জারবা বেচারী তো বিশ্বাস ই করতে পারছে না যে ইয়াজ এসেছে। পাশে ইয়াজ শুধু একবার ফিসফিস করে ওকে বলেছে,
— তুমি যে আমাকে লাড্ডুর মতো ঘুরাচ্ছো না এটা আমি সুধে আসলে উসুল করব। তোমার তিড়িং বিড়িং ছুটাবো আমি।
জারবা শুধু একবার ঢোক গিললো কিন্তু কিছু বলে নি।
________________
অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয় নি। রোদের পরিবার,ইয়াজের পরিবার,সাবার পরিবার সহ বেশ কিছু গেস্ট এখনও আছে। সবাই রোদের কথা জিজ্ঞেস করলেও কেউ ওকে পেলো না। আদ্রিয়ান ফোন করলেও রোদ ধরে নি। আদ্রিয়ান মিশানকে বললো,
— বাবা দেখো তো তোমার মা রুমে নাকি?
সবাই তখন আলাপ করছিলো বিয়ের। মিশান পা ঘুরিয়ে যাবে ঠিক ঐ সময় যেন হিংস্র ভাবে সিরি দিয়ে নামলো রোদ। পরনে এখন ওর বাসার কাপড়। সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে। কাউকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই টেবিল থেকে কাটা চমচ তুলে সোজা সামনে শশুড়,ফুপা, আরিয়ান আর রোদের বাবার সামনে গিলো। ফুপার হাতটা টেবিলে রাখা ছিলো। হিংস্র ভাবে রোদ পরপর দুই বার ফুপার হাতে কাটা চামচ দিয়ে শরীরের শক্তি দিয়ে আঘাত করলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় সবাই থমকে গেলো। ফিনকি দিয়ে র*ক্ত ছুটছে ফুপার হাত থেকে। রোদ তখন থরথর করে কাঁপছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। ফুপা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন। বাকিরা হতবাক হয়ে গিয়েছে।হঠাৎ ফুপি চিৎকার করে উঠতেই রোদ তার থেকে দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে বললো,
— এই চুপ। আরেকটা কথা বললে এই কাটা চামচ আপনার কন্ঠনালীতে ডুকিয়ে দিব।
রোদের এহেন রুপে ফুপি চুপ করে গেলেন। ফুপার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় রোদ বললো,
— তোর মতো কু*ত্তাকে ভাগা বসিয়ে কু*ত্তা দিয়ে খাওয়াবো আমি। জা*নো*য়া*র।
কাউকে কিছু বলার বা বুঝার সুযোগ না দিয়েই রোদ চলে গেল। রোদ যেতেই ফুপা নিজের স্বরে চেচিয়ে উঠলো। ফুপি স্বামীকে ধরলেন। জারা আর জুরাইন দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু বাবার দিকে এগুচ্ছে না। আদ্রিয়ানের বাবা গেস্টদের বিদায় দিলেন। সবাই বেশ আগ্রহী ছিলেন কাহিনি কি সেটা জানতে। রাদ রোদের কাছে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে আটকে বললো,
— আমাকে সময় দাও রাদ। বিশ্বাস করো তো? জাইফাকে নিয়ে বাসায় যাও।
আদ্রিয়ানের ভরসায় আর বাবার জোরাজোরিতে রাদ যেতে রাজি হলো। আদ্রিয়ান ধীর পায়ে হেটে হেটে কাউকে কিছু না বলে রুমে ডুকলো।
#চলবে
#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৯(বর্ধিতাংশ)
আদ্রিয়ান পা ঠেলে যেন রুমের সামনে এলো। কিছু একটা খুব খারাপ যে হয়েছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় নি ওর। দরজা খুলে রুমে ডুকতেই দেখলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। হাতরে লাইট অন করতেই দেখলো বিছানায় মিশিকে বুকের মধ্যে নিয়ে রোদ শুয়ে আছে। মিশিকেও চেঞ্জ করিয়ে দিয়েছে। লাইটের আলো চোখে পরতেই রোদ চোখ মেলে তাকালো। সামনে আদ্রিয়ানকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসে বললো,
— মিশিকে কোলে নিন। চলে যাব এখনই।
