ভালোবাসার_ভিন্ন_রং #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৫৫(শেষাংশ) #সমাপ্ত_পর্ব

0
361

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৫(শেষাংশ)
#সমাপ্ত_পর্ব

বেশ সুন্দর ভাবেই বিয়েটা সম্পূর্ন হলো। জারবাকে বিদাই করা মোটেও সহজ হলো না কারো জন্য। এই মেয়ে তো এখানেই কেঁদে নিজেকে এলোমেলো করে ফেলেছে। দুই ভাইয়ের চোখেও পানি। ইয়াজ আরিয়ানের হাত ধরে বললো,

— ভাই আজ নাহয় থাকুক। কাল নাহয় নিয়ে যাব নে। ও ভয় পাচ্ছে।

আদ্রিয়ানের বাবা’র বুকের উপর পড়া পাথর যেন এতেই সরে গেলো। কোন বর বউয়ের কান্নায় এতটা গলে যায়। জারবার কান্নায় ইয়াজ নিজেই ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কতটা টেনশনে আছে তা ওর চেহারায়ই বুঝা যাচ্ছে। আদ্রিয়ানের বাবা এবার বুক থেকে মেয়েকে সরিয়ে দুই গালে হাত রেখে বললেন,

— আম্মু। যেতে হবে তো। কালই আবার আমরা নিয়ে আসব তোমাকে। দেখো সবাই অপেক্ষা করছে। আব্বুর কথা শুনবে না আব্বু’র পরি?

জারবা কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়লো। দুই ভাই মিলে বোনকে গাড়িতে তুলে দিলো। ইয়াজ শেষ মেষ কান্ড করেই বসলো। রোদ যখন ইয়াজকে কিছু বলছিলো যাতে জারবার সব ঠিক করে নিয়ে যায় তখনই ছেলেটা কেঁদে ফেললো। যদিও ওরা সাইডে ছিলো। রোদের কোলে আদ্র থাকাতে ও তেমন ভাবে সামলাতেও পারলো না। আদ্রিয়ান ওদের দেখতেই এগিয়ে এলো। ইয়াজ’কে জড়িয়ে ধরলো। সান্ত্বনা দিলো। ইয়াজ বোকার মতো করে রোদের হাত ধরে বললো,

— রোদ বোন আমার প্লিজ আজকে চল না আমার সাথে। আম্মু বাদে তো তেমন কোন বোন নেই আমার। তুই চল না। নাহলে জারবা ভয় পাবে।

রোদ চাইলেও যেতে পারবে না। কারণ আদ্র নিয়ে কোথাও ও থাকতে পারে না। তারমধ্য মিশি আছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে রোদ বললো,

— আচ্ছা আমি দেখছি। দাঁড়া।

রোদ তিশা আর অন্য একটা কাজিনকে বউয়ের সাথে পাঠিয়ে দিলো। কিছুটা সস্তি পেল ইয়াজ। বিদায় জানিয়ে বউ নিয়ে রওনা দিলো। পেছন থেকে জাইফ মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিল আজ বোনের শশুর বাড়ী থাকবে। এখন ক্যান্সেল। যার জন্য থাকবে সে ই তো নেই। রোদ বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। এই দু’জনে যে কিছু চলছে তা ও আগেই বুঝেছিলো। ঠিক একবছর আগে।
.
ভেন্যু ছাড়বে এমন সময় চিৎকার শুনা গেলো। দিশা গলা ফাটিয়ে কেঁদে দিলো। পেইন উঠেছে বুঝতে কারো বাকি রইলো না। রাতুল তারাতাড়ি ওকে ধরলো। একপ্রকার হইচই লেগে গেল মুহূর্তেই। মেহমান সব আগেই চলে গিয়েছিলো যারা ছিলো তারা আত্মীয়। সবাই ছুটলো হসপিটালে। ছোট আদ্র’কে নিয়ে রোদ ও গেলো। হসপিটাল সামনেই। তাই আদ্রিয়ান ও না করে নি। শুধু ঘুমন্ত মিশি’কে মিশান সহ বাবা-মা আর সাবা’দের বাসায় পাঠিয়ে দিলো। আরিয়ানা আর আলিফ ও ছোট। ওদের যাওয়ার মানে হয় না।

