মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_৯ ( প্রথমাংশ )

0
665

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৯ ( প্রথমাংশ )

” মামি! মামা তোমাকে ডাকছে। এখন নাকি বেড়োবে। ”

ইনায়া এসে পল্লবীকে ডাক দিলো। স্বামীর প্রসঙ্গ উঠতেই পুরনো কথা অসম্পূর্ণ রইলো। ননদের পানে একপলক তাকিয়ে স্টাডি রুম থেকে প্রস্থান করলেন পল্লবী। মালিহা তপ্ত শ্বাস ফেলে ইনায়ার সাথে লিভিং রুমে অগ্রসর হতে লাগলেন। ভাই ও ভাবীকে বিদায় জানানোর জন্য।
.

ঘোর অমানিশায় ছেয়ে ধরিত্রী। চন্দ্রিমা লুকিয়ে মেঘের অন্তরালে। শীতল পবন বইছে চারিদিকে। বৈরী আবহাওয়া। বৃষ্টি হতে পারে। লিভিং রুমের সোফায় বসে মেয়েটি। আনমনে অস্থিরতা অনুভব করছে। ঘড়ির কাঁটা তখন দশের কাছাকাছি। বাহ্যিক বৈরী ভাব তার অন্তরেও প্রভাব সৃষ্টি করছে। বারংবার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে প্রবেশদ্বারে। অপেক্ষায় একজনের। মালিহা ওয়াটার বটল হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলেন। হঠাৎ পুত্রবধূকে লক্ষ্য করে ঈষৎ চমকালেন! হৃদি একসময়ে এখানে! পরক্ষণে বিষয়টি অনুধাবন হতে তৃপ্তিময় ঝলক পরিলক্ষিত হলো চেহারায়। পুত্রের অপেক্ষায় পুত্রবধূ। মধুরতম মুহূর্ত! মুচকি হেসে উনি নেমে এলেন। এগিয়ে গেলেন হৃদির কাছে।

” কি রে মা! তুই এখানে? ”

বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন উনি। আকস্মিক ওনার কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। তড়িঘড়ি করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

” ম্ মা! ”

” কত রাত হয়েছে। এখনো জেগে আছিস কেন মা? যা ঘুমিয়ে পড়। ”

হৃদি আমতা আমতা করে দরজার পানে দু’বার তাকালো। অতঃপর মায়ের কাছে সত্য ই বললো,

” মা তোমার ছেলে তো এখনো এলো না। বাহিরে জোরে বাতাস বইছে। আ আবহাওয়া ভালো না। ”

উনি প্রসন্ন হলেন এহেন কথায়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” চিন্তা করিস না মা‌। আমার ছেলেটা এরকম ই। দেশসেবাই ওর সমস্ত ধ্যান জ্ঞান। বাড়ি ফেরার কথা বোধহয় মনেই থাকে না। তুই রুমে যা। ও ঠিক সময়মতো চলে আসবে। ”

কক্ষে ফেরার প্রস্তাব ঠিক মনমতো হলো না। তাই দ্বিমত পোষণ করলো হৃদি,

” সমস্যা নেই মা‌। আমি এখানেই আছি। ঘুম আসছে না। তুমি বরং যাও। বিশ্রাম নাও। উনি এ-ই চলে আসবেন। ”

মালিহা বুঝতে পারলেন স্বামীকে না দেখা অবধি এ মেয়ে প্রস্থান করবে না। তাই উনিও আর বিরক্ত করলেন না।

” ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। বেশি রাত করিস না কিন্তু। কেমন? ”

” হুম। তুমি এবার তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। বয়স হচ্ছে তো। বেশি বেশি বিশ্রাম দরকার। ”

মালিহা হেসে ওর গাল টিপে দিলেন।

” ও রে পাকা মেয়ে রে! মা’কে এত তাড়াতাড়ি বুড়ি বানিয়ে দিচ্ছিস? ”

দাঁত বের করে হাসলো হৃদি। সে হাসিতে সংক্রমিত হয়ে উনিও হাসলেন।

” আচ্ছা আচ্ছা। আমি যাচ্ছি। ইরু বোধহয় ফিরে খাবে না। তাই বেশি দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস। রাত জাগা বাজে অভ্যাস। ”

মাথা নাড়ল মেয়েটি। কথার ভীড়ে ‘ ইরু ‘ শব্দটি ঠিক খেয়াল করলো না। অন্যথায়..