আদ্রিয়ানের হৃদপিন্ড খুব জোরে জোরে বিট করছে অজানা আশঙ্কায়। রোদের এমন নির্লিপ্ততা মানতে নারাজ এই মন। রোদের চোখে,মুখে রাগের লেশ মাত্র নেই যা কিছুক্ষণ আগেও ছিল। আদ্রিয়ান একবার মিশির দিকে তাকালো। তাকাতেই যেন সব ভুলে মেয়ের কাছে তড়িৎ গতিতে এসে গালে হাত বুলিয়ে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,
— এই রোদ মিশির গালে এমন লাল দাগ কিসের? এই দাগ…
— আমি মে’রেছি।
আদ্রিয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলে আলমারি থেকে বোরকা বের করতে গেলো রোদ। দুই সেকেন্ড সময় লাগলো আদ্রিয়ানের বুঝতে যে রোদ আসলে বললো টা কি? ওর এতটুকুন মিশি’কে মেরেছে। আদ্রিয়ান ফট করে বেড থেকে নেমে রোদের বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে এনে অসহায়ের মতো করে চেহারা আর ভীতু চোখজোরা নিয়ে থমকানো গলায় প্রশ্ন করলো,
— আমার কতটুকুন মেয়ে রোদ। ওকে কীভাবে মারলা? ওকে কেন মারতে হবে রোদ? তুমি কীভাবে হাত তুললা? এই রোদ তুমি কীভাবে পারলা? আমার মেয়েটার গাল কেমন লাল হয়ে আছে। আসো তুমি। দেখো। আসো না। দেখো লাল হয়ে গিয়েছে।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো আদ্রিয়ানের। রোদ’কে ধরে টেনে নিতে চাইলেও রোদ ঠাই দাঁড়িয়ে। গলায় কান্না আটকে রোদ বললো,
— মিশানকে ডেকে আনুন। এখনই যাব।
আদ্রিয়ান এবার হিতাহিত জ্ঞান হারায়। রোদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই রোদের পিঠের মেরুদণ্ড গিয়ে সজোরে ঠেকলো আলমারির শক্ত হাতরে। মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো আদ্রিয়ান,
— এই তুই আমার মেয়ের গায়ে হাত কীভাবে তুললি? কেন তুলেছিস হাত বল? তোর সাহস কীভাবে হলো? কতটুকু আমার মেয়ে? তোর হাত কাঁপলো না?
রোদ এবার নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ হলো। আলমারি ঘেঁষে বসে পরে আহাজারি করতে লাগলো। ভয় পেয়ে গেল আদ্রিয়ান যখন নজর গেল রোদের জখম হওয়া হাতে। এই হাতটা’তেই ঐ দিন তেলের ছিটা লেগেছিলো যা অনেকটা সেরেও গিয়েছিলো অথচ এখন বাজে ভাবে র*ক্তাত হয়ে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগিয়ে আগুনে পুরার পর হয়তো এই হাতে কিছু দিয়ে আঘাত করা হ’য়েছে। চামড়ার স্তর পুরে সাদা চর্বির স্তর বের হয়ে কিছু জায়গায় জায়গায় কালো হয়ে চর্বি আর র*ক্ত জমে আছে। রোদ তখনও ঐ হাত ফ্লোরে ফেলে আহাজারি করছে, কেন মেয়েকে মারলো। আদ্রিয়ানের বুক এবার হাঁপরের মতো উঠা নামা করছে। পা যেন ফ্লোরে আটকে গিয়েছে। রোদের হাত দেখেই যেন গা গুলিতে আসছে ওর। বহু কষ্টে পা ফেলে আদ্রিয়ান রোদের পাশে বসে পরলো তখনই নাকে চামড়া পুড়ে যাওয়া গন্ধ এলো যা রোদের হাত থেকে আসছে। নিজেকে সামলাতে বারবার ব্যার্থ হচ্ছে আদ্রিয়ান। এই চামড়া পুড়া গন্ধে কেমন পেট গুলিতে আসছে।
আদ্রিয়ান রোদের সামনে বসে হাত দুটির স্থান দিলো রোদের গালে। কিছু বলার চেষ্টা চালালো কিন্তু তার আগেই রোদ ধাক্কা দিলো আদ্রিয়ানের বুকে। আদ্রিয়ান ছিটকে পরতেই রোদ চিৎকার করে বললো,
— আমি কাল কতবার বলেছি, চলুন চলে যাই। কিন্তু আপনি চলেন নি। কাল চলে গেলে তো এমন হতো না।
রোদের দম আটকে আসছে। একটু থেমে আবারও বললো,
— ওকে আমি কতবার বলেছি আমার সাথে সাথে থাকতে। শুনে নি আমার কথা। মেরেছি। বেশ করেছি। কতটুকু মিশি আমার। ওকে কীভাবে..