দিশার হাত ধরে রাতুল ওকে সাহস দিচ্ছে। যখন লেবার পেইন এ দিশা ছটফট করছিলো তখন রাতুল ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আল্লাহ’কে ডেকেছে। একসময় বাবা মায়ের প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাতুল দিশার মেয়ে ভূমিষ্ট হলো। নরমালেই এসেছে সে। একদম ছোট্ট একটা শিশু। বাচ্চাটাকে পরিষ্কার করেই দেয়া হলো তার বাবা’র কোলে। ভিন্ন রং এর আবির্ভাব ঘটলো রাতুলের জীবনে। বাবা হওয়ার মতো অতুলনীয় খুশিতে যেন পাগল প্রায় হলো রাতুল। দিশা’কেও দেখানো হলো। দূর্বল শরীরে ও দিশা হাসলো। ছোট্ট একটা রাতুল এসেছে দিশা আর রাতুলের ভালেবাসার চিহ্ন হিসেবে। কতশত কষ্ট। অবহেলা আর তিক্তটা পূর্ণ একটা সম্পর্ক এখন জোড়ালো হলো। মজবুত হলো। ভৃত্তি’টা যেন মজবুত হলো ছোট্ট এই প্রাণের স্পন্দনের মাধ্যমে।
.
জারবা এসেই নেতিয়ে গেলো। ইয়াজ কোলে তুলে সোজা ড্রয়িং রুমে এনে রাখলো ওকে। তিশা আর অন্য কাজিনটা থাকাতে কিছুটা সুবিধা হলো। ইয়াজের মা তারাতাড়ি হাত ধুয়ে বউয়ের জন্য খাবার নিলো। তখন মেয়ে’টা খেতে পারে নি। ইয়াজের বাবা পাশেই লেবুর পানিতে চিনি মিশাচ্ছেন। নিশ্চিত মেয়েটা টায়ার্ড এটা ভেবেই করা। এক ছেলে পেলে বড় করেছেন তারা। এখন তাদের মেয়ে এসেছে। মেয়েকে একদম এই রাজ্যের রাজকন্যা বানিয়ে রাখবেন তারা।

যেই ভাবা সেই কাজ। তারাতাড়ি করে ইয়াজের বাবা জারবাকে শরবত দিলেন। খেয়ে যেন দূর্বল জারবা একটু সস্তি পেলো। ইয়াজ ততক্ষণে সেরওয়ানী খুলে পাতলা টিশার্ট পড়ে এসেছে। এসেই দেখলো ওর মা জারবাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। কেমন বোকাসোকা বউ ওর। মাথার ঘোমটা তো দূর থাক টিকলিটা ও সোজা নেই। ইয়াজ জানে ওর পরিবারে এমন একটা বোকা পাখি ই দরকার ছিলো। যাকে ওর বাবা-মা পুতুলের মতো রাখবে। টোনাটুনির সংসারে এই জারবার ই প্রয়োজন ছিলো। সারাদিন ইয়াজ বাসায় না থাকলে তারা একা একাই সময় পার করে এখন তাদের সঙ্গী হলো।

খাওয়া হতেই তিশা জারবা’কে রুমে নিয়ে গেলো। পিছন থেকে ইয়াজ বলে দিলো,

— তিশা ওকে এগুলো খুলিয়ে পাতলা ড্রেস পরিয়ে দিস।

তিশা “আচ্ছা” ভাই বলে ভেতরে গেলো। জারবাকে ঐ সব খুলাবে কি উল্টো নিজের ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে জারবার ঠোঁটে দিতে দিতে বললো,

— ইশ নতুন বউ সব লিপস্টিক খেয়ে ফেলেছে।

বলেই আবার জারবাকে বড়সড় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো,

— কখন এভাবে থাক। ইয়াজ ভাইকে পাঠাচ্ছি।

— তুমি আরেকটু থাক তিশা।

— উহু। রাত কত হলো। বেচারা ইয়াজ ভাইয়ের পকেট খালি করে এখনি ঘুমাতে যাব আমি।

বলেই জারবার কানে কানে কিছু বলে চলে গেল। টিপটিপ করা বুক নিয়ে বসে রইলো জারবা। এতটাও বোকা নয় ও যতটা তিশা ভাবলো। লজ্জায় লাল হয়ে ঠাই বসে রইলো ও।
তিশা সোজা ইয়াজের কাছে গিয়ে বললো,

— ইয়াজ ভাই, পাঁচ হাজারের এক টাকা ও কম চলবে না।

— কি করবি?