মালিহা ওয়াটার বটল পূর্ণ করে নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে ধাবিত হলেন। লিভিং রুমে একাকী রয়ে গেল হৃদি। বিড়বিড় করতে করতে মেয়েটা সোফায় বসে পড়লো,

” কত রাত হয়ে গেল। উনি এখনো বাহিরে করছেন টা কি? বাড়ি বাড়ি নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন নাকি পতাকা উত্তোলন করছেন? যত্তসব দরবার। ”

বিরক্ত বোধ হচ্ছে। তবুও সেথা হতে যাচ্ছে না। ওকে তো কেউ থাকতে বলেনি। নিজে থেকে স্বেচ্ছায় থাকছে আবার বিরক্ত বোধও হচ্ছে। এ কেমন দ্বৈত জ্বা লা! সহসা এ জ্ব’লন সমাপ্ত হলো। বেজে উঠলো কলিংবেল। উচ্ছ্বসিত হয়ে দ্রুত পায়ে মূল দ্বারের পানে অগ্রসর হলো হৃদি। বিলম্ব না করে দ্বার উন্মুক্ত করলো। অবশেষে দেখা মিললো একান্ত মানবের। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে দাঁড়িয়ে মানুষটি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ওকে দেখে ঈষৎ চমকিত! সে চমকানো ভাব চোখেমুখে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট রূপে। হৃদি আলতো হেসে বলল,

” হাই! দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন। ”

দৃষ্টি সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে সালাম দিলো ইরহাম।

” আসসালামু আলাইকুম।‌ ”

স্বল্প অপ্রস্তুত হয়ে সালামের উত্তর দিলো মেয়েটি,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”

লিভিং রুম এরিয়া ত্যাগ করতে করতে ইরহাম গম্ভীর স্বরে শুধালো,

” এখনো জেগে কেন? ”

হৃদি প্রত্যুত্তর দিতে যাচ্ছিল যে আপনার জন্য। তবে তা আর বলা হলো না। থমকে গেল গম্ভীর মানবের ভাবস্ ওয়ালা উপদেশ শুনে।

” আর কখনো জাগবে না। ঘুমিয়ে পড়বে। ”

পেছনে দন্ডায়মান মানবীর কথা শোনার জন্য দাঁড়ালো না ইরহাম। বড় বড় কদম ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পেছনে রয়ে গেল বিহ্বল হৃদি!

” এ কেমন লোক রে বাবা! ”

ভানু’র দ্যুতি ছড়িয়ে ধরনীর বুকে। আলোকিত চারিদিক। গভীর নিদ্রায় মগ্ন মেয়েটি। ঘুমের ঘোরে উষ্ণতার খোঁজে আরেকটুখানি ডানে চেপে গেল। জাপটে ধরলো পাশবালিশ। তবে শিরা উপশিরায় কেমন শিরশিরানি অনুভূত হচ্ছে। অস্বস্তি জাপটে ধরছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এমন অস্বস্তি তাকে ঘুমোতে দিলো না। বিরক্ত হয়ে ঘুমকাতুরে আঁখি জোড়া মেলে তাকালো। তাকাতেই হলো বিহ্বল! পাশবালিশের বদলে এসব কি! ও মা! অনাবৃত উদোম উদরে পেঁচিয়ে তার হাতটি। হৃদির চঞ্চল আঁখি যুগল একবার উদোম উদরে, আরেকবার নিজ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় চমক এলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। যখন নয়নে মিলিত হলো নয়ন। নভোনীল চক্ষু জোড়া তার পানেই আবদ্ধ। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি। ভুলে গেল নিজস্ব অবস্থান। বিপরীতে থাকা মানুষটিও গভীর চাহনিতে তাকিয়ে। যে চাহনি তোলপাড় সৃষ্টি করছে হৃদয়ে। তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে র-ক্ত কণিকায়। সম্মোহিত মেয়েটি অনাবৃত উদরে এখনো হাত পেঁচিয়ে। অতিবাহিত হলো কয়েক মুহূর্ত। নভোনীল চক্ষু জোড়া যেই পলক ঝাপটালো ওমনি চেতনা ফিরলো হৃদির। নিজস্ব অবস্থান অনুধাবন করে আঁতকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে সরে গেল। একপলক বিহ্বল স্বামীর পানে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো। এলোমেলো ভঙ্গিমায় দৌড়ে প্রবেশ করলো ওয়াশরুমে। সশব্দে বদ্ধ হলো দ্বার। খুলে রাখা দোপাট্টাটি তখনো বালিশের পাশে। মিস্টার চৌধুরী তো হতবাক, হতবিহ্বল সব একত্রে! কি থেকে কি হয়ে গেল এ!