আদ্রিয়ান তখনও ফ্লোরে বসে আছে। রোদ কথাগুলো বলেই জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। আদ্রিয়ান তারাতাড়ি উঠে রোদের কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। রোদ দম আটকে আটকে বললো,
— আমি নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারছি না। প্লিজ চলুন এখান থেকে।
— হু হু যাব তো সোনা। এখনই যাব।
রোদ আবারও কেঁদে উঠলো। কেন ছোট্ট পরিটার গায়ে হাত তুললো বলেই অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আদ্রিয়ান ওকে আরো শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,
— বাবা-মা সন্তানকে মারতেই পারে। স্বাভাবিক হও রোদ। দয়াকরে আমাকে বলো কি হয়েছে।
রোদ নিজেকে ছাড়িয়ে বেডে গিয়ে মিশির পাশে বসে ঘুমন্ত ছোট্ট প্রাণটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতে ব্যাস্ত হলো। আদ্রিয়ানও পাশে বসলো। রোদের হাত ধরে অনুনয় করে বললো,
— রোদ আমাকে এই চিন্তা থেমে মুক্তি দাও। কি হয়েছে বলো?
রোদ শান্ত চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। ঘুমন্ত মিশির পরণের পাতলা গেঞ্জিটা পেট থেকে তুলে বুক পর্যন্ত উঠিয়ে দিলো। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকাতেই হতবিহ্বল হয়ে গেল। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল আদ্রিয়ান। ছোট্ট মিশির বুকের দিকে লাল হয়ে আছে। যা বুঝার বুঝে গেলো আদ্রিয়ান। ওর হাত পা যেন অবশ হয়ে গেল। এতক্ষণের আতঙ্ক, ভয়,আশঙ্কা, উৎকন্ঠা সব যেন এবার দলা পাকিয়ে চোখ দিয়ে বর্ষিত হচ্ছে। নিজের শক্ত হাতের ভয়াবহ কম্পন টের পেলো আদ্রিয়ান। প্রচুর বেগ পেতে হলো যেন হাতটা তুলতে। কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে মেয়ের বুকে রাখলো। শক্ত হাতটা নরম ভাবে বুলিয়ে দিতে লাগলো ছোট্ট মিশির বুকে। আবার কি মনে করে সরিয়ে নিলো।
রোদের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো আদ্রিয়ান। রোদ একেবারে থমকে গেলো। আদ্রিয়ানের এমন বুক ফাটানো কান্না যেন রোদ সহ্য করতে পারছে না। হাউ মাউ করে কেঁদে যাচ্ছে আদ্রিয়ান। এ যেন এক ব্যার্থ বাবা মেয়েকে আগলে রাখতে না পেরে বুক ফাটা আর্তনাদ করছে। আদ্রিয়ানের এমন কান্নায় ঘুমন্ত মিশিও নড়েচড়ে উঠছে। রোদ তারাতাড়ি আদ্রিয়ানের মুখ চেপে ধরলো। ইশারায় বুঝালো, মিশি উঠে যাবে। আদ্রিয়ান রোদের বুকে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো। পুরুষ মানুষের এমন কান্না সত্যিই ভয়াবহ। কতটা আঘাতে জর্জরিত হয়ে একজন শক্তিবান প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এভাবে কাঁদে? রোদের চোখ দিয়ে ও পানি ঝরছে। জা*নো*য়া*র টা ছোট্ট মেয়েটাকে ছাড়ে নি। ক্ষুধার্থ হাতের তৃষ্ণা নিবারক হিসেবে ছোট্ট প্রাণটাকে ছাড়ে নি।
রোদ অনুভব করলো বুকের সুতির কাপড়টা ভিজে উঠেছে তার প্রিয় পুরুষের অশ্রুতে। একহাতে আগলে নিলো আদ্রিয়ানকে৷ বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে গেলো এতবড় সুঠাম দেহের অধিকারী আদ্রিয়ান রোদের ছোট বুকে। নিজেকে বাবা বলতেও আজ যেন লজ্জা লাগছে আদ্রিয়ানের। ঘরে বসে, সামনে থেকেও কি না ছোট্ট মা’টাকে আগলাতে পারে নি ও।
.