— তোমার বউকে তো ঠিকঠাক সদর ঘাট বানিয়ে দিয়ে এলাম। এবার টাকাটা দাও।

— কি করে?

— ঘুমাচ্ছে।

— ওহ।

বলে পকেট হাতড়ে হাজার টাকার কচকচে পাঁচটা নোট তিশার হাতে দিয়ে বললো,

— এটা পুরোটা তোদের দু’জনের। রোদের টা আলাদা রাখা আছে।

তিশা খুশিতে আত্মহারা হয়ে চলে গেল। ইয়াজ ড্রয়িং রুমের লাইট গুলো অফ করে রুমে গেলো। ওমা! পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইয়াজ লাইট জ্বালাতেই চমকালো। এই রাতের বেলায় চাঁদের আলোর ন্যায় আপসরী তার বিছানায়৷ এক হাত ঘোমটা টেনে সে বসে আছে। ইয়াজের অপেক্ষা বুঝি? ঠোঁট কামড়ে হাসলো ইয়াজ। এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে। কাছে এসে ঘোমটা তুলতেই দেখা পেলো পরমা সুন্দরীর। ইয়াজের অর্ধাঙ্গিনীর। হ্যাঁ ইয়াজের বউ। কথাটা বারকয়েক আওড়ালো ইয়াজ। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো জারবা’র কোমল মুখ। কেঁপে উঠল জারবা। ইয়াজ ওর হাত ধরে বললো,

— জড়িয়ে ধরি। একবার শুধু। প্লিজ!

জারবা চুপ করে রইলো। ইয়াজ এগিয়ে এলো কিছুটা। আলতো হাতে জড়িয়ে নিলো। একসময় শক্ত হলো হাতের বাঁধন। আস্তে করে জারবার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

— আমার বউ।

— আমার জামাই।

ইয়াজ হেসে ফেললো। ওকে ছেড়ে উঠে বললো,

— শয়তান তিশাকে বললাম তেমাকে হেল্প করতে।

বলে নিজেই মেকাপ রিমুভার দিয়ে জারবার মেকআপ তুলতে লাগলো। একদম পরিষ্কার করে জারবার জন্য আনা একটা নাইট ড্রেস ওর হাতে দিয়ে বললো,

— রুমে চেঞ্জ করো। আমি বারান্দায় আছি। চেঞ্জ করে ডাকবে।

জারবা ঘাড় নাড়ালো। ইয়াজ যেতেই চেঞ্জ করে একেবারে নিজেও বারান্দায় এসে বললো,

— আমার শেষ।

ইয়াজ ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বললো,

— ফ্রেশ হয়ে একেবারে ওযু করে এসো।

ভদ্র মেয়ের মতো তাই করলো জারবা। এসে একসাথে দুজন নফল নামাজ আদায় করলো একসাথে। শেষ করে জারবার মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে ওকে ফুঁ দিলো ইয়াজ। ইয়াজের মুখের গরম বাতাস বেশ উপলব্ধি করলো জারবা। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ইয়াজকে। ইয়াজ দাঁড়িয়ে ফট করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ধীমি গলায় বললো,

— নাও আই ওয়ান্ট ইউ মাই সুগার ক্যান্ডি।

জারবা লজ্জায় মুখ গুজলো ইয়াজের বুকে। ঘর কাঁপিয়ে হাসলো ইয়াজ। মনে মনে বললো, “পাগলের বুঝ ষোল আনা”।
.
দিশার বাচ্চা দেখে যেই না বাড়ি ফিরবে তখনই জানতে পারলো দিশা ব্রেস্ট ফিড করাতে পারছে না। হসপিটালের বিশেষ দুধ ও ডক্টর চাইছে না বারবার দিতে কারণ সেটা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দেয়া হয় না। আপাতত অন্য কেউ ফিড করাতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু এমন সময় কাকেই বা পাবে রাতুল। মেয়েটাও ক্ষুধায় কেঁদে যাচ্ছে। পৃথিবীর আলো দেখেছে তার চার ঘন্টা হয়ে এলো। হঠাৎ ওদের কথার মাঝে দিশার মা বলেই ফেললো,

— রোদ মা তুই একটু খাওয়া না। দিশার তো হচ্ছে না।

রোদ চমকালো। একটু বেশিই চমকালো। চমকালো রাতুল নিজেও। আদ্রিয়ান হয়তো একটু চমকেছে কিন্তু ততটাও না। রাতুলের মা রোদের হাত ধরে বললেন,

— মা একটু খাওয়াও না। দেখো কিভাবে কাঁদছে।

রোদ কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রকে কোলে নিয়ে এসে বললো,

— অবশ্যই খাওয়াবে। কেন নয়?