বিছানায় বসে সুপারি টুকরো টুকরো করে খণ্ডিত করে চলেছেন রাজেদা খানম। সমস্ত ধ্যানজ্ঞান সে কর্মে। তখনই সেথায় আগমন হলো নাতবউ এর। উন্মুক্ত দ্বারে দাঁড়িয়ে মেয়েটি দৃষ্টি আকর্ষণ করলো,

” আসসালামু আলাইকুম দাদি। আসবো? ”

ওর পানে একঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন দাদি। অনুমতি প্রদান করলেন,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আয়। ”

মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো মেয়েটি। দাদির পাশে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলো,

” বসতে পারি দাদি? ”

দাদি হাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। অনুমতি পাওয়া মাত্রই বাঁ পাশে বসলো হৃদি। একমনে অবলোকন করতে লাগলো সুপারি কাটা।

” অ্যামনে গোল গোল চোখ কইরা কি দ্যাহোছ? ”

” সুপারি কাটা দেখছি গো দাদি। বেশ ডেঞ্জারাস আছে। তোমার হাতে লাগে না? ”

দাদি মৃদু হেসে বললেন,

” না লাগে না। বছরের পর বছর কাটতে কাটতে অভ্যাস হইয়া গেছে। ”

” আচ্ছা তোমরা সিনিয়র সিটিজেনরা এত পান ভক্ত হও কেন? মানে এই পান পাতায় কিসের এত স্বাদ? আমার তো দেখতেই কেমন লাগে। সাদা দাঁত লাল টকটকে হয়ে যায়। উঁহু হুঁ। ”

মুখ বিকৃত করে বাক্য সমাপ্ত করলো মেয়েটি। ওর সরল স্বীকারোক্তি শুনে নিঃশব্দে হাসলেন রাজেদা খানম।

” পান হইলো নে শা র লাহান। বুঝলি? একবার দুইবার তিনবার খাইলে নে শা ধইরা যায়। আরো খাইতে মন চায়। ছাড়তে ইচ্ছা করে না। ”

” তাই নাকি? আচ্ছা তাহলে তুমি এই নে*শায় কবে থেকে নে*শাক্ত হলে? ”

” আমার বিয়ার পর থে। তোগো দাদার পান বহুত পছন্দ আছিল। হ্যার দ্যাহাদ্যাহি আমিও খাইতে আরম্ভ করলাম। এরপর.. ”

হৃদি দুষ্টুমি করে সুর টেনে বললো,

” ওহ্ হো! দাদাজানের অভ্যাস তোমাতে ট্রান্সফার হলো? নট ব্যাড! ”

” ব্যাড বুড ছাড় তো। একখান খাইয়া দ্যাখ। ভাল লাগবো। ”

হৃদি দ্বিধান্বিত স্বরে শুধালো,

” বলছো? খাবো? দাঁত লাল হয়ে যাবে না? ”

” রাখ তো ছে ম ড়ি তোর লাল নীলের কথা। একখান খাইয়া দ্যাখ। ”