এই ঘটনা প্রায় বাড়ীর। ছোট ছোট প্রাণরা আদরের নামে মলেস্টের শিকার হচ্ছে। যা চোখে দেখেও কিছু পরিবার বুঝতে অক্ষম কেউ বা বুঝেও প্রতিবাদ করতে অক্ষম আত্মীয়তা রক্ষায়। কিছু পরিবার হয়তো এতদিনের চেনা পরিবার ভেঙে যাবে বলে কিছু বলতে পারে না। খুব কম সংখ্যক অভিভাবক প্রতিবাদ করে। নিজের ঘরের কিছু নোংরা মস্তিষ্কের পুরুষের কাছেই প্রতিনিয়ত মোলেস্ট হয়ে আসছে নিজের ঘরের মেয়েরা। কিছু ন*র*পি*চা*শের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় এই ছোট বাচ্চারা। বিকৃত মস্তিষ্কের এই পুরুষের বিচরণ আমাদের সমাজে অহরহ অথচ আমরা তা জেনেও নির্বাক।
________________
কিছুক্ষণ আগে~
“পুরুষের আদরের হাত মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্তই। ঘাড় থেকে যেন পিঠে না হয়। যদি হয় তাহলেই বুঝবি ওটা আদরের হাত না। নোংরা হাত ওটা।”
কথাটা রাদ ছোট থেকেই রোদকে বলতো। ভাই হিসেবে রাদ ছিলো বোনের ভরসার স্থান। মায়ের সাথে যতটা না কথা রোদ শেয়ার করত তার থেকে বেশি করত ভাইয়ের সাথে। শেল্ফ ডিফেন্স সহ আরো নানা বিষয়ের ধারণা রোদ পেয়েছিলো রাদ থেকে। ভাইয়ের কথা পইপই পালন করতো রোদ তাই হয়তো নিজেকে আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে অপবিত্র সব স্পর্শ থেকে। অপরিচিতদের মাঝে বাসে হোক বা পরিচিতদের মধ্যে বাসাতে রোদ এ ব্যাপারে ছিলো সর্বদা সচেতন। তথাকথিত ভাইদের মতো রাদ বলতো না,”আমি সব বিপদে তোর পাশে আছি। চিন্তা করবি না” বরং রাদ ওকে বলতো, ” ভাই তো সবসময় থাকবো না, নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত তোর নিজেরই করতে হবে”। সেই হিসেবে রোদকে অনেক বিষয়ে ছোট থেকেই অবগত করেছিলো রাদ। বয়সে যেহেতু অনেকটা বড় তাই রাদ এই সব বিষয়ে যতটুকু বুঝতো বোনকে বুঝাতো।
.