রাতুল যেন ভিষণ চমকালো। তারাতাড়ি ওকে দিশার কেবিনে নিলো। রোদ মিনমিন করে বললো,

— অন্য কোথাও খাওয়াই।

ওর চাচি বললো,

— কি হয়েছে? আমরাই তো।

রোদ মুখটা নীচু করে রাখলো। আদ্রিয়ান জানে রোদ কারো সামনে ফিড করাতে পারে না আদ্রিয়ান ছাড়া। ও আদ্রিয়ানের সামনেই ঢেকে ঢেকে ফিড করায়। আদ্রিয়ান রোদকে নিয়ে পাশের কেবিনে গেলো। সেটা খালি আপাতত। সেখানেই রোদ প্রথম বারের মতো আদ্র বাদে কাউকে ফিড করালো। ছোট কয়েক ঘন্টার মেয়েটা কিভাবে খাচ্ছে। কি মনে করে কেঁদে ফেললো রোদ। আদ্রিয়ানের ও চোখ লাল হয়ে গেল। ছেলেকে আরেকটু চেপে ধরলো। ওদের মেয়েটা থাকলে তো এভাবেই খেত। ভাবতেই কেমন গলায় দলা পাকিয়ে কান্না আসে। রোদ খাওয়ানো হতেই বাচ্চাটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো৷ চাইলেও থাকতে পারবে না এখানে। কেমন একটা টান অনুভব হচ্ছে এখনই। আদ্র ততক্ষণে জেগে উঠলো। জাগতেই তার খাবার চাই। রোদ ছেলেকে খায়য়ে একেবারে বের হলো। রোদের চাচি এসে বললো,

— জাইফা এসে আবার সকালে খাওয়াবে। এখন বাসায় যা মা।

রোদ যাওয়ার আগে ও বারবার তাকিয়ে দেখলো ঘুমন্ত মেয়েটাকে। মন চাইছে না যেতে। তবুও অপারগ রোদ আদ্রিয়ান।

____________________

বর্ষা কেটে শরৎ উঁকি দিচ্ছে। সাদা সাদা কাঁশ ফুলে চারদিক ঘেরা। আশে পাশে লেক আর নদীর পানি এখন টাইটুম্বুর। সবাই ঘুরতে যাচ্ছে প্রিয়জনকে নিয়ে। হারাচ্ছে সাদা মেঘের আড়ালে। প্রেম বিলাস করছে নব পুরাতন সকল জুটি৷ কেউ কেউ শরৎ উৎযাপন করতে সাদা শাড়ী পড়ে এসেছে। ষড়ঋতু’র দেশ হলেও আমরা তিনটা বাদে বাকিগুলো তেমন উপভোগ করতে পারি না। কিন্তু চারুকলা থাকাতে তা ভুলাও সম্ভব না। প্রতিটা ঋতু এখানে পালন করা হয়। বরণ করা হলো নিত্য নতুন সাজে।
এত সবের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো রোদ। গাড়িতে বসেই দেখছিলো ও। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়েছে আজ কয়েক মাস হলো। নিউট্রিশন এন্ড ফুড ইন্জিনিয়ারিংএ করছে রোদ। রোদ নিজের কোন ইচ্ছে প্রকাশ করে নি। আদ্রিয়ান ই এটাতে দিলো। রোদ ও না করে নি কারণ এটাও বায়োলজি বেস্ড। রোদের অনেকটা সুবিধা হবে। সরকারি ভার্সিটি হওয়াতে রোজ আসার ঝামেলা নেই। আজ পরিক্ষা বিধায় এসেছে। রোদের পরিক্ষার সময় আদ্র’কে আদ্রিয়ানই রাখে। মা ছাড়া থাকতে চায় না সে।
গাড়িটা বাসাতে ডুকতেই দৌড়ে মিশি এলো। বাড়ির সামনেই ছিলো আজ। রোদ নামতেই হাঁটু জড়িয়ে ধরে বললো,

— মাম্মা?