দাদি পানের বক্স হতে একটি সাজানো পান ওর হাতে তুলে দিলেন। হৃদি ইতিউতি করছে। মুখে দেবে কি দেবে না দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। অবশেষে দ্বিধা ত্যাগ করে মুখে পান পুরে নিলো। আস্তে আস্তে চিবোতে শুরু করলো।

” কি ক্যামন লাগতাছে? ”

হৃদি মৃদু স্বরে পান চিবোতে চিবোতে অস্ফুট স্বরে বললো,

” সত্যি বলছি। মন খারাপ করো না আবার। আমার না কেমন যেন লাগছে। ”

সশব্দে হেসে উঠলেন রাজেদা খানম। নাতবউ এমন আদুরে মুখ বানিয়ে বলছে না হেসে পারলেন না। ওনার হাসি দেখে হৃদি কাঁচুমাচু মুখে পান চিবোতে লাগতো। কেমন যেন স্বাদ লাগছে! প্রথমবার বলে কি!

বিবাহ পরবর্তী জীবনে অতিবাহিত হয়েছে ক’দিন। হৃদি আজ স্বামীর সঙ্গে পিতৃগৃহে যাচ্ছে। বিয়ের পর প্রথমবারের মতো। স্বাভাবিক ভাবেই আনন্দ, উত্তেজনা বিরাজ করছে শিরায় উপশিরায়। খুশি ভাব স্পষ্টত মুখশ্রীতে। টয়োটা প্রিমিও তে পাশাপাশি বসে দু’জনে। ব্যস্ত সড়কে চলছে গাড়িটি। হৃদি কেমন ছটফট ছটফট করছে। একটু পরপর জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাচ্ছে। গুণগুণ করছেও কখনো কখনো। মনের সুখে গান গাইছে কি! গাড়ি চালনার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার অর্ধাঙ্গীর পানে তাকালো ইরহাম। তবে তা স্বল্প সময়ের জন্য। সে মনোনিবেশ করলো ড্রাইভিংয়ে। শহরের যানজট পেরিয়ে তারা পৌঁছালো সুখনীড় এ। গাড়ির হর্ন শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই এগিয়ে এলেন সিকিউরিটি গার্ড। উন্মুক্ত করে দিলেন মূল ফটক। ভেতরে প্রবেশ করলো টয়োটা প্রিমিও টি। থামলো পার্কিং লটে। গাড়ি থামা মাত্রই চঞ্চল প্রজাপতির ন্যায় তিড়িংবিড়িং করে গাড়ি হতে বেরিয়ে এলো মেয়েটি। ছুটলো লিফটের পানে। পেছনে রয়ে গেল নতুন জামাই। যার জন্য এত আয়োজন সে-ই অবহেলিত। ইরহাম সেসবে পাত্তা না দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সকলের জন্য ক্রয়কৃত উপহার এবং নাস্তা সামগ্রী বহনকারী ব্যাগ সমূহ হাতে নিয়ে গাড়ি লক করলো। অগ্রসর হতে লাগলো লিফটের দিকে।
.

ফারহানা এবং নাজরিন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নতুন জামাই আসছে। কিচেনে কত কর্ম ব্যস্ততা! দু’জনেই ঘর্মাক্ত দেহে রান্নার আয়োজন করে চলেছেন। নীতি ও নিদিশা লিভিং রুমে ফারিজার সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত। মোবাইলে ফানি ভিডিও দেখছে এবং হাসছে। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। উচ্ছ্বসিত হলো দু বোন। ফারিজাকে কোল হতে নামিয়ে সোফায় বসালো নিদিশা। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল দরজায়। হাসিমুখে দরজা খুলতেই সে হাসিটুকু মিলিয়ে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ডে। হতবাক নয়নে তাকিয়ে নীতি। এ কি হলো!

চলবে.

[ পাশবালিশ রূপে মিস্টার চৌধুরীকে কেমন লাগলো পাঠকবৃন্দ? হুঁ? মন্তব্য আশা করছি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here