আজ যখন রোদ মেহমানদের সামনে ছিলো তখন ফুপাই ওর মাথায় আদরের নাম করে সেই হাত পিঠে নামায় আর অভ্যাস বসত রোদ সরে যায় তৎক্ষনাত। ফুপার দিকে তাকাতেই তার চোখে খারাপ কিছু আঁচ করে রোদ। বুঝতে আর বেগ পেতে হয় নি কাল থেকে কার নোংরা হাতের স্পর্শ পাচ্ছিলো ও। আদ্রিয়ানকে বলবে বলবে করেও অনুষ্ঠান শুরু হওয়াতে আর কিছু বলতে পারে নি। মিশিকে খাওয়াতে হবে কারণ এশারের পর জাগতে দেয় না রোদ ওকে। ভীর ঠেলে মিশানের কাছ থেকে মিশিকে নিয়ে মিশানকে বলে,
— মিশান মা মিশিকে খাওয়াতে যাচ্ছি। আমি আসলে খেতে বসবা। একা খেলেই তোমার টাল্টি ফাল্টি শুরু হয়ে যায়।
মিশান ঘাড় দুলিয়ে রুদ্র আর রাদের কাছে গেলো। রোদ মিশিকে ফাঁকা জায়গায় চেয়ারে বসিয়ে বললো,
— মাম্মার কিশমিশ এখানেই বসো। মাম্মা খাবার নিয়ে আসছি।
মিশিও খুশি মনে বসে রইলো। “কিশমিশ” ডাকটা অনেক প্রিয়। কিশমিশ তো অনেক মিষ্টি এরমানে মিশিও মিষ্টি। এটা ভেবেই ওর এত খুশি। রোদ চলে যেতেই ফুপা এসে কোলে তুলে নেয় মিশিকে। আদর আদর কথা বলে চকলেট দিবে বলে পাশের খালি রুমে নিয়ে যায়। নিজের নোংরা হাতের ছোঁয়া দেয় ছোট্ট মিশিকে। মিশি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
— দাদ্দাহ ব্যাথা।
থামে নি ফুপা। রোদ খাবার বেড়ে এসে মিশিকে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজে। হঠাৎ পাশের রুম থেকে মিশির কান্নার শব্দে ওদিকে যেতেই দেখে মিশি কাঁদছে আর ফুপা থামানোর চেষ্টা করছে। রোদ হাতের প্লেট রেখে তারাতাড়ি যেয়ে মিশিকে কোলে তুলে নেয়। মিশি মা’য়ের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ফুপা কিছুটা ভরকে গেলেও বলে,
— ব্যাথা পেয়ে কাঁদছিলো তাই থামাচ্ছিলাম আমি মামনি।
রোদ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে প্লেট হাতে নিয়ে চলে যায়। নিজের রুমে ডুকে মিশিকে নামিয়েই বলে,
— কোথায় ব্যাথা পেলে? মাম্মা না বসিয়ে গেলাম।
গোল গোল চোখে পানি ভর্তি নিয়ে মিশি বললো,
— দাদ্দাহ ব্যাথা দিয়েছে।
অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যায় রোদ। কোথায় জিজ্ঞেস করতেই অবুঝ মিশি নিজের বুকে দেখায়। রোদ ঝট করে মিশির পড়নের গাউন দেয় তখনই নজরে আসে ছোট্ট মিশির বুকের লাল দাগ। রোদের চোখে পানি চলে আসে। মিশিকে বুকে নিয়ে বললো,
— ওনার কাছে কেন গিয়েছিলে মা? আর কোথাও ব্যাথা দিয়েছে?
— দাদ্দাহ চকলেট দিবে মিশিকে।
রোদের রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো। বুক থেকে সরিয়েই রাগের চোটে মিশিকে থাপ্পড় মে’রে বললো,
— এই তোকে চকলেট খাইয়াই না আমি? এত কিসের চকলেট লাগে তোর?কেন গেলি? যদি খারাপ কিছু হতো তখন কি করতাম আমি?