— জ্বি মা। আমার মা বাইরে কি করে?

বলেই কোলে তুলে নিলো। মিশি মায়ের গালে চুমু খেয়ে ব্যাগে হাত দিলো। রোদ তাতে আলতো চাপড় মে’রে বললো,

— কিছু আনি নি।

— আমি দেখব।

ব্যাগ হাতিয়ে ঠিকিই মিশি দুটো ক্যাটবেরি করলো। রোদ ওকে নিয়ে ভেতরে ডুকতে ডুকতে বললো,

— একটা বড় ভাইকে দিবে।

— আচ্ছা।

রোদ রুমে ডুকার আগেই আদ্রিয়ানের কথা শুনতে পেলো। ছেলের সাথে কি বলে এই লোক আল্লাহ মালুম। রুমে ডুকতেই দেখলো আদ্রর ছোট্ট পেটে আলগা করে মাথা রেখে আদ্রিয়ান আবদার করে বলছে,

— আব্বা চুলগুলো টেনে দিন।

রোদ ফিক করে হেসে উঠলো। আদ্রিয়ান ঐ দিকে তাকিয়ে বললো,

— কখন আসলা?

— যখন আপনি এক বছরের ছেলেকে চুল টেনে দিতে বলছিলেন।

বলেই ভেতরে ডুকতেই আদ্র’র কাছে এলো। ছোট্ট আদ্র মা’কে এতক্ষণ পর দেখেই হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগলো,

— আমমা। আম্মমা।

রোদ চোখ ভরে ছেলেকে দেখলো। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে বসলো বিছানায়। আদ্রিয়ান ওর ফাইল আর ব্যাগ গুছিয়ে রাখছে। রোদ আদ্র’কে কোলে নিতেই বড় বড় চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মা’কে দেখলো সে। মুখ খুলে আবারও ডাকলো,

— আআম্মা…

— জ্বি মা। এই যে আম্মা। আমার বাবা কি করছিলো? আম্মার বাবা কি খেয়েছে? আব্বা কি তাকে খায়িয়েছে?

আদ্রিয়ান মায়ের কাঁধে মুখ দিয়ে রাখলো। নাক মুখ ঘঁষলো মায়ের গালে। বুকে। মায়ের গালে লালা ভরিয়ে ছলছল চোখে তাকালো। রোদ বুঝে নিলো ছেলে তাকে মিস করেছে। আজই শেষ পরিক্ষা ছিলো। আর চিন্তা নেই। আদ্র’কে বুকে নিয়েই হিজাবটা খুলতে চাইলো। পেছন থেকে কারো হাত তা খুলতে সাহায্য করলো। খুলা হতেই রোদ আদ্র’কে বুকে নিয়ে কাঁত হয়ে শুয়ে পরলো। বাকিটা আদ্র এখন নিজেই পারে। মায়ের কাছে সে খাবে এখন। মায়ের ঘ্রাণ নিবে। একদম শান্ত ভদ্র ছেলে যাবে। চুকচুক শব্দ করে সে খাচ্ছে। রোদ আরেকটু জড়িয়ে বুকের উপর তুলে নিলো। মায়ের বুকের উপর শুয়েই আদ্র খাচ্ছে। অনেক ঘন্টা মা ছাড়া ছিলো আজ।

আদ্র কে শান্ত দেখেই আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে রোদের মাথার কাছে বসলো। চুলে হাত বুলিয়ে বললো,

— পরিক্ষা কেমন হলো?

— আলহামদুলিল্লাহ। আজই শেষ।

— হুম।

— কেঁদেছিলো?

— সেটা আবার বলতে? পাগল বানিয়ে ফেলেছে আমাকে। ওর আম্মা চাই ব্যাস। আব্বা দিয়ে কি আর এত ঘন্টা চলে?

— খায়নি?

— অর্ধেক সেরেলাক্স খেল। জোর করেও খাওয়াতে পারি নি। পরে মিশানের কাছে ঘুমিয়েছিলো একটু।

— ওহ্। আজকে কি ব্যাস্ত?

— কেন?

— এমনিতেই।

আদ্রিয়ান রোদের মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। দুই হাতে চুলের ভাজে বিলি কাটতে কাটতে বললো,

— তোমার জন্য আমি সবসময় ফ্রী? বলো।

— আরে তেমন কিছু না। এমনিই বললাম। আচ্ছা আপনি কি জানেন কাঁশ ফুল ফুটেছে।

— খেয়াল করি নি। উড়ে উড়ে আসে মাঝে মধ্যে।

— হু।

— ঘুমিয়েছে ও। রেখে উঠো। গোসল করে এসো। ওকে আমি করিয়েছি।

রোদ আস্তে করে আদ্র’কে বুক থেকে নামালো। দুই দিকে বালিশ দিয়ে কাপড় নিয়ে ডুকলো ওয়াশরুমে।
.
রাদ, জাইফা তাদের ছেলে রুহানকে নিয়ে এসেছে রাতুলদের বাসায়। রাতুল ই দাওয়াত করেছিলো। দিশা একা হাতে সব রান্না করেছে। হাজার চেয়েও শাশুড়ী থেকে হেল্প নেয় নি ও। রাতুল সামলেছে রুহানী’কে। তার পরীটাকে। একদম ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে ওর। চুপচাপ থাকে। কাঁদে ও খুব কম। রাতুল মেয়েকে কোলে নিয়েই দরজা খুললো। প্রিয় বন্ধুকে দেখে একহাতে জড়িয়ে নিলো। জাইফা এসেই রুহানীকে কোলে নিলো। ওর সাথে বিশেষ এক সম্পর্ক আছে ওর। রুহানীর দ্বিতীয় দুধ মা ও। প্রথম দুধ মা রোদ। পালাক্রমে দীর্ঘ চল্লিশ দিন ওরা ফিড করিয়েছিলো এই ছোট্ট জানটাকে। এরপর থেকে দিশা ই ফিড করাতে পেরেছে। তাই আর প্রয়োজন পরে নি।
ওদের ভেতরে নিয়ে বসালো রাতুল। সম্পর্কের তিক্ততা গুলো এখন নেই। দিশা হাসি মুখে খাবার বেরে দিচ্ছে। রাদ যখন ওকেও বসতে বললো। দিশা মুচকি হেসে বললো,

— উনার সাথে খাব ভাইয়া। আপনি খেয়ে নিন।

রাদ প্রশান্তির হাসি হাসলো। দিশা নামক একটা অধ্যায় একটা সুখী। দুঃখ শেষ সে এখন কারো রাজ্যের রাণী। ভালেবাসার ভিন্ন রং এর দেখা পেয়েছে সে এখন। রঙিন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

_______________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আকাশে উড়ে যাচ্ছে সাদা সাদা ফুলা ফুলা পেজা তুলোর ন্যায় মেঘ। একসাথে কত গুলো সময় পার হলো। মাস পার হলো। জারবাকে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতেই জারবা মুখ গোমড়া করে বললো,

— ছাড়ুন। কথা নেই।

— কেন কেন?

— তখন কে ধমকালো।

— সেই কথা আবার বললে আবারও ধমক খাবা জারবা।

বলেই ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ইয়াজ। বারান্দার রেলিং এ হেলান দিলো। জারবার দিকে তাকাতেই সেই রাগ ধরে রাখতে পারলো না। কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললো,

— সময় হোক জারবা। আমরা ও বেবি নিব। এখন তুমি সামলাতে পারবে না ময়না পাখি।

— পারব। সত্যি।

— দেখা যাক। আল্লাহ দিলে হবে। এত অধৈর্য হলে হয়?

— হুম।

— আমার জান কি খেয়েছে?

— হুম।

জারবার হাতটা নিজের বুকে রাখলো ইয়াজ। জারবা তাকালো। এই লোকটার নেশালো চোখে ও ডুবে যায় বারবার। হাজার বার। ভিন্ন ভিন্ন ভালোবাসার রং দেখতে পায়। একদম কাছে থেকে। যতটা কাছে থেকে বুকের ধুকপুকানি শুনা যায়।
.
বিকেল হতেই আদ্রিয়ান ফিরে এলো। রোদ তখন কিচেনে ছিলো। হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে আদ্রিয়ানকে দেখে আবারও কিচেনে ডুকে শরবত নিয়ে রুমে গেলো। এগিয়ে দিতেই আদ্রিয়ান এক ঢোকে খেয়ে নিলো। রোদ জিজ্ঞেস করলো,

— এত তারাতাড়ি?