এই প্রথম মা’য়ের হাতে আদরের বদলে মাইর খেয়ে ছোট্ট মিশি কেঁদে উঠলো ভয়ে। রোদও বেডে বসে কেঁদে উঠে। মা’য়ের কান্না সহ্য হলো না মিশির। নিজেও কান্না করতে করতে উঠে এসে মা’য়ের কোলে বসে হিচকি তুলতে তুলতে বললো,
— মাম্মা মিশি আর চকলেট খাবে না। মিশি দাদ্দাহর কাছে যাবে না। মাম্মা তুমি সেড হলে মিশিও সেড। মিশি আর কোথায় ব্যাথা পায় নি।
রোদ বুকে জড়িয়ে ধরে মিশিকে। আদরে আদরে ভরিয়ে তুলে বারবার মাফ চায় মিশির কাছে। রাগের চোটে যে নিজের কলিজায় আঘাতটা করেছে রোদ। মিশিকে গোসল করিয়ে বুকে ক্রিম লাগিয়ে খায়িয়ে বুকে নিয়ে শুয়ে পরে। ছোট্ট মিশি মা’য়ের আদরে ভুলে যায় একটু আগে যে মা মে’রেছে। মিশি ঘুমাতেই রোদ ওর কপালে চুমু খেয়ে উঠে নিজেও সব পাল্টে নেয়। ফোনটা বের করে ঠান্ডা মাথায় কাউকে ফোন করে। তারপর যেন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারে না। ওর সাথে যা করেছে তাতে হয় তো রোদ শাসিয়ে ছেড়ে দিতো কিন্তু মেয়ের বেলায় মা নরম হয় না। না ই ছেড়ে দেয়। তখনই রণচণ্ডী রুপে এসে রোদ নিচে সবার সামনে গিয়ে আক্রমণ করে।
.
হঠাৎ নিচ থেকে চেচামেচির আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো রোদের। ঠোঁটের কোণে ঝুলে উঠলো বাঁকানো হাসির সুক্ষ রেখা। আদ্রিয়ান ও উঠে বিধ্বস্ত হয়ে বুক থেকে। রোদ ওর হাত ধরে বললো,
— চলুন নিচে।
আদ্রিয়ান কিছুই বলে না। রোদের সাথে নিচে যায় তখনই দেখে ফুপা আর ফুপি সমানে চেঁচাচ্ছে। জুরাইন আর জারা সাইডে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে। আসল ঘটান কেউ ই জানে না। দুই জন কালো পোশাকধারী লোক ফুপাকে দুই দিক থেকে ধরে আছে। রোদকে দেখতেই ফুপি দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে বললো,
— বউমা। ওনাদের বলো না ওনাকে ছেড়ে দিতে।
রোদ কঠিন চোখে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। আদ্রিয়ান অবাক হলো রোদের চিন্তায়। রোদ জানতো পুলিশ দিয়ে আজকাল ন্যায় বিচার পাওয়া ভুষির ঢেরে মধ্যে সুচ পাওয়ার সমান তাই রোদ তখন সোজা RAB ( Rapid Action Battalion) এ খবর কারণ এদের হাত থেকে এত সোজা না। রোদ তখন ইশানকেই কল করে কারণ ইশানের শশুর RAB এ আছেন। ইশানই ফোন করে জানাতেই তারা হাজির হয়েছেন। রোদ আদ্রিয়ানের হাতটা শক্ত করে মুঠ করে নিয়ে তাদের সামনে এসে ফুপার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে বললো,
— এই লোক শিশু মলেস্ট করেছে আর আমাকে আপত্তি কর ভাবে ছুঁয়েছে। একবার না বারবার।
বাসার সবাই মাথায় যেন বাজ পড়লো। ফুপি রোদের ব্যাপারে আঁচ করতে পারলেও মিশির কথা মাথায়ও আসে নি। ফুপি একদম শান্ত হয়ে রুমে চলে গেলেন। আর কত জীবন এভাবে পার করবেন? আর কত সবার চোখে নিচু হবেন? অতীতে ভুল আঁকড়ে না থাকলে আজ হয় তো এই দিন দেখতে হতো না।
#চলবে…..
[ আজকের পর্বে কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ ছিলো। এক সেল্ফ ডিফেন্স জানা আর দ্বিতীয়ত বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখা। হাজার চাচা,মামা হোক। কার দৃষ্টি কেমন তা তো কেউ জানে না।
আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায়।]
(দেখলেন কত তাড়াতাড়ি পর্ব দিচ্ছি। এতদিন তো লেট হওয়ার বকেছেন এবার প্রশংসা করুন)