— একটা মিটিং ছিলো।

— ওহ্।

— কি করছিলে?

— আদ্র’র খিচুড়ি রান্না করলাম৷

আদ্র তখন হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে আসতেই রোদ কোলে তুলে নিয়ে মিশানকে বললো,

— আব্বু দেখো তো বোন কোথায়। বলো মা ডাকে। খাবে এখন।

আদ্রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এখন বাইরে যাব। মিশান মিশিকে নিয়ে এসো। তুমি ই রেডি হও।

দুই লাফে মিশান বাবা’র কাছে এলো। আদ্রিয়ান জানে ছেলে কতটা খুশি হয়েছে। মিশান শুধু বাবা’কে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানিয়েই দৌড়ে।
মিশান যেতেই রোদের থেকে ছেলে’কে নিলো আদ্রিয়ান। আদ্র গালে টোল ফেলে হেসে উঠলো। মুখে ডাকতে লাগলো,

— আবব্বা। আব্বা।

— জ্বি আব্বা। আব্বা’র জান কি খেলছিলো।

আদ্রর বয়সে বাকি বাচ্চারা আরো কথা বলতে পারলেও আদ্র একটু কম পারে। তাতে অবশ্য রোদ আদ্রিয়ান কারোই আফসোস নেই। তাদের ছোট্ট সোনা মা-বাবা’কে ডাকতে পারে এই ঢের। আদ্রর আধো আধো গলায় এই “আব্বা আম্মা” ডাকটা দুই জনের কাছেই স্বর্গ সুখ এনে দেয়।

রোদ আদ্রিয়ানের ব্লাজার খুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাবেন।

— দিয়া বাড়ি।

— আজব কেন?

— কাঁশ ফুল দেখতে।

রোদের ঠোঁটে আলতো হাসির রেখা ফুটলো। আদ্রিয়ানটা কিভাবে যেন সব বুঝে যায়।
.
আদ্রিয়ানের কোলে আদ্র। রোদের হাতে ধরা মিশি তার হাত ধরা মিশান। পাঁচজন একসাথে হেটে যাচ্ছে সামনের দিকে। সাদা সাদা কাঁশ ফুল বিলাস করছে তারা। এত এত জুটি এখানে অথচ এমন ভরা সংসার কয়জনের আছে? আদ্রিয়ান রোদের আছে। যাদের সংসার এখন পরিপূর্ণ। হয়তো মাঝে মধ্যে বুকের কোন এক জায়গায় চিনচিন ব্যাথা হয়। একটা প্রাণ নাহয় চলে গিয়েছে। তবুও আজ ওরা আছে। এত এত ভালোবাসাময় ঘিরা একটা রঙিন পৃথিবী আছে। যার সর্বোপরি জুড়ে আছে ভিন্ন রং এর বিচরণ। দূর থেকে যেন বাকিরা হিংসা করবে। এতটা সুন্দর গোছালো সংসার ও হয়? এতটা ভালোবাসা কি আদৌও হয়? উত্তরের থেকে উদাহরণটাই নাহয় হোক রোদ আদ্রিয়ানের এই ভিন্ন রং এর ভালোবাসা।

#সমাপ্ত

[ “রুদ্রিয়ান” মানে কোন নতুন গল্প লিখব না। যেখান থেকে “ভালোবাসার ভিন্ন রং” আজ শেষ হলো সেখান থেকেই শুধু করে কয়েকটা পর্ব লিখব আপনাদের অনুরোধে। সেটা পাবেন ২৫ তারিখ থেকে।]
( আমার এই গল্পে অনেক অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আবার অনেক কটু বাক্য ও পেয়েছি। সর্বোপরি পেয়েছি একগাদা অনুপ্রেরণা। ভালোবাসা। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাপোর্ট করার জন্য। শিঘ্রই ফিরে আসব আপনাদের রোদ-আদ্রিয়ান নিয়ে। ভালোবাসা রইলো অবিরাম)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here